এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • স্বপ্নময়ের মধুদা, হেমকান্ত আর আমানুল্লাহর কথা

    Kulada Roy লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ | ১৩৯৭ বার পঠিত
  • কুলদা রায়

    স্বপ্নময়কে প্রথম দেখি কুইনস লাইব্রেরীতে। নিউ ইয়র্কে। ম্যারিক বুলেভার্ডে। সামনে বাস স্ট্যান্ড। সারি দিয়ে বাস ঢুকছে। বের হচ্ছে। একটুও শব্দ নেই। ঠিক সামনেই লাইব্রেরী। শান্ত। সৌম্য। দাঁড়িয়ে আছে।

    স্বপ্নময়ের নাম এর আগে শুনিনি। আমার শোনার কথা নয়। আমি বাংলাদেশের গাঁ-গেরামের মানুষ। খুব বেশি হলে হামেদ খাঁকে চিনি। তাঁর বাপজানের নাম আসমত আলি খাঁ। গ্রাম লাহুড়ি। শঙ্করপাশা। হামেদ খাঁ তার জেব থেকে পুরনো একটা ছোট্ট নোটবুক বের করেন। তার পৃষ্ঠার একপাশে লেখা ধান-পানের হিসাবপাতি। আরেকপাশে লেখা সোনাভানের পুঁথি। আমরা দুজনে মিলে কান্তি মুগডালের ক্ষেতের আলে বসে তালের রস খাই। এর মধ্যে স্বপ্নময় আসবেন কোত্থেকে? আর আমার যা দশা তাতে স্বপ্নময় কি খোয়াবুদ্দিন—চক্রবর্তী কি মুন্সী বাড়ির মাইজা মুন্সী—কিছুই যায় আসে না। হেলেঞ্চা শাকের আবার জাত কি? আমার মা শ্রী বিনোদিনী বনিকও পুঁটি মাছ দিয়ে হেলেঞ্চা শাক রান্ধে। আবার দুয়ারী বাড়ির জরিনা খাতুনও রান্ধে। খেয়ে বলি—আহা। প্রাণ জুড়ালো। আমি হুকো খাইনা বলে হামেদ খাঁয়ের খুব রাগ। বলেন, ফরিদপুইরা মুশায়, আপনে কি খেরেস্টান!
    আমি তাঁকে দীন ই ইলাহীর কথা বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু হামেদ খাঁর এতে মন নাই। আকবর বাদশার সঙ্গে তার খাতির নেই। ভাড়ারা গ্রামের লালন ফকিরের সঙ্গে মেলে ভালো। তিনি ততক্ষণে গান ধরেছেন--
    এমন মানব সমাজ কবেগো হবে সৃজন
    যেদিন হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খ্রীস্টান
    জাতি গোত্র নাহি রবে...

    এর মধ্যে ম্যারিক বুলেভার্ডে তুষার পড়ে। আমি স্বপ্নময়কে দেখতে পাই। তিনি পশ্চিমবঙ্গের কোনো এক মফস্বল শহরের এক স্টেডিয়ামে ফুটবল খেলা দেখছেন। ততক্ষণে লোকজন হোইহুল্লোড় করছে। স্ট্রাইকার বাঁ দিয়ে ঢুকে ডান দিকে একটি ছোট পাস দিতে গিয়ে বাম দিকেই লম্বা করে পাশ দিলেন। স্বপ্নময় দাঁড়িয়ে গেছেন। রেফারীর বাঁশি বাজছে। গোল না ফাউল ঠিক বলা যাচ্ছে না। স্বপ্নময় বললেন, এখন ফোনে কথা বলা যাবে না।
    বললাম, নিউ ইয়র্ক থেকে বলছি।
    তিনি ঘনঘন দম নিচ্ছেন। বললেন, আগে খেলা দেখে নেই। ফোনটা কেটে দিলেন।
    ফলে স্বপ্নময়কে রেখে আমাকে তাঁর মধুদার দিকে যেতে হয়।

