এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • কম্যুনিটি ইন্টারপ্রেটিং --- এক অন্য ধরণের ভাষাচর্চার অভিজ্ঞতা

    Sreyoshi Bose লেখকের গ্রাহক হোন
    ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২১ | ৯৬১ বার পঠিত
  • কম্যুনিটি ইন্টারপ্রেটিং --- এক অন্য ধরণের ভাষাচর্চার অভিজ্ঞতা

    কোনো ভাষা ভালো ভাবে ব্যবহার করতে পারা মানে কি কেবলই সেই ভাষায় সুললিত ভাবে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারা? অনেকের তেমনই ধারণা। কিন্তু ভাষার পরিচয় শুধু মাত্র সাহিত্যে নয়; তার পরিচয় সাধারণ জীবন যাপনের অংশ হিসেবে দৈনন্দিন ব্যবহারে। শহুরে বাংলা অল্পবিস্তর ইংরেজী মিশ্রিত এবং বিশুদ্ধতাবাদীদের ভ্রূকুটি ও বিদ্রূপ সত্বেও এটাই এখন বাস্তব। মজাটা হয় তখন যখন আপনি পুন্ডরীকাক্ষ পুরকায়স্থ ওরফে গৌরহরির মতো পুরোপুরি বাংলায় কথা বলতে বাধ্য।

    ধন্যবাদের প্রত্যুত্তরে আমরা বাংলায় কি বলি? ভেবে দেখলাম বাংলায় কেউ ধন্যবাদ বললে আমরা সাধারনত ঘাড় কাত করে হেসেই উত্তরের কাজ চালাই বা ‘আরে কোনও ব্যাপার না’ বা ‘আরে ঠিক আছে ঠিক আছে’ বা খুব বেশী হলে ‘ধন্যবাদ জানানোর প্রয়োজন নেই’ বলি। আমার দশ বছরের কন্যা কিছুতেই তা মানে না। সে ইংরেজীর ‘ওয়েলকাম’ এর বাংলা হিসেবে সবাইকে ধন্যবাদের উত্তরে ‘স্বাগত’ বলে বেড়ায়। ‘হ্যাপী ফ্রাইডে’ বা ‘হ্যাপী উইকেন্ড’এর বাংলা কী? টি টি ওয়াই বা টেক্সট টেলিফোন, যা প্রধানত বধিরদের জন্য তৈরী বা তাদের সুবিদার্থে ব্যবহৃত, তার বাংলা যে পাঠ্যফোন, তা কে জানত? মানে আমি অন্তত জানতাম না। বসের (boss) বাংলা কী? বস বা অফিসের অন্য লোক সামনে রয়েছে তাই বসের নাম নেওয়া যাচ্ছেনা, সে ক্ষেত্রে কী উপায়? আমি নিজে তাৎক্ষণিক ভাবে কিছু খুঁজে না পেয়ে বানান করে বলেছি “ব দন্ত্য স বলছে...”। আর অন্য বাঙ্গালী সহকর্মীদের বলতে শুনেছি “আমাদের দলের সর্দার...” (এমনকি মহিলা টিম লীডকে বোঝাতেও), “আমার মাথা (হেড) বলছে...”। আর তারপর এমন কিম্ভূতকিমাকার হাস্যকর ভাষান্তরে নিজেদের মধ্যেই হাসাহাসি চলতে থাকে। “বস” বোঝাতে কাজ চালাতে স্রেফ দিদিমনি আর বড়বাবুর মতো চলতি শব্দ ব্যবহার করা যায় হয়ত, কিন্তু কথা হল ইংরেজী কথাগুলো এমন ভাবে আমাদের প্রতিদিনকার ভাষায় ঢুকে গেছে যে চট করে বাংলা প্রতিশব্দ মাথায় আসেনা।

