এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • বিশ্বপরিচয় : একটি বৌদ্ধিক রাহাজানি?

    মুক্তচিন্তার পথিক
    অন্যান্য | ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০ | ২৩৫৯ বার পঠিত
  • বিজ্ঞানের সঙ্গে সাহিত্যের মেলবন্ধন করবার ইচ্ছা রবীন্দ্রনাথের বরাবরই ছিল। সম্ভবত এই প্রয়াসেই বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু, মেঘনাদ সাহা, সত্যেন্দ্রনাথ বসু এবং প্রশান্তচন্দ্র মহালনবিশ ছিলেন কবির অতি কাছের মানুষ। আর আইনস্টাইনের সঙ্গে কবির কথোপকথনের কাহিনী তো জগতবিখ্যাত হয়ে আছে। এর সবকিছুই তাঁর বিজ্ঞানের প্রতি প্রবল ভালবাসার প্রমাণ হিসাবে আমরা নিতে পারি। 'ভারতী' 'বালক' ও 'সাধনা' পত্রিকা তিনটিতে কেন্দ্র করে রবীন্দ্রনাথ বিজ্ঞানালোচনায় প্রথম উদ্যোগী হন যাহাতে তিনি বেশ কযেকটি বিজ্ঞানপ্রবন্ধ লিখেছিলেন। তবে তাঁর এই ভালোবাসার চুড়ান্ত প্রকাশ দেখা গেল জীবনের শেষ লগ্নে এসে যখন তাঁর হাত থেকে 'বিশ্বপরিচয়'র মতো অসাধারণ বিজ্ঞান গ্রন্থখানির সৃষ্টি হল। তিনি যে বিজ্ঞানপ্রেমিক ছিলেন, বিজ্ঞানের রস আস্বাদনে তাঁর যে লোভের অন্ত ছিল না, সেটা আমরা এই বইয়ের উৎসর্গপত্র থেকেও জানতে পারি। বইটি তিনি উৎসর্গ করেছিলেন বিখ্যাত বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে।

    বিশ্বপরিচয় গ্রন্থখানি পড়লে আমাদের মনে হতেই পারে যে রবীন্দ্রনাথ হয়তো বিজ্ঞানের উপরে অগাধ পড়াশোনা করে নিজের জ্ঞান ও উৎকর্ষতা বাড়িয়ে নিয়ে, নিজেকে বিজ্ঞান-সমৃদ্ধ করে গ্রন্থটি লিখতে বসেছিলেন। তাঁর মানের একজন ব্যক্তি, যিনি নিজেকে ক্রমাগত ভেঙেছেন ও গড়েছেন - এ কাজ করতেই পারেন। বিশেষত বিশ্বপরিচয়ের উৎসর্গপত্রে সত্যেন্দ্রনাথ বসুর উদ্দেশ্যে তিনি যখন বলেন, "আমি বিজ্ঞানের সাধক নই সে কথা বলা বাহুল্য। কিন্তু বালককাল থেকে বিজ্ঞানের রস আস্বাদনে আমার লোভের অন্ত ছিল না।" এবং দাবী করেন, "কয়েকটি প্রামাণ্য গ্রন্থ সামনে রেখে সাধ্যমতো নিড়ানি চালিয়েছি।" তখন এ কথা আমাদের মনে হতেই পারে যে রবীন্দ্রনাথ সত্যিই বোধহয় বিজ্ঞানের বেশ কিছু আকর গ্রন্থ পড়ে বইখানি লিখতে বসেছেন।

    কিন্তু ছন্দপতন ঘটে যখন ওই একই উৎসর্গপত্রের শেষের দিকে রবীন্দ্রনাথ অন্যরকম কিছু মন্তব্য করে বসেন। যদিও তিনি আন্তরিক অকপটতায় কথাগুলো বলার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু ত‍ার মধ্য থেকেই বেরিয়ে এসেছিল এক সংশয়। প্রথমে দেখা যাক, রবীন্দ্রনাথ ঠিক কী বলেছিলেন। সত্যেন্দ্রনাথকে উদ্দেশ্য করে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, "শ্রীমান প্রমথনাথ সেনগুপ্ত, এম. এসসি, তোমারই ভূতপূর্ব ছাত্র। তিনি শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ে বিজ্ঞান-অধ্যাপক। বইখানি লেখবার ভার প্রথমে তাঁর উপরেই দিয়েছিলেম। ক্রমশ সরে সরে ভারটা অনেকটা আমার উপরেই এসে পড়ল। তিনি না শুরু করলে আমি সমাধা করতে পারতুম না, তাছাড়া অনভ্যস্ত পথে শেষ পর্যন্ত অব্যবসায়ীর সাহসে কুলোত না। তাঁর কাছ থেকে ভরসাও পেয়েছি, সাহায্যও পেয়েছি।"

