আমি থাকি মূল কলকাতা শহর থেকে প্রায় ঘন্টা দুয়েক দূরে। হুগলী জেলার উত্তরপাড়ায়। আমার কাজের জায়গা কলকাতায়। সেখানে আমাকে প্রায় যেতে হয়। এবং আমার কাজটা সব সময় মোটেই ঘরে বসে কাজ নয়। নিয়মিত মাসিক চাকরীরও নয়। যে প্রায় গোটা মাস ছয়েক গৃহ বন্দী হয়ে থাকলে চলে যাবে। কোভিড পরবর্তী পরিস্থিতিতে লক ডাউন উঠে যাওয়ার পর থেকে আমাকে প্রায় নিয়মিত না হলেও সপ্তাহে বার চারেক কলকাতায় যাতায়াত করতে হয়েছে। তাও আমি অনেকের থেকে ভাগ্যবান কলকাতায় আমার বন্ধুর বাড়িতে অনেকটা সময় তারা আমাকে থাকতে দেয়। প্রচন্ড ভালোবাসে এবং আমাকে সহ্য করে। শুধু এইগুলো লেখার জন্য আমি এই কথা গুলো বলতে বসিনি। মফস্বল থেকে কলকাতায় যাতায়াত করেন কত মানুষ তার হিসেব আমার কাছে নেই। কলকাতার মধ্যে কত মানুষ থেকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাতায়াত করেন নেই তার পরিসংখ্যান। কত মানুষ বাইরের জেলা গুলো থেকে তাদের মূল কাজের জায়গায় ট্রেনে করে যাতায়াত করতেন তাও কি আমরা হিসেব করে দেখেছি প্রতিদিনের নিরিখে? জানি না। কাজেই যখন ট্রেন বন্ধ এই মানুষ গুলো কোথায় কিভাবে যাতায়াত করছেন? নাকি করছেন না? নাকি তাদের সবার কাজ চলে গেছে? এখন তাঁরা কী করছেন? কী খাচ্ছেন? নাকি সত্যি মরে গেছেন জানি না। তবে আমি এমন কিছু মানুষকে চিনি যাঁরা ঘন্টা তিনেক সাইকেল চালিয়ে প্রতিদিন মরিয়া হয়ে কাজ করতে আসছেন অফিসে। আবার বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন ঘন্টা তিনেক সাইকেল চালিয়ে। কোভিড পরবর্তী কালে বাসের ভাড়া বেড়েছে। টোটোর ভাড়া বেড়েছে। অটোর ভাড়া বেড়েছে। উবেরে উঠলে মনে হয় মাসের রোজগার করা টাকার অর্ধেক দিয়ে দিচ্ছি। তার সাথে কাজ কমছে। টাকা কমছে। উৎকন্ঠা বাড়ছে। এটা জানি শুধু আমার একার নয়। অনেকেরই। শহরে মেট্রো চলছে। উঠলে মনে হচ্ছে কোন প্রথম বিশ্বের দেশে আছি। আমি এফোর্ড করতে পারছি। উঠছি। আর যাঁরা পারছেন না? জানি না। ফেসবুকে এইদানিং একটা ট্রেন্ড খুব দেখছি। সবাই বড্ড বেশি ভাবনায় পড়ে গেছি আমরা পুজোর ভিড় নিয়ে। সত্যি তো ভিড় কেন হবে? সবাই অন লাইন থেকে কেনাকাটা করছি তো। অপদার্থ যারা তারা ভিড় করবে। স্মার্ট ফোন নেই। ব্যাঙ্কে টাকা নেই। তোদের আবার পুজোয় ভিড় করা কিসের? এই কথাটা বলার পরে সপাটে যিনি আমার দিকে তাকালেন তিনি বললেন যারা ভিড় করছে তাদের সবার ফোন আছে। টাকা আছে। গাড়ি আছে। মেনে নিলাম বেশ। আর যাদের কাছে ভিড় করছেন কেনার জন্যে? যারা ভিড় করলে রাস্তার আইসক্রিম। ফুচকা। বাদামওয়ালার বাদাম। কিম্বা যারা শহরে আসলে আরও অনেকের প্রয়োজন হয় তারা একটু সুবিধে পাবে। যাদের কথা এই মাগগি গন্ডার যুগে আমরা ভাবিনি একবারও? ভাববোও না। তবুও পুজোয় কেন ভিড় হবে? আমরা অবশ্যই চিৎকার করবো পুজোয় ট্রেন চললে রাজ্যের কত ক্ষতি হবে। কত লোক মরে যাবে। আমি মরে যাবো। আমার বাড়িতে বয়স্ক মা মরে যাবে। চিন্তাটা বড্ড আমাকে নিয়ে। কিন্তু ঠিক কত লোক বেরোজগার হয়ে গেল? ঠিক