বলছি সেই সিমলে পাড়ার গপ্পো।
সিমলা স্ট্রিট কলিকাতার একটি প্রাচীন রাস্তা। মার্ক উডের (১৭৮৪) ও আপজনের (১৭৯৩) কলিকাতা মানচিত্রে রাস্তাটির কোনও উল্লেখ না থাকলেও সম্ভবত উনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে রাস্তাটি নির্মিত হয়ে থাকবে। লেফটেন্যান্ট এইচ অ্যাবারক্রম্বি (Lt. H. Abercrombie) এবং ক্যাপ্টেন এইচ. এন. ফরবেস (Capt. H. N. Forbes) মিলিতভাবে ১৮৩৬ খ্রিঃ কলকাতার যে মানচিত্র প্রস্তুত করেন, তাতে এই পথটি দেখানো আছে। শক সাহেব ১৮৬৬ খ্রিঃ কলিকাতার জনগণনার যে প্রতিবেদন তৈরি করেছিলেন তাতে কলিকাতা শহরের ৪৩৮টি রাস্তার একটি তালিকা দেওয়া আছে। ওই তালিকার মধ্যে ১১৯ নম্বরে সিমলা স্ট্রিটকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সিমলা নামটি কলিকাতার ইতিহাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সম্রাট ফারুকশিয়ারের কাছ থেকে যে ৩৮টি গ্রাম খাজনার ভিত্তিতে লাভ করেন, তার মধ্যে সিমলা গ্রাম অন্যতম। সিমলাকে সে সময়ে ডিহি বা মৌজা উভয় নামেই অভিহিত করা হত।
ফর্ম্মান তো পেলেন চতুর ইংরেজ বেনিয়ারা। কিন্তু সে ফর্ম্মান কার্যকর করতেও চালাকির আশ্রয় নিয়েছিলেন মিঃ হলওয়েল। সে কথাই শুনুন এবারে।
প্রাণকৃষ্ণ দত্ত মহাশয়ের লেখা “কোলকাতার ইতিবৃত্ত’ বইতে তিনি লিখছেন—“রসিদ মল্লিক ও সুরজ মল্লিক নামক দুই ভ্রাতা ছিলেন, ইঁহারাও মুসলমান। এখন ইহাদের বংশের কোন সন্ধান পাওয়া যায় না। কিন্তু পুর্ব্বে এ অঞ্চলের ইঁহারা প্রধান একঘর জমীদার ছিলেন। হোগলকুড়িয়া সিমলা, মৃজাপুর, বেনিয়াপুকুর, পাগলা ডাঙ্গা, ট্যাংরা ও দলন্দ - ইহাদের জমীদারীভুক্ত ছিল।
১৭৫৪ খ্রীঃ ৮ই আগষ্ট, হলওয়েল সাহেব সুকৌশলে উক্ত দুই ভ্রাতার নিকট নামমাত্র মূল্য দিয়া উহার পাট্টা লিখাইয়া লন। ঐ বৎসর ৮ই ডিসেম্বর কলিকাতার কাউন্সিল বিলাতে যে পত্র লেখেন, তাই এই “গত ৮ই আগষ্ট মিঃ হলওয়েল অতিকষ্টে ডিহিসিমলার স্বত্বাধিকারীর নিকট, ২,২৮১ টাকায় উহা ক্রয় করিয়াছেন, উহা কলিকাতার একটী প্রধান অংশ, উহা খরিদ করায় বিশেষ উপকার হইয়াছে। আমরা যে মুল্য দিয়াছি, বর্ত্তমান তহসিলেই জমীর খাজনায় তা অপেক্ষা অনেক অধিক আয় হয়। হলওয়েল বলেন, যখন উহা আমাদের হস্তে বন্দোবস্ত হইবে, তখন আরও অনেক অধিক আয়ের সম্পত্তি হইবে তাহার সন্দেহ নাই। কিন্তু স্বত্বাধিকারের মধ্যে এখনও অনেক গোল আছে, তাহা আমরা এখনও নিষ্পত্তি করিতে পারি নই, যখন পারিব, তখন আপনাদিগকে জ্ঞাত করিব। ইতিপূর্বেই হলওয়েল বিনামূল্যে