তমসা অরণ্যকে ভাবতে নিলে ক্যান্সার হাসপাতালের দোতলায় একটা দুপুর মনে পড়ে যায়। সারে সারে পর্দার আড়ালে শুয়ে আছে চেয়ার পাশাপাশি, কাছাকাছি। কেউ কাউকে দেখছি না অথচ টের পাচ্ছি পানির বোতল খুললো কেউ, একজন ফোনে নাতীর জুতোর মাপ জানাচ্ছে, খুুক করে কাশি, আল্লাহ বলে পাশ ফিরলো কেউ, একজন বানান করছে C cat, B boy, D David, W water, J joy 804-333, বাঁধের মতোন খুলে গেল চিপসের একটা প্যাকেট, নাক ডাকছে কেউ যেন একটা খেঁকশিয়াল দরজা খুলে হুক্কাহুয়া ডেকে দুম করে আবার বন্ধ করে দিল দরজা। আমার পাশের চেয়ারে এক বৃদ্ধা এসেই জানালার পর্দা সরিয়ে খবর ছড়িয়ে দিলেন- what a pretty sky! তখন টিভির মুখোমুখি চেয়ার বেছে নেয়াকে তুমুল বোকামি বলে মনে হয়। আমাকে আকাশ দেখার তৃষ্ণা দিয়ে বৃদ্ধা তখন নার্সকে বলছেন, 'একদিন এখানে না আসাটা ভীষণ মিস করবো। এর কারণ হয়তো এই সময়টা একান্তই আমার সময়, কাউকে বিনোদন দেয়ার কোন দায় নেই।' আমাদের মধ্যকার পর্দায় ছায়া ফুটে উঠে, ওঁর জানালার রোদ কুকুর ছানা হয়ে আমার পায়ের কাছে ভিড়ে। আকাশ দেখা বৃদ্ধাকে ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করে যেমন ওঁ আকাশ দেখে। অথচ চোখ পর্দায় ধাক্কা খেতে খেতে কেবল ফিরে আসে না পাওয়া নিয়ে। তমসা অরণ্য যেন সেই পর্দার পাশের মানুষ- যার সাথে কখনো দেখা হয় না, কখনো জানা হয় না কোথায় থাকে ও, কি তার সমাজের দেয়া নাম।
তমসার প্রোফাইলের ছবিটা বড়ো অদ্ভুত- ব্লেড দিয়ে কেউ তার নিজের একটা চোখ কেটে নিচ্ছে। তমসা ছবির নাম দিয়েছে দৃষ্টিফুল। সূচ, ঝাড়ুর শলা, ব্লেড এগুলো দেখলে আমার অন্য রকম প্রতিক্রিয়া হয়, সেই ছোটবেলা থেকেই। ধরুন সূচ দেখলে মনে হয় একটা সূচ বারো হাজার সূচ হয়ে আমার চোখে ঢুকে পড়ছে। ছুরি দিয়ে কাজ করতে গেলে মনে হয় এই বুঝি হুট করে আমার গলায় বসে যাবে কিংবা ভাবতে বসি কেমন হবে অপুর গলায় বসিয়ে দিলে। সূচ, ব্লেড, ছুরি ওগুলোতে আমার ভীষণ অস্বস্তি, যন্ত্রণা। অথচ আমারই দু'বছরের মেয়ে কী অনায়াসে গরুর মাথা কেটে মগজ বের করা দেখে! সেদিন ল্যাবে ওর রক্ত নিল, বেরুনোর পর এক রোগী বললেন 'আশ্চর্য মেয়ে তো আপনার, এতটুকু কান্নার শব্দ পেলাম না।' মেয়ে বড়ো হয়ে নার্স হতে চায়- ছুরি, সুই তাই ওর মেয়েবেলার সখী। আর আমি সখীহারা হয়ে ঘুরে বেড়াই নিজের ভূগোলে।
তমসাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে যেমন ও আকাশ দেখে। কে সে- নারী? কেমন নারী? ভীষণ সুখী, খামখেয়ালী? অথচ তার সাথে কখনো আমার কথা হয় না। আমি কখনো কারো বন্ধু হতে পারি না। ফাহমিদা বারী, আমাদের ক্লাসের সবথেকে মেধাবী ছিল, ও বলতো, 'তুমি বড়জোড় ফ্রেন্ডলি হতে পারো, ফ্রেণ্ড হতে পারো না।' এখানে এসে আমি যেন আরও একা হয়ে গেছি। আমার কাছে ভার্সিটি মানে লাইব্রেরীর এগারো তলার একটা ঘরে টেবিল উপচে পড়া বই, জানালা থেকে দেখা দূরে বন্ধুরা কী করে ফুটে- ঘাসে, দেয়ালে, শেষ বিকেলে...
এবারও রুবানা আপা, অর্ঘ্যদা গেট টুগেদারের আয়োজন নিয়ে জমজমাট পরিকল্পনা করছেন, আমাদের উৎসাহ দিচ্ছেন। ডাক্তার তো বলেন এ সময়টায় হতাশা পেয়ে বসতে পারে, তাই সম্ভব হলে বন্ধুদের সাথে হৈচৈ করে কাটাতে, আনন্দ করতে। আজকাল নিজেকে ভীষণ একলা লাগে। এগারো তলার ছোট্ট জানালায় দাঁড়ালে যেমন নিজেকে একলা মনে হয়। আত্মীয় স্বজনের করুণাক্রান্ত চোখ থেকে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে- দূরে কোথাও, ভিড়ে কোথাও। গ্রুপের আড্ডায় যেতে পারলে বেশ হয়। আচ্ছা, তমসাও কি আসবে এবার? অর্ঘ্যদার সাথে ওর তো ভীষণ ভাব, দেখা করতে নিশ্চয়ই আসবে। সেদিন দোকানে একটা সূচের বাকসো দেখলাম। কী যে সুন্দর সব সূচ যেন বান্ধবী! তমসার জন্য কিনে ফেললাম, যদি যাই, যদি দেখা হয়।
অবশ্য তমসার সাথে আমার রোজ দেখা হয় পর্দার ভাঁজে, ঘরের আনাচে কানাচে যেখানে চোখ যেতে পারে না কখনোই, আমার গোপন অন্ধকারে। আমি দেখি ও কখনো নিজের চোখ কাটতে বসেছে, কখনো পায়ের তলায় সুই-সুতো দিয়ে সেলাই করছে, কখনো আমরা মজার খেলা খেলি- ফুলেল ভাতে উপুড় করে সূচ ঢেলে দেই, এবার সূচ খুঁজতে হবে তবে ভাত খাওয়া থামানো যাবে না। একবার দু'বার মুখে সূচ ঢুকে গেলে তমসা হাসি থামাতেই পারে না। তমসার হাসি ঝকঝকে রোদের মতোন, ছড়িয়ে যায়।
তমসাকে ভীষণ খুব দেখতে ইচ্ছে হয় যেভাবে ও আকাশ দেখে। আচ্ছা, সূচগুলো পেলে কি করবে তমসা? ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টির মতো ঝড়িয়ে যাবে সেলাই ফোঁড়াই? না, ও অন্য কিছু করুক। অন্য কিছু যা আমি এখনও খুঁজে বের করতে পারি নি।