গুপুর আইডিয়াটা কি চাঁদে টিনটিন থেকে? হেব্বি।
গোপু = গোপন পুলিশ? আমার তেমনি মনে হলো
রবিবার বিকেল সাড়ে পাঁচটা। একেতেই লকডাউন তারপর আবার দিনটা ছিল রবিবার। তাই অন্যদিনের তুলনায় প্রায় ফাঁকাই ছিল হাওড়া ব্রিজ। এমন সময় ওই এলাকায় কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশ কর্মীদের কানে ভেসে আসে এক মহিলার চিৎকার। একটু খোঁজ করতেই চোখে পড়ে হাওড়া ব্রিজের ৪ নম্বর পিলারে বেয়ে ক্রমশ উপরে উঠে পড়ছেন মাঝ বয়সী এক মহিলা। রবিবাসরীয় বিকেলে হঠাৎ এমন দৃশ্য দেখে কার্যত হতভম্ভ হয়ে যান কর্তব্যরত ট্রাফিক সার্জেন্ট। দ্রুত খবর দেওয়া হয় নর্থ পোর্ট থানায়। খবর পেয়ে এলাকায় পৌঁছায় পুলিশ বাহিনী। তলব করা হয় দমকলকেও। এরপরই শুরু হয় তাকে বাবা-বাছা করে বোঝানোর পালা। কিন্তু কে শোনে কার কথা! নোবেল হারিয়েছে বলে দাবি, একি আর চাট্টিখানিক ব্যাপার! সুতরাং, নিচে উপস্থিত পুলিশ আধিকারিকদের জোর গলায় তিনি জানিয়ে দেন, তার খোয়া যাওয়া নোবেল না ফেরানো পর্যন্ত কিছুতেই নিচে নামবেন না তিনি। দমকল ও পুলিশের কর্তাদের সব প্রস্তাব পত্রপাঠ খারিজ করে দিয়ে তিনি দাবি করেন, অমর্ত্য সেনের থেকে তার নোবেল ফেরানোর জন্য বহু কাঠখড় পুড়িয়েছেন তিনি। বারবার প্রশাসনের দ্বারস্থ হয়েও কোনও কিছুতেই কোন লাভ হয়নি। বাধ্য হয়েই এই চূড়ান্ত পদক্ষেপ নিতে হয়েছে তাকে। এরপর অবশ্য প্রায় ঘন্টাখানেকের প্রচেষ্টায় অবশেষে তাকে নামাতে সক্ষম হয় পুলিশ ও দমকল বাহিনী।
মাস্ক পরিল। হাত ধুইল। থালাও বাজাইল। তবু, ঔষধ আসিল না। তালা ঝুলিল। ইকনমি পড়িল। মজুরও মরিল। তবু, করোনা মরিল না। দাম চড়িল। ভাড়া বাড়িল। কর্মী ছাঁটিল। তবু, মাইনে ঢুকিল না। আখড়া খুলিল। লাইন পড়িল। পয়সা উঠিল। তবু, রেশন আসিল না। নেতা চ্যাঁচাইল। পুলিশ ঠ্যাঙাইল। ঝড়ে ভ্যাঙাইল। অনুদান আসিল না। ব্যাংক খুলিল। ইএমআই কাটিল। পেছন ফাটিল। তবু, অফিস খুলিল না।
কিউবা ডাক্তার পাঠাইল। আম্রিকা হুমকি পাঠাইল। চিন সেনা পাঠাইল। নেপাল চিঠি পাঠাইল। পাকিরা পঙ্গপাল পাঠাইল। বাকিরা রাজ্যপাল পাঠাইল। তবু, মাল্যকে দেশে পাঠাইল না। আম্বানি টাকা পাঠাইল। ট্রাম্পকে ক্লোরোকুইন পাঠাইল। নবান্নে লোক পাঠাইল। বিদেশে প্লেন পাঠাইল। জুতিয়া পাকিস্তান পাঠাইল। তবু, গরীবকে বাড়ি পাঠাইল না।
ভাণ্ডে কেস জমিল। ফাণ্ডে টাকা জমিল। স্বর্গে ভিড় জমিল। মর্গে লাশ জমিল। ঘিলুতে ক্রোধ জমিল। তবু, বোধ জমিল না। সকালে অ্যাপ নামিল। বিকালে র্যাফ নামিল। স্পেশাল টিম নামিল। ঘোড়ার ডিম নামিল। সস্তায় শ্লোক নামিল। রাস্তায় লোক নামিল না। কেহ বাড়িতে থাকিল। কেহ মারিতে থাকিল। দেশ চলিতে থাকিল। দ্বেষ দলিতে থাকিল। মানুষ হাঁটিতে থাকিল। মান-হুঁশ, ফাটিতে থাকিল না।
মন্দির খুলিতেছে। মসজিদ খুলিতেছে। ইস্কুল খুলিতেছে না। মামলা ঝুলিতেছে। কোভিড ঝুলিতেছে। চক্ষু খুলিতেছে না। পাজি ভাটাইতে থাকিল। বাজি ফাটাইতে থাকিল। কাজি বিচার লিখিল না। নামাজ শিখিল। মন্ত্র শিখিল। অঙ্ক শিখিল না। প্লেন চলিতেছে। বাস চলিতেছে। ট্রেন চলিতেছে। পেট চলিতেছে না। ক্ষুধা বাড়িতেছে। জ্ঞান ঝাড়িতেছে। গালি পাড়িতেছে। গুলি মারিতেছে। তবু, রা কাড়িতেছে না।
