ঈশ্বর, রাষ্ট্র ও ন্যায়-- এক
গৌরচন্দ্রিকা
গ্রামগঞ্জ থেকে পেটের তাগিদে মহানগরী, শিল্পনগরী ও শহরাঞ্চলে কাজ করতে আসা এককোটির মত মানুষ এ’বছর ভরা চৈত্রমাসের এক রাত্তির আটটায় শুনল আকাশবাণী –মহামারীর থেকে বাঁচতে সবাইকে ঘরে বন্দী হয়ে থাকতে হবে। আরও শুনল – মানুষে মানুষে দুরত্ব বাড়াতে হবে—অন্ততঃ চারহাত। কতদিনের জন্যে? মাত্র একুশ দিনের।
তা’ বেশ। অমন মাঝে মাঝে কারখানার গেটে তালাবন্দী, কাজ না থাকায় খালি হাতে ঘরে বসে থাকা ওদের অভ্যেস আছে। আর এটাতো সবার ভাল’র জন্যে । ‘বহুজন হিতায়, বহুজন সুখায়’ বা ‘সর্বে সুখিনা ভবন্তু, সর্বে সন্তু নিরাময়া’ ভারতেরই কথা।
কিন্তু দিন গড়িয়ে মাস গেল। লকডাউন চলল আরও দু’মাস। বন্ধ হল কারখানা, দোকান, কাজ-কারবার। মাইনে বন্ধ হল। আগের মাসের পাওনা বাকি পড়ল। ফলে পেটে টান পড়ল। ঘরভাড়া বাকি পড়ল। বাড়িওলা দরজায় তালা ঝোলাল। শেষে বৈশাখের গরমে আশ্রয় হল ফ্লাইওভারের নীচে বা হাইওয়ের ধারে। ওদিকে রাস্তায় এলোমেলো ঘুরে বেড়ালে কপালে জুটছে পুলিশের লাঠি। সরকার প্রথমে এদের অস্তিত্ব অস্বীকার করল। পরে বিনে পয়সায় চাল-গম-ডাল দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিল। কিন্তু যাদের রেশন কার্ড নেই ? যাদের মিনিমাগনা পাওয়া চাল ডাল রাঁধার জন্যে তেল-নুন-জ্বালানি কেনার পয়সা নেই? তাদের জন্যে রয়েছে লঙ্গর— ধর্মস্থানে বা কোন এনজিও’র কর্মকান্ডের আঙিনায়।
এরা মানূষের করুণার পাত্র হয়ে বিভিন্ন জায়গায় খাবার থালা হাতে লাইনে দাঁড়িয়ে রইল --ঘন্টার পর ঘন্টা। যাদের বাড়ি আছে, নিজস্ব বা ভাড়া, চাকরি যায়নি, মাইনে বন্ধ হয়নি বা পেনশন ঠিক সময়ে ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা পড়ছে – তাঁরা বললেন সরকার আর কত করবে? পাবলিকের ট্যাক্সের টাকায় কি দানছত্র খুলবে?
মরিয়া লোকজন বেরিয়ে পড়ল নিজেদের গাঁয়ে পৈতৃক বসতবাটিতে আশ্রয় পাবে এই আশায়। বাসে, ট্রাকে, সাইকেলে, অটোতে; শেষ সম্বলটুকু নিয়ে এবং দরকার মত পায়ে হেঁটে। কেউ কেউ দুর্ঘটনার শিকার হল, কেউ খিদের। শেষে জনমতের চাপে টনক নড়ল মহামান্য আদালতের এবং সরকারের । শ্রমিক ট্রেন এবং কিছু বাস চালু হল। তাহাতে কোন কোন ভাগ্যবানে চড়িবারে পায় । ততদিনে দেরি হয়ে গেছে। করোনা মহামারীর সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে আধপেটা খেয়ে বস্তিতে গাদাগাদি করে থাকা ওই পরিযায়ী শ্রমিকদের মধ্যে। ফলে গাঁয়ে ফিরে তাদের স্থান হল গাঁয়ের বাইরে স্কুল ঘরে, পঞ্চায়েত ভবনে নইলে অস্থায়ী কোন সামিয়ানার তলায়--অন্ততঃ ১৪ দিনের জন্যে ।
অথচ এরা কেউ ভিখিরি হতে চায়নি। সবাই চেয়েছিল সম্মানের সঙ্গে রোজগার করে বাঁচতে; দয়ার দান নয় , খুন-পসীনার কামাই। কিন্তু হঠাৎ যে এদের রোজগার বন্ধ হয়ে গেল বা মাথার উপর থেকে ছাদ সরে গেল তার জন্যে কি এরা দায়ী? করোনা মহামারীর বীজ কি এরা এনেছে বা ছড়িয়েছে?
