ফুটপাথে দাঁড়িয়ে ফল কিনতে গিয়ে হঠাৎই ওর পেছনটায় হাত দিয়ে চলে যায় লোকটা। অসহ্য লাগতেই ঘুরে তাকায় মানসী অথচ কিছুই হয়নি এমন ভাব করে লোকটা দ্রুত পায়ে হেঁটে অনেকটা এগিয়ে গেছে ততক্ষণে, দেখে মনে হচ্ছে বয়েস মাঝ বয়েস ছাড়িয়ে পা রেখেছে বুড়োর খাতায়, তবুও স্বভাব পাল্টায়নি। মনে হচ্ছিলো কলারটা ধরে টেনে দুটো চড় লাগায়। তারপরেই যা শুনতে হবে সেটা ভেবে একটু দমে গেলো..হয়ত বলবে 'রাস্তায় চলবেন কারো সাথে ধাক্কা লাগবেনা তা হয়! এবার থেকে বাড়িতে থাকবেন নাহলে প্রাইভেট কারে যাবেন বুঝেছেন ম্যাডাম। যত্তসব, নারীবাদ। এদের জন্যই এত সমস্যা।'
কাল অনুকে দেখতে আসবে তাই টুকটাক কিছু বাজার করতে মানসীকেই বেরোতে হয়েছে।
এই বয়সে খারাপ ভালো চাউনি আর ছোঁয়া সবটাই খুব চেনা। জিনিসগুলো কিনে মেট্রোতে উঠবে বলে স্টেশনে আসে, এখন মেট্রোতে প্রায় সবসময় ভীড়। তাড়াতাড়ি করে দরজা দিয়ে উঠে এগোতে যায় লেডিস সীটের দিকটায়, দরজাটা আটকে বেশ কয়েকজন ভালো মানুষের মত মুখ করে দাঁড়িয়ে, ভেতরে জায়গা আছে তবুও যাবেননা। মানে তাদের শরীরে ঘষে ঘষে যেতে হবে, উপরি পাওয়ার মত একটু স্পর্শসুখ পাবার আশাতে আছেন।
" একটু ভেতরে যেতে দিন প্লিজ।"
" যান, যান এর মধ্যেই যেতে হবে। ওহ্ এই ভীড়ের মধ্যে এত জিনিস নিয়ে উঠেছেন!"
এর মধ্যে যাওয়ার চেষ্টা করতেই আবার পেছনে বেশ একটা জোরালো ইচ্ছাকৃত চাপ খেলো, বুঝেও না বোঝার ভান করে কোন রকমে অস্তিত্ব রক্ষা করতে করতেই বাড়ি ফিরলো মানসী।
" ওহ্, এইজন্য আজকাল আর বেরোতে ভালো লাগেনা বাইরে। কি ভীড় চারদিকে, আর তেমন অসভ্য লোকজন।"
" মা এত কেনার কি দরকার! তোমরা একটু বেশি বেশিই করছো। কি দরকার দিদিকে সাত তাড়াতাড়ি শ্বশুরবাড়ি পাঠানোর শুনি?"
" তা তুমি কি করে বুঝবে মা? বাবার রিটায়ার করার সময় চলে আসছে। তা কি ভাবো?"
" ভাবি তো, তাই তো আমি চাকরির চেষ্টা করছি। তোমার আবার কি হলো, কে অসভ্যতা করলো?"
