২
সরকার, পুলিশ ও আদালত
গত ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহ, দিল্লি শহর দাঙ্গার আগুনে ঝলসে গেছে। মৃতের সংখ্যা তিরিশ ছুঁতে চলেছে।
দিল্লি হাইকোর্টের জাস্টিস মুরলীধর তিন বিজেপি নেতার –অনুরাগ ঠাকুর, পরবেশ বর্মা ও কপিল মিশ্রের –পুলিশ অফিসারের উপস্থিতিতে হিংসার উস্কানি দেওয়া বক্তৃতার ভিডিও দেখে পুলিশ বিভাগকে তিরস্কার করে নির্দেশ দিলেন কালকের মধ্যেই এদের বিরুদ্ধে এফ আই আর করতে হবে। সেই রাতেই ওঁর ট্রান্সফার হয়ে যায় পড়শি রাজ্যের হাইকোর্টে। নতুন বিচারক এসেই ওই রায় স্থগিত করে দিলেন। দাঙ্গায় মৃতের সংখ্যা ৫০ ছাড়িয়ে গেল।
প্রধানমন্ত্রীর স্নাতক ডিগ্রি ( দিল্লির ওপেন ইউনিভার্সিটি সিস্টেমের অন্তর্গত ১৯৭৮ সালে গুজরাত থেকে পাশ) নিয়ে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী কেজরিওয়াল এবং আরও কয়েকজন আর টি আই আইনের হিসেবে দরখাস্ত দিয়ে তথ্য জানতে চায়, রেকর্ড দেখতে চায়। দিল্লি ইউনিভার্সিটি সেইসময় প্রধানমন্ত্রীর সার্টিফিকেট অথেন্টিকেট করে দেয় কিন্তু বিস্তৃত তথ্য দিতে অস্বীকার করে। তৎকালীন মুখ্য আর টি আই কমিশনার ইউনিভার্সিটিকে ওই তথ্য দিতে এবং রেকর্ড দেখাতে আদেশ দেন। দিল্লি হাইকোর্টে.২০১৭ সাল থেকে কেস চলতে থাকে। ইউনিভার্সিটি পুরোপুরি অসহযোগ করতে থাকে। শেষে ২৫ জুলাই, ২০১৯ তারিখে দুপুর ২.১৫ সময় কোর্টে কেস ওঠে। ওই সময় সরকার রাজ্যসভায় আরটিআই আইনের সংশোধনী পেশ করে যাতে দেশের মুখ্য সুচনা অধিকারের কমিশনারের সাংবিধানিক মর্য্যাদা, তাঁর নিযুক্তি , কার্যকাল ( ২ বছর) এবং মাইনে ( চিফ ইলেকশন কমিশনারের সমমানের) বদলে সবকিছু কেন্দ্রীয় সরকারের ইচ্ছাধীন করে দেওয়া হয়।
এভাবে ১৪ বছর ধরে চলতে থাকা সূচনার অধিকার আইন ২০০৫ এর ধার ভোঁতা করে দেওয়া হয়।
উদাহরণগুলো দেখিয়ে এটাই বলতে চাইছি যে আজ আইনসভা, কার্যপালিকা এবং ন্যায়পালিকার মধ্যে আগের মত পাঁচিল তোলা নেই । সব আগল ভেঙে গিয়েছে। ফলে এখন রাষ্ট্র ও সরকার প্রায় সমার্থক। তাই সরকারের সমালোচনা মানেই রাষ্ট্রদ্রোহ। গত কয়েক বছরে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা বেড়ে চলেছে। এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ক্রাইম ব্যুরোর তথ্য নিয়ে পরে আলোচনা করব। আপাততঃ রাষ্ট্রের বদলে ‘সরকার’ শব্দটি অদল বদল করে ব্যবহার করব।
কল্যাণরাষ্ট্র বা ওয়েলফেয়ার স্টেট