    কানাডার টরন্টো শহরে বাংলা ভাষার অনুবাদক বা দোভাষীর কাজ করতে গিয়ে বেশ কিছুবার আমায় এমন থমকে থমকে যেতে হয়েছে। আমার পড়াশোনা ও পেশাগত অভিজ্ঞতা ইংরেজী ভাষায়, কিন্তু তার পাশাপাশি উত্তর আমেরিকার এই দেশে বসবাস করতে এসে আমি কিভাবে বাংলা অনুবাদক/দোভাষী হয়ে গেলাম, তা ভেবে আমি নিজেই অবাক হয়ে যাই। আমি দক্ষিন কলকাতার যেই ইংরেজী মাধ্যম স্কুলে পড়াশোনা করেছি সেখানে আমি কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি হওয়ার সময় বাংলা দ্বিতীয় ভাষা হিসেবেও ছিল না। প্রথম ভাষা ইংরেজী, দ্বিতীয় ভাষা হিন্দি। বাবা মা’র প্রাথমিক অনিচ্ছা সত্বেও, আমার সদ্য জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়াতে চাকরিতে ঢুকে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেড়ানো হিন্দিতে অভ্যস্ত ভূবিজ্ঞানী ছোটমামার কথায় তাঁরা আমায় সেই স্কুলে ভর্তি করেন ও পাঠ্যক্রমে বাংলা ভাষা অন্তর্ভুক্ত করার জন্য আবেদন করেন। ফলস্বরূপ বাংলা চালু হয় ঠিকই, কিন্তু পরবর্তী শিক্ষাবর্ষ থেকে। আমার ভাগ্যে জুটল না। যাই হোক, ক্ষতি হয়নি তেমন, কারণ বাড়িতে গল্পের বই পড়ে আমি যা বাংলা শিখেছি দশ বছর স্কুলে পড়া সত্বেও হিন্দি তার অর্দ্ধেকও শিখিনি। এখনো আমার হিন্দি ব্যাকরণগত ভুলে ভরা। যাই হোক, শুধু মাত্র নিজের আগ্রহের কারণে পরবর্তীতে বাংলা সাহিত্য অনুবাদেরও কিছু অভিজ্ঞতা হয় ।

    টোরন্টোয় আমি যে ধরনের অনুবাদের কাজ করি তার সাথে সাহিত্যের বিশেষ সম্পর্ক নেই। এখানে এই পেশাটিকে বলে কম্যুনিটি ইন্টারপ্রেটিং অর্থাৎ সামাজিক পরিষেবা প্রদানের প্রেক্ষাপটে বা তার প্রয়োজনে অনুবাদ। আইনি পরামর্শ চাই কিন্তু আইনজীবির সাথে সারাক্ষন ধরে ইংরেজীতে কথাবার্তা চালানো কঠিন? বা ডাক্তারকে সঠিক ভাবে ইংরেজীতে বলতে পারছেন না যে ঠিক কী অসুবিধে হচ্ছে বা ডাক্তার ঝড়ের গতিতে ইংরেজীতে কী পরামর্শ দিচ্ছেন তার মাথামুন্ডু কিছু বুঝতে পারছেন না? বা কোর্টে সাক্ষ্য দিতে হবে কিন্তু ইংরেজীতে ঠিক করে গুছিয়ে বলতে পারবেন না? সরকারি খরচায় আপনার জন্য অনুবাদক হাজির। কানাডা আক্ষরিক অর্থে একটি বহুজাতিক, বহুভাষী দেশ। স্পেনীয়, চীনা, জাপানি, ইতালীয়, হিন্দি, পাঞ্জাবী , উর্দু, আরবী , ফার্সী এসব ভাষার মানুষ তো আছেনই, আজেরবাইজানি, আমহারিক, স্বাহিলি ভাষীও কম নেই। তাছাড়া আছেন আদি (অ-ইয়ুরোপীয়) কানাডিয়রা, যাদের ‘ফার্স্ট নেশনস’ বলে অভিহিত করা হয়। তাঁদের মধ্যেও বিভিন্ন ভাষা। কিন্তু সরকারী ভাষা যেহেতু ইংরেজী ও ফরাসী আর সরকার যেহেতু চান না যে কেউ শুধু মাত্র ইংরেজী ভাষার ওপর দখল না থাকার কারণে সরকারী সুযোগ সুবিধে বা পরিষেবা থেকে বঞ্চিত হোক, তাই তাঁরা নিজের পকেটের পয়সা খরচ করে অনুবাদের ব্যবস্থা করে দেন, লিখিত ও কথ্য—যার যখন যেমন দরকার। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জরুরী পরিষেবা, আইনি সাহায্য, অভিবাসন সংক্রান্ত সাহায্য, মানবিক অধিকার ও তার নিরাপত্তা সংক্রান্ত সেবা, যুদ্ধ বিধ্বস্ত বা জাতিবিদ্বেষের বা লিঙ্গবিদ্বেষের কারণে ভূমিচ্যুত হওয়া ট্রমা বা মানসিক আঘাত প্রাপ্তদের জন্য ও মানসিক অসুস্থতা সংক্রান্ত পরিষেবায় এই সুবিধেটি পাওয়া যায়।