    মধু দা বসে আছেন হাসপাতালে। বাম পা লম্বা করে রেখেছেন বিছানায়। তার ইচ্ছে, এই পা দিয়ে শেষবার একটা কিক দেবেন। বলটি লাথি মেরে সোজা জালের মধ্যে পাঠিয়ে দেবেন। বলে উঠবেন—গো-ও-ও-ল।

    মধুদা একসময় ফুটবল খেলতেন। এখন ফুটবলের কোচ। থাকেন মফস্বলে। তার হাতে গড়ে চানু দেশের কোলকাতার সেরা ফুটবলার। তিনি বলেন, বুঝলি রে চানু, দশটা হরিণ মাইরা একটা স্ট্রাইকার পয়দা হয়।

    এইক্ষণে এসে মাইরা শব্দটি আমি শুনতে পাই কুইন্স লাইব্রেরীর ফরেন লিটেরেচারের ১৪৩ নং র‍্যাকের মাঝখানে দাঁড়িয়ে। পয়দা শব্দটাও প্রাণে লাগে। চোখে জল আসে। এই শব্দ আমার। এই শব্দ মধুদারও। বুঝতে পারি আমি মধুদার কাছে যাব। তিনি আমার মতই বাঙ্গাল। কালগুণে উদ্বাসন কাব্যে আছেন।

    মধুদারও এখন সময় নাই আমার সঙ্গে কথা বলার। তিনি নেফ্রলজি ডিপার্টমেন্টে যাবেন। সেখানে তার মুসাতো ভাই এসেছে ট্রিটমেন্টের জন্য বাংলাদেশ থেকে। এগারো নম্বর কেবিনের দরোজা ফাঁক করেই মধুদা বললেন, হে রি ও ফরাইন্যা--ফরাইন্যারে। এক্কারে ভুলছস নি বেতুরিবত। বিছানায় শুয়ে থাকা লোকটার মুখে হাসি। মুখটা ফুলে থাকায় সেই হাসিটুকু পুরোটা ফুটল না। দুহাত দুপাশে বাড়াল লোকটা। মধু নি তুই? হাচা নি? বেদ্দুপ। আয়, ইয়ানো আয়।

    মধুদা সাতচল্লিশের পরে আর একাত্তরের আগেকার কোনো এক সময়ে আমাদেরকে ফিরিয়ে নিয়ে গেছেন। কুমিল্লায়। সেখানে হালদার বাড়ির মেয়েরা মধুদার খেলা দেখে। বাম পায়ে শট মাইরা গোল দেন। গোলকিপার ইরফান ভোদাইয়ের মত দাঁড়াইয়া থাকে। গোলপোস্টের ভিতর দিয়া বল গিয়ে কাছারিবাড়ির দেয়ালে লাগে।
    স্বপ্নময় এবার একটু কফি খাবেন। সেলফ থেকে নেমে পড়েছেন। কফি শফের দিকে বেরিয়ে যেতে যেতে বলছেন, দেয়ালে ল্যাখা--ইয়াহিয়া সাবধান। আমি এই লেখন দেখে বুঝতে পারি—সময় কালটা ১৯৭০।

    স্বপ্নময় বা মধুদা কেউই কিন্তু সত্তর সালের কোনো ব্যাখ্যা দিচ্ছেন না। কী হয়েছিল তা আমাদেরকে ভেবে নিতে হবে। শুধু দিয়েছেন তিনি শব্দের ইঙ্গিত---আইয়ুব খান—সাবধান। আইয়ুব খান ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসক হিসেবে পাকিস্তানের সর্বময় ক্ষমতা নিজ হাতে তুলে নেন। নিজের নাম দেন লৌহ মানুব। ১৯৬৯ সালে গণভ্যুত্থানে সেই লৌহের ন্যায় তিনি গুড়ো গুড়ো হয়ে পড়ে যান। শেখ মুজিব জেলখানা থেকে মুক্ত হন। তারপর দেশে নির্বাচন হয়েছে। বাঙালী একচেটিয়া নৌকায় ভোট দিয়ে পাকিস্তানকে তাল্লাক ঘোষণা করে দিয়েছে। নতুন জেনারেল ইয়াহিয়া গণহত্যা করার নতুন ষঢ়যন্ত্র আটছে। আওয়াজ উঠেছে বীর বাঙালী অস্ত্র ধরো—বাংলাদেশ স্বাধীন করো। তোমার আমার ঠিকানা—পদ্মা মেঘনা যমুনা।

