রক্ত আজ ছুটছে আবার। গরম রক্তে গরম ভাবনা, গরম কথা কিছু সেরে নেওয়া ভালো। স্কুল গ্রুপে খোঁচা মারতে সেখানে স্ফুলিঙ্গ। আরো কিছু গ্রুপ কিছু অবাঙালি পরিমন্ডলে এসব তেমন জমলো না। কিছু দাদারা কেমন আকাশ থেকে পড়েছে মনে হল। সে যাইহোক, আমি আমার কথা বলি।
আন্দোলন করা, প্রতিবাদ করা আমি বুঝলাম এই দুদিনে লোকে বুঝছেই না কি করতে হবে। এদের শাস্তি এই সরকার নিপাত যাক বলে হৈ হৈ, কেউ বলছে এদের সাথে লড়া যায় না, কেউ ভয়ে সিঁটিয়ে, কেউ আপসেট... বেশিরভাগ আজো নির্বিকার। আমার তো কিছু হয়নি, কি হচ্ছে? কোথায় হচ্ছে জানে না কিছু। কেউ সব বেকার মেনে নিয়েছে। অনেকেই মেয়েদের অতি বাড় ভালো না এটাই মানে।
আমার কথা বলি। শুধু শিক্ষা দিতে হবে। এ কাজ মেয়েদেরই। আজ এই সমাজ গড়ার পিছনে আমরাই আছি। একটা মা বার বার ছেলে চাইছে। মেয়ে হোক আর ছেলে হোক দুরকমের প্রতিক্রিয়া চারদিকে। মেয়ে হলেও আমি মিষ্টি খাইয়েছি এই বলায় একটা অহংকার। সেই শুরুর দিন থেকে ভুল করে আসি আমরা। মেয়ে হলে আজো শাঁখ বাজে না। কেন? আমার কাছের মানুষ রাও যখন বলে করতে নেই, বাজাতে নেই তখন আমার শরীরে টাল লাগে। মেয়ে হলে মুখে ভাত নাকি নম নম করে, মেয়ের মুখে ভাতে পুরুত ডাকে না, ওই তিন পুরুষ কে জল দেবার কোনো খেলা নেই। এসব কি? আমাদের তৈরি নিয়ম। মেয়ে হলে এসব করতে নেই। আমরা মায়েরা মেনে নিয়েছি এ নিয়ম। আশ্চর্য। আমরা বংশধর খুঁজি। ছেলে হলে আনন্দ করি।
জন্মানোর গল্প গেল, মেয়ে বড় হল তাকে সহবত শেখাই। ছেলের বেলায় বলি না ভালো করে বোস, পা ঢেকে রাখ, মেয়েকে বলি। চেঁচিয়ে কথা বলবে না মেয়েকে শেখাই। এরপর তাকে পুজোপাঠ শেখাই, শেখাই একের পর এক উপোস। শিবের উপোস মেয়েরা করতে ওস্তাদ, ক জন মেয়ে জানে শিব আসলে কি? সব পুরুষ রাজ। সিঁদুর কি কজন জানে? চুড়ি কেন পরতে হয় কজন জানে? এসব আমরা ভ্যাক্সিন দেবার মত জানিয়ে দিই মেয়েদের বড় হতে হতে। জানাবার আড়ালে কত অজানা থেকে যায়, ভুল থেকে যায়। বাইরে বেরুলে মেয়েটার বদনাম হতে পারে। ছেলেকে কজন শেখায় তোদেরও বদনাম হতে পারে। হাফ প্যান্ট, লু্ংগি, খালি গায়ে একটা ছেলে থাকতে পারে। একটা মেয়ে নয়। এইভাবে ভাগ করে ফেলি দুটো লাইন। মানুষ হিসেবে না, আমরা ছেলে মেয়ে হিসেবে বড় হই। বড় হতে গিয়ে আসে আমাদের ধারণ করার জিনিস। আমি হিন্দু আমি বাঙালি আমি পাঞ্জাবি আমি মারাঠি আমি মুসলিম আমি দলিত আমি কুর্মি এমন কত কত গোল গোল চাকা আমাদের গলায় ঝোলানো। আমরা সেইসব ট্যাগ লাগিয়ে ঘুরতে শিখি। আমাদের ছোটবেলায় খাটা পায়খানা দেখতাম। আর সেই পায়খানার মাল বোঝাই করে কিছু লোক মাথায় করে নিয়ে যেত, তাদের দেখলে এমনিই ঘেন্না লাগত। সমাজ বিজ্ঞানের পাতায় এরাই ঝাড়ুদার, আমাদের বন্ধু এও শিখতে হয় আমাদের। পুরোহিত পুজো করে, কুর্মি ছুতোর চাষী এরকম কত জীবন আমরা বইয়ের পাতায় শিখি। তারপর তাদের জীবনের প্রয়োজনে চিনতে শিখি। আম্বেদকর কে জানি কিন্তু তাঁর স্ট্রাগল কজন জানি? ব্রাহ্মণ মানে উচ্চবর্ণ, পুজো করে ওরা, ঠাকুরের সাথে ডায়রেক্ট কন্টাক্টে ওরাই। ফসল ফলাচ্ছে চাষীরা। এরকম সমাজে নানা আগল নানা বৃত্ত।
