সাঁই সাঁই করে বাতাস ধেয়ে আসছে।সাথে বিন্দু বিন্দু জলকণা।ঝুম বৃষ্টির পূর্ভাবাসই বলা চলে।আকস্মিক তুফানে গাছগুলোর অস্বাভাবিক দুলুনি দেখে মনে হলো তবে কি তারা মহাপ্রলয়ের আগমনী গান শুনেছে যে ক্ষণে ক্ষণে প্রাণপণে অমন ইতস্তত দুলতে আরম্ভ করেছে!খানিকবাদে আকাশটা কালো মেঘে সয়লাব হয়ে গেলো।আকাশটা থেকে চোখ না ফেরাতেই নামলো ঝুম বৃষ্টি।আহ,বৃষ্টি!নিমেষেই তার প্রেমজলে ভিজে সিক্ত হয়ে গেলো আশপাশের প্রতিটা গাছ,তরুর শাখা।হয়তোবা প্রাণ ফিরে পেলো শুকিয়ে মরতে বসা ছোট্ট মরিচ গাছটা।যার ভালোবাসারূপী জলের খুব অভাব পড়েছিলো।যে অভাবে সে মরতে বসেছিলো।বৃষ্টি অন্য সবার মতো তাকে ফিরিয়ে দিলো না।বিরহ যন্ত্রণায় তাকে দগ্ধও করলো না।অযুত ভালোবাসা দিয়ে ওর শুকনো শরীরটাতে বুলিয়ে দিলো শীতল জলের পরশ।
অনেকটা এরকম :
"বিবাগী হয়ে তুই যন্ত্রণায় মজে আর কেঁদে যাবি কত?
ফিরে চা এবার,তোর দরজায় আমি,ভোলাবো দুঃখ যাতনা যত।"
বৈশাখ পেরিয়ে জৈষ্ঠ্যও প্রায় শেষের
দিকে।আষাঢ় আসি আসি ভাব।যার কারণেই বোধ হয় সময়ে অসময়ে আকাশের এই রুদ্ররূপ আর অভিমানী মেঘের অশ্রুরূপী বৃষ্টির সংবরণ।কোয়ারেন্টাইনটা এমনই কাটছে।স্বভাবকৌতূহলী চোখ আর কানজোড়া পেতে কোন পাশ থেকে কোন পাখির ডাক শোনা গেলো,কোন জায়গা থেকে সাইকেলের ক্রিং ক্রিং বেজে উঠলো,কোন পাশ দিয়ে শো শো বাতাস গেলো,বাগানের কোন গাছটায় নতুন করে ফুল ধরলো এসবের খোঁজখবর রেখেই অলস সময়গুলো কেটে যায়।বলা হয়ে থাকে-নেই কাজ তো খই ভাজ।ঠিক তেমটাই ঘটছে।তবে আমি এর মাঝেই জীবনের অর্থবোধকতা খুঁজে চলেছি।
খোলা আকাশের নিচে আনমনে বসে থাকলে নাকি জীবনটাকে খুব কাছ থেকে গভীরভাবে উপলব্ধি করা যায়।জীবন নিয়ে যতশত রহস্য,জল্পনা-কল্পনা সব নাকি স্বচ্ছ জলের মত পরিষ্কার হয়ে যায়।কোয়ারেন্টাইনের সময়টাও আমাদের ঠিক সেই অনুভূতিটা দিয়ে চলেছে।লোকে যাই বলুক,এই পুরো খারাপ সময়ের মাঝেও কিছু অর্থবোধক মূহুর্ত উপহার দিয়েছে লকডাউনের দিনগুলো।যার কৃতিত্ব একদমই ফিরিয়ে দেয়া যায় না।যত্তসব অদ্ভুতুড়ে চিন্তার মাঝে এমনই কিছু চিন্তা আমার এই ছন্নছাড়া মস্তিষ্কে বাসা বেঁধে বসেছে।
আচ্ছা,এক অনন্য রহস্যের আঁধার যে আপনার বাড়িতে লুকিয়ে আছে সেটা কি কখনো খেয়াল করেছেন?উত্তরে হয়তো স্বভাবকৌতূহলী দৃষ্টিতে ড্যাব ড্যাব করে চেয়ে থাকবেন আমার দিকে!মনে মনে ভাববেন,এই ছেলে আবার এসব কি যা তা বলে বেড়াচ্ছে!হ্যাঁ,হ্যাঁ,সেই অদ্ভুত রহস্যের হদিসটা কিন্তু আমি পেয়েছি।পেয়েছি এ কোয়ারেন্টাইনের অলস সময়গুলোতেই।
জানেন,সেটা কি?