    এগুলো মধুদা বা পরাণ বলছেন না। কিন্তু আমরা শুনতে পাচ্ছি স্বপ্নময়ের অক্ষরের ভেতর থেকে ইশারার মত আসছে। তিনি বলছেন গল্প। কিন্তু ইতিহাস গল্পের পেছন থেকে নিজের পায়ে হেঁটে সামনে বেরিয়ে আসছে।

    মধুদার কাছে যাব গল্পটি ছোটো। কিন্তু এর মধ্যে অনেকগুলো গল্প। চানুর গল্প, মন্দিরার গল্প, ফুটবলের গল্প, বিজ্ঞাপনের গল্প, টাকার গল্প, প্রতারণার গল্প। পরানের গল্প। ঢাকার গল্প। কুমিল্লার গল্প। কোলকাতার গল্প। মকবুলের-ইরফানের গল্প। কিন্তু সব গল্পের মধ্যেই মধুদা। তিনি ১৯৭১ সালে কুমিল্লা ছেড়ে চলে আসেন পশ্চিম বঙ্গে। আর ফিরে যাননি। এর মধ্যে ৩০ লক্ষ মানুষ মেরেছে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী আর তাদের দোসর রাজাকার-আল বদররা। ১ কোটি লোক প্রাণভয়ে দেশ ছেড়েছে। গল্পের এসব তথ্য সরাসরি জানা যাচ্ছে না। শুধু পরানের কাছ থেকে জানা যাচ্ছে –সইফুদ্দিন নেই। তাকে রাজাকাররা মেরে ফেলেছে। মধুদার বাঁ পায়ের গোলে নোয়াখালি একাদশ শাখারিটোলা ক্লাবকে হারিয়েছিল বলে সইফুদ্দিন তার পাটি মাথায় তুলে নিয়েছিল। বলেছিল-- দ্যাশ স্বাধীন হইলে তোর পা রূপায় মুড়াইয়া দেব।

    দেশ স্বাধীন হয়েছে। মধুদা পশ্চিম বঙ্গ থেকে আর নোয়াখালি ফিরে আসেননি। এর মধ্যে কদমতলায় টেইলারিংএর দোকান দিয়েছেন। ফুটবল খেলেছেন। সন্তোষ ট্রফিতে খেলবেন-- আশা ছিল। কিন্তু আশা পূর্ণ হয়নি। তিনি স্থানীয় এক ক্লাবের কোচ। কাম ফুটবলঅন্ত মানুষ।কিন্তু জীবন তাকে দুটো তাল্লাক দিয়ে বসেছে বলে এখন হাসপাতালে। কাল তার বাম পাটি কেটে ফেলা হবে। আর শট দিতে পারবেন না। কিন্তু এটা মধুদারও গল্প নয়।

    এটা শ্রাবণীর গল্প। শ্রাবণী কে? দুজন। একজন কুমিল্লার জাকির মিয়ার নাতনী। আরেকজন কোলকাতার অনির্বাণের মেয়ে। জাকির মিয়া পরাণদের প্রতিবেশি অবণী ভট্টচার্যের বাড়িটি কিনেছেন। অবনী দেশ ত্যাগ করেছেন। ভট্টাচার্য বাড়ির জবাগাছ-টগরগাছ চাঁপাগাছগুলি এখন জাকির মিয়ার গাছ। জাকির মিয়ার গাছেও একই রকম ফুল দেয়। জামির মিয়ার নাতনী শ্রাবণী সাঁজি ভইরা রোজ ফুল নিয়ে আসে। নারায়ণ মন্ত্র পায়না, ফুল পায়। তাহলে এই শ্রাবণী দুজন হলেও আদতে একজন। হিন্দু না মুসলিম—জিজ্ঞাসে কোন জন! সে মানুষ। দুজনেই ফুল তোলে। এই তাদের পরিচয়।
    স্বপ্নময় এই গল্পটি আমাকে দেন। কুইনস লাইব্রেরি সোল্লাশে চেচিয়ে ওঠে—গো-ও-ওল।