    সংশয়টা এইখানেই শুরু হয়। জেগে ওঠে অনেক প্রশ্ন। যে বই লেখার ভার পড়েছিল প্রমথনাথের উপরে, হঠাৎ করে সেই ভার রবীন্দ্রনাথের ঘাড়ে গিয়ে পড়লো কেন? প্রমথনাথ ঠিক কতখানি শুরু করেছিলেন? তিনি কেন শেষ করেন নি? যতটুকু শুরু করেছিলেন তাতে করে সহলেখক হিসাবে তাঁকে স্বীকৃতি দেওয়াটা যুক্তিসঙ্গত ছিল কি না? আসুন দেখি, একে একে এই প্রশ্নগুলির জবাব পাওয়ার চেষ্টা করি।

    মূল ঘটনায় যাবার আগে ‘বিশ্বপরিচয়’ গ্রন্থটির শুরুর ইতিহাসটুকু একটু জেনে নেয়া যাক। রবীন্দ্রনাথের এক সময় ইচ্ছে হয়েছিল ‘লোকশিক্ষা গ্রন্থমালা’ রচনা করবার। "সেই গ্রন্থমালার উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষণীয় নানা বিষয়কে বাংলাদে‍শের সর্বসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া। সুতরাং রচনার ভাষাকে হতে হবে সহজ সরল এবং যথাসম্ভব পরিভাষা বর্জিত। অথচ তার মধ্যে বিষয়বস্তুর দৈন্য থাকবে না।" মহাবিশ্ব সংক্রান্ত এই ‘লোকশিক্ষা গ্রন্থমালা’ সিরিজের প্রথম বইটি লেখবার ভার তিনি দেন পদার্থবিদ্যার অধ্যাপকের কাজ নিয়ে বিশ্বভারতীতে যোগ দেয়া তরুণ অধ্যাপক প্রমথনাথ সেনগুপ্তের উপর।

    অভিজিত রায়, বিশ্বভারতী থেকে প্রকাশিত রবীন্দ্রজীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের 'রবীন্দ্রজীবনী ও রবীন্দ্রসাহিত্য : প্রবেশক চতুর্থ খণ্ড' বইয়ের ৯৬ পৃষ্ঠা থেকে উদ্ধৃত করে বলেছেন, "কবির ইচ্ছা যে, এই লোকশিক্ষা গ্রন্থমালার প্রথম গ্রন্থ হইবে বিশ্বপরিচয়। কবি বলেন, ‘বুদ্ধিকে মোহমুক্ত ও সতর্ক করবার জন্য প্রধান প্রয়োজন বিজ্ঞানচর্চার। … জ্ঞানের এই পরিবেশনকার্যে পাণ্ডিত্য (pedantry) যথাসাধ্য বর্জনীয় মনে করি।  এই প্রথম গ্রন্থখানি লিখিবার ভার অর্পণ করা হইয়াছিল প্রমথনাথ সেনগুপ্তের উপর। প্রমথনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতি ছাত্র, সত্যেন বসুর প্রিয় শিষ্য, শিক্ষাভবনে পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক।"

    এবার দেখা যাক, ঘটনাপ্রবাহ কিভাবে এগিয়ে চলেছিল।

    ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের কৃতী ছাত্র প্রমথনাথ সেনগুপ্ত এমএসসি করে পাঁচ বছর বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর কাছে গবেষণা করেছিলেন। ১৯৩৩ সালের মে মাসে গ্রীষ্মকালীন অবকাশে তিনি 'স্টেটসম্যান' পত্রিকায় বিশ্বভারতীর পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক পদের জন্য বিজ্ঞাপন দেখে আবেদন করে ফেললেন। জুন মাসের শেষ সপ্তাহে শান্তিনিকেতন থেকে পেলেন সিলেকশনের সংবাদ। অভিজিত রায় লিখেছেন, "তরুণ প্রমথনাথ শান্তিনিকেতনে চাকরী পেয়েছিলেন সত্যেন বসু এবং জ্ঞানচন্দ্র ঘোষের সুপারিশে।" ঘটনাটা সম্ভবত তাই-ই কারণ প্রমথনাথ নিজেও রবীন্দ্রনাথের উক্তি উদ্ধৃত করে এই কথারই সমর্থন করেছেন।

    ১৯৩৩ সালের ১৫ই জুলাই প্রমথনাথ মাসিক ৭৫ টাকা বেতনে যোগ দিলেন বিশ্বভারতীতে।

    আশীষ লাহিড়ী লিখেছেন, "মেট্রোপলিটান কলেজে বিদ্যাসাগর মশাই যেমন শিক্ষকদের না জানিয়ে আড়াল থেকে শিক্ষাদানের পদ্ধতি পর্যবেক্ষণ করতেন, রবীন্দ্রনাথও, অন্তত প্রমথনাথের ক্ষেত্রে, তাই করতেন।" এরকমই একদিনের কথা লিখেছেন প্রমথনাথ। তিনি ক্লাসে পড়াচ্ছেন, দেখতে পেলেন গুরুদেব দরজায় দাঁড়িয়ে, দৃষ্টি নিবদ্ধ টেবিলের উপরের যন্ত্রপাতির দিকে। ল্যাবরেটরির ভিতরে ঢুকে যন্ত্রগুলি সাগ্রহে দেখে গুরুদেব বললেন, "এবার অধ্যাপনা শুরু করো, বিজ্ঞানের রস আস্বাদনে আমার লোভের অন্ত নেই।"

