এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • বিলুপ্ত বন্দর

    nirmalya das লেখকের গ্রাহক হোন
    ০৩ অক্টোবর ২০২০ | ৮৬১ বার পঠিত
  • (প্রথম)

    শৌন্ডিকালয় বিষ্ণুগৃহে শান্তি নাই। তাহার প্রস্তর নির্মিত রাজপথ। ইষ্টক দ্বারা প্রস্তুত গলিগুলির দুইপাশের দ্বিভূমক-বহুভূমক অট্টালিকাগুলিতে এই ঘনায়মান সন্ধ্যাকালেও দীপ জ্বলে নাই। প্রবীণ নাগরিকরা অবশ্য তাহাদের সান্ধ্য মজলিশে এক-দুইজন করিয়া আসিয়াছেন। তাঁহারা অবশ্য আধুনিক তরুণ-তরুণীদের ন্যায় এ মৃতপ্রায় নগরীটিকে প্রাকৃত উচ্চারণে বিষ্ণুগৃহ বলিতে কুন্ঠা বোধ করেন। তাঁহাদের নিকট এখনও এ নগরী প্রাচীন পরমভট্টারক দিগ্বিজয়ী সম্রাট তাম্রধ্বজ প্রতিষ্ঠিত তাম্রলিপ্ত। মহারাজ তাম্রধ্বজের নাম অবশ্য এখন কেবল জনশ্রুতি। এ বিশ্বে কোন কিছুই স্থির নহে। সকলি পরিবর্তনশীল। প্রত্যহ সূর্যোদয়ের সহিত বিগত রাত্রি অতীতে চলিয়া যায়। দেখিতে দেখিতে ঋতু বদলাইয়া যায়। নববর্ষার প্রারম্ভে রাজপথ পার্শ্বস্থ কদম্ব কাননে শত কদম্বের উচ্ছাস মুছিয়া যায় শরৎ সন্ধ্যার সপ্তপর্ণীর আমোদিত সুগন্ধে। বৎসর গত হয়। শতাব্দী সমাপ্ত হয়। মহাপরাক্রান্ত তাম্রধ্বজ আজ আট শতাব্দীর পরপারে বসিয়া তাঁহার প্রতিষ্ঠিত নব রাজধানী তাম্রলিপ্তের অবশ্যম্ভাবী মৃত্যু দেখিয়া নিশ্চিত দীর্ঘশ্বাস ফেলিতেছেন।

    শৌন্ডিকালয়ের নিভু নিভু দীপালোকে বসিয়া চারি-পাঁচজন বৃদ্ধ খেদোক্তি করিতেছেন। ইঁহারা সকলেই সম্পন্ন গৃহস্থ। দুইজন প্রাক্তন তৌলিক। এক বৃদ্ধ রাজকর্মচারী। অন্য দুইজনের একজন কার্পাস ব্যবসায়ী ও শেষোক্তজন অবসর প্রাপ্ত নাবিক শ্রীলোচন। তাহাদের আলোচনার মূল বিষয় অতএব বাণিজ্য ও সমুদ্র। সুরাপূর্ণ মৃৎভান্ডে একটি চুমুক দিয়া বৃদ্ধ শ্রীলোচন বলিলেন -- "দেখো ভাই! সারাটা জীবন সমুদ্রের উপরেই তো কাটালাম। শ্যাম-কম্বোজ-শ্রীবিজয়-লঙ্কা-তাম্রলিঙ্গ-হরিপুঞ্জ-চম্পা-তুমাসিক এমনকী পুবে মহাচীন আর পশ্চিমে লঙ্কার ওপারে হাজার যোজন পার করে যবনদের আব্বাস রাজাদের আড্ডা অব্দি ঘুরেছি। কিন্তু কস্মিনকালেও কোন ভিনদেশী নাবিকের মুখেও শুনিনি যে সমুদ্র দিন কে দিন পিছিয়ে যায় - এ'কী অনাসৃষ্টি! ঠাকুদ্দার আমলে নাকি এই তাম্রলিপ্তের প্রান্তে মহাসমুদ্র দিবারাত্রি ঢেউয়ে ঢেউয়ে ভেঙে পরতো। নগরবাসীর কানে সে ঢেউয়ের শব্দ সুধাবর্ষন করতো। আর আজ তাম্রলিপ্ত থেকে সমুদ্র কয়েক যোজন পিছনে হঠে গেছে। এখনও প্রাচীন খাতে কিছুটা জল আছে তাই দুচারটি বহিত্র বন্দর থেকে গতায়াত করছে। কিন্তু এ আর ক'দিন! আজ থেকে শতবর্ষ পরে মানুষ বোধহয় তাম্রলিপ্ত বন্দরের নামও ভুলে যাবে। নগর ছেড়ে মানুষজনওতো চলে যাচ্ছে। তাম্রলিপ্তের শ্রেষ্ঠ নাবিকেরা শুনছি চোল রাজাদের আশ্রয়ে উঠে যাচ্ছে। বণিকরাও পাট গোটাচ্ছে। তোমরা তৌলিকরাতো ব্যবসা একরকম বন্ধই করে দিয়েছো। আর দেখো এ শৌন্ডিকালয়েতো আমরা যৌবন থেকে গতায়াত করছি। এরই কতো রমরমা ছিল। শত দীপের প্রভায় মধ্যরাত্রিও দিনের মতো আলোকিত থাকতো। রজতপাত্র--স্বর্ণপাত্রে শ্রেষ্ঠ মাধ্বী পান করতাম। এখন মৃৎভান্ডে একটা দুর্গন্ধময় গরল।"