এটা নিয়ে আজ কোন বিতর্ক নেই যে এই বীজ এসেছে বিমানপথে, সে যে দেশ থেকেই আসুক। আর কাজ হারিয়েছে তালাবন্দীর ফলে। তালাবন্দী হয়েছে রাষ্ট্রের হুকুমে। তাহলে রাষ্ট্র কেন এদের এই সময়ে খাওয়ানো পরানোর দায়িত্ব নেবে না? বিশেষ করে দেশের রাষ্ট্রনায়ক যখন এ’বছর বারাণসীতে দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রের মটো হিসেবে বলেছেন—‘সবকা সাথ, সবকা বিকাস, সবকা বিশ্বাস’।
তাহলে কি ‘সব’ বা ‘সর্বজন’ এর মধ্যে এই প্রান্তিক মানুষেরা নেই? ‘সর্বে সুখিনা ভবন্তু , সর্বে সন্তু নিরাময়া’ কি তাহলে কথার কথা?
এর উত্তর খুঁজতে গিয়েই উঠে আসছে আরও প্রশ্ন, যেমন রাষ্ট্র কেন চাই ? কার জন্যে রাষ্ট্র? রাষ্ট্রকে উৎপীড়নের অধিকার কে দিয়েছে ? নাগরিকদের মধ্যে সমতা আনা কি রাষ্ট্রের দায়িত্ব? রাষ্ট্রকে কি ন্যায়পরায়ণ হতেই হবে? নইলে সংখ্যালঘু প্রান্তিক বা একাকী বিপন্ন মানুষকে কে ন্যায় দেবে ?
উঠে আসছে উত্তর। নানা উত্তর, বেশ যৌক্তিক, আবার পরস্পরবিরোধীও। এই লেখার সীমিত পরিসরে আমরা ছুঁয়ে যাব শুধু আজকের দুনিয়ায় যা যা প্রাসঙ্গিক সেই তত্ত্ব এবং ব্যাখ্যাগুলোকে--- তিনটে প্রায় সমান আয়তনের কিস্তিতে।
সবচেয়ে আগে ভাবা যাক ঈশ্বরের কথা—কারণ এক বিশিষ্ট অর্থে আমরা সবাই তাঁর সন্তান, কাজেই জন্মসূত্রে সবাই সমান। তিনি কোথায় থাকেন সেটা আমরা ঠিক জানিনা। কিন্তু এটা জানি আমাদের দেখাশুনোর নৈতিক দায়িত্ব তাঁর—জীব দিয়েছেন যিনি, আহার দেবেন তিনি।
তাঁর প্রতিভু হিসেবে আমরা আগে রাজাকে পেয়েছি। তাঁর কাজকারবার নিয়ে প্রশ্ন করা যায় না। কারণ, ‘কিং ক্যান ডু নো রং ‘। তাঁর পাত্রমিত্র অমাত্যের দুষ্কৃতির জন্যে তাঁকে অভিযুক্ত করা যেত না।
অবশ্য ইংল্যান্ডে ১৯৪৭ সালের একটি গুরুত্বপূর্ণ আইনি সংশোধনে এটা এখন বাতিল হয়েছে। কিন্তু ভারতে সুপ্রীম কোর্ট ১৯৬৫ সালে পুলিসের গাফিলতির জন্যে সরকারকে বা রাষ্ট্রকে দায়ি করা যায় না বলে রায় দেয়। তবে ইংল্যান্ডের ১৯৪৭ সালের অনুরূপ ভারতেও সংসদে সংশোধন আনা উচিত বলে মন্তব্য করে।
ভারতের ল’ অফ টর্টস অনুযায়ী পুলিশ আমলা বা রাষ্ট্রের কোন পাত্রমিত্র যদি কর্তব্য পালনে এমন কোন পদক্ষেপ নেয়্ যার ফলে কোন নাগরিকের ক্ষতি হয় তবে তার জন্যে কোন প্রতিকার নেই। বলা হয় যে এ না হলে আইনসভা বা আমলা বা পুলিশ স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে না। তাই আজ কোন সরকারি আমলা বা পুলিশ বা মন্ত্রীর বিরুদ্ধে আইনি প্রতিকার চাইলে আগে সরকারের অনুমতি চাই। কারণ ‘রাজাকে তাঁর দরবারে তাঁর অনুমতি ছাড়া বিচার করা যায় না’।