" আর বলিসনা, কিছু লোক বোধহয় অসভ্যতা করতেই রাস্তায় বেরোয়।"
" ওহ্ বুঝেছি, হাত মেরেছে কেউ নিশ্চয়। দিলেনা কেন ধরে একদম থাপড়ে। বা পা টা জুতো দিয়ে মারিয়ে।"
" হ্যাঁ তোমার মত রাস্তায় মারপিট করে আসি আর কি? তারপর দেখবো সবাই চুপ আমি একা। এইসব ব্যাপারে তো কেউ সমর্থনও করেনা।"
" আর কি তাহলে লোকে এইভাবে পেছনে হাত মারুক।"
" বোন, মাকে এইভাবে কেউ কথা বলে! আমাকে বলিস বলিস। ছি ছি। মা যাও তো ফ্রেশ হয়ে নাও আমি চা বানিয়ে দিচ্ছি তোমাকে। আমাদের রাস্তায় ঘাটে প্রতিদিন বেরোতে গিয়ে কত এমন অভিজ্ঞতা হয়। তুমি যাওনা তাই বোঝোনা।"
দিদিকে ভ্যাঙায় অনু.." কত অভিজ্ঞতা হয়..তুই অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতেই থাক মুখ বুজে।"
" কি করবো, তোর মত ঝগড়া করে লোকের মুখ শুনে আসবো। এই তো সেদিন মেট্রোতে একটা লোক তোকে চাপছিলো বলে তাকে এত জোরে কনুই দিয়ে ধাক্কা দিলি যে শেষে চারটে উল্টোপাল্টা কথা বলে গেলো।"
" চোরের মায়ের বড় গলা, দিয়েছি আমিও সেদিন আচ্ছা করে। ইচ্ছে করছিলো দিই একটা চড় বসিয়ে।"
" তা তো দেখেছিই, রীতিমতো ভয় করছিলো আমার। যা হম্বিতম্বি করছিলো লোকটা! আর চোখগুলো কেমন লাল। মনে হচ্ছিলো ভালোনা লোকটা।"
" ছাড়তো, এই রকম কত বদমাশ লোককে শায়েস্তা করেছি আমি।"
দুই মেয়েকে চুপ করতে বলে ঘরে ঢোকে মানসী, হাত পা ধুয়ে পোশাক ছাড়তে ছাড়তে নিজেকে আরেকবার আয়নাতে দেখে। মেয়েরা বড় হয়েছে তবুও মানসীর শরীরের বাঁধুনি এখনো ভালো। তাই হয়ত এখনো কনুইয়ের ধাক্কা খেয়ে যাচ্ছে। ভাবতেই আবার রাগ হলো। ওর মা বলতেন একটা কথা.. " পুড়লো নারী, উড়লো ছাই নারীর তবে কলঙ্ক যায়।" নারীর জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত কলঙ্ক তাকে ছাড়েনা, মৃতদেহ পুড়ে ছাই হলে তার নিস্তার। ছোটবেলায় কথাটা শুনে হাসি পেলেও এখন বোঝে কত সত্যি কথাটা তাই হয়ত দুবছরের বাচ্চা থেকে পঁচাত্তরের বৃদ্ধা রেহাই কারো নেই।
ওহ্ অনুকে শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে হয়ত হাঁপ ছেড়ে বাঁচবে কিছুটা। দুই মেয়েই বড় হয়ে উঠেছে, সুবিমলেরও বয়েস হচ্ছে। রাত বিরেতে পড়ে, গান শিখে ফেরে কত যে চিন্তা হয় তা বলার নয়। যতক্ষণ না বাড়িতে এসে ঢোকে শান্তি পাওয়া যায়না। অপুর থেকেও অনুকে বেশি সুন্দর দেখতে আর স্বভাবটাও তেমনি নরম সরম ছোটর মত দজ্জাল নয়। গান জানে খুব ভালো, সেলাই, রান্না, পড়াশোনা সবেতেই ভালো। একটা পার্টটাইম চাকরিও করছে। অপুটা পলিটেকনিক পাশ করে বি টেকে ভর্তি হয়েছে এবার ফাইনাল ইয়ার। ওর আবার নাচ গানের কোন শখ নেই দুমদাম বল পেটায়। প্রথমে চেষ্টা করেছিলো মানসী এখন হাল ছেড়ে দিয়েছে।
আজকাল তো গ্ৰুপ ছাড়া দুই মেয়ে নিয়ে বেড়াতে যেতেও ভয় পায় সুবিমল বলে, " শোন দিনকাল খারাপ, একা একা মেয়েদের নিয়ে বেড়াতে যেতেও ভালো লাগেনা।" ছোটজনের আবার গ্ৰুপট্যুর পছন্দ নয়। যাক্ একজনের বিয়ে হলে ওরা অনেকটা ঝাড়াঝাপটা হয়ে যাবে।
বিকেলের দিকে ছেলের বাড়ির লোকজনের আসার কথা। বেশ ভালো চাকরি করে ছেলে, অনুর ছবি দেখে ওদের পছন্দ হয়েছে। মানসী সুবিমল দুজনেই ব্যস্ত আজ। অনুকে কাল একটা ফেসিয়ালও করিয়ে এনেছে। আজকাল সব মেয়েরাই এইসব করে, অনুর চুলটা গত পুজোতে স্ট্রেইট করেছে, প্রথমে মানসী আপত্তি করলেও পরে দেখেছে বেশ লাগছে। তবুও ভালো মেয়েটার চুল লম্বা, ছোটটার মত নয়। কোন যত্ন নেই নিজের ওপর, অথচ সাজলে বেশ লাগে।