মানুষের সার্বিক কল্যাণের ধারণা বহু প্রাচীন। আমরা বর্তমান লেখাটিতে আলোচনা করব কীভাবে এই আকাঙ্খা রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে এবং আজকে একজন ব্যক্তিমানুষ কোথায় দাঁড়িয়ে। তার জন্য আমরাসংক্ষেপে পর্যালোচনা করব আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার বিভিন্ন তত্ত্ব, যেমন ইউটেলিটেরিয়ানিজম (হিতবাদ), ইগলিটেরিয়ানিজম (সমতা), ক্যাপাবিলিটি ( সক্ষমতা) এবং জাস্টিস অ্যাজ ফেয়ারনেস তত্ত্ব (পক্ষপাতহীন ন্যায়ের ধারণা)।
না, আমরা কোন শেষ কথা বলার দুঃসাহস করব না । কিন্তু নেড়েচেড়ে দেখব হবস থেকে বেন্থাম-মিলের ইউটিলিটেরিয়ান, নজিকের কন্ট্রাক্টেরিয়ান লিবার্তেরিয়ান চিন্তা, জন রলসের ন্যায়পরায়ণতার তত্ত্ব, এবং মার্থা নুসবাম এবং অমর্ত্য সেনের ক্যাপাবিলিটির ও সমতার তত্ত্ব আর ফ্রাঞ্জ ফ্যাননের কলোনিয়াল অসাম্যের ইগলিটেরিয়ান তত্ত্ব। এবং সবকিছুকেই দেখব আজকের সমসাময়িক বিশ্বের প্রাসঙ্গিকতার সন্দর্ভে।তবে আমাদের দেখার অভিমুখ হবে তাতে কথিত সার্বিক কল্যাণের হাঁড়িকাঠে গলা বাড়িয়ে দেওয়া একজন নাগরিকের জন্যে কী বা কতটুকু সুরক্ষার বন্দোবস্ত রয়েছে।
বহুজন হিতায় বহুজন সুখায়
বিনয়পিটকে বলা হয়েছে প্রথম বর্ষাবাসের পর বুদ্ধ সারনাথে ভিক্ষুদের এই উপদেশ দিয়েছিলেন যে তাঁরা সর্বদা বহুজনের হিত এবং সুখের প্রতি নিবেদিত থাকবেন। এটি ভারতের বেতারকেন্দ্র আকাশবাণীর এমব্লেমে মটো হিসেবে মুদ্রিত রয়েছে।
একটা কথা ভাবাচ্ছে। বহুজন তো সর্বজন নয় । ‘বহুজন’ হল ‘সর্বজনে’র সাব-সেট।
যারা বাদ পড়ল তাদের কী বলব ? প্রান্তিক মানুষ। কারা প্রান্তিক? অস্ট্রেলিয়ায় যারা ভুমিপুত্র সেই মাওরি জনগোষ্ঠী, আমেরিকায় যাদের আধুনিক রাষ্ট্র ঝাড়েবংশে শেষ করে দিল—সেই রেড ইন্ডিয়ান, আর ভারতে উন্নয়নের ঠেলায় ভিটেমাটি ছাড়া হওয়া আদিবাসীরা—যারা গোটা দেশের জনসংখ্যার ৮% , অথচ তাদের ৮০%ই উচ্ছেদ হলেন বাপ-পিতামো’র জমিজিরেত থেকে। এটা কে বা কারা ঠিক করে? রাষ্ট্র মানে ক্ষমতায় থাকা সরকার। ইদানীং কালে লকডাউনের সময় পরিযায়ী শ্রমিকদের কথা আগেই বলেছি। লকডাউনের সময় ঘরবন্দী থাকার নির্ণয় তাদের কথা ভেবে তৈরি হয়েছে যাদের ঘর আছে। কিন্তু যাদের ঘর নেই? মাথার উপরে নিজস্ব ছাদ নেই? এই “আমরা-ওরা” বিভাজন কে ঠিক করে? রাষ্ট্র।
তবু আমাদের একটি রাষ্ট্র চাই—কেন চাই?
রাষ্ট্র কেন চাই?