কিন্তু একটি কেসে সুপ্রীম কোর্ট রাষ্ট্রের এই সার্বভৌম ক্ষমতাকে সীমিত করে বিদেশি আক্রমণ বা বিদ্রোহের পরিস্থিতির মত কিছু ব্যতিক্রমী পরিস্থিতি ছাড়া ওই “কিং ক্যান ডু নো রং “ নীতিকে আজকের আধুনিক ওয়েলফেয়ার স্টেটে অচল বলে ঘোষণা করেছেন। তার বদলে ‘আইনের শাসন’কে প্রাধান্য দিয়ে নাগরিকের জন্যে সমতা, স্বাধীনতা এবং ন্যায়োচিত ব্যবহারের কথা বলে রাষ্ট্রের কর্মচারির গাফিলতিতে নাগরিকের ক্ষতি হলে রাষ্ট্রের দায় বহনের পক্ষে রায় দিয়েছেন। কিন্তু ভারতে রাষ্ট্র নিয়ে ইমিউনিটির ধারণা বা প্রায় রাজার প্রতি সম্ভ্রমের ধারণার মত জনমানসে প্রোথিত হয়ে রয়েছে।
তাঁর আধুনিকতম রূপ হল রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের প্রতিভু রাষ্ট্রপতিকে বা রাজ্যপালকে ‘ইমপীচ’ করা যায় না।
ঈশ্বর, রাজা ও রাষ্ট্রঃ
ঈশ্বরের অনেক বিভুতির মধ্যে একটি হল তিনি ন্যায়পরায়ণ। সৃষ্টির পর পালন ও সংহারের মধ্যেই এটি নিহিত আছে। দুষ্টের দমন এবং শিষ্টের পালন --একেবারে সিভিল ও ক্রিমিনাল কোড। আমরা ছোটবেলা থেকে শিখে নিই—ঠাকুর দেখছেন, উনি পাপ দেবেন।বাস্তব জীবনে মার খাওয়া মানুষ বলে তোমায় আদালতে দেখে নেব। সেখানে ন্যায় না পেলে বলে ওপরে একজন আছেন, তিনি দেখছেন। এ ব্যাপারে ভগবান, আল্লাহ, গড সব সমান। একদিন তাঁদের দরবারে পাপীর বিচার হবে। ঘোর পাপীরা চৌষট্টি নরককুন্ডে নিক্ষিপ্ত হবে। মানবসভ্যতার আদি থেকে এই বিশ্বাস মনের এমন গভীরে প্রোথিত যে নাস্তিকের শিরোমণি মার্ক্সও বলেছেন—”ধর্ম হল নিপীড়িতের দীর্ঘশ্বাস ; হৃদয়হীন দুনিয়ার হৃদয় এবং আত্মাহীন পরিস্থিতির আত্মা। এ হল জনগণের আফিম”।
উদ্ধৃতিটিতে স্পষ্ট – মানুষ চাইছে ধর্ম বা ঈশ্বরের কাছে ন্যায়বিচার। তার বদলে করছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ—‘মেলাবেন, তিনি মেলাবেন’।