    বাকী বৃদ্ধেরা শ্রীলোচনের কথায় দীর্ঘশ্বাস মোচন করিতেছিলেন। বৃদ্ধ সুদত্ত কার্পাস ব্যবসায়ী। তাহার শৌন্ডিকালয়ের বান্ধবদের না জানাইয়া সে আজ মাস দুয়েক ধরিয়া তাহার ব্যবসা গুটাইয়া লইতেছে। কাজটি তাহাকে একান্ত গোপনে সারিতে হইতেছে। তাম্রলিপ্ত রাজ মহাসামন্ত রণশূরের কর্ণে এ সংবাদ পৌঁছিলে তিনি জোরজুলুম করিয়া সুদত্তকে আটকাইবেন। সুদত্ত শ্রেষ্ঠী তাম্রলিপ্তের শেষ দুই-চারিজন বৃহৎ শ্রেষ্ঠীর অন্যতম। তাঁহারা আজ আট-দশ পুরুষ ধরিয়া এ নগরীর বাসিন্দা। তাম্রলিপ্তের স্বর্ণযুগে কোশাম্বী, পাটলিপুত্র, পৌন্ড্রবর্দ্ধন, গৌড় এমনকী সুদুর প্রাগ্-জ্যোতিষ হইতে প্রতিদিন শত শত সার্থবাহ নগরে আসিত। সুক্ষ্ম শুভ্র দুকুল -- কার্পাস বস্ত্র -- রেশম বস্ত্র -- আরক সুগন্ধীতে ভরে উঠতো পোত। এমনকী অশ্ব পর্যন্ত। সেসকল বিদেশের বন্দরে পৌঁছিবামাত্র বণিকদল পোতকে প্রায় ঘিরিয়া ফেলিত। স্বর্ণমূল্যে বিকিয়া যাইত সব সামগ্রী।