ঈশ্বরের জায়গায় রাজা, তারপর এলো রাষ্ট্র। প্রাচীন জনগোষ্ঠীর পশুপালনের দিন থেকেই কি আমাদের অবচেতনে ভেড়ার পাল এবং একজন কালের রাখালের আবশ্যকতা অনুভূত হয়েছে? নইলে মানুষ বিপথগামী হবে? শুধু মোজেসের দশটি আদেশ বা ক্রিশ্চান থিওলজির মেষপালনের মেটাফরই নয়, ইসলাম এবং হিন্দু পুরাণকথাতেও রয়েছে বিপথগামীদের বুঝিয়ে সুজিয়ে ফিরিয়ে আনার নিদান , নইলে নরক বা দোজখে অনন্তকাল পচে মরার ভয়।
ভারতে রাজারা দেব বটেন, রাজবংশীয়দের অনেকেরই নামের পেছনে ‘দেব’ শব্দটি জুড়ে থাকে, যার সুবাদে বাঙালী শচীনদেবকে পেয়েছে। ব্রাহ্মণেরা ভূদেব, রাজারা নরদেব। কিন্তু এঁরা কেউই আইনের উর্দ্ধে ন’ন। স্মৃতিশাস্ত্রে এদের অপরাধের জন্যে দণ্ডবিধান নির্ধারিত রয়েছে। তবে রাজ বা সামন্ততন্ত্রে আইনের চোখে সবাই সমান নয় । একই অপরাধে মনু ব্রাহ্মণ , ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রের জন্যে আলাদা আলাদা শাস্তির বন্দোবস্ত করে গেছেন। মহাভারতের শান্তিপর্বে শরশয্যায় শায়িত ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে রাজার কুশাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহকে ন্যায়োচিত বলেছেন।
আধুনিক রিপাবলিক এবং নির্বাচিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও আইনের চোখে নাগরিকের সমান অধিকার –এসব ধারণা পাশ্চাত্ত্য সভ্যতার দান।
আধুনিক নেশন স্টেট
আগেই বলেছি আমাদের মত গড়পড়তা মানুষ ভাবে রাষ্ট্রের দায়িত্ব হল নাগরিকদের সুখ, শান্তি, সমৃদ্ধি প্রদান করা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের “স্বাধীনতার ঘোষণা”য় বলা হয়েছেঃ
সৃষ্টিলগ্ন থেকে সমস্ত মানুষ সমান। তাদের রয়েছে কিছু মৌলিক অধিকার—জীবন, স্বাতন্ত্র্য ও সুখের সন্ধানে যাওয়া। কোন সরকার এই অধিকারকে ধ্বংস করলে তাকে পালটে দেওয়া বা শেষ করে দেওয়ার অধিকার জনতার আছে। কেননা শাসক সরকারের ক্ষমতার উৎস হল শাসিতের সম্মতি।
আমেরিকার সংবিধানের ভূমিকায় (প্রিঅ্যাম্বল) যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্যের মধ্যে “ওয়েলফেয়ার” (কল্যাণ) এবং “হ্যাপিনেস” শব্দগুলো রয়েছে।
এই প্রেক্ষিতে পাশ্চাত্ত্যে রাষ্ট্র নিয়ে চিন্তার বিবর্তনের ধারাটি একটু ছুঁয়ে দেখা যাক।
টমাস হবস ( ১৫৮৮-১৬৭৯ )বললেন-- রাষ্ট্র গঠনের উদ্দেশ্য আদিম প্রকৃতির কোলে গড়ে ওঠা হিংস্র সমাজ থেকে মুক্তি পাওয়া, যাতে মানুষের স্বভাবজঃ হিংসা, প্রতিশোধ-স্পৃহাকে এড়িয়ে এক শান্তিময় পরিবেশ গড়ে ওঠে।
প্রায় দু’শ বছর পরে জন স্টুয়ার্ট মিল ( ১৮০৬-১৮৭৩) একইভাবে জোর দিলেন ‘ ক্ষয়ক্ষতি’ বা হার্ম থিওরির উপর। বললেন রাষ্ট্র মুখ্যতঃ ক্রিমিনাল ল’ এর প্রয়োগের মাধ্যমেই জনকল্যাণ সুনিশ্চিত করে।
তার আগে জেরেমি বেন্থাম( ১৭৪৮-১৮৩২) পেশ করেছেন উপযোগিতাবাদ বা ইউটেলিটেরিয়ানিজম।
বেন্থাম আনলেন প্লেজার এন্ড পেইনের ধারণা। অর্থাৎ রাষ্ট্রের কাজ ব্যক্তি ও সমষ্টির কল্যাণ। মানে? রাষ্ট্রের যে কাজে লোকের আনন্দ বাড়বে সেটা উচিত পদক্ষেপ আবার যেটার ফলে দুঃখ বা বেদনা বাড়বে সেটা অনুচিত। একজন ব্যক্তির জন্যে এটা একটা মাপকাঠি হতে পারে, কিন্তু গোটা সমাজ বা দেশের জন্যে? যেখানে রয়েছে বিভিন্ন মানুষ, বা জনগোষ্ঠীর , ধর্মের ও ভাষার মধ্যে স্বার্থের সংঘর্ষ? আহা, তার সমাধানের জন্যেই তো হবস রেফারি হিসেবে রাষ্ট্রকে চেয়েছিলেন—দরকার মত পেনাল্টি দেবে , হলুদ ও লাল কার্ড দেখাবে।
এই ধারণাটি নিয়ে একটু বিস্তারিত কথা বলা দরকার। কেননা আজও সমস্ত ধরণের রাষ্ট্র ব্যবস্থায় নীতিনির্ধারণে এই তত্ত্বটি সবচেয়ে প্রভাবশালী। এছাড়া পরবর্তী সব তত্ত্ব—যেমন রলসের ফেয়ারনেস, নজিকের এনটাইটেলমেন্ট, বা অমর্ত্য সেন ও মার্থা নুসবাউমের ক্যাপাবিলিটি—এই উপযোগিতা তত্ত্বের ব্যখ্যা ও সমালোচনার ভিত্তিতে তৈরি হয়েছে।
কথা হল রাষ্ট্র কী করে মাপবে যে তার একটি নির্ণয়ে গোটা দেশের সামগ্রিক হিত বা কল্যাণ-- বেন্থামরা বলছেন ‘হ্যাপিনেস’-- বাড়বে বা কমবে?