হাতের নখগুলোতে সুন্দর করে নেলপলিশ লাগায় অনু। শাড়িটা গায়ে ফেলে দেখে, ব্লাউজটা একবার পরে দেখে। সুন্দর ফিটিংস আছে বেশ।
" অত দেখতে হবেনা, তোকে এমনিতেই পছন্দ হবে। বাবা যা স্টাইল মারছিস দিদি বিয়ের পর তো পাত্তাই দিবিনা মনে হচ্ছে।"
" মা দেখো, কিসব বলছে বোন। আমি শাড়ি পরবোনা কিন্তু।"
" নেকু, শাড়ি পরবোনা। এদিকে মনে লাড্ডু ফুটছে মহারানীর।"
" তোরা থামবি, ওহ্ ভগবান এরা আর পাল্টাবেনা। যেমন মিল তেমন ঝগড়া। অপু মার খাবি এবার।"
বেশ বেলা বেলাই ওরা চলে এলেন, সব মিলিয়ে চারজন। মা বাবা আর মাসি আর মেসো। ছেলে হঠাৎই বাইরে গেছে আসবে কয়েকদিন বাদেই। মানসী সুবিমল ওদের চা দিয়ে গল্প শুরু করলো। তার মাঝেই একবার তাড়া দিয়ে গেলো মেয়েকে, " তাড়াতাড়ি কর ওরা আসতে বলছেন এবার তোকে।"
দুই মেয়েই আসে একসাথে ঘরে। মানসীকে মেয়েদের ইশারা করতে হয়না তার আগেই ঝপাঝপ প্রণাম পর্ব সারা হয়ে যায়।
" আরে থাক থাক, এইসব আবার আছে নাকি এখন! ওরে বাবা আমার বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি গিয়ে প্রায় পঞ্চাশ জনকে প্রণাম করতে হয়েছিলো ঘাড়ের বারোটা বেজে গিয়েছিলো। আমি বারণ করবো না তবে হাতজোড় করে করলেও হবে। বা এখনকার মত টাইট টাইট হাগ।"
হাসি পায় অপুর, ওরে বাবা দিদির যদি সত্যি সত্যিই শাশুড়ি হয় এই মহিলা ভালোই হবে। তবে ছেলেই তো আসেনি, কে জানে কেমন হবে..ওর হবু জাম্বু বলে কথা।
অপুকে নিয়ে মানসী রান্নাঘরে আসে খাবার গোছাতে। ওরা গল্প করছে করুক।
" মা আর কত গোছাবে? একটা ফ্রাই খাই? চলো এবার হয়েছে। দিদিকে কি জিজ্ঞেস করছে শুনি।"
" উহ্ তোর সবটাতেই ছটফট করা, খাবি তো একটু দিয়ে আসি তারপর খাস। হ্যাঁ শুনে রাখো কি জিজ্ঞেস করছে, এরপর তোমার পালা তো।"
" কি! বয়েই গেছে আমার।আমি বিয়েই করবোনা।"
" ওরকম সবাই বলে। বাবা যা দিনকাল পড়েছে বিয়ে দিয়ে আমরা বাঁচি। শ্বশুরবাড়ির লোকরা সামলাক এবার।"
" ও শ্বশুরবাড়ির লোক আর বর কি বডিগার্ড নাকি মা?"
" একদম চুপ, চল এবার। মাথা খাসনা।"
ওরা ঘরে ঢুকতেই পাত্রের মা বলে ওঠে.. " বসুন তো একটু গল্প করি, এত খাবার আয়োজন কেন? আমরা তো এমনিতেই এত আর খেতে পারিনা। তুমিও বোসো, তোমার পুরো নামটা যেন কি?"
" আমি অপরাজিতা, বাড়িতে অপু বলে ডাকে। দিদি অনন্যা, সবাই অনু বলে। আসলে সুন্দর ফর্সা দিদি হবার পর আমি যখন হলাম, একটা কালো রোগা, ঠাকুমার খুব মন খারাপ হয়েছিলো। তাই বাবা ভালোবেসে নাম দিয়েছিলো অপরাজিতা। আমি বাবার লাডলী, দিদি মায়ের।"
" ওহ্ দিদি, আমার ছোটটা একবার বকতে শুরু করলে আর থামবেনা।"
" তাতে কি? খুব মিশুকে আর মিষ্টি আপনার ছোট মেয়ে। আমিও একটু বেশি বকবক করি ও আমার মতই। আচ্ছা অনন্যা, পড়াশোনা ছাড়া আর কি করো? গান তো জানো শুনেছি। যদি তোমার অসুবিধা না থাকে তাহলে একটা শুনিয়ো।"
" সেলাই জানি টুকটাক, আঁকি, ছোটবেলায় নাচ করতাম, এখন আর হয়না। বই পড়তে ভালো লাগে। সময় পেলে মাকে সাহায্য করি।"
" বাহ্ খুব ভালো, আর কিছু শেখোনি?"