    সেইদিনই সন্ধ্যার পর গুরুদেব প্রমথনাথকে ডেকে পাঠালেন উত্তরায়ণে।

    সেখানে তখন বসে প্রিন্সিপাল ডঃ ধীরেন্দ্রমোহন সেন। এইখানে রবীন্দ্রনাথ প্রমথনাথকে লোকশিক্ষার জন্য একটি বিজ্ঞানের বই লেখবার প্রস্তাব দিলেন। বললেন, "তোমার উপর একটা ভার দিতে চাই, বৈজ্ঞানিক বিষয়ে 'লোকশিক্ষা' পাঠগ্রন্থ প্রণয়নের কাজ।" বই লেখার নির্দেশ দিয়ে গুরুদেব তাঁকে বইয়ের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে বললেন এবং লেখবার পদ্ধতি নিয়েও আলোচনা করলেন। "সাধারণ জ্ঞানের সহজবোধ্য ভূমিকা করে দেওয়াই হবে তোমার কাজের উদ্দেশ্য। তাই, জ্ঞানের এই পরিবেশনকার্যে পাণ্ডিত্য যথাসাধ্য বর্জন করতে হবে। পড়তে দিলেন ব্রিটিশ পদার্থবিদ স্যার জেমস জিনসের লেখা একটা বই, ‘থ্রু স্পেস এ্যান্ড টাইম’। বইটি থেকে জনপ্রিয় বিজ্ঞানের বই কিভাবে লিখতে হয় তার একটা রসদ পাবেন প্রমথবাবু – বোধহয় সেরকমই একটা ধারণা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।

    এইখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছেন দীপঙ্কর চট্টোপাধ্যায় - প্রমথনাথ বিজ্ঞানের কৃতী ছাত্র এবং খুব ভাল শিক্ষক হতেই পারেন, কিন্তু "যেখানে এতটা প্রত্যাশা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ লোকশিক্ষামূলক বিজ্ঞানের বই লেখাচ্ছেন এবং সেই বই নিয়ে তাঁর ঈপ্সিত 'লোকশিক্ষা গ্রন্থমালা'র প্রকাশন শুরু করবেন বলে ভেবেছেন, সেখানে প্রমথনাথের যোগ্যতা সম্বন্ধে তিনি নিশ্চিত হলেন কি করে?" এর উত্তর রয়েছে প্রমথনাথকে দেওয়া রবীন্দ্রনাথের প্রস্তাবেই - "আমি বিজ্ঞানের সাধক নই, তবে বিজ্ঞানের সঙ্গে প্রথম পরিচয় ঘটিয়ে দেবার কাজে সাহিত্যের সহায়তা কিভাবে গ্রহণ করতে হবে ও কিভাবে লোকশিক্ষাদান সঙ্কল্পকে সার্থক করে তুলতে পারা যায় সে বিষয়ে নিঃসঙ্কোচে আমার সাহায্য নিতে পার।"

    সত্যি কথা বলতে কি, যার পর নাই খুশি হয়েছিলেন প্রমথনাথ। এর পরের ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায় প্রমথনাথ সেনগুপ্তের রচিত 'আনন্দরূপম' গ্রন্থখানিতে। এই প্রসঙ্গে ওই গ্রন্থটি নিয়ে দুকথা বললে তা নিশ্চয়ই অপ্রাসঙ্গিক হবে না।আনন্দরূপম-এর লেখাগুলি প্রথম মুদ্রিত হয়েছিল 'সাপ্তাহিক বসুমতী' পত্রিকায়, ১৯৭০ সালের ২৮শে মে থেকে ১০ই সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বসুমতীর ৭৪ বর্ষের ৪৮ তম সংখ্যা থেকে ৭৫ বর্ষের ১১ তম সংখ্যা অর্থাৎ মোট চোদ্দো কিস্তিতে। পত্রিকায় প্রকাশের সময় মূল লেখাটির সঙ্গে ছাপা হয়েছিল প্রমথনাথের স্বহস্তে লেখা 'বিশ্বপরিচয়'-এর খসড়া পান্ডুলিপির মধ্যে রবীন্দ্রনাথের সংশোধন সমেত পাঁচটি পৃষ্ঠার প্রতিলিপি। রচনাটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশের বছর দুইয়েক পর 'বসুমতী প্রাইভেট লিমিটেড পাবলিকেশন' থেকে ১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে 'আনন্দরূপম'এর গ্রন্থরূপে প্রকাশ। ৭ই সেপ্টেম্বর বসুমতী পত্রিকায় আসন্ন প্রকাশিত বইটির একটি বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল, যাতে লেখা ছিল, "রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে নানা অজানা তথ্যের সমাবেশে গ্রন্থটি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে একটি অপরিহার্য গ্রন্থ হিসেবে নিঃসন্দেহে বিবেচিত হতে পারে।" কিন্তু কোনো এক অজ্ঞাত কারণে বইটির প্রথম এবং একমাত্র সংস্করণটি প্রকাশিত হওয়ার পর জনমানসের স্মৃতি থেকে হারিয়ে যায়। অভিজিত লিখেছিলেন, "এখন বইটি দুর্লভ, খুঁজলেও পাওয়া যায় না।" প্রায় পঞ্চাশ বছর পর এই হারিয়ে যাওয়া বইটি নবরূপে আমাদের ফিরিয়ে দিলেন সাহিত্য সংসদ।