ফলে এল ফলাফল বা কনসিকোয়েন্সের ধারণা। দেখতে হবে রাষ্ট্রের কোন নীতির ফলে কারও সুখ কারও দুঃখ নিয়ে কাটাকুটি করে গোটা সমাজের গড়পড়তা প্রান্তিক উপযোগিতা বা কল্যাণ ( অ্যাভারেজ মার্জিনাল ইউটিলিটি) বাড়ল কি ?
আচ্ছা, আমার একটি কাজের ফল কি হবে তা কি আগে থেকে পুরোটা বলা সম্ভব? করোনার জন্যে নতুন কোন ভ্যাকসিনের কতটুকু সাইড এফেক্ট হবে তা কি এক্ষুণি বলা যায় ? জলে ডুবতে থাকা একটি বাচ্চাকে বাঁচালেন—সে যদি বড় হয়ে হিটলার হয় ? এই তথ্য আগে জানলে ওকে বাঁচাতেন কিনা?
মানুষ ভবিষ্যদ্বক্তা নয় । আমার নৈতিক দায়িত্ব ডুবতে থাকা মানুষকে বাঁচানো—সে বড় হয়ে যে হিটলারই হবে তার কি গ্যারান্টি?
এত নৈতিকতা নিয়ে কথাবার্তা কেন?
বেন্থাম তখনই জোর দিয়েছিলেন রাষ্ট্র পরিচালনায় নৈতিকতার উপর। আজ সমসাময়িক দার্শনিকদের মধ্যে অন্যতম হিতবাদী পিটার সিঙ্গার বলেন—নৈতিকতার কথা বারবার উঠছে এই জন্যে যে আমরা যে সামাজিক পরিবেশে বাস করি তাতে ব্যাপক অনৈতিকতা বর্তমান। উনি আরও বলেন যে এই হিত বা সুখের বৃত্ত আরও বিস্তৃত হওয়া উচিত যাতে গরীব এবং প্রান্তিক মানুষেরাও এর দায়রায় আসে।
এর থেকে উঠে এল একটি মোটা দাগের হিসেব—মোট ঘরোয়া উৎপাদন বা গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট (জিডিপি)। আর একটু ফাইন টিউন করলে গড়পড়তা মাথাপিছু ঘরোয়া উৎপাদন বা পার ক্যাপিটা জিডিপি। কোন রাষ্ট্রের জিডিপি বৃদ্ধি হচ্ছে মানে তার হাতে দেশের সামগ্রিক সুখ ও কল্যাণ বেড়ে চলেছে।
দেশ /জিডিপি (মার্কিন ডলারে)
আমেরিকা ২১.৪৪
চীন ১৪.৪৪
জাপান ৫.১৫
জার্মানি ৩.৮৬
ভারত ২.৯৪
বৃটেন ২.৮৪
ফ্রান্স ২.৭৩
তথ্যসূত্রঃ ইন্টারন্যাশনাল মনিটরি ফান্ড ২০১৯
দেশ পার ক্যাপিটা জিডিপি (মার্কিন ডলারে ) র্যাঙ্ক
আমেরিকা ৬৫১১১ ৭
চীন ১০০৯৮ ৬৫
ইন্দোনেশিয়া ৪১৭৬ ১০৯
ভারত ২১৭১ ১৩৯
কিন্তু মাথাপিছু বা পার কাপিটা জিডিপির হিসেবে ভারতের স্থান ১৯০টি দেশের মধ্যে ১৩৯তম; পাকিস্তান, নেপাল , বাংলাদেশের থেকে সামান্য উপরে বটে, কিন্তু ভিয়েতনাম (১৩০), মিশর, লাওস (১৩১),ভেনেজুয়েলা(১৩৩), ঘানা (১৩৭), সিরিয়া, ইত্যাদির নীচে।
তা কী করে হয় ? মোট জিডিপির আয়তনে মাঝে মাঝে ফ্রান্স ও বৃটেনকে পেছনে ফেলে পঞ্চম স্থান অধিকার করা ভারত মাথাপিছু জিডিপির মাপদন্ডে ভিয়েতনামের পেছনে?