    লিখিত অনুবাদে তেমন সমস্যা হয় না, কারণ সময় নিজের হাতে। তাই কোনও ইংরেজী শব্দের প্রতিশব্দ না জানলে প্রয়োজন মতো একটু আন্তর্জাল ঘেঁটে, একটু অভিধান ঘেঁটে, একটু গুগল বুকস থেকে বিষয়ের ওপর বই সংগ্রহ করে পড়ে দেখে, এই সমস্যার বিহিত করা যায় এবং সরকারী চিঠি, বিজ্ঞপ্তি, নথি বা প্রচারপত্রের মোটামুটি গ্রহনযোগ্য অনুবাদ করে ফেলা যায়। যদিও আমার অভিজ্ঞতা বলে ইন্টারনেটে সাহিত্য নয় এমন জিনিষ-----যেমন বিভিন্ন বীমা বা ভাতা সংক্রান্ত বিবরণপত্র বা ফর্ম, আয়কর সংক্রান্ত বা বানিজ্যিক চুক্তি----এসব বাংলা ভাষায় বিশেষ পাওয়া যায়না। বেশ কষ্ট করে খুঁজে বার করতে হয় অনুবাদ শাস্ত্রে যাকে বলে ‘প্যারালাল টেক্সট’ । সূত্রের বিশ্বাসযোগ্যতাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

    মনে আছে, টোরন্টোয় এসে অনুবাদকের কাজের জন্য প্রথম যখন পেশাগত প্রশিক্ষণ নিতে যখন শুরু করি, তখন পাঠ্যক্রমের অংশ হিসেবে ভাষান্তর অভ্যাস করার জন্য বাংলা এবং ইংরেজী দুই ভাষাতেই বিভিন্ন ধরণের লিখিত পাঠ্যবস্তু খুঁজে সেগুলি অনুবাদ করতে হত। যেমন স্কুলে বাচ্চাকে নথিভুক্ত করার ফর্ম, বিভিন্ন অনুমতিপত্র, বা হাসপাতাল থেকে দেওয়া সদ্যজাত বা নতুন প্রসূতির যত্ন নিয়ে তথ্য-পুস্তিকা, কানাডায় নতুন অভিবাসীদের জন্য সরকার কী কী সুযোগ সুবিধে দেন—এই সমস্ত বিষয়ের ওপর বিজ্ঞপ্তি বা পুস্তিকা অনুবাদ—এগুলি তাও মোটের ওপর সহজ ব্যাপার। কিন্তু ইংরেজীতে অনুবাদ অভ্যাসের জন্য বাংলায় আইনি বা আর্থিক পরিষেবার জন্য ফর্ম বা চিঠির উদাহরণ বা বলিষ্ঠ কোনো প্রতিচিত্র খুঁজে পেতে আমায় বেশ কষ্ট করতে হয়েছিল, মনে আছে। বাংলায় লেখা আপোসনামা বা বাংলায় ব্যাঙ্ক স্টেটমেন্ট খুঁজতে প্রায় দেওয়ালে মাথা ঠোকার উপক্রম হয়েছিল। পরিচিতদের মধ্যে কেউ এসবের সন্ধান দিতে পারবে কিনা খোঁজ করতে গিয়ে তাদের ঠাট্টার পাত্র হয়ে গিয়েছিলাম শেষে। বাংলায় লেখা ফর্ম বাস্তবে নিশ্চই আছে, কিন্তু আন্তর্জালে তেমন নেই। একটু ইতস্তত করে ফেসবুকে বন্ধুদের অনুরোধও করেছিলাম কারোর কাছে যদি কিছু থাকে, ছবি তুলে যদি আমায় পাঠায়। পেলাম শুধু ক’টা ‘হা হা’ রিয়াক্ট। শেষে বাংলাদেশ সরকারের তথ্য বাতায়ন ঘেঁটে, তাদের এই পাতা ওই পাতা তস্য পাতা ঘেঁটে অল্প কটা বাংলায় রচিত আইনি সাহায্য সম্পর্কিত কাগজপত্র জোগাড় করতে পেরেছিলাম। পরবর্তীতে বেশ অনেক বারই ত্রাতা মধূসুদনের হয়ে আমায় উদ্ধার করেছে বাংলাদেশ সরকারের ওয়েবসাইট এবং বাংলাপিডিয়া, বিশেষত পারিভাষিক শব্দাবলীর ব্যাপারে।