    রবীন্দ্রনাথের কাছে বই লেখবার আদেশ পাওয়ার পর কি হল, তা বরং প্রমথনাথের নিজের বয়ান থেকেই শোনা যাক। "সেদিন থেকেই বিজ্ঞানের সহজ বই পড়তে লেগে গেলাম, তারপর ধীরে ধীরে শুরু হল বই লেখার কাজ। সে এক বিপর্যয় কান্ড ! কোনোদিন বৈজ্ঞানিক তথ্য দিয়ে সুসংবদ্ধ বাংলা রচনায় হাত দিইনি, দু-একটা ছোটখাট রচনা যা লিখেছি, তা হল ইংরেজিতে। তাই এই অনভ্যস্ত পথে প্রতিপদে শুধু হোঁচটই খেতে হল। এগোনো আর হচ্ছিল না, নিজের লেখা নিজেরই এত খারাপ লাগতে আরম্ভ হলো যে দু-এক পাতা লিখেই তা ছিঁড়ে ফেলতাম। ফলে ছিন্ন কাগজের পাতায় ঝুড়ি ভর্তি হয়ে উঠল। খাতাখানাও তার সম্বল হারিয়ে ক্রমশ শীর্ণকায় হয়ে উঠল। অবশ্য এতে একজন খুব খুশি হলেন, উনুন ধরাবার কাজে অনায়াসলব্ধ এই ছিন্নপত্রগুলো আমার স্ত্রী যথাযথ সদ্গতি করে চললেন।" এই উদ্ধৃতিটুকু থেকে বোঝা যায় প্রমথনাথ নিজের বাংলা রচনা নিয়ে বিশেষ আত্মবিশ্বাসী ছিলেন না, কিন্তু এটুকু অন্ততঃ ঠিক যে বইটার লেখকসংক্রান্ত বিষয়ে তখনও পর্যন্ত কারুর মনে কোনও প্রশ্ন জাগে নি।

    এই সময় একদিন এলেন পাঠভবনের অধ্যাপক তনয়েন্দ্রনাথ ঘোষ এবং প্রিন্সিপাল ডঃ ধীরেন্দ্রমোহন সেন। প্রমথনাথের স্ট্রাগল দেখে তনয়বাবু বললেন, "এভাবে তো কোনো সমাধান হবে না, আপনি যা পারেন লিখুন, তবে তথ্যের দিক থেকে যেন হালকা না হয় সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখবেন। আমাদের বিচারে যে ভাষা সাধারণত ভালো বলে আখ্যা পায়, গুরুদেবের হাতে পড়লে তার খোল-নলচে বদলে গিয়ে এক নতুন ভাষা প্রকাশ পায়। কাজেই বৈজ্ঞানিক তথ্য পর পর সাজিয়ে দিন, ভাষার ভার গুরুদেব নেবেন। গুরুদেবের সেই ভাষা দেখে পরবর্তী পর্যায় লিখতে শুরু করবেন।" ডঃ সেন বললেন, "আপনার ভাষায় লিখে যান তথ্যের পারম্পর্য রক্ষা করে, তারপর দেখবেন ভাষা প্রয়োগের অসাধারণ নৈপুণ্যে ও সহজ দৃষ্টান্তের ভিতর দিয়ে কি সুন্দরভাবে গুরুদেব এসব তথ্য শিক্ষার্থীর আয়ত্তগম্য সীমায় পৌঁছে দেন। তাঁর হাতে সেই হবে আপনার সবচেয়ে বড় ট্রেনিং।"

    এখানে একটা বিষয় দেখবার আছে, বই লেখবার এই পদ্ধতি ঠিক হবার পরেও হতভাগ্য প্রমথনাথবাবু কিন্তু ভাবছেন বইটা তাঁরই রচনা হবে। তিনি লিখেছেন, "ওদের উপদেশ মেনে নিয়ে তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু হল, বইটার নামকরণ করলাম, 'বিশ্বরচনা'। ধীরে ধীরে কাজ এগোতে লাগল। ‘পরমাণুলোক’ দিয়ে শুরু হলো বইয়ের প্রথম অধ্যায়, এটা শেষ করে গুরুদেবের কাছে নিয়ে যেতে হবে।" দীপঙ্কর বাবুর ভাষায়, "বইটার নামকরণ করলাম 'বিশ্বরচনা', এ-কথার মধ্যে তারই আভাস পাওয়া যায়।"

