১
বাঙালি ভ্রমনপাগল জাতি, চিরায়ত প্রবাদ। সেই আদিকাল থেকে তারা পাড়ি দিয়েছে নানা দেশে বিদেশে ভ্রমনের নেশায়। দেশে বিদেশে তো দিয়েছেনই তাছাড়া ও পাড়ি দিয়েছে বঙ্গভূমির নানা জানা ও অজানা প্রান্তে।
সময়টা ১৮৭১ সাল । হুগলির বিজয়নারায়ণ কুন্ডু নামক এক মহাশয় প্রথম পাড়ি দিয়েছিল অবিভক্ত বাঙ্গলার পশ্চিমপ্রান্তে, বনে জঙ্গলে ঢাকা পাথুরে মালভূমি অঞ্চল সাঁওতাল পরগণায় । মধুপুর-গিরিডি শাখার রেল লাইন পাতার ঠিকাদারির কাজ নিয়ে। তখন সেখানে মানুষ বলতে ছিল আদিবাসী কোল,ভিল, সাঁওতাল।শিকার ছিল তাদের প্রধান জীবিকা।বন থেকে পেত ফল, মধূ।
পরে সেখানেই থেকে যান তিনি। সেই থেকে শুরু হয় বাঙালির সাঁওতাল পরগনায় আসা।তারপর একেরপর এক বাঙালির চরনধুলো পরল সেই ভূমিতে, গড়ে উঠল একটি উপনিবেশ।রূপনারায়নপুর থেকে ঝাঁঝাঁ,আবার দুমকা থেকে গিরিডি হল তার বিস্তৃতি। তবে সেখানে বেশিরভাগই লোক আসতেন হাওয়া বদলের জন্য তাই তাদের নাম ও ছিল চেন্জ্ঞারবাবু।
সেইকালে এই অন্ঞ্চল ছিল অবিভক্ত বাঙ্গলার অন্তর্ভুক্ত ।পরে ১৯০৫ সালে বঙ্গ ভঙ্গের জন্য এটি স্থান পায় বিহার রাজ্যে। বাঙ্গলার শেষ সীমান্ত হয় রূপনারায়ণপুর।
পুর্বপুরুষদের সেই চরনরেখা অনুসরন করেই আমার সেই যাত্রা মালভূমি অন্ঞ্চলে। বিহার রাজ্যের শিমূলতলা নামক একটি গ্রামে।জানার আগ্রহে কেমন ছিল তাদের সেই ছুটির আনন্দের দিনগুলি।
১৯ শে জানুয়ারি দুপুর ২.০৫ এর ট্রেন ,হাওড়া পাটনা জন শতাব্দী এক্সপ্রেস।৭:০৫ এ ঝাঁঝাঁ সেখান থেকে লোকাল ট্রেন ধরে শিমূলতলা আর এই সফরের আমার দোসর বন্ধু সম্রাট গাঙ্গুলি।
সারাদিন ট্র্যাভেল করার পর ৯:৩০ কিংবা ১০:০০ বাজলো যখন আমরা শিমূলতলা এসে পৌছালাম। স্টেশন তখন জনমানবশূন্য চারিদিক অন্ধকারে ঢাকা। পরিবেশ থমথমে ,নিস্তব্ধ, ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক ,আকাশে রুপোলি চাঁদের আলো ,শুধুমাত্র টিকিট কাউন্টারের সামনে দুটো বাল্ব মিটমিট করে জ্বলছিল । আমরা সেই দিকে এগিয়ে গেলাম।কাছাকাছি আসতেই একজন বছর ষাটের লোক এগিয়ে এসে আমাদের সম্বোধন করলেন "Welcome" ও অপরজন আমাদের ব্যাগগুলো নেওয়ার জন্য এগিয়ে এল ,মনে হল স্থানিয় বাসিন্দা এত রাতে অচেনা কাওকে দেখে সন্দেহের বসে এসেছেন কিন্তু তাও আমি তাকে উত্তর দিলাম"ধন্যবাদ আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না?" ভদ্রলোকটি উওর দিলেন " আমাকে আপনারা চিনবেন না ।আমার নাম অলোক বসু ,আমি এখানকার পুরনো স্টেশনমাষ্টার, আজ সকালে রতন বলল আপনারা আসছেন কিন্তু ওর একটা বিশেষ কাজ পড়ে যাওয়ায় ও আসতে পারেনি তাই ও আমাকে পাঠিয়েছে ।আমি বললাম "ও আচ্ছা।আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ , আপনি শুধু শুধু কষ্ট করলেন" ভদ্রলোকটি উওর দিলেন" আহা তাতে কি আপনারা এখানে থাকেন না ।রাস্তা ঘাট বিশেষ জানেন না ।এটা তো আর শহর নয় তাছারা আমার বয়সে হাঁটাহাঁটি করা ভালোই সম্রাট বলল" বেশ চলুন তাহলে"।