ম্যানিফেস্টো পোড়াইবে। হরেকেষ্ট শোনাইবে। বেশি ট্যাঁ-ফোঁ চলিবে না। মোমবাতি জ্বলিয়াছে। চিতাও জ্বলিবে। তবু, বরফ গলিবে না। শ্রমিক দধীচি হইবে। পাঁজরে রেলপথ হইবে। কেহ কথা বলিবে না।
লেখা: রোহন ভট্টাচার্য্য
একটি মূল্যবোধের চিঠি আর জীবনের অভিমুখ-
বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের অন্যতম কবি নির্মলেন্দু গুণ এর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সহপাঠি ছিলেন। ১৯৮৮ সালে কবি নির্মলেন্দু গুণ জাতীয় দৈনিক সংবাদপত্রে কাজ করতেন। ঐবছরে দেশজুড়ে বন্যাজনিত দূর্যোগ চলছিলো। এইসময়ে তাঁকে লেখা শেখ হাসিনার একটি অসাধারণ চিঠি হুবহু তুলে ধরা হলো;
.........….........................
“বন্ধুবরেষু গুণ,
আপনার অনুরোধে কিছু ছবি পাঠালাম। তবে আমার একটা অনুরোধ রাখবেন। ‘ত্রাণ বিতরণ করছি’ এ ধরনের কোনো ছবি ছাপাবেন না। মানুষের দুর্দশার ছবি যত পারেন ছাপান। আমার ধারণা এ ধরনের অর্থাৎ ত্রাণ বিতরণের ছবি টেলিভিশন ও খবরের কাগজে দেখে দেখে মানুষ বীতশ্রদ্ধ হয়ে গেছে।
ওরা গরিব, কিন্তু সেটা কি ওদের অপরাধ? একশ্রেণি যদি প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ আহরণ না করত তাহলে এরা কি গরিব হতো? কার ধন কাকে বিলাচ্ছে? যা কিছু আছে সকলে মিলে ভাগ করে ভোগ করলে একের কাছে অপরের হাত পাতার প্রয়োজন হতো না।
ওদেরই সম্পদ লুট করে সম্পদশালী হয়ে আবার ওদেরই দুর্দশার সুযোগ নিয়ে সাহায্য দানের নামে হাতে তুলে দিয়ে ছবি ছাপিয়ে ব্যক্তিগত ইমেজ অথবা প্রতিষ্ঠা লাভের প্রয়াস আমি মানসিকভাবে কিছুতেই মেনে নিতে পারি না। আমার বিবেকে বাধে। তবুও অনেক সময় পারিপার্শ্বিক চাপে পড়ে অনেক কিছুই করতে হয়। আমিও করি। বিবেকের টুঁটি চেপে ধরে অনেক সময় সমাজ রক্ষার তাগিদে, সঙ্গীদের অনুরোধ বা অপরের মান রক্ষার জন্য এ ধরনের কাজ বা ছবি তুলতে হয় বৈকি। তবে যে যাই দান করুক না কেন, বিলি করুক না কেন, এটা তো ওই গরিব মানুষগুলোর অধিকার, তাদেরই প্রাপ্য।
ক্ষমতার দাপটে কেড়ে নেওয়া ওদেরই সম্পদ অথবা ওদের পেটের ক্ষুধা দেখিয়ে দেশ-বিদেশ থেকে ভিক্ষে এনে এদের দান করা। এখানে ‘ক্রেডিট’ নেওয়ার সুযোগ কোথায়? এই ‘ক্রেডিট’ নিতে যাওয়াটা কি দুর্বলতা নয়? আত্মপ্রবঞ্চনা নয়? কতকাল আর বিবেককে ফাঁকি দিবে? এই গরিব মানুষগুলোর মুখের গ্রাস কেড়ে খেয়ে আবার এদেরই হাতে ভিক্ষে তুলে দিয়ে ছবি ছাপিয়ে ইমেজ তৈরির পদ্ধতি আমি পছন্দ করি না।
আমি মনে করি, যা দান করব তা নীরবে করব, গোপনে করব। কারণ এটা লজ্জার ব্যাপার, গর্ব করার ব্যাপার মোটেই নয়। গর্ব করার মতো কাজ হতো যদি এই সমাজটাকে ভেঙে নতুন সমাজ গড়া যেত। গর্ব করার মতো হতো যদি একখানা কাঙালের হাতও সাহায্যের জন্য বাড়িয়ে না দিত। ফুটপাথে কঙ্কালসার দেহ নিয়ে ভিক্ষের হাত না বাড়াতে সেটাই গর্ব করার মতো হতো।