বেনিয়াপুকুর, পাগলাডাঙ্গা, ট্যাংরা, এবং দলন্দ অধিকার করিয়াছিলেন। ১৭৫২ খ্রীঃ ১৫ই ডিসেম্বর, তিনি কলিকাতায় যে রিপোর্ট প্রকাশ করেন, তাহা ৬৪ সালে মুদ্রিত হয়, উহার ১৪০ পৃষ্ঠায় স্পষ্টই লিখিয়াছেন ---“বেনিয়াপুকুর, পাগলাডাঙ্গা, ট্যাংরা এবং দলন্দে কোম্পানির কোন অধিকার ছিল না, ক্রমে আপনা আপনি আসিয়া মিশিয়া গিয়াছে।” এ কথার অর্থে পাঠক বুঝিতে পারিবেন, কোম্পানি জমীদারদিগকে কিরূপ “মূল্য দিয়া সন্তুষ্ট করিয়া” ৩৮ খানি গ্রাম ক্রয় করিয়াছিলেন। এখন ঐ মুসলমান জমীদার বংশের যদি কোন উত্তরাধিকারী জীবিত থাকে, তাহা হইলে সে ব্যক্তি হয় দরজী অথবা খানসামা প্রভৃতি নীচ বৃত্তি দ্বারা দীনভাবে জীবন কাটাইতেছে। উহাদের ট্যাংরার জমীদারী দখলের সময় মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র আপত্তি করিয়াছিলেন, তিনি নুরজী মল্লিকের নিকট তাহা ক্রয় করিয়াছেন, ও তাহার পাট্টা প্রদর্শন করেন। কোম্পানি উক্ত পাট্টা জাল বলিয়া উপেক্ষা করেন এবং বলেন, নুরজী মল্লিক ১৫ বৎসর পুর্বে মরিয়া গিয়াছে, তোমার পাট্টার তারিখ ৯ মাস পুর্বে মাত্র, সুতরাং ইহা গ্রাহ্য করা যাইতে পারে না অথচ কোম্পানি নিজের বেলা ১৭৫৪ খ্রীঃ ৮ই আগষ্ট, সেই নুরজী ও রসিদ মলিকের নিকট সিমলার পাট্টা কিরূপে লিখাইয়া লইলেন, বুঝিতে গেলে হাস্য সম্বরণ করা যায় না। সিমলা এবং পাগলাডাঙ্গা একত্রে ২২৪৫বিঘা, তন্মধ্যে ১১৬ বিঘা দেবোত্তর ও ব্রহ্মোত্তর বাদে কোম্পানি প্রতি বৎসর ৪৯৬১ টাকা খাজনা বন্দোবস্ত করিয়াছিলেন”।
ডঃ ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর রচিত “স্বামী বিবেকানন্দ” পুস্তকে সেকালের উত্তর কলিকাতা বিশেষতঃ সিমুলিয়া অঞ্চলে ঘর বাড়ি নির্মাণ শৈলীর উপর আলোক পাত করেছেন। সে সময় সঙ্গতিসম্পন্ন লোকেরা অবস্থানুসারে এক বিঘা থেকে ৪/৫ বিঘা বা ততোধিক জমি নিয়ে বসতবাটি নির্মাণ করতেন। এই বসতবাড়ির বহির্ভাগ মোটা থাম বিশিষ্ট, ৫ ফোকরের পাকা ঠাকুর দালান এবং বিস্তৃত প্রাঙ্গণ থাকত। একদিকে থাকত গোয়ালবাড়ি । বাহির বাড়ি ও ভেতর বাড়ি পৃথক হত। বাহিরে ও ভিতরে উভয়স্থলে কুয়া, শৌচাগার থাকত। আবার কারও অন্দরমহলে পুকুর, আবার কারও বা খিড়কীতে পুকুর থাকত। অবস্থাপন্ন লোকেদের বাড়ির পাশে আস্তাবল থাকত। এসব সম্পন্ন পরিবারে বার মাসে তের পার্বণ তো লেগেই থাকত। ধনীদের পৃথক অতিথিশালা থাকত। ব্রাহ্মণ ও কুলীনেরা সেখানে থাকতে পেতেন।
