এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • শোক চিল

    Rifon Sircar লেখকের গ্রাহক হোন
    ১১ জুন ২০২১ | ১৫৪৩ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • একটা টাটকা শোক থেকে আরেকটা টাটকা শোকে চলে যাচ্ছি। প্রথমটার থেকে দ্বিতীয়টায় গেলে পরের গুলো লঘু হয়ে যাচ্ছে। আসলে ধীর গতিতে দেখলে আমাদের এই শোক উবাচ অনেকটাই সময় ধারার মতো ইতিহাস মেনে চলছে, যুগ বদলালেও আমরা একেবারে যুগপৎ বদলে যাইনি। রামের কাছে একটা মৃত্যু ভোর ভোর এসে পৌঁছায় তো সেটা শ্যামের কাছে সেটা প্রাক দুপুরে। তারপর দুজনের শোকবহর চলে প্রকৃতি মেনে। আমি আপনি সেখানে হাত ঢোকাতে পারিনা। বড়জোর পারলেও আম্ফান ইয়াসে ভেসে যাওয়া শুকনো ত্রাণ বিনিময়ের মতো, হাত বুলিয়ে ছেলে ভুলোনো। কিন্তু রাম শ্যাম? রাম শ্যাম রহিম করিমের আবহাওয়ার খবর ভেসে যায় পাড়া থেকে বেপাড়া হয়ে পরিচিত গ্রহান্তরে। তারপর শোক পাথর ভেঙে ভেঙে নিক্তি মাপে স্বজন-পড়শি। খুচরো কথার মতো পড়ে থাকে কে চলে গেলো ছেড়ে, এরপর শোকের নিক্তিতে পরিবারের কে বেশী এগিয়ে। সন্তান সন্ততিরা এই খুচরো সান্ত্বনাপাড়ার মুখ্য বাসিন্দা হয়, ক্রমে জীবিত থাকলে স্ত্রী অথবা স্বামী। এরপরে আর এই পাড়া আর দীর্ঘ হয় না। নতিদীর্ঘ পাড়ার আলোচনা স্তিমিত হয়। বছর ভোর গুনতে গুনতে এই শোকও ক্লান্ত দুপুরের একা চিল হয়ে যায়। তারপর ওই সান্ত্বনা তালিকার প্রথম কয়েক জনের মনে পড়ে, ঠিক ওই একা চিল টাকে। খাঁখা চিলেকোঠায় সে চলে আসে আলটপকা রাত দুপুরে।


    কিন্তু এই শোক যাতায়াত ঠিক কতটা টাটকা হয়, তা একমাত্র মেপে রাখতে পারে মগজ। একটা মৃত্যু থেকে পরের মৃত্যুতে এসে শ্বাস নেওয়া এই স্বকর্ণ অভিঘাতে তাই মগজই হয়ে ওঠে একমাত্র কুলদেবতা, যে কিনা সমস্ত মাপা আছেদ্যা নিয়ে এক লহমায় পরিবার কর্তাকে অগ্নি পরীক্ষায় ফেলে। এই সামান্য সময়তেই তো কেপে ওঠে রাম শ্যাম রহিম করিমেরা। তারা সময় প্রত্যাশাও করেনি কোনো দিন এইসময়ের কাছে, তবুও এতো মুহুর্মুহু ফোন আসে কেন ফোনে? কেন আর এক পলকেও মনে পড়েনা উপরওয়ালার নাম? আর আমরা অপর দিকে খেলে যাই ওদের নিয়ে, ছেলে খেলা..


    অন্য দিকে এই শোকবহরের মহানিয়ন্ত্রক মস্তিষ্ককেই আমার পরাক্রমী লাগে একমাত্র। যাকে নিয়ে লিখব বলেই তো গোটা লেখার অছিলা। রাম রহিমের মতো আমিও এর সঙ্গ করলাম একটা মাস। তাই এই কথা গুলো লিখছি বলেই আমার কাছে কেউ আবার প্রশ্ন তুলতে পারেন শোক উত্তাপের। আমি তাকে এড়িয়ে যাবই না, বরং তাকেও বুঝিয়ে দিতে পারি আমার নিঃশোক উপলব্ধি। এই নিঃশোক কথা-লেখাকে যে সায় দিচ্ছে তারও নাম সেই মগজই। আমাদের হাজার স্মৃতিকে যে ধরে রেখে ছিলো, তাকেই তো মৃত্যু ঝাপটা সামলিয়ে নিতে হয়েছে..