    যাইহোক, প্রথম অধ্যায় লেখা শেষ করে প্রমথনাথ রবীন্দ্রনাথের কাছে নিয়ে গেলেন। রবীন্দ্রনাথ সাগ্রহে লেখাটি পড়তে আরম্ভ করলেন ও তার উপর কলম চালিয়ে চললেন। কিছুক্ষণ পরে বললেন, “রচনাটি আমার কাছে রেখে যাও, কাল ফেরত পাবে। বিজ্ঞানের সঙ্গে প্রথম পরিচয় ঘটাতে হলে ভাষাটা কীরকম হবে, তাই শুধু দেখিয়ে দেব। একটা কথা মনে রাখতে হবে, এসব গ্রন্থের শুরুথা ও শেষটা যেন বেশ চিত্তাকর্ষক হয়, এতে যদি একটু সাহিত্যরস বিতরণ করতে হয় তাও করতে হবে।" দীপঙ্কর বাবুর লিখেছেন, "শুনলে মনে হবে, প্রমথনাথের লেখার উপর যে কলম চালাতে হচ্ছে, সেজন্য কবি যেন কুন্ঠিত। তাই আশ্বাস দিচ্ছেন, ভাষাটা বদলে দেওয়া ছাড়া আর কিছু তিনি করবেন না।"

    প্রমথনাথকে আরেকটি চমকপ্রদ কথা বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, "বৈজ্ঞানিক রচনা লিখে প্রথমে দেখাতে হবে এমন দু-একজনকে, বিজ্ঞানের সঙ্গে যাঁদের পরিচয় নেই। তাঁরা পড়ে যদি বুঝতে পারেন, তাহলে নিঃসন্দেহে ধরে নেবে লেখার উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। ..... এ বিষয়ে আমাদের 'গোঁসাই' (নিত্যানন্দবিনোদ গোস্বামী) নিতান্ত নিরীহ ভালোমানুষ, লেখাটা প্রথমে গোঁসাইকে দেখিয়ো, বোধগম্য হয়েছে, বলে উনি সার্টিফিকেট দিলে পরে আমাকে দিও, যতটুকু ঘষামাজা দরকার করে দেব।"

    স্পষ্টতই, ঘটনাপ্রবাহের এই পর্যন্ত গুরুদেব স্রেফ প্রমথনাথের রচিত বইটির "ঘষামাজা"র দায়িত্বই নিয়েছিলেন - এটুকু বেশ বোঝা যাচ্ছে।

    তার পরের দিন গুরুদেবের কাছে প্রমথনাথ যেতেই তিনি বললেন, "তোমার রচনা পড়েছি, শুরু যেভাবে করেছ তার পাশে লিখে দিয়েছি কিভাবে শুরু করতে হবে। মনে হয় বাংলায় বিজ্ঞানের সহজবোধ্য বই 'এই ভাষায়' লেখাই সংগত হবে।" প্রমথনাথকে পান্ডুলিপিটি ফিরিয়ে দিয়ে গুরুদেব আরও বললেন,"পরমাণুলোক অধ্যায়ের বাকি অংশটা এই ভাষায় লিখে আমাকে দিয়ে যাবে, সাতদিনের মধ্যেই, দেরি করলে কিন্তু চলবে না। তথ্য আহরণ ও তা সাজানোর ব্যাপারে তোমার মুনশীয়ানা আছে, এখন ভাষাটা ঠিক হলেই স্বচ্ছন্দে লিখে যেতে পারবে।"

    এইখানে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছেন দীপঙ্করবাবু, "রবীন্দ্রনাথ কি যথার্থই বিশ্বাস করতেন যে তাঁর ব্যবহৃত ভাষায় প্রমথনাথ বই লিখতে পারবেন? .... একজনের পক্ষে কি অকস্মাৎ আর-একজনের ভাষায় লেখা সম্ভব?" এ প্রশ্ন আমাদেরও। রবীন্দ্রনাথের এ বক্তব্য কি স্রেফ প্রমথনাথের উৎসাহবর্ধনের জন্য নাকি কিছু অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য আছে?

    রবীন্দ্রনাথের পরামর্শ মেনে লিখে চললেন প্রমথনাথ। প্রথম অধ্যায় 'পরমাণুলোক'-এর লেখা শেষ করে রবীন্দ্রনাথের কাছে আগেই পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল। এবার পর পর লেখা হল নক্ষত্রলোক, সৌরজগৎ, গ্রহলোক, ভূলোক এবং উপসংহার ইত্যাদি অধ্যায়। "মনে আছে দু-ঘন্টায় এক পৃষ্ঠার বেশি এগোতে পারা গেল না, অনভ্যস্ত নূতন পথে চলতে বারবার আড়ষ্টতা এসেছে, আবার নূতন উদ্যমে চলতে হয়েছে।" আর পাশাপাশি চলতে লাগলো রবীন্দ্রনাথের সংশোধন।

    কদিন বাদে গুরুদেব ডেকে পাঠিয়ে বললেন, "বিশ্বরচনা বইটার যে-কলেবর হতে চলেছে তাতে তার অঙ্গচ্ছেদ করা তিনি আবশ্যক বলে মনে করেন। দুটো আলাদা বই হলেই ভালো হয়।" রবীন্দ্রনাথ স্থির করলেন, দুটো বইয়ের নাম হবে - 'বিশ্বপরিচয়' ও 'পৃথ্বীপরিচয়''। আদেশ হল বিষয়বস্তুও পুনর্বিন্যাস করবার।