স্টেশন থেকে বেরিয়ে একটি চায়ের দোকান ছাড়িয়ে পাথুরে পথে এসে পড়লাম আমরা । রাতের শান্ত, স্নিগ্দ্ধ পরিবেশ।চারিদিক অন্ধকার কিন্তু তার মধ্যেও প্রকৃতি যেন জানান দিচ্ছে তার অস্তিত্বের।বনে ঢাকা মালভূমি ।সেই মালভূমির চারপাশে গড়ে উঠেছে নানা বাড়ি । বেশির ভাগ ই ছিল একতলা। ক্কচিৎ একটা দুটো দুতলা বাড়ি।
পাকদন্ডীর পথ অতিক্রম করে শেষমেষ আমরা আমাদের গন্তব্যে পৌছালাম ।অলোক বাবুকে আমরা অবশ্য পাকদন্ডীর আগেই বিদায় জানিয়েছিলাম। ব্যাগগুলো রতন দা আগেই লোক দিয়ে এনে রেখেছিল তাই এসেই স্নান ,খাওয়া সেরে শুতে বেশী দেরি হয়নি কিন্তু রাত অনেক হওয়ায় ও ক্লান্ত থাকার জন্য বাঙ্গলোটা ভালো করে ঘুরে দেখতে পারিনি তবে বাঙ্গলোটি যে বেশ বড় তা আন্দাজ করতে পারলাম ।দুটো বড় বড় শোয়ার ঘর ।যার মধ্যে একটিতে আমার থাকার ব্যবস্থা আর অপরটিতে সম্রাটের । তাছাড়া ও একটা বৈঠকখানা ,একটা খাবার ঘর ,পেছনে ইঁদারা সামনে বাড়ান্দা লাগোয়া উঠান।
২
এখানে সকাল হয় না সকাল আসে । অনেক শিশির ভেজা পাহাড়ি পথ পেড়িয়ে ,স্বর্ণ অলঙ্কার পরে আসে । খাটে শুয়ে ঘরের টালির ছাদের ফাঁক থেকে আসা আলোর ছটা আর পাখির কলরবে বেশ লাগছিল। প্রকৃতির এইরূপে আগমনের সাক্ষি হইনি আগে কোনদিন।
এই আনন্দিত প্রানতরঙ্গের মাঝে আমি বাইরে এসে উঠানে দাঁড়ালাম,ঘড়িতে দেখলাম তখন বাজে ৬:৩০ সম্রাট তখনও ঘুমাচ্ছে ,এরই মধ্যে রতনদা এসে চায়ের জন্য জিজ্ঞেস করে গেছে। আসলে রতনদা এই বাঙ্গলোটির caretaker, প্রায় ৩০ বছর এখানেই আছেন ।শুনেছি ভালো পরিবারের লোক,আগে নাকি বেশ প্রতিপত্তিও ছিল কিন্ত সবই লটারি আর ধারে হারিয়েছন।বয়সে আমার থেকে ১৬ কিংবা ১৭ বছরের বড় হবেন ।তার সঙ্গে আমার পরিচয় অবশ্য সেই ছোট থেকে । বাবার সঙ্গে প্রায়শই দেখা করতে আসতেন আমাদের বাড়িতে।
কিছুক্ষনের মধ্যেই রতনদা হাজির। চায়ের কাপ আমাকে ধরিয়ে জিজ্ঞেস করল "কালকে রাত্রে কোন অসুবিধা হয়েনি তো তোমাদের ?"
আমি উত্তর দিলাম "না না কোন অসুবিধা হয়নি "
রতন দা - " তা তোমার বন্ধু কোথায়? ঘুমচ্ছে নাকি"
আমি উত্তরে বললাম "হ্যা ।আসলে গতকাল অনেকক্ষন জার্নি হয়েছে তো তাই ক্লান্ত হয়ে পরেছে। "
" সেটা ঠিক। কলকাতা থেকে আসা এখানে সত্যিই কষ্টসাধ্য তা বাবা এখন কেমন আছে এখনও চাকরি করছেন না রিটায়ার করেছেন?"
