১
১৪/১২/ ২০০৪
বড় ঝামেলায় পড়েছেন আত্মারাম। ঝামেলা বলে ঝামেলা- সোজা সাপটা ফ্রড! যাকে বলে ধোঁকাধড়ির মামলা। সাবধানে গ্রামীণ ব্যাঙ্কে ম্যানেজারির একত্রিশ বছর পার করেছেন, কোন বড় কমপ্লেন বা শো-কজ হয়নি। ওনার ‘গোপন চরিত্রে’ কোন কলংকের দাগ নেই। আর তিনটে বছর পেরোলেই রিটায়ার। এমন সময় কিনা ওঁরই ব্র্যাঞ্চে তিন লাখ টাকার জালসাজি? আমানত মেঁ খয়ানত! সরকারের আস্থা ও ‘বিশ্বাসভঙ্গ’? আত্মারাম চিত্তাওয়ার রায়পুর শহরের ‘আপলা মানুষ” বা মারাঠি ভাষাভাষিদের এলাকা লাখেনগর পাড়ার তিনপুরুষের বাসিন্দে।
এই কান্ডের নায়ক হল ওঁর আগে যে ম্যানেজার ছিল সেই ধর্মেশ সাহু। হাসিখুশি গোবেচারা স্বভাবের লোকটার যে পেটে পেটে যে এত তা কেউ বুঝতে পারেনি। নাঃ, মানুষ চেনা দায়।
চাকরির গোড়ায় ওঁর এক সহকর্মী ছিল বিলাসরাও মরাঠে। একই শহরের নামজাদা উকিলের ছেলে। ইন্টারভিউয়ের সময় বোর্ড খুব ইম্প্রেসড। হবেনা কেন? ইংলিশ মিডিয়াম, রোটারি ও লায়ন্স ক্লাবের থেকে সমাজসেবার প্রমাণপত্র, এক অজ্ঞাত- কুলশীল মাউন্টেনিয়ারিং সংস্থার থেকে পাওয়া রক ক্লাইম্বিং ট্রেনিং এর সার্টিফিকেট। কিন্তু প্রোবেশন পিরিয়ডেই দেখা গেল ওর ব্রাঞ্চে কেউ একটি চেকে জাল সই করে পঞ্চাশ হাজার টাকা মেরে দিয়েছে। কাস্টমার এসে চেঁচামেচি করল, ব্যাপারটা থানাপুলিশ অব্দি গড়াল। নতুন ব্যাংক; বাজারে বদনামের ভয়ে কর্তৃপক্ষ কাস্টমারের পাওনা মিটিয়ে কমপ্লেইন উইথড্র করিয়ে হাঁফ ছাড়লেন বটে, কিন্তু এনকোয়ারি শুরু হল—কে সেই কালোভেড়া? তাসের প্যাকের মধ্যে নকল বাদশাটি কে বটে?
সলিড প্রমাণ বলতে কিছুই নেই, তবে সন্দেহের সুঁই ঘুরল ওই সপ্রতিভ হোঁশিয়ারচাঁদ বিলাসরাওয়ের দিকে। কিন্তু শুধু সন্দেহের বশে কতটুকু এগোনো যায়! তায় ছেলেটার বাবা শহরের নামজাদা উকিল।
শেষে চেয়ারম্যান পার্সোনাল হিয়ারিংএর জন্যে বিলাসরাওকে ওঁর চেম্বারে ডেকে পাঠালেন। আধঘন্টা নিভৃত বার্তালাপের পর ছেলেটি রেজিগনেশন লেটার দিয়ে হাসিমুখে ওঁর চেম্বার থেকে বেরিয়ে আসে। ওকে আর এই ব্যাংকের ত্রিসীমানায় দেখা যায়নি। কী কথা হয়েছিল? কেউ জানেনা।
তবে দশবছর পরে এক ট্রেনিং এর সময় কফি টেবিলের আলাপচারিতায় আত্মারাম শুনতে পেলেন যে চেয়ারম্যান সেদিন ছোকরার কানে দিয়েছিলেন একটি বীজমন্ত্র -গ্রামীণ ব্যাংক ছোট হলেও সরকারি ব্যাংক; পুঁজির বেশির ভাগ কেন্দ্রীয় সরকারের। তাই এই কেস সি বি আইয়ের কাছে তদন্তের জন্যে যাবে। ব্যাংক সারকামস্ট্যানশিয়াল এভিডেন্সের ভিত্তিতে ছেলেটাকে এ্যারেস্ট করাবে। ওর উকিল বাবা ওকে জামিনে খালাস করাবেন ঠিকই, কিন্তু শনিবারে গ্রেফতার করলে জামিন পেতে পেতে সেই সোমবার। আর আটচল্লিশ ঘন্টা হাজতবাস হলে ব্যাংক ওকে ট্র্যাডিশন অনুযায়ী সাসপেন্ড করবে। আদালতে কেস চলবে। ব্যাংক চাইবে যাতে সহজে ফয়সালা না হয়। তারিখ পে তারিখ, তারিখ পে তারিখ!