--এর একটা কারণ হতে পারে ভারতের বিশাল জনসংখ্যা—১৩৩ কোটি বা ১.৩ বিলিয়ন। আর বাস্তবিক দারিদ্র্যের কারণ সম্পত্তির কেন্দ্রীকরণে দ্রুত্ বৃদ্ধি। ভারতের শীর্ষ ১% ধনীর হাতে গোটা দেশের সম্পত্তির ৭৩% বা নীচের দিকের ৭০% জনসংখ্যার সম্পত্তির চারগুণ। এটা অক্সফ্যামের অধ্যয়ন যা ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরামের সামনে ২০১৮তে পেশ করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল যে ভারতের বিলিওনারদের সম্পত্তির পরিমাণ সরকারের একবছরের বাজেটের চেয়ে বেশি।
এই বৈষম্য দেখিয়ে দিচ্ছে যে জিডিপি বা আয়ের মাপকাঠি ধরে সুখ বা কল্যাণ মাপলে সমস্যা আছে। তাতে রাষ্ট্রের কাছে যে ‘ডিস্ট্রিবিউটিভ জাস্টিস’ বা সম্পদ বিতরণে ন্যায় আমরা আশা করি তার খামতি ধরা পড়ে না। তাহলে জিডিপি ছেড়ে ‘সুখ’ বা ‘হ্যাপিনেস’ অন্যভাবে মাপা হোক । কারণ জিডিপির ভিত্তি হল আয় । শুধু ইনকাম দিয়ে কি মানুষের সুখ মাপা যায় ?
অবাক কান্ড ! ভুটান সরকার জিডিপিকে সরিয়ে সমৃদ্ধির জন্যে একটি নতুন সূচক ঘোষণা করেছে—গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস (জি এন এইচ) বা সমগ্র রাষ্ট্রীয় সুখ। এটি ১৮ জুলাই ২০০৮ তারিখে আইন পাশ করে ভুটান রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারক দর্শন হিসেবে সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এই সূচক তৈরি হয়েছে নাগরিকদের জীবনের ৩০টি মাপকাঠির সমন্বয়ে।
রাষ্ট্রসংঘ ২০১১ সালে সাধারণ পরিষদে ‘হ্যাপিনেস’ এবং ‘প্রজা-কল্যাণ’কে একটি ‘মৌলিক মানবিক লক্ষ্য’ বলে ঘোষণা করে এবং সমস্ত সদস্য দেশকে ভূটানের উদাহরণ অনুসরণ করতে বলে। ২০১২ সালে প্রথম ‘ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট’ প্রকাশিত হয় এবং ‘২০শে মার্চ’ ইন্টারন্যাশনাল হ্যাপিনেস ডে’ হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় ।
তবে ভুটানের অল্প জনসংখ্যা , বৌদ্ধধর্মকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে বাধ্যতামূলক করা এবং দারিদ্র্য ইত্যাদির ফলে ওই উদাহরণ তেমন গ্রহণযোগ্যতা পায় নি।
কিন্তু রাষ্ট্রের দায়িত্ব নাগরিকের সুখ ও কল্যাণ বা এককথায় “হ্যাপিনেস” এর বৃদ্ধি ও বিকাশ – এই ধারণাটি তো আসলে সেই ‘হিতবাদ’ থেকেই গড়ে উঠেছে।