বেথুন কলেজের কিছু অংশ ও বেথুন রো-এর অংশবিশেষ নিয়ে অবস্থিত ছিল সিমলা বলে। সিমলা বাজার সম্বন্ধে মহেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছেন—“আমাদের সময় যেটা সিমলা বাজার ছিল তা হল এখানকার বেথুন কলেজের বাড়ির দক্ষিণ-পশ্চিম অংশ এবং খানিকটায় বেথুন কলেজের পশ্চিম দিককার রাস্তা হইয়াছে।” ১৮৭৯ খ্রিঃ বেথুন স্কুলে কলেজ বিভাগ খোলা হয়। এর ভারপ্রাপ্ত হলেন অধ্যাপক শশীভূষণ দত্ত। সরকার বেথুন কলেজ সম্প্রসারণের জন্য সিমলা বাজারটা অধিগ্রহণ করেন, তার কিছু অংশ বেথুন রো প্রশস্ত করার জন্য ক্রয়মূল্যে কলিকাতা পুরসভাকে হস্তান্তরে প্রস্তাব দেন। এই প্রসঙ্গে কলিকাতা পুরসভাকে লেখা বাংলা সরকারের সেক্রেটারির পত্র থেকে জানা যায় যে সরকার ২ বিঘা ৮ কাঠা ৮ ছটাক জমি ৮৩,১২০ টাকায় অধিগ্রহণ করেন। প্রতি কাঠার মূল্য ১৭১৪ টাকা, রাস্তা প্রশস্ত করার জন্য পুরসভার প্রয়োজন ৩ কাঠা ১২ বর্গফুট জমি। ওই জমি বিনামূল্যে সরকারের কাছ থেকে চাওয়া হয়েছিল। সরকার পুরসভার ওই প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন। অবশেষে পুরসভা তাঁদের ২৩শে মার্চ ১৯১১ খ্রিস্টাব্দের অধিবেশনে সরকারের প্রস্তাব গ্রহণ করেন। অর্থাৎ ১৭১৪ টাকা কাঠা দরে ৩ কাঠা ১২ বর্গফুট জমি সরকারের কাছ থেকে কেনার ব্যবস্থা হয়।
সিমলা বাজারের মধ্য দিয়ে সাধারণের চলাচলের একটি পথ ছিল। এই পথ দিয়ে মানিকতলা স্ট্রিট, বেথুন রো ও সিমলা স্ট্রিটে আসা যাওয়া করা হত। বেথুন কলেজের জন্য বাজারের জমি অধিগ্রহণ করায় এবং পরবর্তীকালে বেথুন কলেজ প্রাচীর দিয়ে ঘিরে দেওয়াতে সেই পথটি বন্ধ হয়ে যায়।
বেথুন রো-র সাথে আরেকটা পরিবারের নাম অঙ্গাঙ্গী ভাবেই জড়িয়ে আসে। সে হ’ল নান-দের পরিবার। এনারাও কলকাতার প্রাচীন তন্তুবায়। হুগলী’র রাজবলহাট গ্রাম থেকে অষ্টাদশ শতকে কলকাতায় চলে আসেন রামসুন্দর নানের বাবা। এবং এই সিমূলিয়া গ্রামে যেহেতু প্রচুর তাঁতী পরিবার বাস করতেন তাই সিমলে পাড়াতেই থাকতে শুরু করেন। ৮ নং কৃষ্ণ সিংহ লেনে (এখন বেথুন রো) ছিল এদের আদি বাড়ি। এই রামসুন্দর নানে’র ছেলে ঈশ্বরচন্দ্র নান ছিলেন তদানীন্তন ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর স্টিভেডর। সেখান থেকেই ধাপে ধাপে উন্নতি। ব্যবসা দারুন চলতো সেসময় কারণ কলকাতা বন্দর তখন পূর্ব ভারতের অন্যতম ব্যস্ত বন্দর। দম ফেলার ফুরসত ছিল না তাঁর। মানিকতলা স্ট্রীট (যা এখন রামদুলাল সরকার স্ট্রীট) ও আজকের বেথুন রো’র সংযোগস্থল থেকে পশ্চিমদিক অব্দি ছিল ঈশ্বরচন্দ্রের বর্দ্ধিত বসতবাড়ি। এখন বেথুন রো আর রামদুলাল সরকার স্ট্রীট (মানিকতলা স্ট্রীট) দুজায়গায় মিশেছে। মূল বেথুন রো ওই ১৩৩ নং বাড়ি থেকে শুরু যার পূবদিকেই ছিল সেই চলন্তিকা বোর্ডিং হাউস। আর একটা মুখ হ’ল নানেদের কালীমন্দিরের সোজাসুজি।