আজ একুশ শতকে ওই উদ্ধৃতিতে ‘ধর্ম’ শব্দটির জায়গায় বসিয়ে নিন ‘রাষ্ট্র’। দেখতে পাবেন আমরা সব দুঃখের নিদান হিসেবে ভগবানের জায়গায় রাষ্ট্রকে। আধুনিক রাষ্ট্রের ধারণা এবং তার ঔচিত্যের যুক্তি আমরা শিখেছি পাশ্চাত্ত্য থেকে। কিন্তু উনিশ শতকের প্রুধোঁ , বাকুনিনের মত নৈরাজ্যবাদী দার্শনিকের সঙ্গে মার্ক্সও চাইতেন ঈশ্বর ও রাষ্ট্রের বিলোপ। তাঁরা রাষ্ট্রের নিপীড়নের শক্তির এবং স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠার সম্ভাবনার ব্যাপারে সচেতন ছিলেন। ভাবতেন --স্বেচ্ছায় গঠিত সিভিল সোসাইটির সংগঠন এবং জনতার মিলিশিয়া রাষ্ট্রের পরিবর্ত হবে। মানবসমাজ কাল্পনিক সমাধানের বদলে সমস্যার বাস্তবিক সমাধান খুঁজবে। নির্ণয় নেবার ক্ষমতা অন্য কোন শক্তিকে—ঈশ্বর বা রাষ্ট্র-- অর্পণ করবে না ।
অবশ্যি মার্ক্সীয় চিন্তাধারায় রয়েছে-- সমাজতন্ত্রের পর রাষ্ট্রের ধীরে ধীরে ক্ষয়ে গিয়ে মিলিয়ে যাওয়া। তাই অনেক কম্যুনিস্ট ভেবেছিলেন সোভিয়েত সমাজতন্ত্রে রাষ্ট্রযন্ত্রের ক্ষয় শুরু হয়ে গেছে। ১৯৩১ সালে সাম্যবাদীদের পত্রিকা লেবার মান্থলি লিখল - আজকের সোভিয়েত ইউনিয়নে রাষ্ট্রের ‘মিলিয়ে যাওয়ার’ লক্ষণ স্পষ্ট।
কিন্তু ছ’মাস পরে রাশিয়ার কাউন্সিল অফ পিপলস কমিসার্স এর চেয়ারম্যান মলোটভ ওই পত্রিকাতেই লিখলেন যে শ্রেণীসংগ্রাম শেষ হয়নি বরং তীব্র হচ্ছে। ফলে রাষ্ট্র এখন থাকবে।
এই যুক্তিতে আজও রাষ্ট্র রয়েছে এবং দিনের পর দিন আরও শক্তিশালী হচ্ছে। রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি পুতিন ২০০০ সালে নির্বাচিত হয়েছিলেন । ছ’লাখ এর বেশি নাগরিক ওদেশে করোনায় আক্রান্ত, তারই মধ্যে গণভোট হচ্ছে তাঁকে ২০৩৬ পর্য্যন্ত টিকিয়ে রাখা যায় কিনা সেই প্রশ্নে।
এ ব্যাপারে এশিয়াটিক রাষ্ট্রগুলো এককাঠি সরেস। এখানে গড়ে তোলা হচ্ছে এক একজন করে রাষ্ট্রনায়কের মানসমূর্তি যা প্রায় ভগবানের সমান। রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রনায়ক এক এবং অভিন্ন। তাঁকে প্রশ্ন করা মানে ব্লাসফেমি, এখানে রাষ্ট্রদ্রোহ বা দেশদ্রোহ। চীন, নর্থ কোরিয়া থেকে শুরু করে ভারত—শুধু ডিগ্রির তফাৎ। আমাদের দেশে ৪৬ বছর আগের ২৪শে জুন এমার্জেন্সির ঘোষণার পর সেই যে ‘ইন্ডিয়া ইজ ইন্দিরা এন্ড ইন্দিরা ইজ ইন্ডিয়া’ নামকীর্তন শুরু হল তার গুঞ্জন আজও বর্তমান, শুধু নামরূপ বদলে যায় । একইভাবে ঈশ্বর এবং রাষ্ট্র এই একুশের শতকে হাত ধরাধরি করে রয়েছে। জনগণনায় দেখা যায় স্বঘোষিত নাস্তিকের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। কিন্তু ব্যাপক জনমানসে তার প্রভাব অতি নগণ্য। আমার কিছু আর এস এস বন্ধুরা বলেন এবং লেখেন—নমো রাষ্ট্রদেবায়!