পদবীতে বাঁধা আমরা। কাগজে আজো বিয়ের বিজ্ঞাপন, রাশি মেলানো বিয়ে, জাত মেলানো বিয়ে কত কি চলে। আমরা সব মেনে নিয়েছি। সবার কথা ছেড়ে নিজের চেনা গন্ডিটাই বলি।
আমি বামুনের ঘরের মেয়ে। শুধু এই বলে আমার গব্বের শেষ নেই। আজো যারা বামুন তারা জানে কি ফেসিলিটি পেয়ে বড় হলাম আমরা। একটা উচ্চ বর্ণ। তোমায় দেখতে ভালো হবে, তোমার পরিবার পড়া লেখা জানে তাই তোমার সেই স্ট্রাগল নেই তুমি প্রথম সেই প্রজন্ম নও যে শিক্ষা পাচ্ছে, তুমি পুজো পাঠের বাতাবরণে বড় হবে। তুমি ধর্ম কি জানো। পাপ কি পুণ্য কি সব জানো। তুমি শুচি অশুচি জানো। জানো অনেক মন্ত্র, পুজো পাঠ। যেখানে যাবে চ্যাটার্জি ব্যানার্জি বলে সম্মান পাবে। বামুনদের আবার ছোট পৈতে বড় পৈতে আছে, যারা চালকলা বেঁধে পুজো করে বেড়ায় তাদের আসন অতটা উপরে নয়। এরকম অনেক কিছু আছে। তোমার দেখা সমাজ তোমায় বলে দেবে ও সরকার, ও মন্ডল,ও মিত্র এদের দল তোমার দল এক নয়। তুমি ওদের একটু হলেও তাচ্ছিল্য করতে শিখবেই। অসবর্ণ বিয়ে চলবে না। চললে তোমার সমাজে পদস্খলন হল। বামুন বলে নিজেকে ঘেন্না করেছিলাম সেদিন যেদিন নতুন বিয়ের পর বাপের বাড়ি এসে জেনেছিলাম আমার বিয়েতে যিনি পুরোহিত ছিলেন তিনি যখন জানেন এই বিয়ে বামুন কায়েতের সে নাকি বলেছিল এ বিয়ে সে দিতে পারবে না। সেই মুহূর্তে খুব বড় টানাপোড়েনে বাবা ভাইকে পড়তে হয়। আমি শুনে থ। আমার ভাই নাকি সেই পুরোহিতকে এক হাত নিতে গেছিল। আমাদের পৈতে হয়। তাও শুধু ছেলেদের। এরকম কত নিয়ম সমাজে। আমরা কতটুকু জানি?
আমার জীবনের আরেক মজা আমার শ্বশুর বাড়ির টাইটেল। এরা আসলে মিত্র মুস্তাফি। কিন্তু মুস্তাফিটাই লিখতে অভ্যস্ত। এবার এই মুস্তাফি শুনে লোকে আগে আমার হাতের দিকে তাকায়, সিঁথিতে তাকায়। অনেকে এক সময় এসে জল খাবে কিনা ভাবত। ছেলের হিন্দি ম্যাম একবার বলেন, আপনাদের তো সুবিধা আছে, উর্দু দিয়ে হিন্দি পড়াতে পারবেন। আমি ভাবি বোঝো কান্ড। টনক আবার নড়ল, মেয়ের টেন বোর্ডের ফর্ম ফিলাপের দিন। ওকে স্কুল থেকে বলে, তোমার রিলিজিয়ন কি জেনে আসবে। আমি শেখাইনি। স্কুল কনফিউজড, এই পদবী, মুসলিমও হতে পারে। সেদিন মেয়ে রিলিজিয়ন জানতে পারে। আমার দেখার চোখ আমায় পুজো করার উপকার ভুলিয়ে দিয়েছিল সেই বিয়ের পুরোহিত কেসে। আমি অন্য সার্কেলে এসে অনুভব করতে লাগি সব বাড়ির আলাদা নিয়ম। এসব আমরা তৈরি করি। আমার বাড়ি যদি বৃহস্পতিবার মানে আমার শ্বশুরবাড়ি শনিবার মানে। ঠাকুরে ঠাকুরে অন্তর আছে। এসব বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস পড়তে গিয়ে জানি। চণ্ডী, মনসা এসব দেবতার পুজো কি করে একটু একটু করে ঢুকলো, আমাদের সময় সন্তোষী মা, আস্তে আস্তে বাজারে লোকনাথ বাবা, শনি দেবতা, হনুমানজী কত কি উঠলো।