কতলোক ফোন নেই বলে মেট্রো চড়তে পারলো না। আর মেট্রো চড়তে পারলো না বলে একদলা ভিড় বাসে উঠে সেই লোকগুলো পরিস্থিতি আরও জোরালো করলো। কেন বড় কোম্পানি থেকে শুরু করে ছোট সবাই ছেঁটে দিল তাদের কর্মী। এক রাতের নোটিসে চলে গেল চাকরী? আর সেইসব ভিড় করা লোকগুলো যারা কাজ করতে আসতো শহরে তারা কোথায় গেল? ভূতের গল্পের মতো মনে হয় তখন। ফাঁকা থাকলেই যদি রোগ না থাকে তাহলে ফাঁকা থাকলে ক্ষিদেও কি থাকবে না? প্রশ্ন গুলো সব নিজেকে করলাম। অযথা আবার রেগে মেগে খিস্তি দিয়ে ভূত ভাগিয়ে প্রেসারের ট্যাবলেট খাবেন না। কারণ ওই যে দোকানে যাওয়ার লোকটাকেও এরপর আমরা বিশ্বাস করবো না। করতে পারবো না। দেওয়া হবে না বিশ্বাসের ওপরে কোভিড হীন ছাপ।
আমার ভাইয়ের অফিস চালু হয়ে গেছে মে মাসের মাঝামাঝি থেকে। ওকে অফিস যেতে হচ্ছে জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে, নাহলে চাকরিটা থাকত না। কোন্নগর থেকে অটো ধরে বালিহল্ট সেখান থেকে বাস ধরে সল্টলেক। এইভাবে চালিয়েছে সেপ্টেম্বর অবধি। আমি ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকতাম কবে না জানি সংক্রামিত হয়। শেষে সেপ্টেম্বরে আর না পেরে বাইক কিনেছে। এখনও কাঁটা হয়ে থাকি, জি টি রোড আর বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়ের লরিগুলোর কথা মনে করে।
আমাদের পরিচিত এক ঝালমুড়িওলা, লোকাল ট্রেনে বিক্রি করত, বচ্চা ছেলেই বলা যায় বছর ত্রিশেক হবে মেরেকেটে। আগস্টে শুনলাম আত্মহত্যা করেছে। যাদের চিনতাম লোকাল ট্রেনে, কে কেমন আছে, আদৌ আছে কিনা জানি না। অবশ লাগে ভাবতে গেলে।
একেবারে শুরুতে কড়া লকডাউনের পক্ষে ছিলাম, এখনো তাই আছি, কারনঃ
• লকডাউন না হলে সরকারের পক্ষে দায় ঝেড়ে ফেলা সহজ
• সাধারন মানুষের ওপর দোষ চাপানোও সহজ হয়ে যায়
• জীবন মৃত্যু তুচ্ছ করে বাজার চালু রেখে অর্থনীতিকে সচল রাখার দায় সাধারন মানুষের হওয়া উচিত না, দুঃসময়ে মানুষকে দেখাটাই সরকারের কাজ।
পার্লামেন্ট বানানো, প্লেন কেনা, এক্স ওয়াই জেড ক্যাটেগরির নিরাপত্তা সব কিছুর টাকা আছে, কিন্তু অর্থনীতি চালু রাখতে গেলে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে বেলুন ওয়ালাকে বেলুন বেচেতে বেরুতে হবে, এটা সরকারেরই পার্স্পেক্টিভ - এটা আমার গোলমেলে মনে হয়।
এবার কথা হচ্ছে, মানুষ তাহলে কী করবে? সত্যি যা করছে তার বাইরে কিছু করার নেই। যা করার সরকারেরই করার ছিল, করেনি। মানুষ তার জন্যে সরকারকে চাপ দিতে পারে। তবে মানুষ যেহেতু একটা অসমসত্ত্ব ব্যাপার, তাই, কে জানে।
আর এমনিতে মানুষের সচেতন হওয়া দরকার তা তো বটেই, সে তো মানুষের চাড্ডিপনা না করা দরকার, বিদ্বেষ খুনোখুনি না করা দরকার, কত কী। ওসব আজাইরা কথা, ও হবে না।
ভুলভাল যুক্তি। গরীবদের না মেরে, তাদের ভর্তুকি দিয়ে বাঁচানো হোক। ক্লাবগুলোকে ৫০০০০ দিয়ে মোচ্ছব না করে কুমারটুলির শিল্পী, ডেকরটার্স ইত্যাদি জীবিকায় জড়িতদের টাকা দেওয়া হোক। কিন্তু এই ভীড় মেনে নেওয়া যায় না .