    যাই হোক, কথা হল লেখা তবু সামলে নেওয়া যায় । কিন্তু অপ্রস্তুত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে কথ্য অনুবাদের ক্ষেত্রে কারণ সেই ক্ষেত্রে গবেষনা বা নিদেনপক্ষে ‘ভেবে নেওয়ার’ সময়টুকুও থাকে না। কথোপকথনের তাতক্ষনিক অনুবাদে যা বলার তা তখনই বলতে হবে আর মুখ থেকে একবার যা বেরিয়ে যাবে তা আর ফেরত নেওয়ার উপায় নেই। তাই প্রথম যেদিন ‘হ্যাভ আ নাইস উইকএন্ডের’ এর বাংলা বলতে হয়েছিল, অনভ্যস্ত আমি ঘাবড়ে গিয়ে আমতা আমতা করে বলেছিলাম ‘আগামী দিনগুলি ভালো কাটুক’। ভেবেছিলাম সঠিক অনুবাদ না হলেও বার্তাটা মোটামুটি ব্যক্ত করতে পেরেছি---অন্তত তখনকার মত পরিস্থিতি সামলানো গেছে। বলার পরই মনে হয়েছিল ‘সপ্তাহ-শেষের বা সপ্তাহান্তের ছুটি ভালো কাটুক’ বললে আরেকটু যুৎসই হত। কিন্তু ততক্ষনে কথা অন্য দিকে ঘুরে গেছে।

    বেশী শুদ্ধ বাংলায় বলারও বিপদ আছে। অনুবাদ হতে হবে সাধারণের বোধগম্য, প্রচলিত ভাষায়। একবার এক ডাক্তার এক প্রায় সত্তর বছরের মহিলাকে বলছেন ‘ইয়ু নীড আ নেকরেস্ট’। আমার তো নেকরেস্টের কোনও চলতি বাংলায় প্রতিশব্দ তখন কিছুতেই মনে আসছে না। আমি বললাম, ‘আপনার গ্রীবাবলম্বনের প্রয়োজন’। মহিলা (ও পার বাংলার) ভুরু কুঁচকে বললেন ‘কী কইতাসেন? বুজতাসি না’। এদিকে আমার নিজের কোনও বক্তব্য বা মন্তব্য করা মানা; আমার শুধু মাত্র দুই পক্ষ একে অপরকে যা বলেছেন সেটুকুই অনুবাদ করার অনুমতি আছে, বাড়তি নিজস্ব একটি শব্দও না। তাই আমি আবার ডাক্তার কে ‘কী কইতাসেন? বুজতাসি না’ ই অনুবাদ করে বললাম। ডাক্তার এবার ইশারার ভাষায় নেমে এলেন। হাতের ইশারা করে বোঝাতে বোঝাতে বললেন ‘নেকরেস্ট ইউ নো, নেকরেস্ট। আ সাপোর্ট ফর ইয়োর নেক’। আমিও এবার গ্রীবাবলম্বন থেকে সোজা ‘ঘাড় ঠেস দেওয়ার জিনিষ’ এ নেমে গেছি। বোঝাতে পারলেই হল। মিশন সাকসেসফুল।

    প্রায়ই আমায় ওপার বাংলার বাঙ্গালীদের জন্য অনুবাদ করতে হয়। তখন বুঝি শব্দ ব্যবহারে তফাত। যেমন, আমরা এপারে যাকে ‘বর’ বা ‘স্বামী’ বলি (হাজব্যান্ড), তাকে ওপারে বলে ‘জামাই’। এই ব্যাপারটা আমি প্রথম জানতে/বুঝতে পারি একটা পুলিশ কেসে—একটি বধূ নিগ্রহ কেসে সাক্ষীর জবানবন্দী চলাকালীন। এক মুহুর্তের জন্য ঠিক মেলাতে না পারলেও, আন্দাজ করে ফেলেছিলাম নিগৃহিতের ভাষ্যে ‘জামাই’ বলতে কাকে বোঝানো হচ্ছে।

