মীর মশাররফ হোসেন(জন্ম-১৮৪৭র ১৩ই নভেম্বর অবিভক্ত নদিয়া জেলার কুমারখালির লাহিনিপাড়ায় মাতুলালয়ে।এটি এখন বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলাতে।উইকিপিডিয়াতে এ সম্পর্কে ভুল তথ্য দেওয়া আছে।সেখানে অবিভক্ত ফরিদপুরের পাংশা তাঁর জন্মস্থান বলে উল্লেখ করা আছে।এটি সম্পূর্ণ ভুল। মৃত্যু-১৯১২ র ১৯ শে ডিসেম্বর অবিভক্ত ফরিদপুর জেলার রাজবাড়ির বালিয়াকান্দি থানার পদমাদি গ্রামে,উনিশ শতকের বাংলা সাহিত্যের এক সব্যসাচী লেখকের।বিশেষ করে এই কালপর্বে বাঙালি মুসলমানের সাহিত্যপিপাসার উন্মোচনে তাঁকে আদি পুরুষ হিশেবে চিহ্নিত করা যায়।
মীর মশাররফ যেন বাঙালি মুসলমানের সুপ্তি ভাঙালেন। আধো ঘুম, আধো জাগরণে থাকা বাঙালি মুসলমান সমাজ যেন একটা আলসেমি কাটিয়ে জেগে উঠলো তাঁকে প্রধান সাংস্কৃতিক মুখপাত্র হিশেবে পেয়ে।বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উন্মষ লগ্নের সাংস্কৃতিক ভাবনার জনক হিশেবে মীরকে চিহ্নিত করা যায়। উনিশ শতক জুড়ে বাঙালি র ঘরে ঘরে মীর হয়ে উঠেছিলেন একান্ত কাছের মানুষ।তাঁর জীবন ও সাহিত্য ধর্মের বেড়াজাল অতিক্রম করে আপামর বাঙালি সমাজের কাছে বিশেষ রকমের আদরের বিষয় হয়ে উঠেছিল।বিশ শতকের সিংহ ভাগ জুড়ে জনপ্রিয়তার শিখরে থাকা মীর মশাররফ হোসেন এই একুশ শতকের মধ্য ভাগেও সমান জনপ্রিয়।বাঙালির মনের এবং ঘরের খবর সকলের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য।
উনিশ শতকীয় বাঙালির গ্রামীণ জীবনের অর্থনৈতিক , মানসিক, সামাজিক দৈন্যের কথা মীর যেভাবে ফুটিয়েছেন তার সঙ্গে তুলনা চলে তাঁর ই জন্মভূমি কুমারখালির আর এক সুসন্তান কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের।মীর গ্রামীণ বাঙালির নানাবিধ দৈন্যে আবদ্ধ থাকেন নি।সেই দৈন্য থেকে উত্তরণের পথের সন্ধান করেছেন। এই সন্ধানের ভিতরেই জাগ্রত রয়েছে তাঁর জীবন ও কর্মের মৌলিকত্ব।মানসিক দারিদ্রের মূলে যে থাকে সাংস্কৃতিক দারিদ্র--সেটা নিজের জীবনে অভিজ্ঞতা থেকে খুব ভালো ভাবে উপলব্ধি করেছিলেন মীর। অর্থনৈতিক দারিদ্র মোচনের ভাবনা একজন সাহিত্যশিল্পীর থাকবেই।সেটা না থাকা টাই আশ্চর্যের বিষয়।বলাবাহুল্য মীরের ভাবনা তে অর্থনৈতিক দারিদ্র মুক্তির ভাবনা প্রথম থেকেই খুব সচেতন ভাবেই ছিল।