ঈশ্বরচন্দ্র নান এই কালীবাড়ি যা পরিচিত নিস্তারিণী কালীবাড়ি ব’লে, তা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ১২৭২ বঙ্গাব্দের (ইংরেজি ১৮৬৫ সাল) শুভ রথযাত্রার দিন এই কালীমন্দিরের বিগ্রহ পূজো পেতে শুরু করেন। এর এখন ঠিকানা ২৫ নং বেথুন রো। ঈশ্বরচন্দ্র নানের এক প্রতিবেশী কৃষ্ণচন্দ্র সিংহ দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণী মায়ের অনুরূপ একটি কালীমূর্তি বানিয়ে আনেন সুদূর কাশী থেকে। প্রসঙ্গত বলা যায় যে ১৮৫৫ সালের ৩১ মে মা ভবতারিণীর বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল রানী রাসমনির হাতে। সে হিসেবে এই নিস্তারিণী মন্দির মাত্র দশ বছরের ছোট। যাই হোক সেই কৃষ্ণচন্দ্র সিংহ মশাই যে কোনো কারণেই হোক এই নিস্তারিণী কালীর বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করতে না পারায়, সেই বিগ্রহ তিনি ঈশ্বচন্দ্রের হাতে তুলে দেন। সেই থেকে মা পূজিত হয়ে আসছেন এই নানেদের কালী মন্দিরে। এই মন্দিরের মূল পূজানুষ্ঠান সেই কালীপুজোতেই। এছাড়া এই কালীমন্দির প্রতিষ্ঠার আগে থেকেই নানেদের পরিবারে দুর্গাপুজোও হয় পালা ক’রে। এখন সম্ভবত এই দুর্গাপুজো এই মন্দিরেই হয়ে থাকে। ঈশ্বরচন্দ্র ৭ জানুয়ারি ১৮৭৪ সালেই এ মন্দিরের খরচ-খরচা পরিচালনার জন্য একটা অছি পরিষদ না ট্রাস্টী গঠন করেছিলেন। সেই ট্রাস্টীর কাজকর্ম এখনো বহমান।
রথযাত্রার দিনে এ মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়েছিল বলে প্রতি বছর ওই দিনে নিস্তারিণী মা’র জন্মতিথি পালিত হয়ে থাকে। এই মন্দিরের মধ্যে কালী ছাড়াও আছে শিবমন্দির, নারায়ণের ঘর আর দুর্গাদালান। যেহেতু তন্তবায় সম্প্রদায় বৈষ্ণব মতের অনুগামী তাই এ মন্দিরে বলি হয়ই না। প্রতিদিন নিত্যপুজো হয় নিয়ম করেই। প্রতি অমাবস্যায় মা’র লুচি মিস্টি ভোগ হয়। কলকাতার ওই অঞ্চলে ইদানীং প্রচুর অবাঙালি বাস করেন। এখন তাদের কাছে খুব প্রিয় এই কালী মন্দির। ইচ্ছেময়ী মা এখন তিনি।
#
©গৌতমদত্ত
#
কৃতজ্ঞতা--
কলিকাতার রাজপথ সমাজ ও সংস্কৃতিতে – অজিতকুমার বসু।
কলকাতার পুরাতন কাহিনী ও প্রথা - মহেন্দ্র নাথ দত্ত।
কলিকাতার কাহিনী – সুকুমার সেন।
কলকাতার ইতিবৃত্ত – প্রাণকৃষ্ণ দত্ত।
কলিকাতা সেকালের ও একালের – হরিসাধন মুখোপাধ্যায়।
এবং গুগুল।