তবু একটা কথা। ইকনমিক্সের ওই মার্জিনাল ইউটিলিটি বা উপযোগিতার প্রান্তিক বৃদ্ধি তো মানুষে মানুষে আলাদা হবে। খালি পেটে একটা রসগোল্লার মার্জিনাল ইউটিলিটি বা যে ইতিমধ্যে দশটা খেয়েছে তার ১১ তম রসগোল্লার স্বাদ কী করে তুলনা করা যায় ? তর্কের খাতিরে বলা যেতে পারে যে একজন কোটিপতির থেকে ১০০০ টাকা নিয়ে একজন দিন -আনি -দিন -খাই মানুষকে দিলে কোটিপতির যতটা ‘সুখ’ বা ‘প্রান্তিক উপযোগিতা’ বা ‘মার্জিনাল ইউটিলিটি’ কমবে তার চেয়ে গরীব মানুষের ওই ১০০০ টাকা পেয়ে প্রান্তিক উপযোগিতা অনেক গুণ বেশি হবে। ফলে নীট সামাজিক উপযোগিতা কমবে না , বেড়ে যাবে। এই ধারণার ভিত্তিতেই প্রগতিশীল করনীতি যা উচ্চ আয়ের ক্ষেত্রে বেশি চড়া হারে কর আদায়ের পরামর্শ দেয় । কিন্তু বাস্তবে কী ঘটে দেখুন।
গত বছর ৫ জুলাই বাজেট বক্তৃতায় বিত্তমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন ঘোষণা করলেন যে যাদের বার্ষিক আয় ২ কোটির থেকে ৫ কোটির মধ্যে তাদের ট্যাক্স ১৫% এর জায়গায় ২৫% এবং ট্যাক্সের উপর সারচার্জ ৩% করা হল এবং যাদের আয় ৫ কোটির বেশি, তাদের ৩৭% ট্যাক্স এবং ৭% সারচার্জ দিতে হবে। ফলে ওদের বাস্তবিক ট্যাক্স ক্রমশঃ.৩৯% এবং ৪২.৭% হবে।
ব্যস, চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেল। দেশ জুড়ে মিডিয়ায় বলা হল—এ অন্যায়। আমেরিকাতেও ৪০% এর বেশি নেয়া হয়না। এতে সরকারের খুব একটা লাভ হবে না । বিত্তশালীদের ব্যবসা বাড়ানোর ইচ্ছে কমে যাবে ইত্যাদি। দুটো মাস গেল না , সরকার ওই বাড়তি করের প্রস্তাব ফেরত নিল।
এবছর করোনা মহামারী রুখতে এবং গরীবদের আর্থিক সাহায্য করতে সরকারের টাকার দরকার। লকডাউনে বিজনেস এবং ট্যাক্স আদায় প্রায় বন্ধ। তখন বেশ কয়েক জন সিনিয়র ট্যাক্স অফিসার মিলে ‘করোনা ঠেকাতে রাজকোষীয় পদক্ষেপ’ বা “ফোর্স” নাম দিয়ে একটি প্রস্তাব প্রত্যক্ষ করের কেন্দ্রীয় বোর্ডের চেয়ারম্যান পি সি মোদীর কাছে পাঠালেন যার মোদ্দা কথা হল যাদের এক কোটির উপর আয় তাদের কর ৩০% থেকে বাড়িয়ে ৪০% করা হোক আর যাদের আয় ৫ কোটির বেশি তাদের উপর সম্পত্তি কর লাগানো হোক । এই প্রস্তাবের সার অফিসারদের অ্যাসোশিয়েশনের টুইটার হ্যান্ডলে প্রকাশিত হল। হয়ত ভেবেছিলেন দেশের দুর্দিনে এমন প্রস্তাব দেওয়ায় সবাই বলবে—সাবাশ! কিন্তু হল উলটো।
কেন্দ্রীয় সরকার ওই প্রস্তাবকে ফালতু বলে নাকচ করল এবং দেশের সংকটের সময় এসব করে বিশৃংখলা সৃষ্টি করা ও ইউনিয়নের টুইটারে এটা প্রকাশ করার অভিযোগে তিনজন অফিসার সাসপেন্ড হয়ে কেস খেলেন।
তাহলেও রাষ্ট্র চাই কিছু পাবলিক গুডের জন্য, মানে যার লাভ ধনী গরী্ব, করদাতা এবং যাকে দিতে হয়না --সবাই পাবে। যেমন রাস্তাঘাট, শান্তিরক্ষার জন্যে পুলিশ ও দেশরক্ষার জন্যে সৈন্যবাহিনী।
আবার প্রাকৃতিক দুর্যোগে ত্রাণ –রাষ্ট্র ছাড়া কে আছে মধুসূদন দাদা!