কেউ কেউ বলবেন এত ভাবার দরকার নেই । ভারতের সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রের তিনটি স্বতন্ত্র স্তম্ভ— সংসদ (আইন প্রণয়ন), প্রশাসন ( আইনি কাঠামোয় রাষ্ট্রের দৈনন্দিন পরিচালনা) এবং ন্যায়পালিকা ( বিচারব্যবস্থা তথা আইন ও তার প্রয়োগ নিয়ে বিতর্ক হলে তার সমাধান)। তিনটেই স্বতন্ত্র , সরকার নাগরিকের সংবিধান প্রদত্ত অধিকারে কাঠি করলে হাইকোর্ট এবং সুপ্রীম কোর্ট রয়েছে। তারা ঠিক দেখবে।
হিন্দি বলয়ে জনতার প্রবাদ--ঈশ্বর কী দুনিয়া মেঁ দের হ্যায়, পর অন্ধের নহীঁ হ্যায়।
ভগবানের রাজ্যে দেরি হতে পারে কিন্তু অন্যায় হবে না।
তাই কি? আমার কেমন সন্দেহ হচ্ছে।
বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে
ইদানীং কার কাজ যে কে করছে বোঝা যাচ্ছে না। পুলিশ করছে বিচার ও শাস্তিদান। আদালতের মুখে শুনছি সরকারের বয়ান। সরকার অর্ডিনান্স জারি করে সাংবিধানিক পদে পরিবর্তন ঘটাচ্ছে। কয়েকটা উদাহরণ দেখুন।
আদালত ও সরকার
সুপ্রীম কোর্টের জাস্টিস অরুণ মিশ্র (প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি, কোলকাতা হাইকোর্ট) গত ফেব্রুয়ারি মাসে ইন্টারন্যাশনাল জুডিশিয়াল কনফারেন্সের ‘ভোট অফ থ্যাঙ্কস’ দিতে গিয়ে অপ্রাসঙ্গিক ভাবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর গুণগান করতে লাগলেন। বললেন—উনি ভারসেটাইল জিনিয়াস; থিঙ্কস গ্লোব্যালি অ্যান্ড অ্যাক্টস লোক্যালি। এও বললেন উনি নিয়মিত প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন এবং আলোচনা করেন। এ নিয়ে সুপ্রীম কোর্ট বার এসোশিয়েশন (সিনিয়র অ্যাডভোকেট দুষ্যন্ত দাভে) এবং ইন্ডিয়ান বার কাউন্সিল (ললিত ভাসিন) বিরূপ মন্তব্য করলেও কার কি এল গেল। এই ঘনিষ্ঠতা যে বিচারবিভাগের স্বাতন্ত্র্যের প্রেক্ষিতে যে আদৌ কাম্য নয় তা আলাদা করে বলার দরকার নেই।
উত্তর প্রদেশের কংগ্রেস নেতা শচীন চৌধুরি করোনার সময়ে নিয়ম ভেঙে প্রেস কনফারেন্স করে প্রধানমন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রীর মহামারী নিয়ন্ত্রণে কথিত ব্যর্থতার অভিযোগ করায় রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে বন্দী হলেন। এলাহাবাদ হাইকোর্ট তাঁকে জামিন দিল এই শর্তে যে মামলা চলাকালীন আগামী ১৮ মাস পর্য্যন্ত উনি কোন সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করতে পারবেন না । চৌধুরী এই আদেশের বিরুদ্ধে সুপ্রীম কোর্টে গেলেন । সর্বোচ্চ আদালত হাইকোর্টের শর্তাধীন জামিনের আদেশ বহাল রাখল। এবং প্রধান বিচারপতি বললেন যে সোশ্যাল মিডিয়া হচ্ছে বন্দুকের মত। কাজেই হাইকোর্ট ঠিক বন্দুক ব্যবহার না করার শর্তের মত সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করার শর্ত রাখতেই পারে।
এর আগেও উনি এপ্রিল মাসে পরিযায়ী শ্রমিকদের শুকনো চাল-ডাল ছাড়া কিছু টাকা দেওয়ার দাবিকে নাকচ করে বলেছিলেন—সরকার ওদের খাবার দিচ্ছে, আবার টাকা চাই কেন?
