নিবিড় বাঁশবনে ঘেরা ছোট্ট দীঘি। তরঙ্গহীন জলে ছায়ামাখা গোলাপী পদ্ম, গোল ঢেউ খেলানো পাতা। পানকৌড়ি হঠাৎ মুখ ডোবালেই স্থিরজলের তলায় শ্যাওলাদাম উঠত কেঁপে। তরঙ্গেরা ছুঁয়ে ফেলত পদ্মের পাঁপড়ি। ডাকঘরের মতো আকাশ জুড়ে মেঘেদের চিঠি দেওয়া নেওয়া চলত যখন, দীঘির স্বচ্ছ জলের আয়নাবুকে মিলত শরতের গন্ধ। সে গন্ধ এখনও পাই প্রবাসী বারান্দায়। সেই পদ্ম পাঁপড়ির রঙ রামধনু বেয়ে মিশে যায় বেগুনী ল্যাভেন্ডারের মঞ্জরীতে। সেই দিগন্তজোড়া কাশের ঢেউয়ের মিঠে ছলাৎ ছলাৎ শব্দ বয়ে আসে প্যানপাস গ্রাসের গমরঙা রেশমী চিরল রোঁয়ায়।
মার্কিনদেশে মা এসেছেন গোলার্ধ পেরিয়ে। মহাসপ্তমীর আবাহনে দর্পণচর্চিত মহাস্নানের পর মায়ের ত্রিনয়ন জেগেছে কুশের প্রাণপরশে। এদেশের পুজোতে ছেলেবেলায় দেখা বাংলাকে খুঁজে পাই। মন্ডপসজ্জা থেকে পুজোর উপকরণ,আলপনা সবেতেই ঘরোয়া যত্ন, প্রবাসী আবেগ। মন্ডপের মার্কিনি বহিরঙ্গ আড়ম্বরহীন হলেও অন্দরে প্রবেশ করলেই শরতের আকাশ। স্বর্ণকুমুদের মতো স্নিগ্ধ মায়ের মুখ, চোখের কোল জুড়ে গিরিগৃহে আসার আনন্দ, স্মিত ঠোঁটের কাছে নাকছাবিতে একটুখানি লজ্জা, সোনাকুঁড়ি ফলের মতো চিকন চুলের সীমান্তে উজ্জ্বল মুকুট। নয়নজোড়া রূপ, অন্তর জুড়ে স্নেহ। মায়ের এই শাশ্বত মূর্তি দেখার পর থিমপুজোকে মনে হয় নিষ্ফল আষ্ফালন। শাঁখা-সিঁদুর, আলতা পাতা, কাজললতা, দর্পণ, ডালিম ফুলে সাজানো বরণডালা, নকশাতোলা রঙিন কোলসরা, কাঠের বারকোষে অন্নভোগ, অষ্টমীতে পিতলের পুষ্পপাত্রে ১০৮টা পদ্ম, ঢাকের বাদ্যি, বাঙালি দুর্গাপুজোর শাশ্বত ছবি।
খুব ভোরে যখন ডিঙ্গি বেয়ে পদ্মফুলওয়ালারা ফুল ভেঙ্গে নিয়ে যায়, পাংশুবর্ণ জলাশয়ের হৃদয়জুড়ে পড়ে থাকে ছেঁড়া পাঁপড়ির টুকরো, শূন্য পাতায় উবে যাওয়া শিশিরের স্মৃতি। যেমন মা চলেছেন কৈলাশের গিরিপথে। পিছনে পড়ে থাকা গ্রামছাড়া তাল সারির পথে টুপ করে এসে বসে নীলকন্ঠ পাখি। বাবার কাছে গল্প শুনেছি আগেকার জমিদাররা দুর্গাপূজার উদ্বোধন করতেন নীলকন্ঠ পাখি দিয়ে। দুই পাখা জুড়ে আশমানি আর ঘন নীলের মেশামেশি, গলার অংশ শিবের মতো নীলবর্ণ। নীলকন্ঠ পাখি আজও মায়ের বাড়ি ফেরার পথে সন্ধ্যেবেলার শঙ্খধ্বনির মতো করুণ।
সাইপ্রাসের শিকড়ে আসন্ন হেমন্তের হিম ঘন হয়ে উঠছে। বরফের দেশ থেকে পরিযায়ী পাখিরা সার বেঁধে চলেছে বিষুব রেখার দিকে। মেরু বাতাস ছুঁয়ে গেলে ছোট ছোট ব্যথারা বিস্মৃতির তল থেকে বুদ্বুদের মতো ভেসে উঠতে থাকে। এবার হেমন্ত আসবে। অস্তরাগের শীতল সন্ধ্যে নামবে ঝরাপাতার উপর। উৎসবের স্মৃতিরা চন্দনের গন্ধের মতো ক্রমশ মেদুর হয়ে উঠতে থাকবে পরবর্তী উৎসবের অপেক্ষায়।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।