    রাম রহিম শ্যাম করিমের সান্ত্বনা পাড়ায় আমার নাম ছিলো না। থাকার কথাও নয়। তবুও মৃত্যু এলো, রোদেলা এক দিনের পর পরবর্তী দিন রোদ হয় যেমন, গত দিনের ইতিহাস মুছিয়ে আরেকটা চকচকে স্রোত। কিন্তু ইতিহাস মুছে যায় পুরোপুরি? স্রোত খাজের ছায়ায় তাই ডুবে থাকে স্মৃতি। আমার বেড়ে ওঠার স্মৃতি অপটু ডুবুরির মতো মুখ তুলতো সেই দিন গুলোয়। আমি একটুও ওদের ভাসিয়ে রাখতে চাইতাম না। মাঝ পুকুরে অনেকটা জল খেয়ে নিলে শিক্ষানবিশ আমার সাঁতারবেলায় যেমন কষ্ট হতো, খানিকটা তেমনই হয়েছে। আর বাদবাকি টা নিজেও জানিনা। তবে আমাদের সেই সমবেত শোকের দিন গুলো ছেড়েও এখনও কথায় কথায় অনেক স্মৃতি উঠে আসছে। যে স্মৃতিতে দম চাপা কষ্ট হলেও আজলা করে নিতেই হবে। না হলে, আমার যে আলোময় সহোদরদের খুন করেছি, তাদের ফিরে পাবো? 


    বহুদিন আগে স্কুলের এক বিএড পড়তে আসা শিক্ষিকা যা বলেছিলেন সেটা সারাংশ করলে হয়; আমাদের পূর্ব পুরুষের চলে যাওয়াটাই সবচেয়ে বড়ো সত্যি, তবে তাঁদের চলে যাওয়ার পর আরেকটা যেটা সত্যি পড়ে থাকে সেটা আমাদের থেকে যাওয়াটা। রোম থেকে রোমে, মূল থেকে মূলে আসলে তো থেকে যায় আমাদের শিকড়েরা। তাই সেই সকাল গুলোতে মেঘলা রোদে তলিয়ে বসলেই আমার সেই ম্যাম এর প্রথম দিনের ক্লাস করানোর কথাই বারবার ফিরে আসতো মগজে। ম্যামের কথা গুলো ভেসে ওঠার পর তাই আমি আরো সচেতন হয়েছি। যে অতল থেকে এখন স্মৃতিরা ভেসে আসে তাদের শোক কাটিয়েই জায়গা করে দিচ্ছি। এই জায়গায় একটা ঘেটো কলোনীর মতই যেন বেঁচে থাকতে পারে রাম রহিমের পিঠে হাত বোলানোর থেকে উঠে আসা স্মৃতি, পরিজনের কান্নার স্মৃতি, আমার ছেলেবেলা। আবার হাঁটতে হাঁটতে এখন "রক্তের" কাঁধ ছুলে যে মায়া স্মৃতি গড়ে উঠছে সেসবও.. সব।


    এহেন সময়তেই তাই আমার মগজের স্মৃতি খোড়া আর নির্মাণের একটা সময় রেখা পাতলাম, যেখানে ডুব সাঁতার কেটে রাম রহিম শ্যাম করিমের শোক চিল আমার খাঁখা চিলেকোঠাতে দু দণ্ড বসতে পারে।



    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • π | ১১ জুন ২০২১ ২৩:৪৩494857
  • বেশ লাগল লেখাটা।


    স্নৃতিদের ঘেটো কলোনির মত বেঁচে থাকা,  এই শব্দবন্ধ মনে থেকে যাবে হয়তো।

  • Sarfaraz Hossain | ১৮ জুন ২০২১ ১২:৫৫495054
  • চমৎকার লাগলো লেখাটা! শোকের ভিতর থেকে তার জটিল বিন্যাসকে ভাষায় তুলে ধরা! অপূর্ব!

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। বুদ্ধি করে মতামত দিন