    গরমের ছুটিতে গুরুদেব আলমোড়া যাবেন। প্রমথনাথের উপর আদেশ হল, 'বিশ্বপরিচয়'-এর সমস্ত পান্ডুলিপি সম্পুর্ণ করে দ্রুত ওঁর হাতে তুলে দিতে হবে। আলমোড়ায় নিভৃতে "বিশ্বপ্রকৃতির সান্নিধ্যে" বসে উনি গ্রন্থের পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের কাজটি সমাধা করবেন। ফিরে এসে বইখানি ছাপাবার ব্যবস্থা হবে বিশ্বভারতী প্রেসে। "বিশ্ব-পরিচয়-এর শেষ অধ্যায় লিখে দিয়ে এলাম গুরুদেবের হাতে। এটা সংশোধিত হয়ে ফিরে এলে তৈরি করতে হবে নতুন করে সমগ্র পাণ্ডুলিপি সুন্দর নির্ভুলভাবে লিখে, তারপর তা তুলে দিতে হবে ওঁর হাতে, আলমোড়া যাবার আগে - এই হলো গুরুদেবের নির্দেশ।" দীপঙ্কর চট্টোপাধ্যায় লিখছেন, "এই অবস্থাতেও কিন্তু প্রমথনাথের করা খসড়া এবং রবীন্দ্রনাথ কতৃক তার সংশোধন, কাজের এই ধারা বজায় থেকেছে।"

    এর পরই আরম্ভ হল, নাটকের পরবর্তী পর্যায়।

    গুরুদেবের আলমোড়া যাওয়ার আগের দিন বিকালে তাঁর নির্দেশমত গ্রন্থের চুড়ান্ত পাণ্ডুলিপি তৈরী করে রবীন্দ্রনাথকে দিতে যাওয়ার জন্য প্রমথনাথ বাড়ি থেকে বার হতেই দেখেন ডঃ ধীরেন্দ্রমোহন সেন দরজার সামনে। তিনি বললেন, "আপনার বইয়ের 'ম্যানাসক্রিপট' নিয়ে গুরুদেবের কাছে যাচ্ছেন বুঝি, আমাকেও ডেকেছেন, চলুন না একসঙ্গে যাই।" পাঠকপাঠিকগণ, ডঃ সেনের বক্তব্যের "আপনার বইয়ের" - এই শব্দবন্ধটি নজর করবেন কিন্তু।

    যাইহোক, দুজনে একসঙ্গেই রবীন্দ্রনাথের কাছে গেলেন।

    খুবই আগ্রহের সঙ্গে গুরুদেব পাণ্ডুলিপিটি গ্রহণ করলেন। বললেন যে, আলমোড়ায় নিভৃতে বসে ভাষার দিকটা আরও মাজাঘষা করবার সময় পাবেন। একথা সেকথার পর "ডক্টর সেন হঠাৎ ওঁকে বললেন, 'বিশ্ব-পরিচয় নিয়ে আপনি যে পরিশ্রম করেছেন, তাতে বইটার যুক্ত-গ্রন্থকার হওয়া উচিৎ -  রবীন্দ্রনাথ-প্রমথনাথ।' গুরুদেব সঙ্গে সঙ্গে বললেন, 'সে কি রে, বইটার বিষয়বস্তু রচনার কাজ তো প্রমথই করেছে, আমি শুধু ভাষার দিকটা দেখে দিয়েছি। গ্রন্থকার তো প্রমথনাথ হওয়াই উচিত, তবে আমার নামের সঙ্গে যদি প্রমথ যুক্ত করতে চায়, তাহলে প্রমথনাথ-রবীন্দ্রনাথ হওয়াই ঠিক হবে'।" আশীষ লাহিড়ীর মতে, "আইনস্টাইন-বোস-এর বদলে বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান নাম দেওয়ার বহু-প্রচারিত কাহিনীটি রবীন্দ্রনাথের সম্ভবত অজানা ছিল না।"

    এইসব কথাবার্তার ধরণ দেখে প্রমথনাথের মনে হল, বিশ্বপরিচয় বইটার লেখকের নাম নিয়ে কোথায় যেন একটা সংশয় জেগেছে। নিঃসন্দেহে এটা প্রমথবাবুর জন্য বড় রকমের ধাক্কা ছিল। তিনি তো গোড়া থেকেই ভেবেছিলেন যে তাঁর নামেই বইটা হবে। বইয়ের সব তথ্যও তো তাঁরই যোগাড় করা। মূল খসড়াটিও তাঁর। এরপরেও রবীন্দ্রনাথ যেহেতু ভাষার সবকিছু ঢেলে সাজিয়েছেন, সেহেতু যুক্ত-গ্রন্থকার নামে পরিচিত হলেও হয়তো খুব বেশি হারাবার নেই বলেই সম্ভবত ভাবলেন প্রমথনাথ। দীপঙ্কর বাবু লিখছেন, "বলা বাহুল্য, প্রমথনাথ ঠিকই বুঝেছিলেন। কয়েক বছর ধরে প্রমথনাথের পুস্তক রচনার যে অভিনব উদ্যমটি চলে আসছিল, এতদিনে রবীন্দ্রনাথ তার অসঙ্গতিটা বুঝতে পারেন। কিন্তু এতদিনের প্রতিশ্রুতির বন্ধন সহসা ছিন্ন করতে প‍ারছিলেন না। তাই এই ছোট্ট নাটিকাটির অবতারণা।"

    প্রশ্ন জাগে, ডক্টর সেনের অযাচিতভাবে প্রমথনাথের বাড়ি আসা, একসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কাছে যেতে চাওয়ার প্রস্তাব করা এবং এইভাবে শেষ মুহুর্তে যু্গ্ম গ্রন্থকারের নাম প্রস্তাব করা - সবটাই কি তাহলে গট-আপ?