যে স্বপ্ন আমার বাবা দেখেছিলেন, সেদিন কবে আসবে? আমার অনুরোধ আপনার কাছে, সেই ছবি ছাপাবেন না যে ছবি হাত বাড়িয়েছে সাহায্য চেয়ে, আর সেই হাতে কিছু তুলে দিচ্ছি ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে। অনেকেই তুলে থাকেন। আমার বড় অপরাধী মনে হয় নিজেকে। লজ্জা হয় গরিব মানুষদের কাছে মুখ দেখাতে। আমরা সমাজে বাস করি। দুবেলা পেট পুরে খেতে পারি। ভালোভাবে বাঁচতে পারি। কিন্তু ওরা কি পাচ্ছে? ওদের নিয়ে এ ধরনের উপহাস করা কেন? ওরা বরদাশত করবে না, একদিন জেগে উঠবেই সেদিন কেউ রেহাই পাবে না। আমার অনুরোধ আশা করি রাখবেন।
শুভেচ্ছান্তে
শেখ হাসিনা
৯.১০.৮৮’”
(এই লেখা শ্রী বাহাউদ্দিন গোলাপ- এর পোস্ট থেকে সংগৃহীত।)
আমার এক বন্ধু ছিল, যার বাবা তার জীবনটা নরকে পরিণত করে দিয়েছিল। ইস্কুলের পরীক্ষায় প্রথম হলেও নিস্তার নেই। কেন একশোয় একশো পায়নি, অতএব মার। সঙ্গে তাঁর কাজ ছিল ছেলেকে ক্রমগত নিজের বন্ধুদের প্রতি বিষিয়ে তোলা। প্রতি মুহূর্তে প্রতিযোগিতার দিকে ঠেলে দেওয়া। একজন মানুষকে সব পারতে হবে? সবেতেই শ্রেষ্ঠ হতে হবে? এমন আগ্রাসী ছিল লোকটি যে ছেলেকে শ্রেষ্ঠ করতে দুর্নীতিতেও পিছ পা ছিল না। আবৃত্তিতে প্রথম করতে হবে। আগের বারের জাজকে ডেকে আনলো ছেলেকে আবৃত্তি শেখাতে। সে জাজও তেমন বস্তু। জীবনে একবার বহুরূপীর ওয়ার্কশপে গেছিল সেই ভাঙিয়ে খায়। ছন্দ থেকে স্ক্যানিং থেকে কবিতার দর্শন - কিস্যু বোঝে না। উল্টে বেশ পাতি কিছু কবিতা লিখে আমার বন্ধুর বাবাটির থেকে পয়সা নিয়ে বই করে। তারপরে তাকে উৎসর্গ করে দেয়। এবং পাড়ায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে সে বই জোর করে কেনাতো। বুঝতেই পারছেন একেবারে চোরের সাক্ষী গাঁটকাটা। তো সেই জাজকে ডেকে এনে ছেলেকে কবিতা শিখিয়ে পরের বছর পাড়ায় ইনফ্লুয়েন্স খাটিয়ে সেই জাজকেই বসালো বিচার করাতে। কিন্তু আরো জাজ তো ছিলেন। অতএব তাতেও সুবিধে হল না। ছেলেটিকে জোর করে দ্বিতীয় করা হল। এবং বাড়ি গিয়ে ছেলেটি আবার মার খেল।
এই ছেলেটিই পড়তে গেল নামকরা এক প্রতিষ্ঠানে। গেল প্রযুক্তিবিদ হতে। আটকে গেল সেখানে। সারাজীবন বাবার ভয়ে সব মুখস্ত করে গেছে। বোঝেনি কোনো সাবজেক্টই। উচ্চশিক্ষায় মুখস্ত দিয়ে চালাতে পারছিল না। একের পর এক পরীক্ষায় অকৃতকার্য। সঙ্গে গাঁজা। বাবার সঙ্গে ততদিনে তার সম্পর্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে আদায়-কাঁচকলায়। যাই হোক, প্রতিষ্ঠান শেষমেশ ছেলেটিকে আর রাখলো না। বাড়ি ফিরে এল যখন সে ধ্বংসস্তুপ। নেশায় নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে। নেশার পয়সা না দিলে তাণ্ডব করে বাড়িতে।
এখানেই শেষ না। ছেলেটি তার ছেলেবেলার প্রতিদ্বন্দ্বিতা সত্ত্বেও যে কোনো কারণেই হোক, আমাকে ভালও বাসতো, ভয়ও পেত। গোপনে গোপনে আসতো আমার কাছে। বসে বলতো তাকে ইউ এস থেকে প্রতিরক্ষার বিশেষ বরাত দিয়েছে। তার কাজ এমন এক সফটওয়্যার তৈরী করা যা ম্যাট্রিক্সের মত হবে। সফটওয়্যার গুড আর ইভিল-কে আলাদা করবে। ধ্বংস করবে সুপার ওয়ারিয়র দিয়ে। এ খুব গোপন প্রকল্প। আমাকে ছাড়া কাউকে ভরসা করে বলতে পারছে না ও!
