এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • jol_dip | 233.29.***.*** | ২৫ মার্চ ২০১৫ ১৬:৫১667401
  • বাড়িটা

    ************
    শহর কলকাতায় অলিগলির অভাব নেই | এই গলি গলি দিয়েই অনেকটা রাস্তা পেরিয়ে যাওয়া যায় | যারা চেনে তারা অনেক সময় শর্টকার্ট করার জন্য বা পাওনাদারকে ফাঁকি দেবার জন্য বা অন্য প্রয়োজনে এই গলির আশ্রয় নেয় | পুলিশের চোখে ধুলো দিতে একসময় বিপ্লবীরা এইসব গলিপথ ব্যবহার করত | পরবর্তীকালে একাধিক আন্দোলনের সময়ও গলিগুলো ব্যবহার হয়েছে‚ আজও হয় | কোন গলি সরু‚ কোন গলি বেশ হৃষ্টপুষ্ট বহরে | প্রতিটা গলির দুধারে ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকে সার সার বাড়ি | নিস্তব্ধ দুপুরে অলস আমেজে আরমোড়া ভাঙ্গা নীরব বাড়িগুলোর নেপথ্যে হয়ত আছে শ্রুত বা অশ্রুত কিছু ইতিহাস | কেউ কেউ সেই ইতিহাসে বেঁচে থাকে আবার কেউ কেউ সেই ইতিহাস নিয়ে বেঁচে থাকে | এমনই এক গলির মধ্যে গলি‚ তস্য গলির মধ্যে বাড়িখানা দাঁড়িয়ে আছে ভগ্নস্তুপের মত | বাড়ির শরীর বেয়ে নেমেছে বট-অশত্থের ঝুরি | নোনা ধরা দেওয়াল থেকে ঝরে পড়া ধুসর ধুলো ডাঁই হয়ে ঢিপি গড়ে তুলছে | ইঁটের লাল রঙ আজ আর তেমন চট করে চোখে পরে না | জানলা-দরজার কাঠের ফ্রেম উইপোকার ঢিপি | কাঠের খড়খড়ি কবেই খুলে পরে গেছে | স্থানে স্থানে ফাটল দিয়ে বেরিয়ে এসেছে নানান আগাছা | কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে না দেখলে বোঝা যায় না যে ঐ বট-অশত্থ-বুনো গাছের আড়ালে আছে একটা বাড়ির ভগ্নস্তুপ |

    খুব ভালো করে তাকালে দেখা যায় বাড়িটির সবটাই এখনো ভেঙ্গে পরেনি | একটা অংশ এখনো টিমটিম করে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে | যদিও সেখানেও গজিয়েছে আগাছার জঙ্গল‚ দেওয়ালের ফাটল দিয়ে মুখ দেখিয়েছে কিছু অনামী গাছের পাতা তবু সে অংশটা এখনো সগর্বে ঘোষনা করছে নিজের অস্তিত্ব | ঐ অংশেই থাকেন এ বাড়ির শেষ বংশধর আদিত্য নারায়ন রায় | মাঝে মাঝে বাড়ি থেকে বের হন যখন তখন তাকে দেখা যায় | ময়লা ধুতি‚ মইচট হয়ে যাওয়া হাফহাতা শার্ট‚ গালে খোঁচা খোঁচা অনেকদিনের না কামানো দাড়ি‚ মাথার চুলে যেন কতকালের জট | হন্তদন্ত হয়ে হাঁটে | কোথায় যাচ্ছে কেন যাচ্ছে সবাই জানে | পাড়ার ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা পাগল পাগল করে ক্ষেপায় আদিত্য নারায়নকে | ওদের পাত্তা দেয় না সে | খিদে পেলেই সে হন্তদন্ত হয়ে ছোটে প্রতিমার কাছে | প্রতিমা‚ তার সহধর্মিনী | একসাথে থাকে না তারা অনেকদিন হল |