    ২.
    মধুদার নোয়াখালির অবনী ভট্টাচার্য দেশ ছেড়েছিলেন। সেটা ১৯৭১ সালে।

    কিন্তু বরিশালের হেমকান্ত দেশ ছেড়েছিলেন ১৯৪৭ সালে। তাদের বাড়িতে বাগান ছিল। ছিল পুকুর। ছাত্র পড়ানো ছাড়া আর কিছুই করেননি তিনি। তিনি লিখেছেন নিজের কবিতা—

    ১৬ই আগস্ট হল কলঙ্কের দিন
    পাকিস্তান মাগিল জিন্না। প্রত্যক্ষ সংগ্রাম।
    তার পরে পাল্টে গেল আমাদের গ্রাম।

    হেমকান্ত এখন সব হারিয়ে রিফুজি কলোনিতে। নিঃস্ব। তার নাতনী টুনি টিউবোয়েল থেকে জল আনতে গিয়েছিল অন্ধকারে। তার দশ কি বারো। তাকেও যৌন নিগ্রহের শিকার হতে হয়। রেহাই পায় না। কাউকে বলতেও পারে না। চুপ করে থাকে।

    স্বপ্নময়ের এই গল্পটির নাম উদ্বাসন কাব্য। স্বপ্নময় লিখেছেন--হেমকান্ত হঠাৎ কনকলতার দিকে তাকালেন। বললেন, বৌমা, সেইদিনের ঘটনাখান একবার কও দেখি। সেই দ্যাশের ঘটনাটা, তুমি আমাদের খিরকির পুকুরে স্নানে গেছিলা শীতকালে। কমল বোধহয় তখন বরিশালে। তুমি পুকুরে, কয়েকটা ছ্যামরা চিল্লাইয়া উঠল—পাক-পাক-পাক পাকিস্তান...।
    কনকলতা ঘোমটা দিলেন। বললেন—সেই কথা অখন ক্যান? অনেক পুরানো কথা। অন্ধকার কথা। হেমকান্ত বল্লেন-এই আলোয় আমার অন্ধকার কথা দরকার, কও, কও, লাজ কী, য্যান কইছিল হেই ছেমড়া গুলাইন? সব লিখ্যা যামু।
    কনকলতা মাথ নিচু করে থাকেন।

    কও না, কও। আমি জানতাম, ভুল্যা গেছি। তখন সব গ্রামেই এইরকম কথা শুনা যাইত। কনকলতা চুপ।
    কিছুক্ষণ বিড়বিড় করেন হেমকান্ত। তারপর বলেন, পাক পাক পাক পাকিস্তান হিন্দুর ভাতার মোছলমান।
    কনকলতা ঋতুস্নান সেরে পুকুর থেকে উঠবে। এমন সময় ওই রব। পাক পাক পাক পাকিস্তান... . কনক তখন ভয়ে চুপ। অই মানুষগুলো কুয়াশায় আর অন্ধকারের মত অচেনা। আবার পাক পাক পাক পাকিস্তান...। অন্য স্বরে হিন্দুর ভাতার মোছলমান।

    মধুদার গল্পের ইরফান, মকবুল, সইফুদ্দিন নামের যে মানুষগুলোর কথা আমরা এতক্ষণ মধুদার কাছ থেকে শুনতে পাচ্ছিলাম হেমকান্তর কাছে এসে শুনতে পাচ্ছি ভীন্ন মানুষদের কথা। এদের চিনতে আমাদের কষ্ট হচ্ছে। এদের কারণেই কোনো ভরসা পাচ্ছেন না অবণী ভট্টাচার্য। তার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। বিশ্বাস ভেঙ্গে চুরে ঝরে পড়ছে। এতো শুধু বিশ্বাস নয়—একটা জলজ্যান্ত দেশ। দেশটাও খণ্ড খণ্ড হয়ে পড়ছে। পায়ের নিচে চাপা পড়ছে মানুষের অধিকার বোধ। নিরাপত্তা। জীবন ব্যবস্থা। বেঁচে থাকার উপায়। মান-অপমানের সীমারেখা লুপ্ত হচ্ছে।

