কৃষ্ণগহ্বর (black hole) শব্দটা সংবাদমাধ্যমের কল্যানে আমজনতার কাছে একেবারেই অপরিচিত নয়৷ একশো বছরেরও বেশী সময় ধরে জিনিসটার রহস্য বিজ্ঞানী, কল্পবিজ্ঞান লেখক থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষকে রোমাঞ্চিত করেছে৷ কিন্তু নোবেল পুরস্কারের তালিকায় উঠতে কৃষ্ণগহ্বরের লেগে গেল ২০২০ সাল৷ এবারে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কারের অর্ধেক পাচ্ছেন রবার্ট পেনরোজ৷ তিনি দেখিয়েছেন, কৃষ্ণগহ্বর হল সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্বের অমোঘ ভবিষ্যৎবাণী৷ বাকি অর্ধেক ভাগ করে নিচ্ছেন রেনার্ড গেঞ্জেল এবং আন্দ্রে গেজ৷ তাঁরা আকাশগঙ্গা ছায়াপথের কেন্দ্রে একটি অতি ভারী ঘনবস্তু আবিষ্কার করেছেন৷ বলা বাহুল্য ঐ বস্তুটি কৃষ্ণগহ্বর ছাড়া অন্য কিছু হতে পারে না৷
ব্ল্যাকহোল নামটা তুলনামূলকভাবে নতুন হলেও ব্ল্যাকহোলের মত কিছু একটা বস্তুর অস্তিত্ত্ব কল্পনা করা হয়েছিল উনবিংশ শতকের আটের দশকে৷ আমরা যদি একটা ঢিলকে ওপর দিকে ছুঁড়ি, সেটা এক সময় নীচে নেমে আসবে৷ যদি আরো জোরে ছুঁড়ি, সেটা আরো ওপরে উঠে আরো একটু দেরিতে মাটিতে পড়বে৷ কিন্তু এতটাও জোরে কি ছুঁড়তে পারি, যাতে করে ঢিলটা আর ফিরে আসবে না, পৃথিবীর অভিকর্ষের মায়া কাটিয়ে মহাশূণ্যে হারিয়ে যাবে? হ্যাঁ পারি, এবং সেই বেগকে বলা হয় মুক্তিবেগ৷ পৃথিবীপৃষ্ঠের ওপর মুক্তিবেগের মান ১১.২ কিমি/সেকেন্ড৷ তো এমন কোন নক্ষত্র যদি থেকে থাকে যার পৃষ্ঠের ওপর মুক্তিবেগ আলোর বেগের চেয়ে বেশী, তাহলে তো সবকিছুই, এমনকি আলোও, আটকে পড়বে ঐ নক্ষত্রের টানে! যদিও সেই কল্পনাকে বাস্তব রূপ দেওয়া যায়নি৷ তারপর ১৯১৫ সালে আইনস্টাইন সাধারণ আপেক্ষিককতার তত্ত্ব ( General Theory of Relativity) বাজারে আনলেন আর সঙ্গে সঙ্গেই সোয়ার্জচাইল্ড একটা নিখুঁত সুষম বৃত্তাকার বস্তুর জন্য আইনস্টাইন সমীকরণের খুব সুন্দর একটা সমাধান বের করে ফেললেন৷ সোয়ার্জচাইল্ডের সমাধানে একটা বিন্দু পাওয়া গেল যেখানে গিয়ে আর পদার্থবিজ্ঞানের কোন জানা নিয়ম কাজ করে না৷ ঐ বিন্দুই হল অনন্যতা (singularity)৷ দেখা গেল অনন্যতাকে ঘিরে ঘটনা দিগন্ত (event horizon) নামে এক বৃত্তাকার তল আছে, যেখান দিয়ে বাইরে থেকে ভেতরে জিনিসপত্র ঢুকবে, কিন্তু ভেতর থেকে কিছু বাইরে বেরোবে না৷ আলোও না৷ পরে আরো অনেক বিজ্ঞানী আইনস্টাইন সমীকরণের