    তাম্রলিপ্ত আমদানী করিত কেবল স্বর্ণ। অবশ্য ফিরিবার সময় লঙ্কা হইতে শ্রেষ্ঠ মুক্তা আনা হইতো। আজ বন্দর প্রায় মৃত। মহান পাল সাম্রাজ্য হতমান। পরম সৌগত সম্রাট ধর্মপালের ত্রয়োদশ-চতর্দশ উত্তর পুরুষরা কোনক্রমে মগধ-পৌন্ড্র-বঙ্গ এর রাজদন্ড দুর্বল হস্তে ধারন করিয়াছেন। দক্ষিণ হইতে চোল শক্তি , নর্মদা তীর হইতে কলচুরী রাজ রণহুঙ্কারে মেদিনী প্রকম্পিত করিতেছেন। অপরদিকে ভারতভূমের পশ্চিমাকাশে বহ্নিছটা। ভয়ংকর যবন বারংবার বিধ্বস্ত করিতেছে পশ্চিম সীমান্ত। সুদত্ত শ্রেষ্ঠী সমস্ত সংবাদ রাখিয়া থাকেন। ব্যবসায়ীকে সংবাদ রাখিতে হয়। রাষ্ট্র বিনষ্ট হইবার পূর্বে সরিয়া পড়িতে না পারিলে রাজগৃহের পূর্বেই লুন্ঠিত হয় শ্রেষ্ঠীগৃহ। পশ্চিমে সুপ্রাচীন সোমনাথ মন্দির যবন সুলতান লুন্ঠন করিয়া বিনষ্ট করিবার সময় সুদত্তের জন্ম হয় নাই। তখন তাহার পিতামহের পিতার কাল। তিনি অশনী সংকেত পড়িতে পারিতেন। তিনিই প্রথম সমুদ্রপারে সুমাত্রায় শাখা প্রতিষ্ঠা করেন। পিতামহ ও পিতা সে শাখা পরিচালনা করিলেও তাম্রলিপ্তই ছিল তাঁহাদের কেন্দ্র। তাঁহারা তাম্রলিপ্ত ছাড়িয়া যাইবার চিন্তা মনে স্থান দেন নাই। সুদত্ত দিয়াছেন। তিনি তাঁহার সম্পদ একটু একটু করিয়া শ্রীবিজয় ও চম্পায় পাঠাইয়া দিয়াছেন। শ্রীবিজয় বর্ধিষ্ণু শৈলেন্দ্র সম্রাটদের রাজধানী। তবু শ্রীবিজয় হইতে চম্পা তাঁহার মনে ধরিয়াছে বেশী। একমাত্র পুত্রকে পুত্রবধূ সমেত পাঠাইয়া দিয়াছেন। আগামী পূর্ণিমার পূর্ণ জোয়ারে তাম্রলিপ্তের শুষ্ক খাত পুনর্যৌবনা হইবে। তিনি একটি বৃহৎ বহিত্র বোঝাই করিতেছেন। রাজা রণশূরকে জানাইয়াছেন তিনি সমুদ্র বাণিজ্যে লঙ্কা যাত্রা করিতেছেন। রাজা বাধা দেন নাই। উপরন্তু কয়েকটি শ্রেষ্ঠ মুক্তা সংগ্রহের অনুরোধ করিয়াছেন। সে মুক্তা বোধহয় উপঢৌকন পাঠাইবেন মহারাজ মহীপালদেবের দরবারে। সুদত্তের গৃহে এখন তাঁহার প্রাচীনা গৃহিনী ভিন্ন আর আত্মজন কেহ নাই। গৃহিনীকে লইয়াই সমুদ্রযাত্রা করিবেন। এদিককার অবশিষ্ট ব্যবসা কোনক্রমে চালাইবে পুরানা কর্মচারী পঞ্চানন। তিনি লঙ্কার পরিবর্তে ভাসিয়া যাইবেন চম্পার পানে। আর ফিরিবেন না। এ পুরাতন নগরে এ প্রাচীন বন্ধুবর্গ সমভ্যিবাহারে বহুকালের শৌন্ডিকালয়ে সুরাপানের সুখ আর মাত্র কয়দিন। তাঁহার হৃদয় সিক্ত হয়। কিন্তু তিনি বণিক। আপন হৃদয়াবেগের প্রতিক্রিয়া তাঁহার একটি বলিরেখাতেও কুঞ্চন ফেলে না। তাঁহার চিন্তাসূত্র ছিন্ন হইল। শ্রীলোচন কম্বুকন্ঠে হাঁক পাড়িয়াছেন--- 'চম্পক'!