কল্লোল বাবু ঠিক লিখেছেন, মূল সমস্যা অন্যখানে। লকডাউন কখনো সম্ভব, সব সময় নয় |
এই ভিডিওটা দেখুন,
ভিডিওটা দেখছি না, কারন চিন্তাটা রোগের বিস্তার থেকে সরকারের দায় এড়ানো নিয়ে বেশি। লকডাউন সম্ভব না, এই ব্যাপারটা আসতে শুনি অর্থনীতির কী হবে ঐ চিন্তা থেকে।
অর্থনীতি বাঁচাতে যদি প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে মানুষকেই রাস্তায় নামতে হয় তাহলে সরকার তুলে দেওয়া হোক। যে লোকটা পেটের দায়ে হাটে মাঠে বাসে গুতোগুতি করে বেলুন বেচতে গেল, সে তার গাঁয়ে ফিরে বিনা চিকিৎসায় একঘরে হয়ে মরে গেলে অর্থনীতির কিছু উপকার হলেও হতে পারে, কিন্তু সরকার ঐ লোকটারও একটু উপকার করতে পারতো তাকে বাড়ি থেকে বেরুতে না দিয়ে, তার বাড়ি থাকার ব্যবস্থা করে দিয়ে। নতুন সংসদ ভবনের খবর তো আজও দেখলাম কাগজে।
বাজার খোলা থাকুক এই দাবিটা এক ধাক্কায় সরকারের দায় কমিয়ে দেয়। হাট বাজার ব্যবসা বাণিজ্য সব যদি চালুই থাকে তাহলে আর সরকার সাহায্য করবে কেন! এমনিতেও করছে না, কিন্তু ওমনিতে করা উচিত, বা করলে ভালো হতো, এই সুতোটাও আর অবশিষ্ট থাকে না।
আর তাছাড়া হু মাস কয়েক আগে মুখোশ পরতেও না করেছিল। ওসব যাগ্গে।
ভিডিওটা দেখলে একটা ব্যাপার পরিষ্কার হত যে, অন্তত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কোন পরিপ্রেক্ষিত থেকে লকডাউনের প্রসঙ্গটা তুলছেন। লকডাউন কিন্তু গোড়া থেকেই কখনোই প্রাথমিক জনস্বাস্থ্যগত ব্যাপার ছিল না, থাকার কথাও নয়। ভারতে যেভাবে লকডাউন শুনেছি বা দেখছি করা হচ্ছে অন্তত নাবারো'র কথা শুনে মনে হচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শে নয়।
লকডাউন করতে হলে প্রথম থেকে মডেলিং এর ভিত্তিতে করতে হত, লকডাউন কখন খোলা হবে সেটা প্রথম থেকে বিবেচ্য; এবং এঁরা যে কথাটা বার বার করে বলছেন, লকডাউন একটা সাময়িক স্টপ গ্যাপ আপৎকালীন ব্যবস্থা, যত দ্রুত সম্ভব লকডাউন খুলে নিতে হয়।
একটা উদাহরণ দিলে হয়ত কি বলতে চাইছি বোঝানো যাবে: নিউজিল্যাণ্ডে যখন লকডাউন ঘোষণা করা হয়, তার এক সপ্তাহ আগে থেকে প্রচুর মডেল পর্যালোচনা করা হয়েছিল যে লকডাউন চলাকালীন কি পরিমাণে কনট্যাক্ট ট্রেসিং, টেস্টিং, এবং কতভাবে মানুষকে যদি সামাজিক/ভৌগোলিক দূরত্ব বাড়ানো যায়, তাহলে আন্দাজ মতন কতদিন পরে লকডাউন খোলা যাবে। তাছাড়া, লকডাউন হলে পরে যে আর্থিক সমস্যা দেখা দেবে তাকে