বিগত ১লা জানুয়ারি, ২০১৮ সালে মহারাষ্ট্রের ভীমা কোরেগাঁও সভায় দলিত-সবর্ণ সংঘর্ষে একজন দলিত মারা যায়। কিন্তু ঐ দাঙ্গা বাঁধানোর অপরাধে পুলিশ নাগপুর মুম্বাই, দিল্লি ও হায়দ্রাবাদ থেকে দশজনকে বন্দী করে। এঁদের মধ্যে আশি বছরের কবি ভারভারা রাও, ছত্তিশগড়ে আদিবাসী ও শ্রমিকদের আইনি অধিকার নিয়ে আন্দোলন করা সুধা ভরদ্বাজ যিনি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপকও বটেন, সাংবাদিক গৌতম নওলাখা, আইআইটি’র অধ্যাপক এবং দলিত গবেষক ও লেখক আনন্দ তেলতুম্বে উল্লেখনীয়। দু’বছর হয়ে গেল এদের চার্জশীট দিয়ে বিচার শুরু হয়নি। কিন্তু এঁরা সর্বোচ্চ আদালতেও জামিন পান নি। এমার্জেন্সির সময়ের কুখ্যাত মিসা অ্যাক্টের চেয়ে বেশি দমনমূলক রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা অধিনিয়মে এঁদের জেলে রাখা হয়েছে। এঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ যে এঁরা “আর্বান নকশাল” এবং প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এভিডেন্স বলতে কিছু কাগজের টুকরো যাতে কোন তারিখ বা স্থান নেই , কে লিখেছে জানা নেই। আইনজীবিদের মতে এগুলো ট্রায়াল কোর্টেও এভিডেন্স হিসেবে গণ্য হবে না।
আরও উল্লেখনীয় যে ৮১ বছরের ভারভারা রাওয়ের জেলে ডাক্তারি পরীক্ষায় করোনা পজিটিভ ধরা পড়েছে।
অথচ মালেগাঁও বিস্ফোরণ কান্ডের প্রমুখ আসামী প্রজ্ঞা সিং ঠাকুর আনলফুল অ্যাক্টিভিটিজ প্রিভেনশন অ্যাক্টে (ইউএপিএ) এবং টেররিস্ট অ্যাক্ট ও বিস্ফোরক অ্যাক্টে বিচারচলাকালীন খারাপ স্বাস্থ্যের অজুহাতে জামিন পেয়ে প্রচন্ড গরমের মধ্যে নির্বাচনী প্রচারে নেমে পড়েন এবং সাংসদ নির্বাচিত হন।
৩রা ডিসেম্বর, ২০১৮। উত্তর প্রদেশের বুলন্দশহর জেলার একটি গ্রামে দাঙ্গা থামাতে গিয়ে ইন্সপেক্টর সুবোধ সিং মাথায় গুলি লেগে মারা যান, তাতে প্রধান অভিযুক্ত বজরং দল নেতা যোগেশ রাজ এবং বিজেপির যুবনেতা শিখর অগ্রওয়াল। এদের বিরুদ্ধে সরকার প্রথমে খুন, হত্যা, সরকারি কর্মচারির কাজে বাধা পরে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা দায়ের করে। কিন্তু কয়েকমাস পরে এরা এলাহাবাদ কোর্ট থেকে জামিন পেয়ে যায়।
পুলিশের হাতে গরম ন্যায়