    চম্পক এ শৌন্ডিকালয়ের মালিক। সেও বয়োবৃদ্ধ। পূর্বে তাহার শৌন্ডিকালয় গমগম্ করিত দেশী-বিদেশী বণিক আর নাবিকে। ভুগর্ভস্থ কক্ষে ভান্ডে ভান্ডে সঞ্চিত থাকিত শ্রেষ্ঠ সুরা। দশ-বিশ জন সুন্দরী দাসী সুদৃশ্য ভৃঙ্গারে সুরা তুলিয়া দিত গ্রাহকের হস্তে। চকিত চাহনী , মৃদু হাস্য , লঘু চাপল্য গ্রাহককে মোহগ্রস্ত করিত। মুহুর্মুহু হাঁক পড়িত সুরার জন্য। শৌন্ডিকালয়ে দুই-চারিটি বাসকক্ষের ব্যবস্থাও ছিল। বিদেশী বণিক কী নাবিক সুরা রসিকার প্রেমে নিশিযাপন করিত। সে সব দিন কবে গত হইয়াছে। বণিককুল আর নাবিক দলের সহিত ভৃঙ্গার সুন্দরীর দলও অন্তর্হিত হইয়াছে। চম্পক কক্ষের বাহিরে একটি উচ্চ পীঠে বসিয়া ঢুলিতেছিল। শ্রীলোচনের হাঁকে তাহার তন্দ্রা ছুটিয়া গেল। কিঞ্চিৎ বিরক্তও হইল। এখন তাহার শৌন্ডিকালয়ের একমাত্র কর্মচারী এক চতুর্দশ বর্ষীয় বালক। সে চপল বালক কখন যে কোথায় অন্তর্হিত হয়। এ'বৃদ্ধ কয়টি তাহার বহুকালের গ্রাহক। কিন্তু মহাকৃপণ। ঐ সুদত্ত শ্রেষ্ঠীর স্বর্ণের লেখাজোখা নাই অথচ শৌন্ডিকালয়ে দুই পয়সা উড়াইবার লোক নহে। এখন সে বালক আশেপাশে নাই। অতএব চম্পককেই উহাদের তর্জনগর্জন শুনিতে হইবে।

    সে কক্ষের দ্বারে আসিয়া দাঁড়াইল। বিনীত কন্ঠে শুধাইল -- আমায় ডাকছিলেন কর্ত্তা!
    শ্রীলোচন আবার গর্জন করিয়া উঠিলেন -- এটা কী সুরা নাকি পাঁচন! কোন ভালো সুরাও কী রাখোনা নাকি!
    চম্পক এক পুরুষে শৌন্ডিক নহে। এ তাহার পারিবারিক ব্যবসা। সে বিনয়ের সাথেই বলিল -- ভালো সুরা স্বর্ণমুদ্রায় ক্রয় করিতে হয় কর্ত্তা। এখন কী আর সেসব দিন আছে! এখন কড়ির যুগ।
    --- তা আমরা কী স্বর্ণ দিতে অপারগ মনে করো!
    শ্রীলোচন আজ সত্যই খেপিয়াছে। বিনয়াবতার চম্পক বলিল -- ছি ছি কর্ত্তা! ও'কী কথা! আপনারা তাম্রলিপ্তের শ্রেষ্ঠ সন্তান। কিন্তু কর্ত্তা আপনারা ভিন্ন গত এক পক্ষকালে অন্য কোন গ্রাহক এ শৌন্ডিকালয়ে পদার্পণ করেননি। তবে দামী সুরা কষ্ট করে সঞ্চয় করে কী ব্যবসা করব বিচার করুন। মহামান্য সুদত্ত শ্রেষ্ঠী মহাশয়কে জিজ্ঞাসা করুন ব্যবসার অবস্থা।