এই অবস্থায় ও অন্য কোন জায়গায় চাকরির জন্যে চেষ্টা করতে পারবে না। কয়েক বছর পর যথেষ্ট প্রমাণ না পাওয়ায় আদালত ওকে খালাস করে দেবে। কিন্তু ততদিনে ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়ে যাবে। ওর কপালে যে রাজতিলক লেগে যাবে তাতে কেউ ওকে চাকরিতে নেবে না, বিশেষ করে পাবলিক সেক্টরে। তবে অন্য রাস্তা আছে।
ও যদি নিজের ইচ্ছেয় ‘ব্যক্তিগত কারণে ত্যাগপত্র’ পেশ করে তাহলে ব্যাংকও বদলা-টদলা না নিয়ে ওকে চুপচাপ ছেড়ে দেবে। ওর বয়েস কম, সদ্য কলেজ থেকে বেরিয়েছে। কোন ভাল চাকরি খুঁজে পেতে অসুবিধে হবে না। সামনে গোটা জীবন পড়ে আছে। এখন ও ভেবে দেখুক। আরে নিজের ভাল তো পাগলেও বোঝে। তাহলে বিলাসরাও বুঝবে না কেন?
সেই থেকে আত্মারামের ওই সব চালাকচতুর শহুরে এবং বড়লোকের ছেলেদের থেকে বড় ভয়। ওঁর দৃঢ় বিশ্বাস এরা পয়সার জন্যে করতে পারে না হেন কাজ নেই। তারপর এরা শাস্তি পাবে না। এদের বাবা বা কাকা শহরের নামী উকিল, আই এ এস, স্থানীয় শাসক দলের ছোটখাটো নেতা বা কালেক্টর অফিসের বড়বাবু। এদের হাত অনেক দূর যায়। এরা সবসময় বেঁচে যায়। ফেঁসে যায় কোন ছোটখাটো বলির পাঁঠা। এদের থেকে শতহস্ত দূরে থাকাই ভাল।
একবার রেলওয়ে পাড়ার অমনই এক চালাকচতুর বলিয়ে কইয়ে কলিগ ওঁর ব্রাঞ্চে এসেছিল। ইউনিয়ন গড়তে হবে- কর্মচারিদের স্বার্থ দেখার জন্যে। আত্মারাম হ্যাঁ বলেননি, না’ও বলেন নি। কিন্তু সাধারণ সভা ও ইলেকশনের দিন ঘরে ছিলেন। ওই ছোকরা সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়ে নতুন ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট হল। একমাস পরেই ও পেন-ডাউন স্ট্রাইকের নোটিস দিল।
আত্মারাম তাঁর সদ্য রেভিনিউ অফিস থেকে রিটায়ার হওয়া বাবাকে ধরলেন—
-কী করি বলুন তো, বাবা?
-কায় লা, শ্রীরাম?
-ইউনিয়নের নেতা স্ট্রাইক করতে বলছে যে! পেন-ডাউন না কী যেন।
- নেতাটি কে?
--এক বংগালী দাদা।
--শোন, ওদের কথায় নাচিস না। ওরা সবসময় পায়ে পা দিয়ে সরকারের সঙ্গে ঝগড়া করতে চায়। সরকারের সঙ্গে ঝগড়া করে কেউ পারে? দ্যাখ, আমি এত দিন চাকরি করেছি। কখনও বসের মুখে মুখে তক্কো করি নি। ইউনিয়নকে চাঁদা দিয়েছি, কিন্তু সবসময় বসের পেছন পেছন ঘুরেছি, সামনে আসি নি।এতে আমার কোন লাভ হয়নি, কিন্তু লোকসানও হয়নি,--সেটাই আসল কথা। তুই ওই দিন সিক লীভ নে।
আত্মারাম বাবার অবাধ্য হননি।
কালের নিয়মে বাবা একদিন চলে গেলেন, কিন্তু আত্মারাম একই নিয়মে সারাজীবন কাটিয়ে গেলেন। বিয়ে হয়েছিল মারাঠি পাড়ার রামমন্দিরে দিনের বেলায়। সবাইকে তখন জিলিপি সিঙাড়া খাইয়েছেন। ফি’ বছর গণেশ উৎসবে একদিনের লাড্ডু প্রসাদের খরচা দিয়েছেন। ছুটির দিনে রামমন্দিরে গিয়ে গণেশস্তোত্র আর ‘বিঠঠল বিঠঠল, জয়হরি বিঠঠল’ ধ্বনিতে গলা মিলিয়েছেন। ওঁর শোবার ঘরের দেয়ালে টাঙানো রয়েছে শেগাঁও-ওয়ালে গজানন মহারাজের গেরুয়া এবং কলকেধারি বয়স্ক ছবি। গিন্নি ভগিনীমন্ডলে সমাজ সেবার কাজে হাত লাগান, ছেলে মেয়ে পড়াশুনো করেছে সরস্বতী শিশুমন্দিরে। উনি নিশ্চিত ওঁর মাথায় প্রয়াত আই-বাবার (মা-বাবার) এবং স্বয়ং ভগবানের বরদ হস্ত রয়েছে। তাই ওনার কোন বড় বিপদ হবে না। তাহলে বুড়ো বয়সে এটা কী হল? কেন হল?