হ্যাঁ গিয়েছিল ইউ এস এ-তে একদা। শুনতাম আমি। অন্য নানা কথা বলতাম। ছোটবেলার স্মৃতি, ওর ভাল কাজের স্মৃতি একে একে ধরিয়ে দেবার চেষ্টা করতাম। আমাদের নানা বদমাশির গল্প। যখন সে সব শুনতো আবার ফিরে আসতো নিজের মধ্যে। কিন্তু কিছুক্ষণেই সেই...। ওর বাবাকে রাস্তায় চেপে ধরে একদিন বলেছিলাম চিকিৎসার কথা। ছেলেটি এইভাবে তো শেষ হয়ে যাচ্ছে। প্রথমে আমাকে খানিক চোখ গরম করতে গেল। তারপরে দেখল যখন ফলাফল সুবিধের হবে না তখন পাড়ায় একে ওকে আমার নামে নানা কথা বলতে থাকল। মানে আমি কেমন গুন্ডা প্রকৃতির আর কী! কিন্তু ছেলের চিকিৎসা করালো না কিছুতেই। অথচ চাকরীতে প্রচুর দুনম্বরি করেছে লোকটা। টাকার কুমীর। কিন্তু...। সম্ভবত ছেলে মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছে এটা ডাক্তার বললে ওর সম্মান যাবে, অথবা ডাক্তার ছেলের প্রতি ওর করা অপরাধগুলো জেনে যাবে, যে কোনো কারণেই হোক করালো না চিকিৎসা। এমন কী পরে থানা-পুলিশ করেও চেষ্টা হয়েছিল। লাভ হল না। চলে গেলো ছেলেটি অকালে। কিচ্ছু করতে পারিনি আমরা। এখন ভাবি ওই অঞ্চলে থাকলে আমি আলাদা কিছু আদৌ করতে পারতাম? ভেবে আর...।
এত কথা মনে হল কাল হাওড়া ব্রিজে উঠে পড়া মানুষটির কথা শুনে। নোবেল, অমর্ত্য সেন, অভিজিৎ বিনায়ক, জিন, গবেষণা, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক - প্রতিটি শব্দ শুনছিলাম আর বন্ধুর কথা মনে করছিলাম। মনে করছিলাম একটা ব্যর্থ শিক্ষা ব্যবস্থা, ব্যর্থ অভিভাবকের দল (স্রেফ পয়দা করেছে বলে যারা সন্তানের মালিক) কেমন করে হত্যা করে সন্তানদের। এর বিরুদ্ধে আসলেই কোনো ব্যবস্থা নেই। আমি জানি না ওনার অতীতেও এমন কোনো উচ্চাকাঙ্খার তাড়না আছে কী না, কিন্তু সন্দেহ হচ্ছে। এই ভারসাম্যহীনতা আসলে এঁদের একদমই না। এঁরা সেই সব মানুষ যাঁরা আমাদের ভারসাম্যহীনতার শিকার। এঁরা সামনে এলে আমরা 'পাগল' বলে খিল্লি করি, কারণ নিজেদের ভারসাম্যহীনতাকে স্বীকার করার শিক্ষা বা হিম্মত আমাদের নেই। আমাদেরই চিকিৎসা দরকার, কিন্তু এও জানি হবার সম্ভাবনা প্রায় শূন্য।