    সুদত্ত বাধ্য হইয়া শ্রীলোচনকে থামাইলেন -- শ্রীলোচন! চম্পক ঠিক কথাই বলেছে। এ তাম্রলিপ্তে আর ব্যবসা করা সম্ভব নয়। চম্পক শ্রেষ্ঠ সুরা সংগ্রহ করে বেচবে কাকে! আমরা ক'জন বৃদ্ধ কতটুকু সুরা পান করতে পারি। তবে কথা দিচ্ছি আমি তোমাদের শ্রেষ্ঠ সুরা পান করাবো।
    -- চম্পক!
    চম্পক দ্রুত পদক্ষেপে শ্রেষ্ঠীর পার্শ্বে আসিল। সুদত্ত শ্রেষ্ঠী কোমরবন্ধের অভ্যন্তর হইতে একটি মৃগচর্মের স্থলী বাহির করিলেন। তাহা হইতে গণিয়া গণিয়া দশটি স্বর্ণমুদ্রা বাহির করিয়া চম্পককে প্রদান করিলেন --- এই স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে শ্রেষ্ঠ সুরা ক্রয় করো। আগামী পূর্ণিমায় আমি সমুদ্রযাত্রা করছি। ততদিন আমার বান্ধবদের আমি শ্রেষ্ঠ মাধ্বী পান করাতে চাই। যাও।

    চম্পক বহুকাল পর স্বর্ণমুদ্রা স্পর্শ করিয়া বিহ্বল হইয়া পড়িয়াছিল। সে আভূমি নত হইয়া বিদায় লইল।

    শ্রীলোচন বিস্ময়ে স্তব্ধবাক হইয়া পড়িয়াছিলেন। চম্পক চম্পট দিলে তিনি প্রশ্ন করিলেন -- এ কোন দেশের স্বর্ণমুদ্রা! মহারাজ মহীপালদেব কী স্বর্ণমুদ্রা প্রস্তুত করছেন!

    -- না বন্ধু! এ স্বর্ণমুদ্রা বিদেশী। এ হল শ্রী বিজয়ের সম্রাট সংগ্রাম বিজয়তুঙ্গবর্মনের। চলো আজ উঠি। রাত অধিক হলে গৃহিনী ভৎসর্না করবেন।

    সকলে মৃদু হাস্যে গাত্রোত্থান করিলেন। শৌন্ডিকালয়ের বাহিরে আসিয়া যে যাহার পথ ধরিলেন। শ্রীলোচন ও সুদত্তের গৃহ একই দিকে। তাঁহারা একসাথে চলিলেন। শৌন্ডিকালয়টি একটি অপ্রশস্ত গলির প্রান্তে। দুই পার্শ্বে ঠাসাঠাসি করিয়া উঠিয়াছে বহু অট্টালিকা। তাহার মধ্যে অধিকাংশই তমিস্রাচ্ছন্ন। নতুবা কোন কোন কক্ষে মৃদু দীপালোক। এ অঞ্চলটি পোতাশ্রয়ের নিকট। তাম্রলিপ্তের এ গলিটি শৌন্ডিকালয় ও জনপদবধূদের আস্তানা স্থল হিসাবেই খ্যাত ছিল। রাত্রিতে এ স্থল পূর্বে গমগম করিত। প্রতিটি অট্টালিকার দুয়ারের নিকট সুসজ্জিতা দাসী। মালাকার, সুগন্ধী বিক্রেতাদের দৌরাত্ম্য চলিত গ্রাহককুল লইয়া। নুপূর নিক্কনে -- কলহাস্যধ্বনিতে -- চপল সংগীতে মুখরিত রাত্রিযাপন করিত তাম্রলিপ্ত। এখন শূন্যপ্রায় গলি। দুই-চারিটি অট্টালিকার সম্মুখে অন্ধকারে মিশিয়া এক-দুইজন গণিকা গ্রাহকের প্রত্যাশায় রাত্রি জাগিতেছে। ইহারা এই দুই বৃদ্ধকে বিলক্ষণ জানিত। দুই বৃদ্ধ সম্মুখ দিয়া চলিয়া যাইলেও কেহ আগ্রহ দেখাইল না।

    শ্রীলোচন বলিলেন -- নাহে সুদত্ত! সত্যিই এ শহর মরে গেছে। শৌন্ডিকালয় আর গণিকালয় গ্রাহক শূন্য হলে সে নগর মৃত বলে গণ্য হয়।