ওঁর কোন উচ্চাশা ছিল না। চেয়েছিলেন নিশ্চিন্ত নিরাপদ জীবন। রিটায়ার করলে যা পাবেন ও যা জমেছে তা’ কুড়িয়ে বাড়িয়ে যথেষ্ট। কাস্টমারকে লোন দেয়ার ডিসিশন বা অ্যাসেট পারচেজ থেকে বরাবর নিজেকে সরিয়ে রেখেছেন। ওসব দায়িত্ব সেকন্ড অফিসার বা ফিল্ড অফিসাররাই সামলেছে।
দাদুর আমলে তৈরি পৈতৃক বাড়িতেই উনি সুখী। ব্যাংকে কাজ করেও উনি সিগ্রেট খান না; মদ ছুঁয়ে দেখেননি।নেশা বলতে শুধু ঘন্টায় ঘন্টায় চা।
বাঁ-হাতের কারবারে ওনার একান্ত অনীহা। লোন দিতে কমিশন খাওয়া? ওঁর কাছে ওসব মহর্ষি বিবস্বানমনু কথিত গুরুপত্নীগমনের মত মহাপাপ।
উনি জানেন ওঁর কলীগরা ওঁকে নিয়ে হাসাহাসি করে, করুণার চোখে দেখে। একবার ওঁর অন্য শাখায় ট্রান্সফারের সময় সেই বাঙালি দাদা উপস্থিত ছিল। ও তখন ব্যাংকের অডিট সেলে আছে। সেই সুবাদে একদিনের স্ন্যাপ অডিট করতে ওখানে এসেছিল। বিকেলে কিছু কাস্টমার এবং অল্প ক’জন স্টাফ মিলে সংক্ষিপ্ত ফেয়ারওয়েল পার্টি।শেষে স্থানীয় স্কুলের একজন টিচার বললেন—আমি একটা চুটকুলা শোনাব।
সবাই ইরশাদ ইরশাদ, হো জায়ে, হো জায়ে করে তোল্লাই দিল। উনি শুরু করলেনঃ
‘সেবার আমাদের পাড়ার ভরত যাদব রতনপুরের শনিবারের গো-হাটায় দুধেল গরু কিনতে গেছল। আমিও সঙ্গে গেছলাম। গরুর দাম হয় কত লিটার দুধ দেয় তার হিসেব কষে। ধরুন, লিটার প্রতি একহাজার টাকা। যেমন, যে গরু একবারে দশ লিটার দুধ দেবে তার দাম দশ হাজার টাকা, পনের লিটার দিলে পনের হাজার টাকা এ’রকম। বিক্রেতা দরদাম ঠিক হলে ক্রেতার সামনে গরু দুইয়ে দেখায়, ক্রেতা সন্তুষ্ট হলে টাকা দিয়ে গরু নিয়ে বাড়ি ফেরে। র লুঙ্গির খুঁটের জোর পনের হাজার। কিন্তু নজর পড়ল কালোর মধ্যে সাদা ছিট ছিট এক অতি সুন্দর দুধেল গাইয়ের দিকে। তবে ওর দাম চল্লিশ হাজার টাকা। এত দাম? কত লিটার দুধ দেয়? এক লিটারও না। গাভীন হয়নি তো! কেন? ও কোন ষাঁড়ের পাল খায় না, ভারি দেমাক। তাহলে এত দাম? বাঃ ওর ক্যারেকটার ভাল যে! গরুর মধ্যে অমন ‘পবিত্র চরিত্র’!
সবাই ফিক ফিক করে হাসল।
মাস্টারমশাই এবার বললেন—আরও আছে। এই গুণ শুধু গরুর মধ্যেই বিরল নয়, মানুষের মধ্যেও। তবে চারপাশে চাইলে এক- আধজন মহাত্মার দেখা পেয়েও যেতে পারেন।
এবার সবাই খ্যা-খ্যা করে হাসল এবং বারবার আত্মারামের দিকে চাইতে থাকল।
আত্মারামের কান লাল হয়ে উঠল, কিন্তু উনি বিচলিত হলেন না। জানেন যে, এসব প্রলোভন ব্যাংকারদের সামনে আসে, কিন্তু তার ফাঁদে পড়তে নেই।
কিন্তু এবারের ব্যাপারটা যে অন্যরকম। একেবারে পুলিশে ছুঁলে আঠেরো ঘা’ কেস।
ঠিক দু’মাস আগে ১২/১০/২০০৪
ধর্মেশ সাহু হাসিখুশি হ্যান্ডসাম বছর তেত্রিশের ইয়ংম্যান।কাস্টমার এবং কলীগদের মধ্যে বেশ পপুলার।তার থেকে তিনমাস আগে ব্র্যাঞ্চের চার্জ নিয়েছেন ভাউ আত্মারাম। কাগজপত্তর সব ঠিকঠাক। পুরনো অডিট রিপোর্ট ভাল, লোন ডকুমেন্টে কোন ত্রুটি নেই।
বাদ সাধল একটা চেক। জনৈক রোহিণী সাহুর নামে জারি করা একটা পঁচিশ হাজারের চেক। চেক ইস্যু হয়েছে সাড়ে পাঁচমাস’ আগে জনৈক শ্যামজীরাওয়ের অ্যাকাউন্ট থেকে, এখন কালেকশনের জন্যে এক সপ্তাহ আগে ওরিয়েন্টাল ব্যাংক থেকে এসেছে। কিন্তু শ্যামজীরাও তো তার অ্যাকাউন্ট চারমাস আগে বন্ধ করে দিয়েছে। এখন উপায়? চেক বাউন্স করা? শ্যামজীরাওকে খুঁজে পেতে চেক ফেরত দেয়া? নাকি আবার অ্যাকাউন্ট খুলতে অনুরোধ করা? কিন্ত এসব ঝামেলায় যদি চেক তামাদি হয়ে যায়? আর পনের দিন পেরোলেই ছ’মাস পুরবে। ওই চেক ইনভ্যালিড হয়ে যাবে।
আত্মারাম এরিয়া অফিসে ফোন করে জানতে চান কী করা? পরের দিন এরিয়া অফিস থেকে দু’জন অডিটের লোক এনকোয়ারিতে আসে। ওরা শ্যামজীরাওয়ের বন্ধখাতার লেজারশীটের লেনদেন প্রায় আতসকাঁচ দিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। তার ব্যাংকের লেজারশীটে লেখা ঠিকানায় যোগাযোগের চেষ্টা করে। কী আশ্চর্য! ওই ঠিকানাটি একটি মোটরকার রিপেয়ারিং গ্যারেজের।ওখানে কোন শ্যামজীরাও থাকে না।
তারপর ওরা রোহিণী সাহুর ঠিকুজি কুষ্ঠি খুঁজে তার বাড়িতে পৌঁছে যায়।
এরপর আকাশ ভেঙে পড়ে। কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়েছে যে!