এ’বছরই মন্দা থেকে ছোট বিজনেসকে বাঁচাতে ভারত সরকার ব্যাংক লোনের ১০০% গ্যারান্টি দিচ্ছে। লকডাউনে ত্রস্ত গরীব মানুষকে অতিরিক্ত পাঁচ কিলো আনাজ বিনে পয়সায় দিচ্ছে। আবার ঘুর্ণিঝড় আমপান বা ব্রহ্মপুত্রে বন্যা –ছোটবড় সাহায্যের ঝুলি নিয়ে রাষ্ট্রকেই এগিয়ে আসতে হচ্ছে।
রাষ্ট্র চাই-- বাজার ডামাডোল হলে অর্থনীতি পাঁকে পড়লে টেনে তোলার জন্যে । যেমন ২০০৮ সালে লেম্যান ব্রাদার্স সংকটে পড়লে আমেরিকায় একের পর এক ব্যাংক ফেল করলে সরকারকেই আর্থিক সাহায্যের ক্রেন নিয়ে পথে নামতে হল।
এই শতকের সবচেয়ে খ্যাতিমান এবং বিতর্কিত অর্থনীতিবিদ টমাস পিকেটি পাঁচ বছর আগেই একটি চ্যানেলকে দেয়া সাক্ষাতকারে বলেছিলেন—বাজার সমতা আনবে এ আশা বাতুলতা। খরচা বা উপভোগের উপর কর না বসিয়ে বরং সম্পত্তির উপর উঁচু হারে একটা গ্লোবাল ট্যাক্স চাপালে অসাম্য অনেকটা কমানো যেতে পারে।
অমর্ত্য সেন ও মার্থা নুসবাম আঙুল তুলেছেন রাষ্ট্রের সাহায্যে সমাজের গড়পড়তা জ্ঞানভান্ডার গড়ে তোলার দিকে। অর্থাৎ রাষ্ট্র চাই—নাগরিকদের কাছে দরকারি তথ্য পৌঁছে সামুদায়িক চেতনা (কলেক্টিভ কনসাসনেস) বাড়িয়ে তুলতে। এই যে বিশ্বব্যাপী করোনা প্যানডেমিক, তার সম্বন্ধে সঠিক তথ্য এবং আচরণবিধি যদি রাষ্ট্রের মাধ্যমে নাগরিকদের কাছে না যেত তাহলে আতংকিত মানুষ গোমূত্র, গোবর, ফিনাইল থেকে শুরু করে যত হাতুড়ে ডাক্তার ও টোটকার শরণাপন্ন হত এবং হয়ত ১৯১৯ এর প্লেগ মহামারীর রিপিট পারফরম্যান্স হত ।
তবে জ্ঞানচর্যাভিত্তিক রাষ্ট্রভাবনা( এপিস্টেমিক পাওয়ার অফ স্টেট) বহু প্রাচীন। অ্যারিস্টটলের ( ৩৮৫—৩২৩ খ্রিষ্টপূর্ব) বিশ্বাস ছিল সমুহের যুক্তিযুক্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর ক্ষমতায় এবং গণতান্ত্রিক সংস্থার মাধ্যমে রাজ্য পরিচালনায়। এর পক্ষে তাঁর যুক্তির ভিত্তি ছিল তিনটিঃ জনতার খোলাখুলি স্বচ্ছ আলোচনা ও বিতর্ক, রাষ্ট্রের মাধ্যমেএকজায়গায় সমস্ত তথ্যের একত্র হওয়া এবং বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সমস্যার উপর আলোকপাত। ওঁর প্রিয় উদাহরণ ছিল ভোজসভার। যদি ভোজসভায় আমন্ত্রিত সবাই কিছু না কিছু খাবার জিনিস নিয়ে আসে তাহলে যে বৈচিত্র্য ও নানান স্বাদের সমাবেশ হয় তেমনই রাষ্ট্র থাকলে নানান তথ্য ও জ্ঞান একত্র হতে পারে।
একটা প্রশ্ন কেউ কেউ করেন যে সমতা(ইকুয়ালিটি) ও দক্ষতার( এফিশিয়েন্সি) মধ্যে তো ভাসুর -ভাদ্রবৌ সম্পর্ক। সবাইকে সমান করে দিলে শ্রমিকের মধ্যে দক্ষতা বৃদ্ধির প্রেরণা লোপ পাবে কিনা?
মুশকিল হল এঁরা কেবল আয়ের সমতা বা সমান মাইনের কথা বলছেন। রাষ্ট্র মাইনে ছাড়াও দক্ষ শ্রমিককে নানা ভাবে পুরস্কৃত করতে পারে। আসলে প্রতিযোগিতা উৎকর্ষ বাড়ায় এবং দাম কমায়। বিপরীতে একচেটিয়া কারবার উৎকর্ষ কমায় ও দাম বাড়ায়।
আর সরকার মনোপলি নিয়ন্ত্রণ আইনের মাধ্যমে প্রতিযোগিতা বাড়িয়ে উৎকৃষ্ট পণ্য ও সেবা কম দামে সবাইকে পাইয়ে দিয়ে ‘হ্যাপিনেস’ বাড়ানো বা কষ্ট লাঘব করতে পারে।
এস,
অনেক ধন্যবাদ।
আমার মেয়েও বলল-- ওদের আমেরিকান ইন্ডিয়ান, এবং নিগ্রো বা আফ্রো-আমেরিকান নয় 'আফ্রিকান আমেরিকান'।
সত্যি বুড়ো হয়েও গেছি, সময়ের থেকে পিছিয়ে পড়েছি। ঃ(((
কিন্তু দুটো কিস্তি মিলিয়ে অন্ততঃ ৫০ টা ফুটনোট ছিল , কেন যে পেস্ট করলে আসছে না?