সমাধান বের করলেন৷ কেউ ধরলেন ঐ নিখুঁত বৃত্তাকার বস্তুটার ভরের সঙ্গে কিছু আধানও আছে, কেউবা আবার ধরলেন বস্তুটা একটা অক্ষের চারদিকে বনবন করে ঘুরছে৷ মোদ্দাকথা এটাই যে সমাধানগুলো কিছু বিশেষ প্রতিসাম্যের (symmetry) উপস্থিতি ধরে নিয়ে করা৷ তা না করলে অরৈখিক (non linear) আর অত্যন্ত জটিল আইনস্টাইন সমীকরণকে বাগ মানানো যেত না৷ কিন্তু ঘটনা হল ঐরকম নিখুঁত প্রতিসম বস্তু তৈরী হওয়া কার্যত অসম্ভব৷ যত দক্ষ কারিগরই হোক, যত ভালো যন্ত্রই থাকুক একদম নিখুঁত গোলক তৈরী করা আদৌ সম্ভব নয়৷ সৌরজগতে যে গ্রহগুলো আছে বা যেসব নক্ষত্রকে আমরা মোটামুটি ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতে পেরেছি তারা কেউই নিখুঁত গোলক নয়, সুষম তো নয়ই৷ যাঁরা ভগবান টগবানে বিশ্বাস করেন, ইদানীং তাঁরাও বলেন যে ভগবানের কোন সৃষ্টিই আর যাই হোক, "পারফেক্ট" নয়৷ একদম নিখুঁত প্রতিসাম্য অতএব নেহাত দুর্ঘটনা ছাড়া ঘটা সম্ভব নয়৷ তাই যদি হয়, তো ব্ল্যাকহোল বলেও আসলে কিছু হয় না৷ সোয়ার্জচাইল্ড ও অন্যান্যরা যে নিখুঁত গোলকের কল্পনা থেকে অঙ্ক কষেই ঐরকম বিজাতীয় বস্তু পাওয়া যাচ্ছে৷
অন্তত ষাটের দশক অবধি বিজ্ঞানীরা এটাই মনে করতেন৷ তারপর রবার্ট পেনরোজ এবং স্টিফেন হকিং এর অনন্যতা উপপাদ্য (singularity theorem) তাঁদের নিশ্চিন্তির ঘুমে ব্যাঘাত ঘটাল৷ (হকিং জীবিত থাকলে নিশ্চিতভাবেই নোবেল পুরস্কারে ভাগ বসাতে হাজির হয়ে যেতেন) পেনরোজ এবং হকিং দেখালেনঃ যদি মহাকর্ষই একমাত্র চালিকাশক্তি হয় আর আইনস্টানের সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ মহাকর্ষের সঠিক ব্যাখ্যা হয় আর পদার্থের চরিত্র বিদঘুটে (যেমন বিকর্ষণধর্মী মহাকর্ষ) কিছু না হয় তাহলে অনন্যতা অবশ্যম্ভাবী৷ সংশ্লিষ্ট তারাটির গঠনে নিখুঁত প্রতিসাম্য থাকল কি না তাতে কিছু আসে যায় না৷
পেনরোজ, হকিং অঙ্ক কষে কৃষ্ণগহ্বরের অস্তিত্বকে নিশ্চিৎ করেছিলেন৷ কৃষ্ণগহ্বরের উপস্থিতির প্রত্যক্ষ প্রমাণ দিলেন রেনার্ড গেঞ্জেল এবং আন্দ্রে ঘেজের নেতৃত্বে দুদল গবেষক৷ এখন আমরা কোন বস্তুকে দেখতে পাই কারণ সেই বস্তুতে প্রতিফলিত হয়ে আলো আমাদের চোখে আসে৷ দৃশ্যমান আলো না হলেও এক্স রে ব্যবহার করে শরীরের ভেতরের হাড়ের ছবি বা ইনফ্রা রেড ক্যামেরায় অন্ধকারেও কোন প্রাণীর ছবি তোলা যায়৷ কিন্তু ব্ল্যাকহোল থেকে যেহেতু কোন বিকিরণই বাইরে আসে না, তাই তাকে