দেখা যায় রোহিণী সাহু হলেন প্রাক্তন ম্যানেজার ধর্মেশ সাহুর শাশুড়ি। শ্যামজি রাওয়ের অ্যাকাউন্টটি একটি ফেক। কিন্তু গত দু’বছর ধরে এই অ্যাকাউন্টে নিয়মিত ক্যাশ জমা হয়েছে এবং সেখান থেকে কোন ‘ভুতুড়ে’ শ্যামজীরাও নিয়মিত ধর্মেশ সাহুর শাশুড়ির নামে চেক জারি করে কয়েক লাখ টাকা ওনার অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করেছে।
ধর্মেশ এখন চাঁপা জেলার একটি ব্র্যাঞ্চে ম্যানেজার। তাকে সাসপেন্ড করে জেরা করা হয় এবং এই ব্র্যাঞ্চে নিয়ে এসে জেরা করার পর এখানকার ক্যাশিয়ারও সাস্পেন্ড হয়।
তারপরে একমাস ধরে এনকোয়ারির পর ষড়যন্ত্রের গোটা ছবিটা স্পষ্ট হয়। ধর্মেশ সাহু দশটা গাঁয়ের চাষিদের জমির মালিকানা ডকুমেন্টে জমির পরিমাণে একটি করে ডেসিমেল ডানদিকে সরিয়ে দেয়। ফলে জমির পরিমাণ দশগুণ বেড়ে যায়। যেমন ২.৫ হেক্টর জমি হয়ে যায় ২৫ হেক্টর। ও সেই অক্ষরপরিচয়হীন বা কেবল কোনরকমে নাম লিখতে পারে এমন চাষির নামে ২৫ হেক্টরের ঋণপত্র বানায়। চাষি জানে ও তো শুধু ২.৫ হেক্টর জমির হিসেবে লোন নিচ্ছে। ওকে শুধু সেই হিসেবে ঋণ শোধ দিতে হবে। বাড়তি বিশাল ঋণের অধিকাংশ যায় কো-অপারেটিভ ব্যাংকে সার কেনার অর্ডারে। চাষি তার নির্ধারিত নগদ টাকা এবং ন্যায্য পরিমাণের সার পেয়ে খুশি । বাড়তি বিশাল সার--ইউরিয়া ও সুপার ফসফেট-- ফার্টিলাইজার গোডাউনের সুপারভাইজারের মাধ্যমে কালো বাজারে বিক্রি হয়ে ব্যাংক ম্যানেজার বিলাসরাও, ওর ক্যাশিয়ার এবং সার গোডাউনের সুপারভাইজারের মধ্যে ভাগ-বাঁটোয়ারা হয়ে যায়। ধর্মেশ সাহু তার হিস্যে থেকে কিছু টাকা কিস্তিতে ওই লোন অ্যাকাউন্টে জমা করতে থাকে। ফলে ওই খাতা এনপিএ না হয়ে অডিটরের চোখ এড়িয়ে যায়।
এ’রকম ১০৭ জন প্রতারিত কৃষকের খোঁজ পাওয়া গেছে। জানা গেছে ধর্মেশ সাহুর রায়পুরের তাঁতিয়াপাড়ায় একটি তিনকামরার ফ্ল্যাট আছে, স্ত্রীর আর শ্যালকের নামে, নগদে কেনা।
এবার পুলিশে রিপোর্ট করা হয়। রিপোর্ট করা হয় তহসীলের ল্যান্ড রেভিনিউ অফিসে।ওই ১০৭ জনের চাষের জমির কাগজ সরকারি রেকর্ডের সাথে মিলিয়ে দেখতে হবে; রেভিনিউ ডিপার্টমেন্ট থেকে সার্টিফায়েড কপি নিতে হবে। তবে আদালতে অপরাধ প্রমাণ করা যাবে।
এখন রোজ এই সব কাগজ ও দলিল-দস্তাবেজের পাহাড় নিয়ে ল্যান্ড রেভিনিউ অফিসে হত্যে দিয়ে কাজ আদায় করা – কে করবে? তাছাড়া ওই ধোঁকা খাওয়া ১০৭ জন কৃষককে থানায় নিয়ে গিয়ে আইডেন্টিফাই করিয়ে ওদের জবানবন্দী করাতে হবে, কে করবে?