    পুলিশের কাছে বা কোর্টে অনুবাদ করা বেশ আলাদা রকমের কারণ পুরো কথপোকথনই রেকর্ড করা হয় এবং অনুবাদকের ওপর নির্দেশ থাকে যে যথাযথ অনুবাদ তো করতেই হবে কিন্তু সাথে এটাও মাথায় রাখতে হবে যে নিজের থেকে কোনও বাড়তি কথা যোগ করা যাবে না, আর অনুবাদে মূল বক্তব্যের টোন বা চরিত্র বজায় রাখতে হবে। অর্থাৎ কেউ নোংরা কথা বললে বা রাস্তার ভাষায় গালি দিলে সেই ভাষাই অনুবাদ করতে হবে, কথা পাল্টে দেওয়া যাবে না, ভাষা পরিষ্কার করা যাবে না। এই নিয়েও আমি দুশ্চিন্তায় পড়েছি বেশ কিছুবার। যেমন প্রথম যেবার ‘তোর চোদ্দগুষ্টির শ্রাদ্ধ করে রেখে দেব’র অনুবাদ করতে হল পুলিসের সামনে। কয়েক সেকন্ড থতমত আমি। কী বললে যথাযথ অনুবাদ হবে? আর একবার, ক্লায়েন্ট বাংলাদেশের বাঙ্গালী। উকিল প্রশ্ন করছেন বিচারকের সামনে, আমি দুপক্ষের সাওয়াল জবাব বাংলা ও ইংরেজীতে যথারীতি অনুবাদ করে যাচ্ছি। হটাত সাক্ষী বললেন ‘সে বলল “তোর আমি *** মেরে ছাড়ব”। আমি বুঝতে পারছি যে কথাটা অপমানজনক, বুঝতে পারছি যৌনাংগ সম্পর্কিত বা যৌন ক্রিয়া সম্পর্কিত কোনও গালি কিন্তু শব্দটার সাথে পরিচিত না হওয়ায় ঠিক বুঝতে পারছিলাম না অনুবাদে কোন স্তরের শব্দ হলে বক্তার টোনের সঠিক আঁচ পাওয়া যাবে। এদিকে সময় তো চলে যাচ্ছে। উকিল বিচারক সহ সারা কোর্ট আমার অনুবাদের অপেক্ষায়। আমি আন্দাজমত অনুবাদ করে তো দিলাম কিন্তু তারপর আমার বুকের ভিতরের ধড়াস ধড়াস আর বন্ধ হয়না। পুরো রেকর্ডেড। যদি আমায় পরে ধরে বলে তুমি ঠিক শব্দটা বলতে পারোনি তাই মামলার ক্ষতি হল? পরে গালি বিশারদ বন্ধুদের জিজ্ঞেস করে জেনেছিলাম আমি ইংরেজীতে যা বলেছি বাংলা কথাটার নিহিতার্থ তার থেকে অনেক বেশী উগ্র । সুতরাং ভাষা সম্পূর্ন ভাবে ব্যবহার করতে হলে গালাগালাজের জ্ঞান ও থাকা প্রয়োজন বৈকি!

    ইংরেজী ও ফরাসী কানাডায় সরকারী ভাষা ও কর্মক্ষেত্রের ভাষা। সামাজিক ও আর্থিক ভাবে সুষ্ঠ ভাবে থাকতে গেলে এই দুটির মধ্যে একটি অন্তত জানতে হবে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা অভিবাসী বা শরণার্থীদের সরকার ইংরেজী শেখার জন্য বেশ কিছু সুযোগ সুবিধে দেন, প্রায় সবটাই নিখরচায়। কিন্তু ইংরেজী শিখতে উৎসাহী করার সাথে সাথে কিন্তু নিজের ভাষা টিকিয়ে রাখার পরামর্শ ও উৎসাহও ঠিক ততটাই দেন, বিশেষত শিশুদের মধ্যে, যারা এখানে জন্মেছে বা এখানে বড় হচ্ছে। যেমন, স্কুলে চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন ভাষাশিক্ষার ব্যবস্থা (যার মধ্যে বাংলাও আছে), গণ-গ্রন্থাগারে পর্যাপ্ত ভিন্ন ভাষার বই রাখা, অনুবাদের ব্যবস্থা করা ইত্যাদি।

