এখন যা পরিস্থিতি, তাতে একটাই মন্দের ভাল - বহু মানুষ অসুস্থ হয়ে বাড়িতে আইসোলেশনে থাকতে পারছেন। একবার ভাবুন কি অবস্থা হতো যদি তাদের সবার হাসপাতালে ভর্তি হতে লাগত। আমি দেখছি সোশ্যাল মিডিয়ায় লোকজন দাবি করছে "পজিটিভ" খবর ছড়াতে, সরকারকে দোষ না দিতে। মানসিক স্বাস্থ্য এমনিতেই এখন দুর্বল।
বেশ, মেনে নিলাম।
কিন্তু, এর পরে আমাদের কিছু করণীয় রয়েছে।
এই অবস্থাটা মনে রাখবেন যখন স্বাস্থ্য এক্টিভিস্টরা সরকারকে দায়িত্বশীল হতে বলেন, সরকারের একাউন্টেবিলিটি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। সেটাকে প্রোপাগান্ডা বলে বাতিল না করে বক্তব্যের সারবত্তা অনুযায়ী বিচার করবেন।
এই অবস্থাটা মনে রাখবেন যখন ডাক্তার, নার্স, বা হাসপাতালের কর্মীদের পিটিয়ে মারেন আপনারা। এখন কিন্তু তারাই ফ্রন্টলাইনে হাসপাতালের বেডের পাশে রয়েছেন, এবং তারাই মারা যাচ্ছেন, আপনাদের খেয়াল রাখতে গিয়ে। ঐ যে সিয়াচেনের জওয়ান বর্ডারে দাঁড়িয়ে আছেন, ঐরকমই অতন্দ্র প্রহরা।
এই অবস্থাটা মনে রাখবেন যখন তারা তাদের সমস্যার কথা বলেন। পরিকাঠামোর সমস্যা, কাজের পরিবেশের সমস্যা, অপ্রতুল যোগান এগুলো নিয়ে যখন তারা কথা বলেন, তখন একটু সহানুভূতি নিয়ে তাদের কথাটা শুনুন, তাদের দোষ দিলে সমস্যাটা কিন্তু ছোট হয়ে যায় না, বরং এরকম সময়গুলোর জন্য প্রস্তুতি থাকে না।
এই অবস্থাটা মনে রাখবেন আমরা বলি যে স্বাস্থ্য রাজনৈতিক সদিচ্ছার ফলে তৈরি হয়। যদি সরকার কেবল টার্শারি হাসপাতাল বানায় কম্যুনিটি কেয়ার-এর কথা মাথায় না রেখে, যদি স্বাস্থ্য বাজেটে কম বরাদ্দ হয়, তাহলে এরকম দিন আবার হয়ত দেখতে হতে পারে।
এই অবস্থাটা মনে রাখবেন যেখানে ফ্রন্টলাইন কর্মীদের বারবার তাদের জীবন হাতে করে কাজ করতে হয়, আর আমরা সুযোগ পেলেই নিয়ম ভাঙার উৎসব পালন করি। চিকিৎসা-কর্মী, এম্বুলেন্স ড্রাইভার, সাফাই-কর্মী, পুলিশ, সরকারি পরিবহন-কর্মী, সাপ্লাই চেন কর্মী, ওষুধের দোকান চালান যারা, যে বিজ্ঞানীরা ল্যাবে করোনার নিরাময় বা ভ্যাক্সিন বানাচ্ছেন, চাষী যারা অন্নের যোগান দিচ্ছেন - এরকম আরো কত মানুষ আছেন, যাদের কাজ দামী, কিন্তু মৃত্যু মূল্যহীন - কেবল মাত্র একটা স্ট্যাটিস্টিক হয়ে যাচ্ছেন মহামারীর আগ্রাসনে। এদের অনেকেই কিন্তু প্রাপ্য মজুরিটুকু সময় মতো পান না।
এই অবস্থাটা মনে রাখবেন যখন কোনো সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সারকে নিয়ে ঠাট্টা করে তার কাজকে খেলো করেন। মনে রাখবেন, যখন সরকারের থেকে কোনো সাহায্য পাওয়া যাচ্ছে না, তথ্যের জন্য টুইটার ইন্সটাগ্রাম ফেসবুকে হাহাকার চলছে, এই ইনফ্লুয়েন্সাররাই সামনে এসে দিন রাত ধরে তথ্যে দিয়ে চলেছেন, ভলান্টিয়ার করছেন অথেন্টিক তথ্য ভেরিফিকেশনের জন্য। যা রাষ্ট্রের করার কথা তা নাগরিক একক এবং দলবদ্ধ ভাবে করেছেন স্বার্থহীন ভাবে।