    স্বপ্নময় আমাদেরকে নিয়ে যাচ্ছেন বরিশালের হেমকান্তর বাড়িতে। সেখানে একজন পুকুর পাড় দিয়ে জলে নেবে আসে। কনকলতাকে বলে, বিবিযান, দেরি হইয়া যাইতেছে। পানিতে আর কতক্ষণ থাকবা? শীত লাগে না বুঝি? হাত ধর।

    তাহলে কনকলতা আর তার মেয়ে টুনি—দুজনের কেউই রেহাই পায়না। দুজনেই একই নির্যাতনের শিকার। দুজনেই সেই দেশভাগের রাজনীতির কলে পড়া ইঁদুরে পরিণত। প্রথমজন পাক-পাকিস্তানের মোছলমান, দ্বিতীয়জন সারে জাঁহা আচ্ছা সে’র হিন্দু। সব এক।

    ৩.
    স্বপ্নময় চক্রবর্তীর তাল্লাক গল্পটি শুরু হয়েছে একজন রোগীকে নিয়ে। নাম রমাপদ মিত্র। বিবাহিত। দুই ছেলের জনক। ছেলেরা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক খুব বেশী ভালো নয়। প্রথম জীবনে কম্যুনিস্ট পার্টির হোলটাইমার ছিলেন। বিনা কারণে তাকে পার্টি থেকে ভৎর্সনা করেছিল। সেই অভিমানে তিনি পার্টিই ছেড়ে দেন।

    সে সময় তিনি পুরনো মন্দির খুঁজে বেড়াতেন। মন্দিরের গায়ে লেখা থেকে খাড়া ছবি দেখে সে সময়কার সামাজিক ইতিহাস খুঁজে বেড়াতেন। একই সঙ্গে লাইব্রেরীতে গিয়ে বইপত্রের নিয়ে তন্ন তন্ন করে অনুসন্ধান করতেন ইতিহাসের সঙ্গে তার সম্পর্ক। এটা নেশার মত দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। সেজন্য তিনি কোন রোজগার পাতির চেষ্টা করেননি। খরচ বাঁচাতে স্ত্রীকে তার বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন। ধরেছেন দুএকটা টিউশ্যুনি। গ্রাম থেকে কোলকাতার লাইব্রারীতে কাজ করার খরচ যোগানোর জন্য এক মুদিদোকানীর জন্য সওদাপাতি করে আনতেন। সেখান থেকে পেতেন মান্থলি ট্রেনের টিকিট। আর হররোজ দু’আনা পয়সা। সেই পয়সা দিয়েই রুটি কিনে খেতেন। এইভাবে তিনি পুরাকীর্তির তথ্য উদ্ঘাটন করে যেতেন।

    এসব তথ্য তিনি একটা নীল খাতায় লিখে রাখেন। এই যে খাটাটা, এতে আছে কত শিল্পীদের নাম, গ্রাম কথা, লোকাচার। মন্দির বিবরণ। মেলা বর্ণনা। গ্রাম বাংলা ঘুরে ঘুরে সংগ্রহ করা এ রকম হাজারো তথ্যে ভরা রয়েছে এই নীলখাতাটিতে। তিনি নাম দিয়েছেন জীবনখাতা।

    রমাপদ মিত্র এখন বুড়ো হয়েছেন। কিছু তরুণ গবেষকদের গড়ে তুলেছেন। এখন তার কিডনী অকেজো হয়ে পড়েছে। প্রতি সপ্তাহে ডায়ালাইসিস করতে হয়। সেজন্য হাসপাতালে থকতে হয়। সরকার এই চিকিৎসাভার নিয়েছে। আর তার তরুণ গবেষকরা একজন সেবিকা ঠিক করে দিয়েছেন। এই গল্পটি শুরু হয়েছে রোগী রমাপদ মিত্রকে নিয়ে। শেষও হয়েছে রোগী রমাপদ মিত্রকে দিয়ে। স্বপ্নময় চক্রবর্তী লিখেছেন ২০০২ সালে।