    য‍াইহোক, বহু পরিশ্রমে যে সংশোধিত পাণ্ডুলিপিটি তৈরী হল, ১৯৩৭ সালের গ্রীষ্মে আলমোড়া গিয়ে রবীন্দ্রনাথ তা মাজাঘষা করলেন।

    এর বেশ কিছুদিন পর হল নাটকের আসল ক্লাইম্যাক্স !

    এর পর নাটক তরতরিয়ে এগিয়ে চলল। ১৯৩৭ সালের জুন মাসে প্রমথনাথ আলমোড়া থেকে গুরুদেবের লেখা একটি কার্ড পেলেন, যাতে লেখা, "বিশ্ব-পরিচয় থেকে আমার কলম এখনও ছুটি পায় নি।" প্রমথনাথ লিখেছেন, "এর কয়েক দিন পরেই শুনলাম খবরের কাগজে নাকি বের হয়েছে - আলমোড়ার সংবাদদাত‍া জানাচ্ছেন, রবীন্দ্রনাথ বিশ্বপরিচয় নামে একখানি বিজ্ঞানের বই লিখেছেন, বিশ্বকবির হাত দিয়ে এখানাই প্রথম বিজ্ঞানের গ্রন্থ রচনা। শুনেই মনে পড়ল ডক্টর সেনের কথাগুলি, তিনি কেন বইটার যুগ্ম-গ্রন্থকার হওয়ার কথা বলেছিলেন।"

    আশীষ লাহিড়ীর ভাষায়, "পরের অঙ্কের ঘটনা প্রত্যাশা মাফিক চুড়ান্ত।"

    "গ্রীষ্মের ছুটির পর গুরুদেব আলমোড়া থেকে ফিরে একদিন সন্ধ্যের সময় ডেকে পাঠালেন। উত্তরায়নে গিয়ে দেখি ক্ষিতিমোহনবাবু ও শাস্ত্রীমশায়ের সঙ্গে তিনি কথা বলছেন, আমাকে ডেকে সস্নেহে পাশে বসালেন, কুশল প্রশ্ন করলেন। তারপর বললেন, 'দেখো, বিশ্ব-পরিচয় লিখতে লিখতে দেখলুম এর ভাষাটা আমারই হয়ে গেছে, তাই এর মধ্যে তোমাকে কোথাও স্থান দিতে পারলুম না।' একটু থেমে বললেন, 'অবশ্য তুমি শুরু না করলে আমি সমাধা করতে পারতুম না, আর তা ছাড়া বিজ্ঞানের অনভ্যস্ত পথে চলতে শেষপর্যন্ত এই অব্যবসায়ীর সাহসে কুলাতো না। তুমি ক্ষুণ্ণ হয়ো না'।"

    এই হচ্ছে বিশ্বপরিচয় গ্রন্থ রচনার ইতিবৃত্ত।

    রবীন্দ্রনাথের বিশাল পরিচিতি এবং ব্যক্তিত্বের কাছে নতজানু অসহায় প্রমথনাথ 'ক্ষুণ্ণ' হয়েছিলেন কিনা, তা জানা নেই আমাদের। কথাটা সেই মুহুর্তে প্রমথনাথের কাছে মর্মান্তিক ঠেকেছিল সে বিষয়ে হয়তো আমরা নিঃসন্দেহ হতে পারি, বিশেষত কবির অনুরোধেই যখন বইখানি তাঁর লেখা। আশীষ লাহিড়ী বলেছেন, "আসলে ঘটনাটি যে তাঁকে কতখানি আঘাত দিয়েছিল তার প্রমাণ এই যে ১৯৭২ সালে, অর্থাৎ প্রায় চল্লিশ বছর পরেও তার বিবরণ দিতে গিয়ে তিনি প্রায় দিনলিপির মতো করে প্রতিটি খুঁটিনাটির উল্লেখ করেছেন, বিশেষ করে খবরের কাগজের খবরটির কথা।"