আমাদের দেশে এখন তিনটে ভাগ করা যায় - সরকার সমর্থক, সরকার বিরোধী, আর যাদের কিছুতেই কিছু এসে যায় না। সমস্যা হচ্ছে যে এই সমর্থন বনাম বিরোধীতা বাইনারিতে আমরা এটা ভুলেই যাই যে সরকার পরিষেবা প্রদানকারীও বটে, আবার পরিষেবা রেগুলেশন কারীও বটে। এই পরিষেবাগুলো যে সরকারের দেওয়া দায়িত্ব এবং সেক্ষেত্রে একাউন্টেবিলিটি যে আমাদেরকেই দাবি করতে হয়, সেটা আমরা একদম ভুলে মেরে দিই। আর যদি আপনি বাসারকারই হলা পারিষাবা ভাল হবা - দলে পড়েন, তাহলে আপনিও কিন্তু সমস্যার অংশ। সরকারী পরিষেবা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তখনই দেবে যখন সেটা লাভজনক। কিন্তু জীবনদায়ী পরিষেবায় লাভ করতে গেলে রেমডিসিভির ১ লাখ টাকায় বিক্রি হবে, অক্সিজেন সিলিন্ডার তিনিই পাবেন যিনি সর্বোচ্চ দাম দিতে পারেন। এই পরিস্থিতিটা কি আপনি চাইবেন? মনে রাখবেন যে এগুলো কিন্তু একবারের খরচ নয়, বারবার লাগতে পারে। আপনার সামর্থ্য থাকতে পারে, আপনার পাশের বাড়ির বা আপনার আত্মীয়দের মধ্যে সবার আছে সে সামর্থ্য?
এই অবস্থাটা মনে রাখবেন যখন আপনি ঝাঁ চকচকে কর্পোরেট হাসপাতালে যান চিকিৎসা নিতে। যতক্ষন আপনার ইন্স্যুরেন্স কম্পানী সাপোর্ট দিচ্ছে, ততক্ষন পারবেন। তারপর নিজের ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স আর এসেট ভরসা। সেগুলো শেষ হয়ে ঘটি বাটি বিক্রি করে কিটো বা মিলাপে ফান্ডরেইজার করেও না কুলোলে কিন্তু শেষমেশ সেই সরকারি ব্যবস্থাতেই চিকিৎসা নিতে হবে। সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা দুর্বল হলে কিন্তু আমাদেরই সমস্যা - প্রাইভেট চিকিৎসা ব্যবস্থা সেখানে সাপোর্ট দেবে, কিন্তু এই মেরুদন্ডটা ভেঙে গেলে আমাদেরই ক্ষতি।
এই অবস্থাটা মনে রাখবেন যখন কেবল মাত্র সঠিক সরকারী নীতিই আপনাকে মৃত্যুর থেকে বাঁচাতে পারবে। আপনি যদি ভুল নীতি সমর্থন করেন, তার পরিণামে আপনার হাসপাতাল বেড, অক্সিজেন, রেমডিসিভির, টসিলিজুমাব, এম্বুলেন্স এগুলো অমিল হবে। ইকোনমিক্সে অপর্চুনিটি কস্ট বলে যে কথাটা আছে, একদম সেইটা। এর একমাত্র সমাধান হচ্ছে সরকারি স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বরাদ্দ বাড়াতে দাবি করা। পরিকাঠামোর উন্নয়ন করা - আর সেটা কেবল সুপারস্পেশালিটি হাসপাতাল বানালেই বা এইমস বানাতে চাইলেই হয় না। প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নতি দরকার৷ সরকারি নেতা মন্ত্রীদের সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া দরকার। কলকাতার সরকারি হাসপাতাল ব্যবস্থার উপর যে বিপুল চাপ, সেটা কমানো দরকার। দক্ষিণ ভারতে যে বিপুল পরিমান মানুষ চিকিৎসা করাতে যান, তার কারণ কি, সে ব্যাপারে ভাবা দরকার। দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছার।
এই পরিস্থিতিটা মনে রাখবেন, যেখানে মৃতপ্রায় মানুষের থেকে অক্সিজেন ছিনিয়ে নিতে। তাও এমন একটা পরিস্থিতি যেখানে অনেকেই বাড়িতে আইসোলেশনে আছেন। ভাবুন, এমন একটা প্যান্ডেমিক যদি হত যেখানে রোগীমাত্রেই হাসপাতালে ভর্তি করতে হতো। প্যান্ডেমিক হয়ত ভবিষ্যতেও হবে। কিন্তু আমরা আজ কি করছি, তার উপর নির্ভর করছে আগামী করোনাতরঙ্গ বা আগামী প্যান্ডেমিক কিভাবে কাটবে।