" বাবা দুবছর হল রিটায়ার করেছেন।এখন আমার সঙ্গেই থাকে কলকাতায়।আসলে শরীরটাই বাবার ঠিক যাচ্ছে না প্রেসার, সুগার। সবই ধরা পরেছে।"
রতন দা অবাক "সে কি বল। আগে এত ফিট ছিলেন আর এখন এই অবস্থা । তুমি বরং এক কাজ করো বাবাকে নিয়ে কদিনের জন্য এখানে চলে আসো পুরনো লোক দেখলে মনটাও ভালো থাকবে আর এখানকার আবহাওয়ায় কিছুদিন কাটালে শরীরটাও একটু সুস্থ হবে।তুমি জানো কি না জানি না শিমূলতলাকে বলা হয় বিহারের সিমলা। ভারতের বিহার রাজ্যের জামুই জেলার ঝাঁঝা ব্লকের অন্তর্গত একটি গ্রাম এটি।আগেকার দিনে ডা্ক্তারের পরামর্শে স্বাস্থ্য ফেরাতে পশ্চিমের দেশে যাত্রা করত। পশ্চিমের দেশ বলতে শিমূলতলা,গিরিডি,মধুপুর,দেওগড় এইগুলো ই বোঝায়"
"হাঁ বাবার মুখে শুনেছি"
" ও যেটার জন্য আসা ।তোমরা বেরোবে তো আজকে ?"রতদা জিজ্ঞেস করল।
"হ্যাঁ বেরোবোতো নিশ্চয়ই , সময় বলতে আজকের দিনটাই তো"
"ঠিক আছে ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।"
রতনদার এই উচ্ছাস দেখে আমি সত্যিই অবাক হয়েছিলাম তবে এই দূর প্রদেশে একজন সাহায্যের পরিচিতকে পেয়ে বেশ ভালোই কাটছে এই ক্ষনিকের অবসর।
রতনদা চলে গেল। আমি নিজের চা শেষ করে ঘরে ঢুকলাম, সম্রাট ততক্ষনে ঘুম থেকে উঠে গেছে কিন্তু ঘুমের ঘোর এখনো কাটেনি । কিছুক্ষন আড্ডা মারার পর দুজনেই প্রাতঃকর্ম সেরে , জলখাবার খেতে বেরিয়ে পরলাম ।পাহাড়ের লাল রাঙ্গা পাথুরে পথের পাশে একটা ছোটটো দোকান ।আমরা জলখাবার সারলাম। বাবার মুখে শুনেছিলাম এখানকার বিখ্যাত ছানা মুড়কির গল্প ,তাই সেই স্বাদের বাস্তবতা যাচাই করতে ট্রাই করলাম। প্রথমে দেখে ভক্তি না আসলেও মুখে দিতেই তার পূর্নাঙ্গ স্বাদ অনুভব করলাম।ছোট ছোট ছানার দানা ,এত ভালো খেতে হতে পারে তা এখানে না আসলে জানতেই পারতাম না।
ঠিক সকাল ১০:৩০ রতনদা গাড়ি নিয়ে হাজির ।ততক্ষনে আমরা জলখাবার সেরে ফেলেছি। চট করে একটু গুছিয়ে রওয়ানা দিতে বেলা ১১:০০ হয়ে গেল। রতনদার কথা মত প্রথমে আমরা যাব রাজাকোঠি,তারপর লাট্টুপাহাড় ,হলদি ঝড়না আর শেষমেশ তেলেয়া বাজার হয়ে ফেরত।
৩
আমাদের ভ্রমনসুচি অনুযায়ী প্রথমে রাজকোঠি গিয়ে পৌছালাম আমরা ।বিস্তির্ন ফাঁকা মাঠ মাঝে মাঝে গাছপালার জটলা ,ঠিক তার কেন্দ্রবিন্দুতে একটি পৌর রাজবাড়ি । প্রকান্ড রাজবাড়িটির অবস্থা এখন সংরক্ষন করার মতন। দেওয়ালে নানা জায়গায় শ্যওলা ধরা। প্রায় সর্বাঙ্গে পলিস্তারা খসে গিয়ে ইট বেরিয়ে এসেছে। মাথার ছাদ প্রায় নেই বললেই চলে। তবু চারিপাশের অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মানুষকে বারবার তার কাছে টেনে আনবে। পশ্চিমপ্রান্তের মালভূমির ছোট ছোট পাহারগুলি নীল দিগন্ত রেখাটিকে ঢেকে দিয়েছে ।এই দৃশ্য দেখে আমার মনে হল একেই হয়ত বলে ছবির মতন সুন্দর। লাট্টু পাহাড়ের চুড়াটিও স্পষ্ট দেখা যায় রাজবাড়ি থেকে। রাজবাড়িটির প্রকান্ড এই গঠন থেকে প্রায় ২০০গজ দূরে একটি ঝিলও দেখা যায়।
এই অপূর্ব সৌন্দর্য দেখতে দেখতে আমি গাড়ির ড্রাইভারকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম "এই রাজবাড়ি কতদিন আগেকার?"