সেটা মায়ের রান্নাঘর।এ এক অসীম রহস্যের আঁধার।এ রান্নাঘরের আলাদা একটা বৈশিষ্ট্য আছে।আলাদা ঘ্রাণ আছে।আছে আলাদা প্রাণ।আমি একে বলি সাম্রাজ্য।
রান্নাঘরের তাকটা জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বয়ামভর্তি লং,দার্চিনি,এলাচি,গোল মরিচের গুঁড়ো,রসুন বাটার বাক্সটা কিংবা মরিচবাটার বাক্সটা
এ সুবিন্যস্ত ও রহস্যময় সাম্রাজ্যের একেকটা বৃহৎ নগরীর মতো।পরস্পর একত্রিত হয়ে তৈরি করে এক বিশাল সাম্রাজ্য।আবহমান কাল ধরে এ বিশাল সাম্রাজ্যের সেবা পেয়ে পেটের ক্ষুধা নিবারণ করে চলেছে তামাম মানবজাতি।ক্ষমতাধর মার্কিন প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে রাস্তার রিকশাওয়ালা মামাটাও।তবে এ সাম্রাজ্যের বিশালতা নিয়ে আমরা কখনোই ভাবিনা।অনেকের জীবনে তা অপ্রকাশিত রহস্য হিসেবেই রয়ে যায়।যদিও সেটা প্রতিটা ঘরে ঘরেই রাজত্ব করে চলে।আপনার ফুফুর,চাচীর কিংবা খালার।সবার ঘরেই।
সবচেয়ে মজার ব্যাপারটা হলো এই মায়েদের,চাচীদের বা খালাদের সাম্রাজ্যের যে প্রধান সেবা তথা রান্না তার কিন্তু আলাদা একটা বৈচিত্র্য ও ভিন্নতা আছে।পরখ করে দেখবেন যে, আপনার মায়ের রান্না আর আপনার খালার রান্নার স্বাদটা কিন্তু আলাদা।তবে উপাদান-উপকরণ ঠিক একই জিনিসই ব্যবহার করেন তারা।তেমনি ভাবে আপনার চাচীর হাতের চিংড়ীর চচ্চড়ির স্বাদ ও আপনার খালার হাতের চিংড়ীর চচ্চড়ির তুলনায় ভিন্নধর্মী হবে।এ জিনিসটা পুরোপুরি আমায় ভ্যাবাচ্যাকা খাইয়ে দেয়।কখনো কি সেই জিনিসটা চিন্তা করে দেখেছেন?পুরো বাঙাল মুলুকের প্রতিজন মমতাময়ীর হাতের এত্তসব অমৃতের স্বাদ কখনোই কারো সাথে মিশ খায় না।আমি এসব ভেবে তাজ্জব বনে যাই বারংবার।এতশত বৈচিত্র্য,এত বৈপরীত্য কিন্তু উপাদান-উপকরণগুলো তো সব একই!তবে এত বৈচিত্র্যের মাঝেও এক অসাধারণ মেলবন্ধন আছে এ সাম্রাজ্যের।সবগুলো ভিন্ন-ভিন্ন রং যেখানে একসাথ হয়ে তৈরি করেছে এক নান্দনিক সৌন্দর্যের।
সেই সৌন্দর্যটা হলো সন্তানের জিহ্বা।এই জিহ্বায় স্বাদ নিয়েই সন্তান জানান দেয়,পৃথিবীর সব রাঁধুনির চেয়েও তার মায়ের হাতের রান্না সবচেয়ে সুস্বাদু, সবচেয়ে মুখরোচক।এ এক জায়গায় সবাই এক।আমার কাছেও পৃথিবীর যে কোন সেরা রাঁধুনির রান্না আমার মায়ের রান্নার স্বাদের কাছে তুচ্ছ।মা অসুস্থ হয়ে বিছানায় শয্যাশায়ী হলেই বোঝা যায় তাঁর হাতের অমৃতের দাম কতখানি।তখন চিরাচরিত অমৃতের স্বাদ কপালে না জোটায় সন্তানের গোমড়া মুখ দেখেই আঁচ করা যায় কতটুকু অস্বস্তির মাঝে সে বাস করছে।পেটে পড়া অন্য যে কোন খাবারই তখন তার পাকস্থলীতে অজীর্ণতা তৈরি করে।পীড়া দেখা দেয়।
ঐ অমৃত যিনি সারাটাদিন এক করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে প্রস্তুত করেন তাকে আমরা অধিকাংশ সময়ই নিস্তার দেই না।বিশেষ করে সচরাচর অনেক ঘরেই দেখা যায় খাবার একটা দুটো চুল পেলেই কর্তা রেগেমেগে অস্থির।খাবার ছেড়েছুড়ে উঠে পড়েন।শুধু শুধু মেজাজ বিগড়ান।খুব চটে যান।চড়াও ও হয়ে পড়েন অনেকে।কিন্তু কখনোই ভাবেন না ঝড়-বৃষ্ট,ঈদ-পূজা-পার্বণ সব ছুটির দিনেই আপনি অনেকটা সময় বিশ্রাম নিয়ে,ঘুমিয়ে কাটাতে পারেন।কিন্তু তার কোন নিস্তার নেই।তার বিরাম নেই।বিশ্রাম নেই।অনবরত সে খেটেই চলে।শাক-মাছ কাটাকুটি,পেঁয়াজ-রসুন ভর্তা করতে করতেই তার জীবনের অনেকটুকু অংশ ব্যয় হয়ে যায়।ঠিকমত উপভোগ করতে পারে না কোন উৎসব-অনুষ্ঠানও।তারপরও তার কোন রা নেই।উচ্চবাচ্য করে না।হাতের কাটা দাগটা বারবার ছিঁচকাদুনের মতো দেখিয়ে বেড়ায় না।এ কারণেই তাঁরা মা।সৃষ্টিকর্তা তাদের পরশ পাথর বানিয়েছেন।অপরিমেয় ধৈর্য নিয়েই তাঁরা সব সয়ে যান।সংসার ঘানি টেনে চলেন নিত্যদিন।
সকাতরচিত্তে বাড়ির কর্তাদের প্রতি একটি অনুরোধ।মায়েদের যন্ত্রণাগুলো বুঝুন।খাবার টেবিলে বসে লবণ-মরিচ কম বেশি নিয়ে মাথা গরম করবেন না।মুচকি হেসে বলবেন-"তরকারিতে আজ মরিচ একটু বেশি হয়েছে তো কি হয়েছে?ধুর!মনমরা হয়ে থেকো না,একদিনই তো! কাল অবশ্যই ঠিকঠাক হবে।"
*নোয়াখালী,বাংলাদেশ
২৫ জ্যৈষ্ঠ,১৪২৭