এবার মানসীর একটু বিরক্ত লাগে, মনে মনে ভাবে এরা কি চায়! মেয়ে সুন্দর হবে, নাচবে, গাইবে, রাঁধবে, শিক্ষিতা হবে আর কত চাই। কি কাজে লাগে এসব বিয়ের পর, সবটাই তো যাবে খুন্তি নাড়তে নাড়তে আর সবার মন জোগাতে রসাতলে। তবুও চাহিদার শেষ নেই। তাই না বলে পারলোনা।
" দিদি দেখুন, আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবারে পড়াশোনাই আসল, সবাই জানতে চায় মেয়ে কি পড়ছে, মাধ্যমিকে কেমন করলো। তাই এইসবের বাইরে নাচ, গান, আঁকা যেটুকু পেরেছি শিখিয়েছি। আর সময়ই বা কই দিদি। তাও একে পেরেছি অন্য কিছু শেখাতে, ছোটটাকে তো শেখাতেই পারিনি কিছু। আর ওর তেমন ইচ্ছেও ছিলোনা গান শেখার।"
" না না আপনি যথেষ্ট শিখিয়েছেন, মানে আমি বলছি যে আজকাল মেয়েরা যেগুলো শিখছে মানে কিছু স্কুলেও তো শেখানো হচ্ছে সেল্ফ ডিফেন্স, ক্যারাটে এইসব আরকি?"
ছেলের মায়ের কথা শুনে চোখ কপালে ওঠে মানসীর.." সে কি দিদি! মেয়ে আমার লক্ষ্মীমন্ত, যাকে জিজ্ঞেস করবেন সেই বলবে। চাকরি করছে এরপর গুছিয়ে সংসার করবে। তা ঐ সব শিখে কি করবে? এরপর কি মারামারি করে সমাজে টিকতে হবে যে এগুলো শিখতে হবে? আর তখন অবশ্য অত কিছু ছিলোও না। বিয়ে হলেই ব্যাস নিশ্চিন্ত।"
" আজকালকার মেয়েদের পথেঘাটে বিপদ, তা বৌ, মেয়ে, কাকিমা, মাসিমা, ঠাকুমা যেই হননা কেন। আজকাল কি বলবো, বলতে লজ্জা লাগে রামায়ণ মহাভারতের যুগেও অসম্মান ছিলো। তা স্বামী কি বাঁচাবে শুনি? তখনকার দিনেও তো পারেনি। নিজের দায়িত্ব নিজেই নিতে হবে।"
কথাগুলো শুনতে কেমন লাগলেও সব কথাগুলোই তো সত্যি। মনে মনে ভাবে মানসী তাই গলায় জোর এনে বলে, " দিদি হয়ত ঠিকই বলেছেন, তবুও মারকুটে করে মেয়ে তৈরি করতে কে চায় বলুন। রাস্তায় ঘাটে স্বাধীনভাবে চলতেও পারবেনা! ঐ যেমন আমার ছোটটা। কত নালিশ শুনেছি।"
বাবার কাছ ঘেঁষে লক্ষ্মী মেয়ের মত বসে অপু, মায়ের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসে।
" সত্যি দিদি খুব লক্ষ্মী, ছোট থেকেই শুনেছি আমার মত পচা নয়।"
" পচা নয় তবে হাতে পায়ে দুরন্ত ছোট থেকেই। স্কুলে যে কত মারপিট করে এসেছে তার ঠিক নেই। এমন কি পাড়াতেও। তবে খুব সাহস রাখে। সারাদিন সাইকেল চালিয়ে টোটো কোম্পানি করছে।"
পাত্রের মাসির দিকে তাকিয়ে হাসেন ভদ্রমহিলা, " দিদি, একদম তোর আর আমার মত। তাইনা? তা তুমি কিছু শিখেছো?"