    প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় থেকে শুরু করে দীপঙ্কর চট্টোপাধ্যায়, সকল রবীন্দ্রভক্তরাই রবীন্দ্রনাথের মহান জীবনের এই অরাবিন্দ্রীক অধ্যায়টি নিয়ে প্রথমে যেন খানিকটা হলেও লজ্জিত হয়েছেন, এমনকি স্বীকার করতে বাধ্যও হয়েছেন, "কিন্তু একটা কথা মানতেই হবে। গোড়া থেকেই প্রমথনাথের মনে কবি একটা প্রত্যাশা জাগিয়ে তুলেছিলেন। প্রথমে তো বলেছিলেন, বইটা প্রমথবাবুকেই লিখতে হবে। রবীন্দ্রনাথ অবশ্যই তাঁকে সাহায্য করবেন, বিশেষ করে ভাষার ব্যাপারে। এটা বলা কতদূর সঙ্গত হয়েছিল, সেটাই প্রশ্ন।" এক্ষেত্রে আশীষ লাহিড়ী একটা গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছেন, "লক্ষণীয়, ধীরেন্দ্রমোহন সেন যখন যৌথভাবে রবীন্দ্রনাথ ও প্রমথনাথের নাম লেখক হিসেবে রাখবার প্রস্তাব করেন, তখন রবীন্দ্রনাথ সে প্রস্তাবকে আদৌ আমল দেন নি ; তখনও তাঁর কাছে বইয়ের মূল লেখক প্রমথনাথ, আর তিনি এর ভাষাগত ও সাহিত্যিক সম্পাদক। তাঁর মতে যদি-বা যৌথ-নাম দিতে হয়, তাহলেও প্রথম নাম থাকবে প্রমথনাথের। কিন্তু আলমোড়া থেকে কে বা কাহারা রটিয়ে দিল যে কবি রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রথম বিজ্ঞানের বই লিখছেন। অর্থাৎ ওখানে থাকাকালীন অবস্থা এতটাই আমূল বদলে গেল যে এমনকি দ্বিতীয় বা সহকারী লেখক হিসেবেও প্রমথনাথের নাম বিবেচনা করতে আর রাজি হলেন না তিনি।"

    দীপঙ্কর বাবু বলেছেন, "ভাবলে মনে হতে পারে যে, প্রমথনাথকে 'বিশ্বপরিচয়' লিখতে না দিয়ে রবীন্দ্রনাথ যদি নিজে দায়িত্বটা নিতেন এবং প্রমথবাবুকে দিয়ে পাণ্ডুলিপিটি পড়িয়ে নিতেন বৈজ্ঞানিক যথার্থতা সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হওয়ার জন্য, হয়তো ভালো হত। এমনকি শুরুতে না হলেও দুয়েক কিস্তি লেখা প্রমথনাথের কাছ থেকে পাওয়ার পরও যদি এই ধরণের প্রস্তাব স্পষ্ট ভাষায় দিতেন, মন্দ হত না।" কিন্তু এতকিছু স্পষ্টভাবে স্বীকার করবার পরেও যেনতেনপ্রকরণে দীপঙ্করবাবু বোঝাতে চেয়েছেন যে, "শেষ পর্যন্ত 'বিশ্বপরিচয়' একান্তভাবে রবীন্দ্রনাথেরই লেখা বই।"

    'আনন্দরূপম' গ্রন্থের ভুমিকায় প্রমথনাথ "শুধু সত্য কথা স্পষ্ট ও সোজা করে" বলবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কেন যেন মনে হল, রবীন্দ্রনাথ নামক প্রতিষ্ঠানটির চাপে হযতো শেষপর্যন্ত সবকিছু স্পষ্টভাবে তিনি বলে উঠতে পারেন নি।

    শেষে একটি তথ্য - রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর বছর কয়েকের মধ্যেই প্রমথনাথ "ভাগ্যবিপর্যয়ে শিক্ষাক্ষেত্র থেকে নির্বাসিত" হন।

    আশীষ লাহিড়ীর ভাষায় - বুঝ লোক যে জান সন্ধান !
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • এলেবেলে | 162.158.***.*** | ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ১৪:৪০729584
  • বেশ চটকদার লেখা, ততোধিক চটকদার সোর্স সমেত! এখানে মু.প যদিও তাঁর লেখার তথসূত্র দেননি, তবে ধরে নেওয়া যায় তিনি এ ক্ষেত্রে সাহায্য নিয়েছেন তিনজন লেখকের - অভিজিত রায়, আশীষ লাহিড়ী এবং দীপঙ্কর চট্টোপাধ্যায়। অনুরোধ করছি এই লেখার তথ্যসূত্র উল্লেখ করার জন্য। তার পরে অভিজিত রায়ের চটকদারি লেখা নিয়ে দু-কথা বলা যাবে। ও হ্যাঁ, রবীন্দ্রনাথকে লেখক বোধহয় 'অসাবধানে' গুরুদেব বলে উল্লেখ করেছেন তাঁর লেখায়! বেশ লাগল কিন্তু!! এটা কি আশীষ লাহিড়ীর ব্যবহৃত শব্দ যা লেখক কপি-পেস্ট করার সময়ে নজর করেননি? 

  • JAYARSHI BHATTACHARYA | ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ১৯:০২729590
  • অন্যত্র লেখকের এই লেখায় বেশ কিছু তথ্যসূত্রের উল্লেখ ছিলো। আশা করি সেগুলো লেখার শেষে একে একে উল্লেখ করা হবে। লেখাটি অবশ্যই ভাবতে বাধ্য করে। বিশেষ করে প্রমথনাথের জন্য ভাবনা এসেই যায়, রবীন্দ্রনাথ হয়তো সেই ভাবনার মূল বিষয় না।  

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা খুশি মতামত দিন