সরাসরি দেখা সম্ভব নয়৷ কিন্তু ব্ল্যাকহোলের আশেপাশের বস্তুগুলোর গতিবিধি থেকে ব্ল্যাকহোলের অস্তিত্ব জানা সম্ভব৷ বহুদিন আগেই ধনুরাশির মধ্যের একটি তারা Sagittarius A* থেকে তীব্র রেডিও সিগন্যাল পাওয়া গেছিল এবং সেই তারাটি যে আকাশগঙ্গা ছায়াপথের কেন্দ্রস্থলে আছে তাও বোঝা গেছিল৷ আমাদের ছায়াপথটা একটা জিলিপির মত৷ যে জিলিপির এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে আলো পৌঁছতে এক লক্ষ বছর সময় লেগে যায়৷ গেঞ্জেল এবং ঘেজের নেতৃত্বে গবেষকরা দেখলেন ঐ জিলিপির একদম কেন্দ্রের আশেপাশের কিছু নক্ষত্র প্রচণ্ড গতিতে কেন্দ্রকে প্রদক্ষিণ করছে৷ মেলা বা সার্কাসে একটা খেলা দেখেছিঃ একটা বৃত্তাকার ঘরের ভেতরের দেয়ালের মধ্যে কয়েকজন বাইক আরোহী প্রচণ্ড গতিতে ছোটাছুটি করছে, কিন্তু কেউ কারোকে ধাক্কা মারছে না৷ খেলাটার নাম ছিল মৃত্যুকূপ৷ ছায়াপথের কেন্দ্রের তারাগুলোর আচরণও ঐরকম৷ আর সূর্যের মত তারাগুলো কেন্দ্র থেকে অনেক দূরে, জিলিপির প্যাঁচের ওপর বসে হেলেদুলে কেন্দ্রকে প্রদক্ষিণ করছে৷ সার্কাসের তাঁবুর চারদিকে হেঁটে হেঁটে ঘোরার মত৷ S2 নামে একটা কেন্দ্রস্থলের একটা তারা মাত্র ১৬ বছরে ছায়াপথের কেন্দ্রকে প্রদক্ষিণ করে৷ অন্যদিকে আমাদের সূর্য, যে কেন্দ্র থেকে যার দূরত্ব ছাব্বিশ হাজার আলোকবর্ষ, তার এক পাক ঘুরতে সময় লাগে ২০ কোটি বছর! ঐ সময়টাকে যদি একবছর বলি, তাহলে বলবঃ "এই তো গেল বছর টিরেনোসরাসটা ঐ পুকুরপারে ডিম পেড়ে গেল৷" এখন সৌরজগতের ক্ষেত্রেও আমরা দেখেছি সূর্যের কাছের গ্রহগুলো যেমন বুধ, শুক্র এরা পাক খায় খুব তাড়াতাড়ি৷ আবার যত সৌরজগতের বাইরের দিকে যাওয়া যায় তত প্রদক্ষিণকাল বাড়তে থাকে৷ বুধের এক বছর হয় ৮৮ দিনে, বামন গ্রহ প্লুটোর ৯০ হাজার দিনে৷ এর কারণ সৌরজগতের প্রায় পুরো ভরটাই কেন্দ্রে সূর্যের মধ্যে জমা হয়ে আছে৷ যে গ্রহ সূর্যের যত কাছে, তার ওপর সূর্যের টান তত বেশী আর তার প্রদক্ষিণের গতিও তত বেশী৷ ছায়াপথের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার৷ নক্ষত্রগুলোর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে বোঝা গেল আকাশগঙ্গা ছায়াপথের ঠিক কেন্দ্রে সূর্যের ভরের চল্লিশ লক্ষগুণ ভারী কোন অদৃশ্য বস্তু অর্থাৎ ব্ল্যাক হোল রয়েছে৷ এত ভারী ব্ল্যাক হোলের সৃষ্টি কিভাবে হল সে ব্যাপারে অবশ্য বিজ্ঞানীরা এখনও নিশ্চিৎ নন৷