অর্থনৈতিক দারিদ্র মোচনের ভাবনা থাকলেও সেটির প্রয়োগ ঘটানো একজন সাহিত্যশিল্পীর পক্ষে খুব একটা মুখের কথা নয়।মীর কিন্তু উপলব্ধি করেছিলেন যে, গ্রামীণ বাংলার সাংস্কৃতিক দারিদ্রমোচন না করতে পারলে অর্থনৈতিক দারিদ্রমোচনের পথটিকে কিছুতেই উন্মুক্ত করতে পারা যাবে না।সেই ভাবনাকে সামনে রেখেই মীর তাঁর জীবন তরণী বইয়ে ছিলেন,সাহিত্যকর্ম কে পরিচালিত করেছিলেন।গ্রামীণ পটভূমিতে সাহিত্যচর্চা করে বাঙালির মানসিক দারিদ্রমোচনের লক্ষে সাংস্কৃতিক দারিদ্রকে সবথেকে বড়ো সমস্যা হিশেবে দেখে, সেটির নিরসনে জীবনপাত করা--মীর মশাররফের আগে আর কাউকে দেখতে পাওয়া যায় নি।
রামমোহন, বঙ্কিম,বিদ্যাসাগরের ভাবনার সিংহভাগ জুড়ে ছিল শহুরে মধ্যবিত্তরা।আর ও সুনির্দিষ্ট করে বলতে গেলে সেইসব মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্তের মানুষজনেরা, যাঁরা জন্মসূত্রে ছিলেন হিন্দু।এই বিরাট হিন্দু জনগোষ্ঠীর বাইরে গ্রাম বাংলাতে যে ব্যাপক বাঙালি মুসলমান জনগোষ্ঠীর মানুষ রয়েছেন , তাঁরা ওইসব মণীষীদের ভাবনা এলেও ভাবনার সিংহভাগ অধিকার করতে পারে নি। ব্যাতিক্রম অবশ্য ই রবীন্দ্রনাথ।সম্রাট আকবরের উদারতার কথা বলতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ সেই ১৮৮৫ সালেই বলেছিলেন,"....যে কার্য একদল পর্তুগালবাসীর পক্ষেই নিন্দনীয় সে কার্য একজন সম্রাটের পক্ষে অত্যন্ত গর্হিত সন্দেহ নাই।কোনো ধর্মের প্রতি ঘৃণা প্রদর্শন করিলে ঈশ্বরের প্রতি ঘৃণা প্রদর্শন করা হয়।" এমন অকপট কথা উনিশ শতকে বড়ো একটা শোনা যায় নি।
তবু মূলত শহর কেন্দ্রিকতার কারণে ভূমিস্তরের মানুষদের, বিশেষ করে মুসলমান জনগোষ্ঠীর মানুষদের জীবনের দৈনন্দিনতার সঙ্গে সব সময়ে সংযোগ রাখা রবীন্দ্রনাথের পক্ষে সম্ভবপর হতো না।এই জাগা থেকে উনিশ শতকের শেষ লগ্নে এবং বিশ শতকের গোড়ার দিকে গ্রাম বাংলার নাড়ীর সঙ্গে সংযোগ রেখে গ্রামীণ বাংলা ও বাঙালির সাংস্কৃতিক দারিদ্রমোচনে মীর মশাররফ হোসের অবদান বিশেষ ভাবে উল্লেখের দাবি রাখে।কেবল সাংস্কৃতিক দারিদ্রের সুলুক সন্ধান করেই মীর থেমে থাকেন নি।সেই দারিদ্র থেকে উত্তরণের ভাবনায় বাঙালিকে ভাবানো ও মীরের একটি বড়ো রকমের ঐতিহাসিক ভূমিকা।দারিদ্রের সব রকমের কড়াল গ্রাস থেকে বের হতে গেলে প্রথমেই প্রয়োজন মানসিক দৈন্যের আগল কে ভেঙে ফেলা।মীরের ক্ষুরধার লেখনী প্রথম থেকেই সেই দিকে তীক্ষ্ণ নজর রেখেছিল।সামগ্রিক ভাবে তাই মীর কে এক আলোর সন্ধানী যুগপুরুষ হিশেবে অভিহিত করা যায়।