    এখানে স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগে, আর পরবর্তীতেও, অভিভাবককে বলা হয় ইংরেজী শেখানো নিয়ে না ভাবতে; সেটা স্কুলের দায়িত্ব। বরং পরামর্শ দেওয়া হয় বাড়িতে নিজেদের ভাষায় কথা বলতে, এবং সেটা ভাঙ্গা ভাঙ্গা ভাবে বা অন্য ভাষার সাথে মিশিয়ে খিচুড়ি কায়দায় নয়, পরিপূর্ণ ভাবে, যথাযথ ভাবে বলতে। এ ব্যাপারে আমার মেয়ের কিন্ডারগার্টেনের টিচারের কথাটি আমার এখনও কানে বাজে—“এক্সপোজ হার টু অল দ্য রিচনেস অফ ইয়োর ল্যাঙ্গুএজ।“ সত্যিই, নিজের ভাষায় সমৃদ্ধ হলে অন্য ভাষা আয়ত্ত করাও সহজ হয়।

    আজকাল আমরা ‘বাংলা ভাষা উপেক্ষিত, বাংলা ভাষা বিপন্ন’ রব তুলে যেই হাহাকার করছি তার অনেকটা জুড়েই রয়েছে বিদ্রূপ ও দোষারোপমনস্কতা। অভিভাবকের দোষ, স্কুলের দোষ, সিস্টেমের দোষ, এর দোষ, তার দোষ। সেই তুলনায় এই ব্যাপারে ইতিবাচক কী করণীয় আছে সে সম্পর্কে বিশেষ আলোচনা দেখিনা। বিশেষজ্ঞরা আমার চেয়ে ঢের ভালো বলতে পারবেন, তবে আমার ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতা বলে ভাষার প্রতি ভালোবাসা গড়ে উঠলে সেই ভাষা চর্চা করার আগ্রহও নিজে থেকেই গড়ে উঠবে। আর এই ভালোবাসা গড়ে ওঠানোর জন্য অন্য ভাষার প্রতি বিরূপ মনোভাবাপন্ন হওয়ার প্রয়োজন হয় না, অন্য ভাষাকে উপেক্ষা বা অপমান করার প্রয়োজন হয় না। আমি তাই আমার দুই মেয়েকে সুকুমার রায় আর ডক্টর স্যুস দুটোই পড়ে শোনাই, যাতে দু ভাবেই ছড়ার মজা উপভোগ করা যেতে পারে; দাদাঠাকুরের রচনা আর রোয়াল্ড ডাল—দুটোই পালা পালা করে পড়ি আমরা। চলে ফেলুদা আর হ্যারী পটার, টিনটিন আর নন্টে ফন্টে, রূপকথার মধ্যে ফ্রোজেন আর নীলকমল লালকমল, একটা শেষ হলে অন্যটা। আর চলে গাড়িতে যেতে যেতে বা রাতের খাবার খেতে খেতে ছোটখাটো সহজ কিছু শব্দ নিয়ে খেলা, দুই ভাষাতেই।

    সাহিত্য তো আছেই, কিন্তু আমরা যারা সাধারণ অ-সাহিত্যিক মানুষজন, যাদের ভাষার ওপর হয়ত বিশেষ দখল নেই, তাদের দৈনন্দিন জীবনযাপনেও মাতৃভাষা পরিপূর্ণ ভাবে স্থান পাক, সেটাই কাম্য। আগামী প্রজন্মকে আমরা কী শেখাচ্ছি তা তো অন্তত কিছুটা আমাদের হাতে। শুধু দোষারোপে আটকে না থেকে আমরা নিজেরা কী করতে পারি সেই নিয়ে আলোচনা হোক। প্রতিবেশীকে ‘আন্টি’ না বলে মাসি/কাকি বললে সন্তানের সপ্রিভতা কমে যাবে না বা তার ইংরেজী শেখা বা বলাতেও বাধা আসবে না সেটুকে বুঝতে পারা, বা ‘আজকাল তো বাচ্চারা বই পড়তে চায়না’ বলে হাল ছেড়ে দেওয়ার থেকে নিজে বইটা নিয়ে পড়ে শোনানো — হতেই পারে প্রাথমিক পদক্ষেপ।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খেলতে খেলতে প্রতিক্রিয়া দিন