"মালুম নেই সাব তব শুনা হ্যায় বর্দ্ধমান কা রাজা বানায় থা। পর ইয়ে লাট্টু পাহাড় মে সুটিং ভী হুয়াথা।" পরে রতন দার কাছে জেনে ছিলাম "সত্যজিৎ রায়ের সূর্যডোবা" ।
সোজা লাট্টু পাহাড়ের দিকে হাঁটা দিলাম ।পাহাড়ের গায়ে বাধানো সিঁড়ি, তার পাশে পাথরের চাই ।উঠতে বেশ সুবিধাই হল। চুড়াতে উঠতেই অনুভব করলাম চড়া রোদ।তার স্বর্ণরেখায় চারিদক যেন ঝলসে যাচ্ছে । দূর দুরান্ত সবুজে ঢাকা পাহারের পদস্থল, এক আলাদাই অনুভূতি সঞ্চার করছে। তবে বেশিক্ষন থাকা গেল না ওখানে কারন সময় কম তবে দেখার অনেককিছু । এরপর সোজা গিয়ে উঠলাম হলদী ঝর্ণা যা শিমূলতলা থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে। । এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য এক কথায় অসাধারণ। লোকে বলে এই ঝর্ণার জলে জাদু আছে। এর জল খেলে শুধু ক্ষিদে বাড়ে না,এর জলে অনেক রোগ ও সেরে যায়। পাহাড়ের পাথুরে খাতে বয়ে চলেছে এই মৃদু ঝর্ণা।
এই অপরূপ সৌন্দর্য দেখতে দেখতে কখন যে ঘড়ির কাটা এগিয়ে গেছে তা বুঝতেই পারিনি । ঘড়িতে যখন চোখ পড়ল তখন বেলা তিনটে । খিদেতে পেট ফেটে যাচ্ছে। তাই সোজা গাড়ি নিয়ে ঢুকলাম তেলেয়া বাজার। বেলা ৩:৩০ আমরা পৌছালাম। হোটেল বলতে একটা মাত্র খোলা।সেখানেই গিয়ে ঢুকলাম। খাওয়া শেষ করতে বাজল বেলা ৪:১৫ । এখানে দেখার বিশেষ কিছু নেই।এতদূর অঞ্চলের এটাই একটা বড় বাজার।প্রায় সন্দ্ধে হয়ে এসেছে। দূর থেকে ভেসে আসছে মাদলের সুর আর পাকা মহূয়ার গন্ধ। ৫:০০ বাজলো যখন আমরা বাঙ্গলোয় ফিরে এলাম।রাতের খাবারের অবশ্য চিন্তা নেই রতনদাই .... । তাই দুজনে গল্প করে বাকিটা সময় কাটাব ভেবে বসলাম সামনের বারান্দায়।বেশ কনকনে ঠান্ডা ।টিমটিমে আলো।পাশাপাশি দুটো চেয়ারে আমি আর সম্রাট।শহরের কোলাহল থেকে দূরে এই প্রান্তরে আজ যেন দুজনের কারো আর সেরকম ইচ্ছাই নেই গল্প করার।বাইরের নিকষ কালো অন্দ্ধকারে ঝিঝি পোকার ডাক আর নিস্তব্ধতায়
ছুটির আনন্দে কোথাও যেন সম্পৃক্ত হল মন।