    সুদত্ত একথা শুনিতে পাইলেন বলিয়া বোধ হইল না। তিনি চিন্তাকুল মুখে পথ চলিতেছিলেন। হঠাৎ বলিলেন -- শ্রীলোচন! তুমি বৃদ্ধ , তোমার সাতকুলে কেউ নেই। তুমি আমার সাথে সমুদ্রযাত্রায় চলো।

    শ্রীলোচন তরল হাস্যে কহিলেন -- আমার আপত্তি নাই। কিন্তু নাবিক আর অশ্ব বৃদ্ধ হইলে অকর্মণ্য। তোমার অন্ন ধ্বংস করা ছাড়া আর কিছু আমার দ্বারা হবে না।

    সুদত্ত মৃদু কণ্ঠে বলিলেন -- অশ্বের শক্তি তাহার গতিতে কিন্তু নাবিকের তো তার অভিজ্ঞতায়। যুগের পর যুগ ধরে ভারতভূমের শ্রেষ্ঠ নাবিক তাম্রলিপ্তের সন্তানরা। কিন্তু এখন চিত্র বদলেছে। তাম্রলিপ্তের নাবিককূলের বেশীরভাগ গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন চোল রাজ্যে। দাক্ষিণাত্য তাদের কাছে শিক্ষা পাচ্ছে নৌনির্মান বা চালনার। চোল রাজাদের অর্ণবপোত সমুদ্র ছেয়ে ফেলেছে। তাদের সাথে জোর টক্কর চলছে শ্রীবিজয়ের। অথচ কত শতাব্দী ধরে এ সমুদ্রকে শাসন করেছে আমাদের তাম্রলিপ্ত।

    শ্রীলোচন বন্ধুর বক্তব্যে সহমত পোষন করিয়া বলিলেন -- তা ঠিকই বলেছ। আমার কাছেও ডাক এসেছিল চোল রাজাদের। কিন্তু এ বৃদ্ধ বয়সে আর প্রবাসে যাওয়া পোষাবে না। আমি আজ প্রকৃতই বৃদ্ধ।

    -- তুমি বৃদ্ধ বলেই তো অনুরোধ করছি বন্ধু। শ্রীবিজয়--কম্বোজ -- হরিপুঞ্জ --চম্পা -- তুমাসিক এ অত্যন্ত জটিল জলপথ। আমিও তো গেছি বাণিজ্যে। এ পথ তোমার হাতের তালুর মত চেনা। তুমি তাম্রলিপ্তের শ্রেষ্ঠ নাবিক। আমি তোমার সাহায্য ভিক্ষা করছি বন্ধু। তুমি আমার পোতাধ্যক্ষ হও।

    শ্রীলোচন হতবাক হইয়া গেলেন। কোনক্রমে প্রশ্ন করিলেন -- কিন্তু তুমি তো চলেছো লঙ্কা। সেতো উল্টোপথ আর একেবারে সিধে। শ্রীবিজয় -- কম্বোজ -- চম্পা এসব কেন বলছো! তোমার পরিকল্পনা আমায় বিশ্বাস করে বলতে পারো।

    সুদত্ত শ্রেষ্ঠী মানবমন বুঝিতে সক্ষম। তিনি শ্রীলোচনকে বিলক্ষণ চিনেন। এ ব্যক্তি ভরসাযোগ্য। তিনি আপন পরিকল্পনার কথা বিস্তারিত জানাইলেন।