একটা প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক৷ পেনরোজের অনন্যতা উপপাদ্য তো সেই ষাটের দশকের ব্যাপার৷ আর রেনার্ড গেঞ্জেল, আন্দ্রে ঘেজদের পর্যবেক্ষণ নব্বইএর দশকের৷ তাহলে নোবেল পুরস্কার আসতে এত দেরি হল কেন? আসলে কোন প্রত্যক্ষ পরীক্ষালব্ধ প্রমাণ ছাড়া শুধুমাত্র তাত্ত্বিক গবেষণার জন্য নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয় না৷ বছরখানেক আগে সাড়ে পাঁচ কোটি আলোকবর্ষ দূরের M87 ছায়াপথের কেন্দ্রীয় কৃষ্ণগহ্বরের ছবি তুলেছেন নাসার বিজ্ঞানীরা৷ ২০১৫ তে দুই কৃষ্ণগহ্বরেরর সংঘর্ষের খবরও মিলেছে মহাকর্ষীয় তরঙ্গের হাত ধরে৷ কৃষ্ণগহ্বর এখন আর তত্ত্ব আর অঙ্কের বিষয় নয়, ঘোর বাস্তব৷
২০১১ সালে মহাবিশ্বের ক্রমবর্ধমান প্রসারণের হার (Accelerated Exapasion of the Universe), ২০১৭ তে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ (Gravitational Waves), ২০১৯ এ বিশ্বতত্ত্ব ( Cosmology) ও বহির্গ্রহ (Exoplanet) আর ২০২০ তে কৃষ্ণগহ্বর - একবিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল পুরস্কারের প্রায় অর্ধেক এল আছে মহাকাশ থেকে৷ এমন কি ২০১৩ তে হিগস বোসনের (Higgs Boson) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে মহাবিশ্বের রহস্য সমাধানে৷ শেষ করার আগে একজন মানুষের কথা বলে যাই৷ পঞ্চাশের দশকে কলকাতার Indian Association for the Cultivation of Science এর এক গবেষক, প্রচণ্ড প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে বসে একটা পেপার লিখলেন৷ সেই পেপারের উপপাদ্য একটা সমীকরণ, যা এখন জেনারেল রিলেটিভিটির যেকোন টেক্সটবই য়ে অবশ্যপাঠ্য৷ গবেষকটির নাম অমলকুমার রায়চৌধুরী, একেআর নামেই যিনি সমধিক পরিচিত৷ রায়চৌধুরী সমীকরণের ওপর ভিত্তি করেই হকিং ও পেনরোজ তাঁদের অনন্যতা উপপাদ্যে উপনীত হন৷
সত্যেন দত্ত থাকলে হয়ত লিখতেনঃ
"অন্ধকূপের আগল ভাঙিল বাঙালীর উপপাদে,
বিধাতার কাজ সাধিবে বাঙালী ধাতার আশীর্বাদে৷"
কবিতাটা এমনিতে ভালোই, তবে উপপাদ কথাটা যেন কেমন। ভুসুকু পাদের কথা মনে পড়ে গেল। অবশ্য কবি যদি মনে করেন যে বাঙালির উপ পাদে ব্ল্যাক হোলের আগল ভেঙে পড়লো, তাহলে কোন কথা নেই।
এখন মনে করলে প্রায় অবিশ্বাস্য মনে হয় কিন্তু এ কে আর এর একটা ক্লাস আমিও এটেন্ড করেছিলাম নিছক কৌতূহল বশত ,হুজুগ ও বলা চলে
অবশ্যই এক বর্ণ কিছু বুঝতে পারি নি