একটু হেসে অপু বলে, " আমাকে মা অনেক চেষ্টা করে পারেনি, তারপর পাড়ার ক্লাবে বাবাকে আবদার করে ক্যারাটে শিখেছি। ব্ল্যাকবেল্ট এই পর্যন্তই। মা আর বাবার তাই নিয়ে অশান্তি।"
ওদের কথার মাঝেই ছেলের মেসোর কথায় হাসির রোল উঠলো.." আরে বলবেন না আমার শালী যা ছিলো এককালে, আমার বিয়ের সময় তো বরযাত্রীদের একজন ওর পেছনে লেগেছিলো বলে তাকে একদম নাকাল করেছিলো। শেষে বকুনি খেয়েছে শ্বশুরমশাইয়ের কাছে। আর তারপর আমার পিসতুতো ভাই তো প্রেমেই বেঁধে ফেললো বরাবরের জন্য.."
বাকিটা শোনার আগেই সবাই হাসলো, আর ওনার গালেও লজ্জার আভা দেখা গেলো।
ওনারা পরে জানাবেন আর ছেলেকে পাঠাবেন বলে চলে গেলেন। তবে ওরা বুঝলো খুব তাড়াতাড়ি বাড়িতে সানাই বাজবে।
মাঝে কেটে গেছে এক সপ্তাহ। সেদিন সকাল সকাল ফোনটা বেজে উঠলো।
" কি গো কি এত কথা বললে এতক্ষণ ধরে।"
" আরে আমাকে একটু রবিবার ওদের বাড়ি যেতে বললেন।"
" তোমাকে একা যেতে বললেন! কি আশ্চর্য লোকজন। আমিও তো যেতে পারতাম তোমার সাথে।"
" থাক মানসী, এত ভেবোনা। আমি ঘুরে আসি আগে দেখি কি বলেন। বললেন ঐ কিছুনা, ছেলেও সেদিন বাড়ি থাকবে। ওরা আগে আমাদের বাড়ি এসে মেয়ে দেখে গেছেন, তাই আমিও একবার ছেলে দেখে নিই এই আরকি।"
" বাবা ভদ্রমহিলার মাথায় কি বুদ্ধি গো, তবে আমাকেও যেতে বলা উচিত ছিলো ওনাদের।"
সামনে রবিবার সুবিমল গেলেন একাই, যদিও মানসী গজগজ করাতে অপু বলে উঠলো, " ভালোই তো বাবা দেখে আসুক ঐ পাত্র দিদির সাথে মানাবে কি না?ফালতু এসে খাবার দাবার খেয়ে যাবে।"
" তুই চুপ করতো, শুধু বাজে বকা সবসময়। তোর বাবাকে একা পেয়ে কি বলবে কে জানে?"
" সারা জীবন শুধু বাবার ওপরই ছড়ি ঘোরালো এই বৌটা আর বাইরে গেলে এখনো লোকের ধাক্কা খেয়ে আসে।"
রেগে আবার ধমকায় মেয়েকে মানসী.." উফ্ এই মেয়েকে যে কি করে বিয়ে দেবো এত মুখ!"
কিছুক্ষণ বাদে সুবিমল আসেন, একটু গম্ভীরও লাগে। মানসী জানে বাইরে থেকে ফিরলে কিছু বললে বিরক্ত হয় সুবিমল, তাই তখনই কিছু বললোনা। রাতে চারজন একসাথে খেতে বসে সুবিমলের কথায় রীতিমতো অশান্তি হলো খাবার টেবিলে, কথাটা বলতেই চোখ ছলছল করে অনু উঠে গেলো। আর দিদির পেছন পেছন অপু উঠে গেলো চেঁচাতে চেঁচাতে। মানসীও চেঁচাচ্ছেন তখন, " কি দরকার ছিলো বাপু, বারণ করে দিলেই তো পারতে। মেয়ে দুটো খেলোনা, কিছুনা। ভীষণ চ্যাটাং চ্যাটাং কথা ওনার। এরা যে কি চায়!"
" তোমরা তো আমাকে কথা বলতেই দিলেনা তার আগেই কেঁদেকেটে একাকার করলে। শেষটুকু তো শুনলেই না। উনি অনুর বদলে অপুকে পছন্দ করেছেন এর মধ্যে এত কান্নার কি আছে শুনি?"
" তুমি অনুর সামনে কি করে বললে এ কথা! তাছাড়া আমি বড়কে রেখে ছোটকে দেবোনা। আর অপু তো বিয়ে করবেই না।"
" উঃ মহা ঝামেলা তো, শুনছেই না কেউ কথা। আরে মানসী দুজনকেই বৌ করতে চান ওরা।"
" সে আবার কি কথা! একটা ছেলের জন্য দুজনকেই!"