কেন, ব্র্যাঞ্চ ম্যানেজার আত্মারাম ভাউ! এটা তো প্রাথমিক ভাবে ওর ব্র্যাঞ্চের ব্যাপার।
আত্মারামের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে।
১৬ ডিসেম্বর নাগাদ ও গিয়ে তহসীলদারের অফিসে দেখা করে। উনিও এই এলাকায় নতুন এসেছেন। সব শুনে বললেন কোন চিন্তা করবেন না। পাশেই থানা, আমি থানেদার শ্রীবাস্তবজীকে বলে দিচ্ছি। এই শীতের দুপুরে আমার ক্লার্ক আর পুলিশের দুজন এ এস আই মিলে সামনের মাঠে রোদ্দূর পিঠে করে রোজ চারঘন্টার জন্যে বসুন। সাতদিনে কাজ মিটে যাচ্ছে। লিস্ট ধরে রোজ জনাকুড়ি চাষিকে ডেকে আনুন।
এক টেবিলে ওদের জমির রেকর্ড চেক হবে। পাশের টেবিলে পুলিশ ওদের স্টেটমেন্ট নেবে। তারপর ব্যাংকে ফেরার আগে আমার সঙ্গে দেখা করে কতদূর প্রগ্রেস হল, সেটা জানিয়ে তবে যাবেন।
আত্মারাম কাজে নামলেন। সামনে ক্রিসমাসের ছুটি পড়বে। ২৩ তারিখ নাগাদ কাজটা গুটিয়ে ফেলতে পারলে ভাল হয়।
সে’দিন সন্ধ্যেবেলা ১৯/১২/২০০৪
তহশীলদার সোনওয়ানে তিন’বছর আগে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় বসেছিলেন। প্রথম ক্যাটিগরিতে মাত্র ৯টা সীট। তাই উনি সেকন্ড ও থার্ড ক্যাটেগরির ফর্ম ভরেছিলেন। দুটোতেই পাশ করার পর ইন্টারভিউ, তারপর অ্যাপয়েন্টমেন্ট এসব মিলে দেড় বছর লেগে গেল। এখন উনি প্রোবেশন পুরো করে কনফার্মড হয়েছেন।
ওঁর শ্বশুর ছত্তিশগড় সরকারের শিক্ষাবিভাগে সেক্রেটারি। নিজের মেয়ের জন্য মেধাবী হোনহার ছেলে খুঁজছিলেন। পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোতেই তড়িঘড়ি বিয়ে দিয়ে দিলেন। জামাইকে বললেন- আমি মানুষ চিনি। এখন যাই হোক, তুমি অনেকদূর যাবে।
সোনওয়ানে বিশ্বাস করেন যে এই সিস্টেমের সবটুকুই পচে যায়নি। এখনও সূয্যি পূবে ওঠে, পশ্চিমে অস্ত যায়। ওঁর বিশ্বাস, এই সিস্টেমের ভেতরে ঢুকেও দলিতদের জন্যে অনেক কাজ করা যায়। হ্যাঁ, মাঝেমধ্যে নারাজ বড়কত্তা বা মন্ত্রীশান্ত্রীর চাপে দূরদূরান্তরে কোন ধ্যাদ্দধেড়ে গোবিন্দপুরে ট্রান্সফার হতে পারে। তাতে ভয় না পেয়ে পার্ট অফ দ্য গেম মনে করলেই হল। উনি দলিতদের সন্ত সতনামীগুরু বাবা ঘাসীদাসের ভক্ত। রোজ বাবার ছবির সামনে চোখ বুঁজে প্রার্থনা করেন—আমাকে শক্তি দাও বাবা, আমার হাতে যেন কোন অন্যায় না হয়। ক্ষমতা হাতে পেয়ে যেন অপব্যবহার না করি।
সন্ধ্যেবেলা একসঙ্গে চা খেতে খেতে গিন্নিকে বলেন—আমার অফিসে উঁচু প্ল্যাটফর্মের উপর ওই চেয়ারটা যেন বিক্রমাদিত্যের সিংহাসন।ওখানে বসলে আমার গায়ের ভেতর শিরশির করে। ভেতর থেকে কেউ বলে- ধর্ম পালন কর; রাজধর্ম। আজকেও একটা কেস ছিল। বাদী কিন্তু আমাদের সমাজেরই। পঞ্চায়েতের জমি চুপিচুপি কব্জা করে বাড়ি বানিয়েছে।পাটোয়ারি, রেভিনিউ ইন্সপেক্টর সব দক্ষিণা পেয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে থেকেছে। এখন চাইছে আমি যদি নামমাত্র ফাইন করে ওর এই বেআইনি নির্মাণটা আইনি করে দিই।
--তা’ আপনি কী করলেন জীজাজি? করে দিলেন তো? হাজার হোক আমাদের দলিত সমাজের লোক। আপনা আদমী।
প্রশ্ন করেছে অনুজ ধৃতলহরে, কলেজের পরীক্ষা দিয়ে দিদির কাছে ক’দিনের জন্যে বেড়াতে আসা শালাবাবু।
--অনুজ, তুমি বোধহয় বিক্রমাদিত্যের সিংহাসনের গল্পটা শোননি।ওখানে বসলে সবাইকে সমান মনে হয়। রাজা হো ইয়া রংক, পরদেশি হো ইয়া স্বদেশি। নিজের ভাই বা আত্মীয়স্বজনের কথাও ভুলে যেতে হয় , তো কোথায় দাঁড়ায় নিজের জাত বা সমাজের গল্প।
--ওসব পুরনো দিনের বাতিল হওয়া নোট, প্লাস্টিকে মুড়ে বাঁধিয়ে রাখুন গে’। আজকাল কেউ অমন করেনা। সবাই বহতী গঙ্গায় ডুব লাগায়।