সামাল দিতে সরকারের তরফে প্রচুর আর্থিক প্যাকেজ ইত্যাদি ঘোষণা করা হয়, তার মধ্যে একটা ছিল গত বছরের হিসেবে সরকার যে সমস্ত মানুষ দৈনিক রোজগার করেন, বা বিভিন্ন পেশায় রয়েছেন, তাঁদের তিন মাসের রোজগারের সমান অর্থ সাহায্য করবেন (এ টাকা তাঁদের ফেরৎ দিতে হবে না)। তার পরেও লকডাউনের চার রকম স্তর ঘোষণা করা হয়, এবং অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে লকডাউনের ঘোষণা করা হয়, যেদিন করা হয়, তার পর আরো ৭২ ঘন্টা সময় দেওয়া হয়েছিল যাতে বিভিন্ন মানুষজন যে যেখানে আটকার পড়েছিলেন তাঁরা যাতে তাঁদের বাড়ি বা গন্তব্যস্থলে পৌঁছতে পারেন তার বন্দোবস্ত করা হয়েছিল। এ তো গেল একটা ধাপ। তার পরে দ্রুত তৎপরতায় টেস্টিং এর মাথাপিছু হার বাড়ানো হতে থাকে, কনট্যাকট ট্রেসিং প্রায় নিখুঁত করে ফেলা হয়, তাতেও হয় নি, কমিশন বসিয়ে কোথায় ঘাটতি দেখার চেষ্টা করা হয়| যার জন্য যেদিন দেখা গেল ইনফেকশন চূড়ান্ত রকমের, তার অব্যবহিত পরে লকডাউন ঘোষণা করা হয়, কারণ থিওরি অনুযায়ী, লকডাউন এর দিন পাঁচেক পর থেকে Effective Reproduction Number 1 এর নীচে নামতে থাকার কথা। যার জন্য যখন দেখা গেল সেই সংখ্যা শূন্য দশমিক সাতের কাছাকাছি, পুরোপুরি লকডাউনের মাত্রা কমিয়ে অপেক্ষাকৃত সহজতর লেভেলে নিয়ে আসা হল। পরে চোদ্দ দিন করোনামুক্ত থাকার পর নিম্নতম মাত্রায় নিয়ে আসা হয়। এ ব্যাপারটি কিন্তু বিস্তর চিন্তা ভাবনা করে করা হয়েছে।
এছাড়াও লকডাউন কখন শুরু করতে হয় সেই সময় নির্বাচন বিশেষ করে তাৎপর্যপূর্ণ | লকডাউন এর অর্থ আপনি ভাইরাস নির্মূল ("elimination") করার কথা ভাবছেন। সেটা পরিস্থিতি অনুযায়ী আদৌ সম্ভব কিনা, বা সেটা না হলে অন্যান্য কি স্ট্র্যাটেজি অবলম্বন করা যায় সেগুলো নিয়ে বিস্তৃত চিন্তাভাবনা করার একটা জায়গা আছে।
এত সব কিছু না করে খাপছাড়া লকডাউন করলে হিতে বিপরীত হতে বাধ্য যার কথা কল্লোল বাবু লিখেছেন।
পুরো জিনিসটাই তো খাপছাড়া চলছে - লকডাউন করে লাভ হবে না, আর না করে ক্ষতি হবে, তাহলে করাই হোক। অন্তত সরকারের ওপর চাপ থাকবে, সাধারন মানুষের ওপর না থেকে।
আর নিউজিল্যান্ডর থেকে শেখার তো আছেই। তবে এটাও মাথায় রাখতে হবে ওই দেশটা ছোট সাইজের একটা দ্বীপ, ভারতের মত গরীবও না, জনঘনত্বও অনেক কম।
এই যে এত লোক কাজ হারালেন,এই নিয়ে সেরকম কোন সঙ্ঘবদ্ধ প্রতিবাদ নেই,এই আরেক আশ্চর্য !