" আরে না না অপুকে ওনার ছেলের জন্য আর অনুকে দিদির ছেলের জন্য।"
" তা কেন শুনি? উনি তো অনুকেই দেখতে এসেছিলেন, আমরাই বা কেন বিয়ে দেবো ওনার দিদির ছেলের সাথে? তাছাড়া অপু যদি শোনে বিয়ের কথা তাহলে তো বাড়ি ছেড়েই বোধহয় চলে যাবে।"
" ওনার দিদির ছেলেও খুব সুন্দর শিক্ষিত ভালো চাকরি করে। হয়ত বা এই ছেলের থেকেও ভালো। মোটামুটি কাছাকাছি বয়েসও ওদের। যদিও আমি ফটোতে দেখেছি, কারণ এখন ব্যাঙ্গালোরে আছে সামনের মাসে আসবে। আর এই ছেলের সাথে অপুকেই মানাবে। ওর মতই ছটফটে মিশুকে আর ছেলেমানুষ। আসলে মায়ের মতই ছেলে। দুজনে ভাইবোনের মত ঝগড়াও করে।"
" উঃ আমার মাথা ঘুরছে, আমি কিছু জানিনা। মেয়েরাই বা রাজি হবে কেন এমনভাবে পাত্র বদল হয়ে গেলে। আর আমি দুই মেয়েকে কি করে একসাথে দেবো বিয়ে শুনি?"
" তাও ওরা বলেছেন, আগে অনুর হবে নাহলে অপু ওনার ছেলে কেউ আনন্দ করতে পারবেনা। তারপর কয়েকমাস বাদে অপুর হবে। সামনের মাসে দুই ছেলে আসবে দেখো এর মধ্যে যদি বোঝাতে পারো।"
বোঝানোটা খুব সহজ হলোনা, বড়জন বুঝলেও ছোটজনকে বোঝানো খুবই মুশকিল। যাক তবুও মাসখানেকের অপেক্ষা দেখা যাক এই ভেবে সুবিমল বাবু ধৈর্য্য ধরলেন।
" দিদি এমন শুনেছিস, কি অদ্ভুত না সেল্ফডিফেন্স আমি জানি তুই শিখিসনি এই জন্য আমি প্রায়োরিটি পেলাম। এসব কি হচ্ছে মাইরি! এরপর শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে কি মারামারি করতে হবে না টালি ভাঙতে হবে রে?"
" যত সব বাজে বকা তোর, চুপ কর। আমার ভালো লাগছেনা।"
একটু অপরাধী লাগে অপু মানে অপরাজিতার, ওর জন্য ওর সুন্দরী দিদিকে কেউ অপছন্দ করতে পারে এটা ভাবলেই নিজেকে অপরাধী লাগছে খুব। ও কিছুতেই এই ছেলেকে বিয়ে করবেনা সে যাই হোক কেন। ধ্যাৎ বিয়েই করবেনা জীবনে। ও সেদিন থাকবেই না বাড়িতে। কাউকে কিছু না বলে পালাবে সারাদিনের জন্য।
" এই যে সামনের সপ্তাহে ওরা আসবে মনে আছে তো। একটু মুখটার যত্ন নে, তোর বাবার খুব পছন্দ ওদের পরিবার ভালো থাকবি তোরা।"
" নিকুচি করেছে ভালো থাকার, আমি কিছু করবোনা। যা হয় হোক।"
" ছিঃ এইসব আবার কি কথা! এই শিক্ষা দিচ্ছি তোকে !কই দিদি তো এমন বলেনা। ওর তো খারাপ লাগার কথা বেশি।"
মনের আকাশে কালো মেঘ আবার উঁকিঝুঁকি করে অপুর, সবসময় হাসিখুশি থাকে আর মজা করে বলে ওর মনের খবর আর কে রাখে। সবচেয়ে বেশি খারাপ তো ওর লাগছে। চাকরি করবে একা থাকবে নিজের মত চলবে সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেলো। আর তারপর দিদির জন্য যে সম্বন্ধ এসেছিলো সেখানে......