--দেখ অনুজ, তুমি যখন চাকরি করবে তখন দেখব কী কর। অবশ্য তোমার ইমান তোমার কাছে। আমাকে বা তোমার দিদিকে ওসব বলে লাভ নেই।
ইতিমধ্যে একটি বড় ট্রে করে তিনকাপ চা’ নিয়ে ঢুকেছে পার্বতী বাঈ, পেছনের সার্ভেন্ট কোয়ার্টারে থাকা আর্দালি মঙ্গলরামের দ্বিতীয় বউ।
পঞ্চাশোর্ধ মঙ্গলরামের প্রথম বৌ সন্তান জন্মের সময় ধনুষ্টংকার হয়ে মারা যায়। ছ’মাসের মাথায় ও তিরিশবছরের পার্বতীকে চুড়ি পরিয়ে বাবার থানের সামনে সিঁথিতে সিঁদুর দিয়ে ঘরে তোলে। একে বলে চুড়িহাই পত্নী। এদের সমাজে এমন চল আছে, শুধু মিঞাবিবি রাজি হলেই হল। পার্বতীর আগের স্বামীর মনে দুঃখ ছিল যে বিয়ের দশবছরেও পার্বতী কোন সন্তানের জন্ম দিতে পারেনি। দু’দুবার ফুল হয়ে ঝরে গেছে। ওর স্বামী মনে করত সবটাই পার্বতীর দোষ। কোন দিন ডাক্তারের কাছে যেতে রাজি হয়নি। বললেই রেগে যেত। একদিন মদ খেয়ে রাগের মাথায় ওকে চ্যালাকাঠ দিয়ে ঠ্যাঙায় এবং দরজা খুলে খেদিয়ে দেয়। পার্বতী সেই যে বাপের বাড়িতে গিয়ে উঠল তারপর শত সাধ্যসাধনাতেও ফিরতে রাজি হয়নি।
বছর ঘোরার মধ্যে মঙ্গলরামের চুড়ি পরানোর প্রস্তাবে ও না করতে পারেনি। হোক না স্বামী কুড়ি বছরের বড়। সরকারি অফিসের আর্দালি, পাকা ঘর, নগদ মাইনে, শস্তায় তরি-তরকারি-দুধ পাওয়া যাবে। সারাদিন মেমসাহেবের ফাইফরমাশ খেটে মন জুগিয়ে চললে আখেরে অনেক লাভ।
সবচেয়ে বড় কথা মঙ্গলরাম ওকে ভালবাসে। বয়স্ক লোকের ভালবাসা পার্বতী অত বোঝে না। । নিজে ঘরে পুরনো গেঞ্জি, হাফপ্যান্ট সেলাই করে পরে, কিন্তু বৌকে সবসময় নতুন শাড়ি-ব্লাউজ-পেটিকোট কিনে দেয়। আর পতিদেবতাটি একেবারে সাদাসিধে গৌ-আদমী। কক্ষনো বউয়ের গায়ে হাত তোলে না। ওর জ্বর হলে রাত জেগে জলপট্টি করে, মাঝরাতে উঠে গায়ের চাদর সরে গেলে ঠিক করে দেয়।
সোনওয়ানে সাহেব একটু অবাক। এই তো চা খেলাম, আবার কেন? পার্বতী উত্তর না দিয়ে অনুজের দিকে তাকায়। অনুজ বলে-চা’ নয় জীজাজি, কফি। আমি কালই ওই নোকরানীকে বলেছিলাম এই সময় কফি না খেলে আমার মাথা ধরে, তাই বানিয়ে এনেছে। এ কিন্তু বেশ কাজের, একটু শিখিয়ে পড়িয়ে নিলে—
সোনওয়ানে গম্ভীর হলেন।
--আমরা কিন্তু ওদের নৌকর বা নোকরানী বলি না।
অনুজ অবাক হয়। নৌকরকে আর কী বলে ডাকা যায়? ওঃ, হিন্দি ফিল্মের স্টাইলে রামুকাকা?ওসব সিনেমাতেই মানায়, প্র্যাক্টিক্যাল লাইফে—
ভাই ও স্বামীর কথাবার্তায় হাওয়া গরম হচ্ছে দেখে মিসেস সোনওয়ানে কথা ঘোরাতে চাইলেন।
--সুনিয়ে জী, অনুজ ইসবার পাবলিক সার্ভিস কমিশন কী ফর্ম ভরে হ্যায়, বিলকুল আপকে তরহ। আগামী মাসে রিটন এগজ্যাম, ও কিন্তু খুব মেধাবী, অনেকটা আপনারই মত। পাশ তো করবেই। তারপর ইন্টারভিউয়ে ভাল ফল করে আগামী বছর এই সময় নাগাদ পোস্টিং পেয়ে যাবে। দারুণ হবে, কী বলেন।
--সে আর বলতে! তবে ইন্টারভিউয়ে খুব ভাল করতে হবে। স্টিফ কম্পিটিশন।
--হো জায়েগা জীজাজি। পি এস সি মেম্বারেকো একলাখ কা লিফাফা পকড়া দেঙ্গে।ব্যস্, কাম হো জায়েগা।
সোনওয়ানে কফির পেয়ালায় বিষম খেলেন।
--বলছ কী, সরকারি কাজে ঢুকবে ঘুষ দিয়ে?
--আমি না দিলে অন্য কেউ দেবে, এবং তার হয়ে যাবে।
--শ্বশুরমশাই জানতে পারলে?
-- আপনি বড্ড ভোলেভালে জীজাজি। একলাখ টাকাটা উনিই তো দেবেন। পানলিক সার্ভিস কমিশনের মেম্বারের সঙ্গে লেনদেনের কথা তো উনিই আগেভাগে বলে রাখবেন। হ্যাঁ, আমি দুটো পরীক্ষাই ভাল করে দেব। তাতে ফাঁকি নেই।কিন্তু পয়সা না দিলে এসব কাজ হয় নাকি? যা দেব, তার বেশি একবছরে তুলে নেব। আমি কোন ধর্মশালা খুলব নাকি?
সোনওয়ানে উত্তেজিত।
কই, আমার সময় তো টাকা দিতে হয় নি?