মনে হচ্ছে বিচারব্যবস্থায় ন্যায়প্রাপ্তির আশা নাগরিকদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ হারিয়ে ফেলেছেন। তাই কোন নৃশংস অপরাধ ঘটিত হলেই দাবি ওঠে হাতে গরম শাস্তির। পুলিশ অপরাধীকে কোর্টে নিয়ে যায় না, পথেই এনকাউন্টার করে দেয় । আর তাতে তালি বাজায় বেশ কিছু লোকজন , এমনকি কিছু সেলিব্রেটিরাও। গত ৬ ডিসেম্বর শেষ রাতে হায়দ্রাবাদ -বেঙ্গালুরু হাইওয়েতে চারজন বন্দী অপরাধীকে গাড়ি থেকে পালাবার সময় পুলিশ “আত্মরক্ষার্থে” গুলি করে মারে। রাজনেতা অখিলেশ যাদব, মায়াবতী, জয়া বচ্চন, অভিনেত্রী কঙ্গনা রাণাওয়ত , জাতীয় খেলোয়াড় সাইনা নেহাওয়াল, পিভি সিন্ধু—সবারই উল্লাস। যারা একটি মেয়েকে ধর্ষণ করে খুন করেছিল তারা উচিত শাস্তি পেল। ‘জাস্টিস’ হল।
সব গুলিয়ে গেল—আইনের শাসন, ন্যায়পালিকা ও প্রশাসনের কাজের দায়রা, সব। আমরা ক্ষণিক উল্লাসে ভুলে গেলাম পুলিশের কাজ তদন্ত করে আসল অপরাধীকে ধরে প্রমাণ সহ আদালতে পেশ করা। আদালতের কাজ তুল্যমূল্য বিচার করে শাস্তি দেওয়া। অন্য কন্ঠস্বর অপেক্ষাকৃত ক্ষীণ।
দুই দশক ধরে কানপুর এলাকায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সংরক্ষণ প্রাপ্ত দাগী অপরাধী বিকাশ দুবে গত ১০ জুলাই একই ভাবে বন্দী অবস্থায় পুলিশের কনভয় থেকে ভোর বেলায় পালাতে গিয়ে এনকাউন্টারে মারা যায়।
তার আগে কয়েকদিনের মধ্যে কথিত ভাবে দুবে গ্যাঙের ছ’জন একইভাবে পালাতে গিয়ে এনকাউন্টারে মারা যায় । এর মধ্যে প্রভাত মিশ্রের বয়স – স্কুলের মার্কশীট ও আধার কার্ড অনুযায়ী--মাত্র ১৬ বছর। এদের উপর চার্জ ছিল ক’দিন আগে বিকাশ দুবেকে গ্রেফতার করতে গ্রামের বাড়িতে পুলিশ গেলে এরা ছাদের উপর থেকে গুলি চালিয়ে আটজন পুলিশকে হত্যা করে।
উত্তর প্রদেশ পুলিশ গর্বের সঙ্গে ওদের টুইটার হ্যান্ডলের মাধ্যমে ঘোষণা করে যে ২০১৭ সাল থেকে দু’বছরে পুলিশ ৫১৭৮ এনকাউন্টার করেছে। তাতে ১০৩ জন অপরাধী মারা গেছে, ১৮৫৯ আহত এবং ১৭৭৪৫ জন এনকাউন্টারের ভয়ে জামিন ক্যানসেল করিয়ে জেলের ভেতর থাকাই শ্রেয় মনে করেছে।
(চলবে)
@অ্যাডমিন,
এই অংশটিতে ২৪টি ফুটনোট ছিল, কিন্তু একটাও আসেনি। হয়ত আমার দিক থেকে কোন টেকনিক্যাল ফল্ট হয়েছে যেটা বুঝতে পারছি না। প্লীজ, একটু দেখবেন?