উনিশ শতকের গ্রামীণ পটভূমিতে নিজে অবস্থান করেছেন মীর।তাঁর চর্চার উপজীব্য ও ছিলেন গ্রাম বাংলার মানুষ।সেই অবস্থানে থেকে সমাজমনষ্কতার পাশাপাশি ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার এক অপূর্ব নিদর্শন তিনি রেখে গেছেন তাঁর জীবন ও কর্মের ভিতর দিয়ে।বিষয় বৈচিত্রকে ধর্মনিরপেক্ষতার কষ্টিপাথরে মেজে ঘসে সেই সময়ে মীর যে ভাবে উপস্থাপিত করেছিলেন তা আমরা আজ একুশ শতকের প্রক্ষিতে দেখেও বিস্মিত হয়ে যাই।অসাম্প্রদায়িক চেতনা সম্পর্কে মীর তাঁর সৃষ্টির ভিতরে যে অনন্য সাধারণ নজির রেখে গিয়েছেন তা প্রবাহমান বাংলার এক চিরকালীন সম্পদ। এই বৈদগ্ধ্যপূর্ণ সামাজিক -সাংস্কৃতিক অবদান মীর মশাররফ হোসেনকে অনন্যতা দিয়েছে।একটা বিশেষ মর্যাদাতে উপনীত করেছে।মুসলিম মানসের সঙ্গে বাংলার শিল্প-সংস্কৃতির মূলধারার প্রধান সংযোগকারী হিশেবে মীর আমাদের ইতিহাসে চিরস্মরণীয়।
মীরের শৈল্পিক জীবনের মূল বিস্তার ছিল ১৮৬৫ সাল থেকে ১৯১০ সালের মধ্যবর্তী সময়কাল। অঙ্কের হিশেবে ৪৫ বছর ছিল এই ব্যাপ্তিকাল। এই সময়কালে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য প্রায় পঁচিশটি বই মীর লিখেছিলেন।তার বাইরেও মীরের কিছু লেখা থেকে গিয়েছে।কিছু লেখা বেশ কিছুকাল ছাপার মুখ দেখে নি।বিষাদসিন্ধু, জমিদার দর্পণ, গাজিমিঞার বস্তানি র মতো ই সেইসব লেখাগুলোর মূল্য ও অন্যকিছুর থেকে কোনো অংশে কম নয়। অমন একজন সব্যসাচী লেখকের দিনলিপির সন্ধান আমরা সম্প্রতি পেয়েছি কিংবদন্তীতুল্য লোকসংস্কৃতি বিশারদ অধ্যাপক আবুল আহসান চৌধুরীর মাধ্যমে।সেই দিনলিপি টিও ছাপার মুখ দেখেছে বাংলাদেশের প্রথিতযশা প্রকাশনা সংস্থা পাঠক সমাবেশের হাত ধরে।বাংলার সামাজিক ইতিহাসের একটি আকরগ্রন্থ হিশেবে এটি মর্যাদার দাবি রাখে।এপার বাংলায় এতোকাল মীরচর্চা তেমন কিছু ছিল না বললেই চলে।সম্প্রতি অধ্যাপক চৌধুরীর ই সম্পাদনায় মীর সম্পাদিত "হিতকরী" পত্রিকা টি আমাদের হাতে তুলে দিয়ে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ একটি ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছেন।