--টাকা দিতে হয়নি ঠিকই, কিন্তু বাবা একটা কাজ করে দিয়েছি্লেন। তখনকার পিএসসি চেয়ারম্যানের ছেলে একটা বড় ঝামেলায় ফেঁসে গেছল। হমারে বাপু অপনা পঁহুচকে তাগদ সে ছেলেটাকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন। তারপর ছেলেটাকে ওখান থেকে সরিয়ে দিয়ে একটা সেফ জায়গায় পোস্টিং-ব্যস্। হিসাব বরাবর। দুনিয়া লেনদেন সে চলতা হ্যায় জীজু, উঁচনীচ দেখনা পড়তা। কেবল আপ হী—। বিশ্বাস না হয় দিদিকে জিজ্ঞেস করুন, ও সব জানে।
(দুনিয়া লেনেদেন করেই চলে জামাইবাবু, ছোটবড় দেখে চলতে হয়। শুধু আপনিই--।)
সোনওয়ানে উঠে ভেতরে চলে গেলেন।
দিদি ভাইকে ঝাঁঝিয়ে উঠলেন-কী দরকার ছিল তোর এতসব কথা বলার? এখন যদি রাত্তিরে খেতে না আসে—
পরের দিন বেলা দু’টো ২০/১২/ ২০০৪
আত্মারাম এই শীতের দুপুরেও ঘেমে উঠেছেন। রেভিনিউয়ের জমির রেকর্ডের নকলের কাজ প্রায় শেষ। কিন্তু এই চারদিন ধরে মাত্র তিরিশ জনের বয়ান নিয়েছে পুলিশ। স্থানীয় থানার এ এস আই নির্মলরাম এবং মুন্সীজি দুধনাথ। এদের মুখ সারাক্ষণ পেঁচার মত গম্ভীর। মুন্সীজি কথায় কথায় বলেন এই থানায় এত কাজ, এত নালিশ, কিন্তু কার্বন ও কাগজ কেনার মাসিক বাজেট মাত্র ২৫ টাকা। আত্মারাম রোজ ব্যাংক থেকে কাগজ এবং কার্বন নিয়ে আসতে লাগলেন। নির্মলরাম বলল—খিদে পেয়েছে, কিন্তু বাড়ি গিয়ে ভাত খেলে ওর ঘুম পায়।
আত্মারাম রোজ চারবার করে চা’ এবং দু’বার এক এক প্লেট ভাজিয়া(ফুলুরি)ও সামোসা স্থানীয় ক্যান্টিন থেকে আনিয়ে দিতে লাগলেন। তবু কাজ এগোচ্ছে শম্বুকগতিতে।
অবশেষে ওনার বোধোদয় হল যে এদের অসহযোগের আসল কারণ অন্য। এটা ব্যাংকের মানে সরকারের কাজ। এতে হাতের তালু চুলকোয় না। অতিরিক্ত আমদানির কোন চান্স নেই। এটা প্রাইভেট ধোঁকাধড়ি জালসাজির কেস হলে আর দেখতে হত না, একেবারে আ—হা, আহাহা-হা! মুনশীজি চুমকুড়ি কাটেন।
এমন সময় দু’জন চাষি উত্তেজিত হয়ে হাজির।
- প্যার পরথন সাহাবমন। জলদি চলিহ। হমন চারপারাকে।অব্বর ঝগড়া শুরু হোয়থে। খুনাক্ষুন হো জাহি।তুহিমন ভরোসা।
পায়ে পড়ি গো সায়েবেরা। শিগগির চল, আমরা চারপারা গাঁয়ের। বড়সড় হাঙ্গামা শুরু হয়েছে।রক্তারক্তি হল বলে, এখন তোমরাই ভরসা।
যা বোঝা গেল, চারপারা গাঁয়ে কোন নালার পাড় কেটে কারও জমিতে জলধারা বইয়ে দেওয়ায় পাকা ধান পচে যাবার জোগাড়। দুশমনি। এখন গোটা গাঁ দুই শিবিরে বিভক্ত। কিছু ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে লাঠি, বরছা, ভালা, তলোয়ার ও রামদা। শিগগির চল গো।
বিরক্তিতে খিঁচিয়ে ওঠে মুনশী দুধনাথ। দেখছিস না এখানে সরকারি কাজ হচ্ছে? খুব জরুরি কাজ। এসব ছেড়ে এখন তোদের অজ গাঁয়ে যাবার সময় কই?
ওদের অবাক হওয়া ভ্যাবলা মুখের দিকে তাকিয়ে এ এস আই নির্মলরাম বলে- যা যা; এখন পালা। দু’একটা লাশ পড়লে এসে খবর দিস, তখন যাবো’খন।
আত্মারাম চায়ের ফরমাশ করে কাগজ তুলে নাম ডাকেন- সাক্ষী নানকু সিং! তোমার বয়ান হয়ে গেছে। এবার মুন্সীজির কাছে তোমার নাম বলে এই কাগজটায় বাঁহাতের বুড়ো আঙুলের ছাপ লাগাও। এস, আমি ধরে ধরে লাগিয়ে দিচ্ছি।
চা’ আসে, ভাজিয়া আসে। কাজ এগোতে থাকে। আত্মারাম মুনশীজিকে বলতে থাকেন—আজ আমরা অন্ততঃ কুড়ি জনের বয়ান করিয়ে তবে উঠব। দেখুন, এদের রোজ রোজ কাজ কামাই করিয়ে এখানে নিয়ে আসা মুশকিল। তাই আজ যে কুড়িজনকে এনেছি—
কথা শেষ হবার আগে দৌড়তে দৌড়তে এসে হামলে পড়ে চার-পাঁচজন গ্রামবাসী। তাদের মধ্যে চারপারা গাঁয়ের আগের দু’জনকে চিনতে কোন অসুবিধে হয়না। ওরা হাঁপাচ্ছে। তারমধ্যেই একজন চেঁচিয়ে ওঠে--সায়েব তোরা বলেছিলি না দু’একটা লাশ পড়লে তবে খবর দিতে? সোজা তিনটে লাশ পড়েছে চারপারায় বটগাছের পাশে বামনদীঘির ধারে। এবার তো যাবি?