    হাসপাতালে এসেই রমাপদ তার নীলখাতাটি খুলে দেখেন। সেখানে তিনি একদা লিখেছিলেন-- আলমণিপুরে একটি অতি পুরনো মন্দিরের গায়ে লেখা দেখেছিলেন--
    এই শ্রীঁশ্রীঁ বাটিতে কেহ পাদুকা পায়ে দিয়া জাইবেন নাই, যে জাইবেন তাহাকে তাল্লাক।।

    আলমণিপুর হুগলি জেলার বলাগড়ের কাছে একটি গ্রাম। মন্দিরটিতে কোনো বিগ্রহ নেই। পরিত্যাক্ত। এই গ্রামে সন্ধ্যেবেলায় আজানের শব্দ শোনা যায়না। কোনো মুসলমান মানুষ বাস করেনা আলমণিপুর সহ আশেপাশের গ্রামগুলোতে। রমাপদ চিন্তায় পড়েছেন—তাল্লাক শব্দটি কেন উৎকীর্ণ হল হিন্দু মন্দিরে? কীসের কারণে?

    এই-ই প্রশ্ন। এই প্রশ্নটিকে কেন্দ্রে রেখে স্বপ্নময় তাল্লাক গল্পটি লিখেছেন। তার হাতে গড়া গবেষকরা জানাচ্ছেন—সুবল মিত্রের অভিধান অনুসারে তাল্লাক শব্দটির অর্থ শপথ, প্রতিজ্ঞা। তাল্লাক শব্দটির মত শপথ অর্থ বোঝাতে নিষেধ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে ৯৩ নং টালিগঞ্জ রোডে হরিহর ধাম মন্দিরের প্রবেশ পথে--

    দেবালয়ে যাইবে না করিয়া আরোহন

    নিষেধ বিধি কহি সবার আগ্রভাগে
    গাড়ি পালকি ঘোড়া গজাদি নিষেধ আগে
    পাদুকা পাদেতে আর শিরে ছত্রধরে
    না যাইবে গঙ্গাস্নানে দেবের মন্দিরে
    মুনিবাক্য হেলন করে যাইতে হাজার মন
    শপথ আছয়ে প্রবেশ করিতে অঙ্গন।

    আরেকটি ব্যবহার আছে তালাক শব্দটির চৈতনয় চরিতামৃতে—বীর বলে তো, তোকে তালাক ভেড়ের ভেড়ে স্ত্রী। তালাক শব্দটি তাহলে হিন্দুদের লেখা বাংলাতেও আছে।

    কিন্তু আলমণিপুরের মন্দিরে লেখা তাল্লাক শব্দটির একটা ইতিহাস পাচ্ছেন রমাপদ তার সেবিকা বীনাপানির কাছ থেকে।
    বীণাপানির বাড়ি আলমণিপুর। আলমণিপুর নামটি আদিতে ছিল আল আমিনপুর। বিশ্বাসীদের গ্রাম। লোকমুখে পালটে হয়ে গেছে আলমণিপুর।

    স্বপ্নময় লিখেছেন—রমাপদ চোখ বোজেন। দেখতে পান হুগলি নদীতে পর্তুগীজ আর ডাচ বণিকদের জাহাজের পাল সপ্তদশ শতাব্দীর লবঙ্গমাখা হাওয়ায় দুলছে। মুর্শিদাবাদ তখত এ বসে আছেন আলিবর্দি, বাংলার ফঊজদার তখন কে? সুজা খাঁ। মারাঠা সেনাপতি ভাস্কর পণ্ডিতকে হত্যা করা হয়েছে। মারাঠারা হুগলি ছেড়ে চলে গেল, আর প্রচুর মুসলিম সেনা বসে গেল হুগলি জেলায়। গঙ্গার কাছাকছি। ধর্মান্তকরণও হল।