এভাবে সমাজটা অনেক গোল গোল বৃত্তে গড়া। বাংলা ছেড়ে আমি এসে পড়লাম ঝাড়খন্ডের ধানবাদ কয়লাঞ্চলে। আমার দেখার জগত আজো কোথায় পড়ে কি বলি আর। এখানে সমাজে অসংখ্য এই গোল গোল বৃত্ত। এডুকেশন কি সেটা বুঝছি খুব। শিক্ষাটা মর্মে থাকতে হবে। ট্র্যাডিশন বজায় রাখছি বলে আজো এখানে দহেজের রমরমা। জাত পাত বর্ণ বৈষম্য খুব বড় শেকড় বাকড় গজিয়ে বসেছে এখানে। অদ্ভুত সব সংস্কার মানা হয়। কেউ রাজপুত কেউ ভূমিহার কেউ কুর্মি এখানে এই টাইপ শ্রেণী বিভেদ খুব কমন। তাদের নিজের নিজের প্রতিপত্তি এসব খুব কাছ থেকে দেখছি। জাতের লড়াই এখানের বড় বালাই। নীচু জাতের এখানে মরণের শেষ নেই। এদের উপর মিহাজনদের শোষণ দেখা যায় না। আজো এদের চোখে ঠুলি পরানো আছে। কেন্দ্র আর রাজ্য দুই সরকার তাদের নিয়ে ভোটের লড়াই খেলছে। তাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত। বাইরে থেকে আসা আমাদের মত পরিবারগুলো সবাই নিজের আখের গোছাতে ব্যস্ত। শোষণের রাজনীতি এখানে চরম।অশিক্ষা এখানে কি করে মানুষের সর্বনাশ করছে সে একটু চোখ থাকলেই দেখা যায়।
আরো কিছু চেনা গন্ডীর গল্প। মেয়েরা নিজের পায়ে দাঁড়াক এ মানসিকতা আমাদের তেমন করে তৈরি হয়নি। আমরা একটা মেয়েকে বিয়ে দিতে পারলে বেশি খুশি হই সে চাকরি পাবার থেকে। বরের মেরে খেতে আমরা মেয়েরা ভালোবাসি। হ্যাঁ মেরে খাওয়া, রূঢ় হলেও সত্যি। আজ নিজের পেট নিজে চালানোর দায় থাকলেই আমরা অনেকটা বলিষ্ঠ হব। আমরা উল্টে কি করছি, আরো নির্ভরশীল হই আমাদের তথাকথিত হাজব্যান্ডের উপর। ছোটতে বাবার টাকা, তারপর বরের টাকা তারপর ছেলের এটা আমরা বেশ উপভোগ করি। এইসব চেনা ঘেরাটোপে আমরা বন্দী। আমি একবার একটা স্কুলে জয়েন করি। আমার ভাই বলেছিল, শুধু শুধু একজনের অন্ন মারছিস। আমার নাকি চাকরি করার দরকার নেই। কারণ আমার আর্থিক স্বচ্ছলতা আছে। এই মানসিকতা কি ভয়ংকর। আজ সোশাল নেটওয়ার্ক এ আস্ফালন করে কি হবে অনেকেই বলেন। হবে, অনেক কিছুই হবে। আপনারা যখন ন্যুড ভিডিও মেয়েদের নিয়ে খিল্লি করে এঞ্জয় করতে পারেন ঘরে মেয়ে বৌ মা সব থাকাতেও তাহলে আমরাও নিজের মত শেয়ার করে অনেককে জাগাতে পারি, পারবো। সরকারের গদি টলিয়ে দিতে পারি এক হয়ে। একটা ভোটও যদি মেয়েরা না দেয় এই সরকার কে তাহলেই খেলা শেষ। সব আস্ফালন ঘুচবে।
অনেক প্রশ্ন চারদিকে, এই ধর্ষিতার পরিবারকে সরকার আর্থিক সাহায্য দিয়ে মুখ বন্ধ করায়, বিচার কোথায়, এসব কেসের ফাইল নড়ে না কেন - এসব নিয়ে পরে ভাবলেও চলবে। আগে নিজেদের শুদ্ধিকরণ দরকার। জেন্ডার বিয়াসড থেকে বেড়িয়ে আসতেই হবে। মানুষকে মানুষ হিসেবেই থাকতে হবে। পাশবিক আচরণ করলে তার স্থান খাঁচায়। জঙ্গলে। সমাজে নয়।
দু রাত ভালো করে ঘুমোই নি। খুব ব্যস্ত জীবন। তবু অনেক বার ওঠা বসা করে এই লেখা নামালাম। গাল দিতে মন হলে দিতেই পারেন। কিন্তু একটু ভেবে দেখবেন।