রক্তটা ক্রমে জামের কালচে রসে ডুবে যায়। দামিনীর ছোট ছোট হাত বেয়ে সেই রস গড়িয়ে গড়িয়ে পড়তে থাকে কনুইয়ের দিকে। কষাটে স্বাদে তার মুখ তর হয়ে থাকে। সে তালুতে জিভ ঠেকিয়ে টক-টক শব্দ করল। পুকুরের দিকে যেতে যেতে কুসুম চোখ পাকিয়ে বলে — জাম খেয়োনা মা! জাম খেলে পেট কামড়াবে। এতক্ষণে পুকুরে ডুবিয়ে রাখা বাসনগুলোর গায়ে এঁটো নরম হয়ে এসেছে, কুসুম নারকোলের খোলায় রাখা ছাই তুলে বাসনগুলো মাজতে শুরু করে। পুকুরের জলে ছোট ছোট ঢেউ ওঠে, ঢেউয়ের ফণায় রোদ চিকচিক করে। কাঁপতে থাকা রোদের বিন্দুগুলো জুড়ে জুড়ে একটা শিসের মত শব্দ তৈরী হয়। শিসের শব্দটা ক্রমশ বাড়তে থাকে, তীক্ষ্ণ ও তীব্র হয়ে শব্দটা একটা ট্রেনের সাথে চলতে শুরু করে। কামরার মেঝেতে রাখা তেলের আলোটার দিকে একমনে তাকিয়ে থাকে কুসুম। আলোয় কামরাভর্তি লোকের পায়ের বুড়ো আঙুলগুলো চোখে পড়ে। বুড়ো আঙুলে ভরা ট্রেনটা আস্তে আস্তে ঢোকে সীমান্তবর্তী স্টেশনে। ইঞ্জিন পাল্টে যায়, মাটিলাগা বুড়ো আঙুল নিয়ে ট্রেনটা ফের মাঠঘাট কেটে দৌড়তে আরম্ভ করে। রাঢ়ের দুপুরে বড়ো গরম হলকা বয়। ফ্যাকাশে আকাশে পাক খায় ধূসর চিল। তার গা থেকে কাঠিমে-জড়ানো সুতোর মত আলো খুলে খুলে নেমে এসে পুকুরের অনেক গভীরে থাকা শ্যাওলা, ঝাঁঝির ভেতর ঢুকে পড়ে। ট্রেনটা জড়িয়ে যায় ঐখানে, জলতলে মৃদু ঢেউয়ে শামুকের ভাঙা খোলস, লার্ভার দানাগুলি এপাশ ওপাশ করে। ওপাড়ের ঘাটে বাসন মাজতে মাজতে ছুঁড়িগুলো খিলখিলিয়ে ওঠে। কুসুম ঘাটের গোল গর্তটায় লোহার কড়াই বসায়, উঠে দাঁড়িয়ে গোড়ালি ঘোরায়। এ নদীনালার দেশ নয় গো, পদ্মাপারের বউ! রাঢ়ের মাটি ঢের শক্ত, পুকুর এবং দীঘিগুলো মানুষে-কাটা আর জষ্টিমাসের কাঠাফাটা রোদে পিঁপড়েরাও মাথা উল্টে উল্টোদিকে হাঁটে। (চলবে)