" আজ না বেরোলেই নয়, বিকেলে তো ওদের আসার কথা।"
" তাতে কি এখন থেকেই সেজে বসে থাকবো নাকি? ইলার শরীরটা ভালোনা ওকে দেখে চলে আসবো।"
ছোটজনের সাথে পেরে ওঠা মানসীর কম্ম নয় তাই চুপ করে যায়। বন্ধুর বাড়ি যখন যাবে তো যাবেই।
প্ল্যান ঠিক হয়ে গেছে, আজ আর বাড়ি ফিরছেনা। একেবারে রাতে ফিরবে, লীনা একটা প্ল্যান দিয়েছে বলতে বলেছে কেউ একটা অসুস্থ রক্ত দিতে হবে এই অজুহাতে হসপিটালে থেকে ফিরে আসবে। জানে বাবার কাছে খুব বকুনি খাবে, মা কাঁদবে তবুও বেশ হবে।
" কি রে তুই কোথায়? দুপুর তো হলো, স্নান খাওয়া করে একটু বিশ্রাম নিতে হবে তো। ওহ্ এই মেয়েকে নিয়ে আমি যে কি করি!"
" এসে যাবো...চাপ নিয়োনা।"
অপু তখন লোকাল ট্রেনে, সাথে লীনা, পরমা, গন্তব্য ইলাদের বাড়ি।
ভিড়ের মধ্যে পরমা ফিসফিস করে বলে লীনাকে ,"দুটো ছেলে তখন থেকে খুব বিরক্ত করছে। কিছুই করতে পারছিনা এত অস্বস্তি হচ্ছে।"
" পা টা দে জুতো দিয়ে চেপে।"
সবটা বলতে পারেনা পরমা ওকে দুদিক ধরে চেপে ধরেছে এমন বিশ্রীভাবে। এখনো আধঘণ্টা লাগবে পৌঁছতে কি করবে ও। তবুও জোরে ঠ্যালা দেয়। উঁচু গলায় ছেলেটা বলে ওঠে, " দাঁড়াতে শেখেননি, সব জায়গায় গায়ের জোর খাটাবেননা। লেডিসে ওঠেননি কেন?"
.." আপনি কি করছেন? মানে আপনারা? ভীড়ের সুযোগ নিচ্ছেন?"
বাকবিতন্ডার মাঝে একটু দূর থেকে অপু কোনরকমে আসার চেষ্টা করে আর তারপরেই পুরো অশান্তি লেগে যায় হঠাৎই ছুরি বের করে ওরা তেড়ে আসে।
সবাইকে চুপ করে থাকতে দেখে আশ্চর্য লাগে ওদের। অপরাজিতা ঠিক করে নেয় এবার যা করার ও করবে একাই, যা হয় হবে।
হঠাৎই কম বয়েসি একজন এগিয়ে আসে..
" এই যে ভাই শোন, তোমার বাড়ির বোন বা মায়ের সাথে এই ব্যবহারটাই করো তো?"
" আপনি কে (গালাগাল দিয়ে) মা বোন তুলে কথা বলছেন?"
" তাই! মায়ের বোনের কথায় এত গায়ে লাগছে? ওনারা নির্ভয়ে রাস্তায় ঘুরতে পারছেন বলে তোমাদের সাহস এত বেড়েছে। তবে বাড়িতে শিক্ষা কিছুই পাওনি যে মেয়েদের সম্মান করতে হয়।"
" বেশি বাতেলা করবেননা, এই সব মালকে আমার চেনা আছে।"
মাল কথাটা শুনে মাথাটা গরম হয়ে যায়, অপরাজিতা তেড়ে আসে ছেলেটা এগিয়ে যায়। ততক্ষণে ভদ্রলোক ছেলেটার হাতটা চেপে ধরে, ছুরিটা পড়ে যায়। এগিয়ে আসে ততক্ষণে আরো অনেকে। গলায় ধার নিয়ে ভদ্রলোক বলেন, " ওরা মায়ের জাত, মাল নয়। বাড়ির মেয়েদেরকেও কি মাল বলো? ছেলে হয়ে জন্মেছো বলেই কি মেয়েদের অপমান করে ছোট দেখানোই একমাত্র কাজ পেয়েছো তাইনা? একদম ছুঁড়ে বাইরে ফেলে দেবো মস্তানি করলে। ট্রেন বা রাস্তা তোমার একার নয়। ছিঃ আমাদের সবার লজ্জা এই কিছু লোকজনের জন্য।"
প?