    প্রাজ্ঞ নাবিক শ্রীলোচন স্তব্ধ হইয়া শুনিলেন। তাম্রলিপ্তের শ্রেষ্ঠ শ্রেষ্ঠীর দেশত্যাগ করিবার পরিকল্পনা। অতঃপর ধীর কন্ঠে বলিলেন -- ও অঞ্চল আমার অতি পরিচিত। সাধারন অর্ণবপোত কম্বোজ - চম্পা ঘুরে সিধে উত্তরে চলে যায় মহাচীনের উদ্দেশ্যে। কিন্তু আমি জানি দক্ষিণের পথ। কম্বোজের দক্ষিণে আর পূবে অজস্র দ্বীপমালা। অসংখ্য ডুবোপাহাড়। সেসব দ্বীপেও মনুষ্যের বাস আছে। তবে তারা তেমন সভ্য নয় অবশ্য হিংস্রও নয়। সহজ সরল। সেসব দ্বীপের খবর তোমার চোল কী শৈলেন্দ্র কেউই খুব একটা রাখে না। অথচ ওরকম একটি ক্ষুদ্র দ্বীপে আমি বহুকাল আগে দেখা পেয়েছিলাম এক আশ্চর্য জাতির। তারাও বণিক। তাদের ভাষা বুঝিনি। তবে বুঝেছিলাম তারা এসেছে বহুদূরের পশ্চিমের সমুদ্র পেরিয়ে। তাদের পোতগুলিও অদ্ভূত আকৃতির। একেবারে গোল গামলার মতো। তাদের সাথে বাণিজ্য করা খুব লাভজনক। সেবার আমার সামগ্রী প্রায় নিঃশেষিত। মাত্র কয়টি রেশমবস্ত্র পড়েছিল। তাই দিলাম। তার বদলে তারা আমায় দিল ভারী ভারী স্বর্ণমুদ্রা। অমন মুদ্রা আমি কোনদিন দেখিনি। সেসব সোনা কবে বেচে দিয়েছি। কেবল একটি আমার কন্ঠহারে গ্রথিত আছে। এই দ্যাখো!

    শ্রীলোচন তাহার বক্ষের বস্ত্র সরাইলেন। কন্ঠহারে একটি গোলাকার কুন্ডল। একটি গৃহের দোরের মৃদু আলোকে সুদত্ত শ্রেষ্ঠী বিস্ময়াপন্ন চক্ষে পর্যবেক্ষন করিলেন -- এক অদ্ভূত স্বর্ণমুদ্রা। এ স্বর্ণ গুণমানে অতুলনীয়। মুদ্রার উপর অপটু হস্তে সূর্যদেবের চিত্র অঙ্কিত।

    ----- তথাগতের জয় হোক্।

    দুই বৃদ্ধ চমকিয়া দেখিলেন তাঁহাদের পার্শ্বে এক অপরিচিত পথিক। শ্রীলোচন দ্রুত তাঁহার বক্ষাবরণ টানিয়া লইলেন। বলিলেন --

    -- তথাগতের জয়! কী অভিপ্রায়?
    -- পত্র আছে মহাশয়।
    -- পত্র! এক অজানা পথিক অন্ধকার পথিমধ্যে কাহার পত্র আনিল! দুই বৃদ্ধ বিস্মিত নয়নে পরস্পরের দিকে চাহিলেন। অতঃপর সুদত্ত কোনক্রমে প্রশ্ন করিলেন --
    -- কার পত্র!
    -- আমি বাহকমাত্র। পত্র গ্রহন করুন।

    দ্রুত সুদত্তের হস্তে পত্র অর্পণ করিয়া সে অজানা পথিক অন্ধকার পথিমধ্যে এক অট্টালিকার অন্তরালে অন্তর্হিত হইলেন। দুই বৃদ্ধ পথিমধ্যে বিমূঢ়ের ন্যায় ক্ষণিক দাঁড়াইয়া রহিলেন। তাহার পর ধীর পদক্ষেপে অগ্রসর হইলেন। কিঞ্চিৎ দূরে এক বৃহৎ অট্টালিকার বাহিরে উজ্জ্বল দীপ জ্বলিতে দেখিয়া দুই বান্ধব আপনাদের অনিসন্ধিৎসুতাকে আট্কাইতে পারিলেন না। শীল ভাঙিয়া লেফাফা খুলিয়া পত্রটি বাহির করিলেন। ক্ষুদ্র পত্র। সংস্কৃতে লিখিত --

    কালরাত্রির মধ্যযামে আপনারা রাজপূরীতে আতিথ্য গ্রহন করিবেন।

    নিম্নে স্বয়ং মহাসামন্তপতির স্বাক্ষর ও মুদ্রাচিহ্ন।

    ---- --- --- --- ---
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ক্যাবাত বা দুচ্ছাই মতামত দিন