মীর ছিলেন এক ক্ষয়িষ্ণু বাঙালি জমিদার পরিবারের সন্তান।সেই কারনেই জীবিকার প্রয়োজনে তাঁকে নানা জায়গাতে ছুটে বেড়াতে হয়েছিল।দেলদুয়াল জমিদারী এস্টেটে তাঁকে চাকরি নিতে হয়েছিল।সেখানকার বড়ো তরফের শরিক ছিলেন জৈবুন্নেসা।ব্যক্তি জীবনে যিনি ছিলেন বেগম রোকেয়ার বড়ো বোন।তাঁর পুত্রদ্বয় ইতিহাসখ্যাত গজনভী ভাইয়েরা।বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে এঁদের ভূমিকা ছিল ঐতিহাসিক।"বিষাদসিন্ধু"গ্রন্থটি মীর "মাতঃ" সম্বোধনে উৎসর্গ করেছিলেন করিমুন্নেসা কে।মীর প্রথম জীবনে করিমুন্নেসা ও তাঁর পরিবারের কাছ থেকে যথেষ্ট সহযোগিতা পেয়েছিলেন।যদিও করিমুন্নেসার বড়ো ছেলে স্যার আবদুল করিম গজনভীর সঙ্গে নানা কারনে মীরের সম্পর্ক টা খারাপ হয়েছিল।ফলে মীরের সাময়িক কর্মচ্রুতি ও ঘটে।দেলদোয়ারের ই অপর শরিক রাহাতান্ নেসা ও নজমন্ নসার সেরেস্তাতে মীর কিছুদিন কাজ করেছিলেন। এই সময়কালে লেখালেখির জগতে কিছুটা প্রতিহিংসার শিকার হতে হয়েছিল মীরকে।যার জের তাঁর পেশাগত জীবনেও পড়েছিল।
"আহমদী" পত্রিকার সম্পাদক আবদুল হামিদ খান ইউসুফজয়ী ছিলেন মীরের একজন প্রতিদ্বন্দ্বী।দেলদুয়ারের সঙ্গে মীরের ভুল বোঝাবুঝির পিছনে ইউসুফজয়ীর একটা বড়ো রকমের ভূমিকা ছিল। এই বিষয়টি নিয়ে সেই সময়ে ঢাকা থেকে প্রকাশিত "ঢাকা প্রকাশ" পত্রিকাতেও কিছু লেখালিখি হয়েছিল ১৩০০ বঙ্গাব্দের ৭ ই ফাল্গুন সংখ্যায়।মীর নিজে তাঁর "গাজী মিঞার বস্তানি " তে ব্যঙ্গের ছলে এই পর্বের নানা কাহিনী লিখে গিয়েছেন।সে যুগেও নিছক ঈর্ষার শিকার হয়ে মীরের মতো মানুষকে কতোখানি সমাজিক হেনস্তার বশবর্তী হতে হয়েছিল তা ভাবলে দুঃখ হয়।
ছোট লেখা কিন্তু ভালো লেখা। প্রসঙ্গত বাঙালি বিষাদসিন্ধু নিয়ে উলুতপুলুত হলেও জমিদার দর্পণ নিয়ে তদানীন্তনকালে যথেষ্ট বিরোধিতা হয়েছিল। বিরোধীদের পান্ডা ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। সেই প্রসঙ্গটা আসতে পারত। হিন্দু ইন্টেলিজেন্টসিয়ার দীর্ঘকালীন মুসলমানবিদ্বেষের রূপটা আরও স্পষ্টভাবে ফুটে উঠতে পারত।
১) জৈবুন্নেসা।জেবুন্নেসা নন, বেগম রোকেয়ার বড় বোনের নাম ছিল করিমুন্নেসা।
২) দেলদোয়াল বা দেলদোয়ার নয়, জায়গাটির নাম দেলদুয়ার।
৩) উল্লিখিত আবদুল করিম গজনভী ছিলেন করিমুন্নেসার ছেলে, অর্থাৎ বেগম রোকেয়া সম্পর্কে ওনার খালা (মাসী) ছিলেন। তিনি স্যার উপাধি পেয়েছেন; মন্ত্রীও হয়েছেন কিন্তু মধ্যযুগ থেকে বেরোতে পারেননি। তাই বয়সে বড় খালা রোকেয়াকে তিনি পর্দা শেখাতে দ্বিধা করেননি। খালাকে তিনি শর্ত দিয়েছিলেন যদি খালা পর্দা মানেন, (তার মতে খালা বেপর্দা ছিলেন) তবে তিনি বেগম রোকেয়ার স্কুলটি সরকারী করতে সহায়তা করবেন।