?ের স্টেশনে ওরা সবাই নেমে যায়, পুলিশও এসে গেছে তখন। তার মধ্যে মা অন্ততঃ দশবার ফোন করেছে। মেজাজটা ভালো ছিলোনা, তাই বাড়িতেই ফিরে আসে বাধ্য হয়ে। মাকে দুঃখ দিতে আর ইচ্ছে করেনা, ওর জন্য তো অসম্মানিত হবে বাবা মা হঠাৎই মনে হয়েছিলো।
সন্ধ্যেবেলা ওরা আসে, মাতৃভক্ত দুই ছেলে একদম মায়েদের সাথে এসেছে। ওদের গল্প কানে আসে অপুর, " আপনাদের বাড়ি আসার লোভ সামলাতে পারলাম না, তাই ছেলেদের সাথে আমরা দুইবোন আবার চলে এলাম।"
আজ ঐ ভদ্রমহিলার মুখের ওপরেই বলবে, " সরি আপনার ছেলেকে বিয়ে করা আমার সম্ভব হবেনা। আমার অন্য কেউ আছে।"
মা নিয়ে এলেন একসাথে দুজনকে, আজ প্রণামও করতে ইচ্ছে করছেনা। সকাল থেকেই মুডটা অফ। হঠাৎই কানে আসে, " ঝাঁসীর রানীর আজ মন খারাপ কেন?আমরা এলাম গল্প করবো বলে। কি রে তাইনা?"
মুখ তুলতেই চোখ পড়ে যায় ক্লিন সেভড চকচকে একটা মুখের দিকে খুব যেন চেনা। সকালে দেখা চশমা পরা উস্কোখুস্কো দাড়িমুখটা মনে পড়ে গেলো এবার অপুর। সত্যিই হাসি পেলো এবার। উল্টোদিকের মুখগুলোও হাসছে তখন।
মানসী ঠিক বুঝতে না পেরে বলে, " কি হয়েছে দিদি?"
" জানিনা, ঠিক তবে সেটা অপরাজিতাই বলতে পারবে। তবে আপনার ঘরের লক্ষ্মী সরস্বতী দুজনকেই আমাদের খুব ভালো লেগেছে। কি বলিস দিদি। অবশ্য যদি ওদের কোন আপত্তি না থাকে।"
চোরে চোরে মাসতুতো ভাই কথাটা ছোট থেকে অনেকবার শুনেছে তবে বরে বরে মাসতুতো ভাই বোধহয় এই প্রথম দেখলো অপরাজিতা। তবে ওর হবু জাম্বুটাকে দেখে আর কোন মন কেমন থাকলোনা, ভীষণ সুন্দর আর ভালো, একদম দিদির সাথে মেড ফর ইচ আদার। তবে ক্লিন সেভড গালটা ভালো না ট্রেনে দেখা সেই দাড়িমুখটা ভালো ছিলো ভেবে দেখতে হবে এবার।
দিদির বিয়ের মাস ছয়েক বাদে কোন এক উদাস করা বসন্তের দিনে বাবাকে কাঁদিয়ে শ্বশুরবাড়ি গেলো অপরাজিতা। বাবা চোখে জল নিয়ে বললেন, " লক্ষ্মী হয়ে থাকিস অপু, বড় ফাঁকা হয়ে গেলো বাড়িটা, অনুও চলে গেছে।"
ক?
?ঁদতে ভালো লাগেনা কোনদিনই, তবু চোখটা কেমন জ্বালা করলো অপুর। দুই বোন মিলে জড়িয়ে ধরলো বাবাকে সেই ছোট বেলার মত।
বড় শ্বেতপাথরের থালায় দুধে আলতা আর গোলাপের পাপড়ি ছড়িয়ে অপেক্ষা নতুন বৌ আসার। শাঁখে ফুঁ দিয়ে অপরাজিতার শাশুড়িমা হেসে বলেন, " লক্ষ্মী নয় লক্ষ্মীবাঈ হয়েই এসো। হয়ত আমরা মেয়েরাই সব সয়েও পারি অনেক অনেক বেশি, আর তাইতো মায়ের আদরের উমা যুগে যুগে দুর্গা হয়ে আসি।"
আজ সত্যিই মন থেকে ওনাকে মা ডেকে প্রণাম করতে ইচ্ছে করলো অপরাজিতার।
" না না থাক থাক, বরং একটা হাগ হয়ে যাক।"
অনেক অচেনা স্পর্শের মাঝেও এই ভালোবাসার স্পর্শের স্বাদটা বড় চেনা ওর, তাই মনটা বোধহয় আবার ছুঁয়ে গেলো।
*ভালো লাগলে নামসহ শেয়ার করুন।
সমাপ্ত