আত্মারাম বুঝতে পারেন আজকে আর বয়ান নেবার কাজ হবে না।
বেলা চারটে
থানা থেকে কালো ডগগা ভরে সাতজন পুলিশের দলটি চারপারা গাঁয়ে চলে গেছে। তিনটে লাশ পড়ে যাবার খবরে চারদিকে চাপা উত্তেজনা। একটি লাশ নাকি মেয়েমানুষের!
আত্মারাম সেদিনের রেভিনিউয়ের লালশালুতে বাঁধা দস্তাবেজ তহশীল অফিসে জমা করে তহশীলদার সোনওয়ানেজীকে বিস্তারিত কমেন্ট্রি দিচ্ছিলেন। মিঃ সোনওয়ানের মধ্যেও লেগেছে উত্তেজনার ছোঁয়াচ।উনি আর্দালি মঙ্গলরামকে বললেন ওর ঘর থেকে দু’কাপ কফি বানিয়ে আনতে। ওর বৌ পার্বতী নাকি ভাল কফি বানায়। তারপর উনি খুঁটিয়ে প্রশ্ন করতে থাকেন আত্মারামকে।
‘ভোকোয়া’ বা আতাক্যালানে মঙ্গলরাম খুশি মনে রেভিনিউ আদালত থেকে প্রায় পঞ্চাশ গজ দূরে পাঁচিলের কাছে ওর ডেরার দিকে রওনা দেয়। এখন সাহেবের কাছে আর কোন কেস নেই। সাহেব ব্যাংকওয়ালের সঙ্গে খোশগল্পে মেতেছেন। ফলে কফি-টফি বানিয়ে নিয়ে আসতে একটু দেরি হতেই পারে। তারপর দেখতে হবে কিছু ভাল বিস্কুট আছে কিনা।ও জানে যে সাহেব মুখ ফুটে না বললেও এসময় সঙ্গে বিস্কুট দেয়া দস্তুর।
সে যাকগে, এই ফাঁকে ও কিছুটা সময় বৌয়ের সঙ্গে কাটাবে, একসঙ্গে লাল চা’য়ের ছোট কাপে চুমুক দেবে দু’জনে।
ঘরের কাছাকাছি এলে শুনতে পায় খিলখিল হাসির আওয়াজ। একটা তো চেনা, আর একজন কে?
ভেজানো দরজা ঠেলে মঙ্গলরাম পাথর, ওর বুকের ভেতরটা কেউ খিমচে ধরেছে। ছোট্ট ঘরটা এমন অচেনা লাগছে কেন?পার্বতীর শাড়ি-সায়া খাটিয়ার একপাশে মাটিতে লুটোচ্ছে, অন্য পাশে মাটিতে পড়ে একটা কালো প্যান্ট।
পার্বতীর বুকের উপরে চড়ে বসেছে সাহেবের শালাবাবু, এবং দু’জনে মিলে ‘ঘুঘু সই, বাসা কই’ খেলছে।
কয়েক মুহুর্ত; তারপর দ্রুত এগিয়ে যায় মঙ্গলরাম, টেনে ধরে শালাবাবুর কাঁধ, আর বুঁজে আসা গলায় অনুনয়ের স্বরে বলে—এ সাহাব! এ ছোটে সাহাব! নীচে আজা সাহাব। এইসন নহী করতে। ই গলত কাম হ্যায়। এ সাহাব, এ শালাবাবু!
হঠাৎ মিথুনযুগলের চৈতন্য হয়। পার্বতী ছটফট করে নিজেকে ছাড়াতে । কিন্তু ওকে শক্ত করে দু’পায়ের ফাঁকে আটকে রেখেছে অনুজ। ঘাড় ঘুরিয়ে একনজর মঙ্গলরামকে দেখে ও কাঁধের একঝটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দূর দূর করে বুড়ো আর্দালিকে।
ভাগ যা! জলদি ভাগ শালে!
গুঙিয়ে ওঠে মঙ্গলরাম।
কেইসন করথস ভাই শালাবাবু? মান জা মোর বাত লা।
কেমন করছিস ভাই শালাবাবু? আমার কথা শোন; এসব তোদের মানায় না।নেমে পড় ভাই, ছেড়ে দে পার্বতীকে।
অনুজ তখন খেতে ধান রুইতে ব্যস্ত। বাধা পেয়ে খিঁচিয়ে ওঠে।
পা টেনে টেনে আদালত চত্বরে পৌঁছে যায় মঙ্গলরাম। ওকে দেখে সোনওয়ানে সাহেব অবাক। খালি হাতে কেন? কফি কই?
হুমড়ি খেয়ে তহসীলদারের দু’পা জড়িয়ে ধরেছে ওনার আর্দালি মঙ্গলরাম। মুখ ঘসছে পায়ে।
--সাহাবজী, ও সাহাব, দেখ তোর শালাবাবু কেইসন করথে, চল সাহাব, দেখ লে।
ও সায়েব, সায়েব গো! দ্যাখো তোমার শালাবাবু কেমন করছে! চল সায়েব, দেখবে চল।
বিক্রমাদিত্য কি সিংহাসনে বসবেন?
=============================================
৩
৪
৫
“সাহেব, দেখ তো, তোর শালাবাবু কেমন করছে”