একটাই আফশোস। এত খেটে ফুটনোটগুলো দিলাম, কিন্তু কপিপেস্টে একটাও ক্যান এলো না? টেকনিক্যালি আমার কিছু ভুল ?
রঞ্জনবাবু, অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী Aboriginals, আর Torres Strait Islander রা, এঁদের সঙ্গে মাওরিদের নৃতত্ত্বগত কোনো সম্পর্ক নেই,। Aboriginal দের সঙ্গে পাপুয়া'র মানুষের মিল আছে, তবে এঁরা মূলত অস্ট্রেলিয়ারই আদিবাসী । Torres Strait Islander এঁরা সব মেলানেশিয় , এঁদের সঙ্গেও নিউ গিনি অঞ্চলের মানুষের জাতিগত মিল পাওয়া যায় । দুঃখের বিষয়, আজকের অস্ট্রেলিয়াতে এঁরা প্রান্তিক মানুষে রূপান্তরিত হয়েছেন।
মাওরিরা এঁদের থেকে স্বতন্ত্র, মাওরিরা সেই অর্থে নিউ জিল্যান্ডে ৮০০-৯০০ বছর আগে হাওয়াকি দ্বীপপুঞ্জ বা মতান্তরে তাইওয়ান এর কাছাকাছি কোথাও থেকে এসে থাকতে পারেন, এঁরা কিন্তু নিউ জিল্যান্ডের আদিবাসী নন, অধিবাসী বলতে পারেন, দীর্ঘদিনের অধিবাসী। ইউরোপীয়রা আসার পরে এঁদের নানা জাতির সঙ্গে ইউরোপীয়দের বিশেষ করে ইংরেজদের সংঘর্ষ হয় । নিউজিল্যান্ডে কিন্ত মাওরিরা প্রান্তিক নন মোটেই । নিউজিল্যান্ড বাস্তবিক দ্বিভাষী দেশ, ইংরিজি ও মাওরি ভাষায় দেশের জাতীয় সংগীত গাওয়া হয়, ইংরেজ মাওরির সহাবস্থানের চুক্তিপত্র দুই ভাষায় লেখা (যদিও তাই নিয়ে অনেক কিছু বলার আছে/ লেখার আছে), কাজেই মাওরি আর অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী এক করে দেখার ব্যাপারটিকে লেখায় পারলে সংশোধন করে নিলে ভালো হয় ।
"ওয়ার্ডে এন্ডনোট (বা সাব অথবা সুপারস্ক্রিপ্ট) হিসেবে রাখা টেক্সট অন্যত্র পেস্ট হয় না - এ এক ঝঞ্ঝাট। খুব সম্ভবত কপি-ই হয় না। আপনি কপি করে, পেস্ট করার আগে দেখবেন ওগুলো সিলেক্ট হচ্ছে কিনা।"
আমি কিন্তু Word 2016 এ লিখে দেখলাম কোনো অসুবিধে হলো না ।
Reference ট্যাব থেকে endnote বা footnote যেটা ইচ্ছে insert করুন, তারপর ctrl - এ করে পুরো টেক্সট চিহ্নিত করুন, তারপর কপি পেস্ট করে দেখলাম এলো তো (নিচে দেখুন) ।
"test[1]
[1] Testing testing"
(আমি ব্যক্তিগত ভাবে ওয়ার্ড ব্যবহার করি না, কাজেই এর বেশি কিছু জানি না ) ।
রঞ্জনবাবু কি ধরণের সফটওয়্যার ব্যবহার করেন? আপনি কি গুগল ডক ব্যবহার করেন?
অরিন,
ছোটবেলা থেকে অনেক কিছু (তথাকথিত জিকে বইয়ের পুঁজি সম্বল করে) ভুল তথ্য/ধারণা মাথায় গেড়ে রয়েছে। মাওরি তার অন্যতম। মূল লেখায় শুধরে নিচ্ছি। অনেক ধন্যবাদ!
এলসিএম,
আমি আলাদা করে ওয়ার্ড ফাইলে উইন্ডোজ ১০ এ অভ্রতে সুলেইমান লিপি ইউজ করে সেভ করে রাখছি। আসলে অনেক দিন পরে লিখতে গিয়ে এইসব সমস্যা হচ্ছে, ঠিক করে নেব।
মনে হয় এই ব্র্যাকেটে হয়ে যাবে। ট্রাই করছি লাস্ট কিস্তিতে। যদি ঠিক হয় , তাহলে ওইভাবে প্রথম দুটো ফের পেস্ট করব। তখন পুরনো দুটো প্লীজ ডিলিট করে দেবেন।