    ওই যে গ্রামটা, যে গ্রামে একটা প্রাচীন শিব মন্দির ছিল, ওই গ্রামটারও অন্য কিছু নাম ছিলো হয়তো। সেই নামটা বদলে গেল। নতুন নাম হল আলমোমিনপুর। হাজি-মৌলভিরা যেমন এসেছিল ফকির দরবেশ সুফিরাও এসেছিল। শ্বেত শুভ্র দাড়ি শোভিত আমানুল্লাহকে যেন দেখতে পান রমাপদ। দেখেন তার নিষেধের হাত। মন্দুর ভাঙতে দেয়নি আমানুল্লাহ। সে নিজে রক্ষা করেছিল। হয়তো সেই অঞ্চলে ওর প্রতিপত্তি ছিল, সে আগলে রেখেছিল ওই মন্দির, অপবিত্র হতে দেয়নি। সে পাথরে লিখিয়ে রেখেছিল--
    এই শ্রীঁশ্রীঁ বাটিতে কেহ পাদুকা পায়ে দিয়া জাইবেন নাই, যে জাইবেন তাহাকে তাল্লাক।।

    এজন্য হয়তো ওকে লড়তে হয়েছিল, কষ্ট পেতে হয়েছিল। সে সময়ের মৌলবাদিরা ওরে তাল্লাক দিয়েছিল। রমাপদ এরপর আর কিছু বলেন না। বলেন বীণাপানি গানে গানে—বিনা হাওয়ায় বিনা পানি হল ইন্তেকাল। খুন হয়েছিলেন আমানুল্লাহ।

    মুসলমান আমানুল্লাহ খুন হলেন মৌলবাদি মুসলমানদের হাতে। তাহলে কার গল্প বলছেন স্বপ্নময়? হিন্দুর, না, মুসলমানের?

    স্বপ্নময় লেখেন না--বলেন মানুষের গল্প। আমানুল্লাহর গল্প। জাকির মিয়ার নাতনী শ্রাবণীর গল্প। আর হেমকান্তর নাতনির অন্ধকার মুখের গল্পটি। আর সুদেষ্ণার সেই ছেলেটির গল্প যে ছেলেটি সবে ক্লাশ এইটে উঠেছে। গুজরাতে দাঙ্গার খবর শুনে ছেলেটি ট্রেনে রওনা হয়ে গেছে দাঙ্গা থামাতে। আহমেদাবাদে। সেখানে তার পেন ফ্রেন্ড থাকে। সে মুসলমান। আর সুদেষ্ণার ছেলেটা হিন্দু। এই সত্য। এই সুন্দর।

    কুইনস লাইব্রেরীর বুক সেলফে স্বপ্নময় হাসেন। আর আমি চেয়ে দেখি মধুদা হেমকান্ত আর আমানুল্লাহর লোকজন অনেক ভেদরেখাকে তাল্লাক দিয়ে বসে আছে। এরা সবাই লালন-ধর্মে আছে।

    http://www.galpopath.com/
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ | ১৩৯৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • dd | ***:*** | ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ০২:১৪73965
  • পড়লাম।
    ভাল লাগার কথা আর নতুন করে কী-ই বা বলব! ঠিক্কথা।

    "আরেকটি ব্যবহার আছে তালাক শব্দটির চৈতনয় চরিতামৃতে—বীর বলে তো, তোকে তালাক ভেড়ের ভেড়ে স্ত্রী।" - এটার রেফারেন্স দিবেন, কুলদাবাবু? ছন্দটা ক্যামন, কানে লাগছে?
  • রোবু | ***:*** | ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ০৯:৩০73966
  • যথারীতি অসাধারণ।।
  • | ***:*** | ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ১১:০৫73962
  • পড়লাম।
    ভাল লাগার কথা আর নতুন করে কী-ই বা বলব!
  • Damru | ***:*** | ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ১১:১৫73963
  • বলার কি দরকার ? লিখলেই তো ল্যাটা চুকে যায়।
  • de | ***:*** | ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ১১:৩৫73964
  • বাঃ!
  • Kalparshi Bandyopadhyay | ***:*** | ১২ মার্চ ২০১৪ ০৫:২৯73967
  • এত ভালো করে স্বপ্নময় কে ভাললাগার কথা কেন বুঝিয়ে বলেন কুলদা রায় বাবু , যা পড়লে চোখে জল আসে ?
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। বুদ্ধি করে মতামত দিন