    আদিত্য এ বাড়ির শেষ তবে বংশের শেষ নয় | আদিত্য নারায়নের একমাত্র ছেলে প্রাদিত্য নারায়ন এ পরিবারের এখনো পর্যন্ত শেষ প্রজন্ম | প্রাদিত্য নারায়ন এখনও অকৃতদার | প্রাদিত্য নারায়ন তার মা প্রতিমাদেবীকে নিয়ে আলাদা থাকেন | হাবিজাবি অনেক কিছু চেষ্টা চরিত্র করে নিজেকে সেইভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি বছর পঁয়ত্রিশের প্রাদিত্য নারায়ন | বর্তমানে অংশীদারীতে একজনের সাথে প্রোমোটারী ব্যবসা শুরু করেছেন | বলতে নেই মন্দ আয়ও হচ্ছে না | সেই আয়ের পয়সা আর মা প্রতিমা দেবীর অবশিষ্ট অলঙ্কার আনুকুল্যে কাছাকাছি তাদেরই বানানো একটি ফ্ল্যাটে ইদানীং থাকেন তারা | বাবা‚ আদিত্য নারায়নকে বারকয়েক এখানে এনে রাখার চেষ্টাও করেছিলেন | বেশ কিছুদিনের জন্য আদিত্য নারায়নকে রেখেওছিলেন কিন্তু তিনি ফাঁক পেয়েই পালিয়ে গেছেন | সেই থেকে আর কোন চেষ্টা করেননি প্রাদিত্যনরায়ন বাবাকে নিজের কাছে নিয়ে আসার | প্রাদিত্যর স্থির বিশ্বাস আদিত্য নারায়ন সুস্থ নন | কোন সুস্থ মানুষ ঐ ভগ্নপুরীতে থাকতে পারে না |

    প্রতিমা যদিও ছেলের সাথে থাকেন অনোন্যপায় হয়ে‚ তবু মাঝে মাঝেই আদিত্যনারায়নের জন্য প্রাণটা কাঁদে | যতই হোক হাতে ধরে তো এনেছিলেন তিনি | খোকন্‚ অর্থাৎ প্রাদিত্যনারায়ান বাবাকে পাগল বলে মনে করলেও তিনি কিছুতেই পাগল বলে মানতে পারেন না | মানুষটার একটাই বাতিক তার পূর্বপুরুষের বাড়ি | এই বাড়িটা যেন তার প্রাণ | মানুষটা ভাবে যে খোকন তাদের পূর্বপুরুষের এই বাড়িটাকে বারোয়ারী আবাসনে পরিণত করবে | খুব ভুল তো ভাবেন না | খোকন ঐ তালেই আছে | তার নিজেরও মত তাই | প্রাদিত্য প্রায় বলে কলকাতা শহরে একটা জমি সে অলি-গলির ভেতর হোক বহুমূল্যবান | নিজস্ব কোম্পানীর ব্যানারে এই প্রজেক্টটা নামাতে পারলে দেখে কে প্রাদিত্যকে | নিজেদের ফ্ল্যাট তো থাকবেই‚ তার ওপর এক একটা ফ্ল্যাট যে দামে বিকোবে তাতে দুদিন লাগবে না লাল হয়ে যেতে | রাজী হয়নি মানুষটা | ঐ ভগ্নপুরী থেকে সেই কারনেই বেরিয়ে আসা প্রতিমার | যদি তার অভাব‚ খোকনের অভাবে লোকটা নুইয়ে পরে | কিন্তু তা তো হয়নি‚ উল্টে মানুষটার বাড়ি নিয়ে বাতিক আরও বেড়েছে |

    আদিত্যনারায়নের কথা

    *************************

    সারাক্ষণ বাড়িটাকে পাহারা দেয় আদিত্যনারায়ন | ভেঙ্গে যাওয়া পাঁচিলের গা বেয়ে যেখান দিয়ে একটা ছোটো বটগাছের ডাল বেরিয়ে মোটা গুঁড়ির মত হয়েছে ঠিক সেখানটায় বসে থাকে সে | এখান থেকে সামনের রাস্তাটা স্পষ্ট দেখা যায় | সতর্ক চোখে সে পাহারা দেয় |
    গাছের একটা শুকনো পাতা কিম্বা একটা ঢিল পড়লেও চমকে ওঠে আদিত্য | সারাক্ষণ মনে হয়‚ এই কেউ বুঝি আসছে তার কাছ থেকে বাড়িটাকে ছিনিয়ে নিতে | সবাই তার বাড়িটার প্রতি শ্যেন দৃষ্টি দিয়ে বসে আছে | বাড়িটার পিছনে একটা বুজে যাওয়া পুকুর আছে | কম জায়গা জুড়ে তো বাড়িটা নয় | জমির কাটা এখন কত যাচ্ছে যেন খোকন সেবার বলেছিল | বাড়িটা খোকনের কাছে শুধুমাত্র একটা প্রোপার্টি | কেউ বোঝে না বাড়িটা কত অমূল্য তার কাছে | বাপ-পিতামহ-প্রপিতামহের বাড়ি | অর্থ দিয়ে তার মূল্য মাপা যায় না | বাড়ি কি শুধু ইঁট-কাঠ-পাথরের একটা খাঁচা নাকি ? তার তো প্রায় মনে হয়‚ বাড়িটার একটা প্রাণ আছে | কান পাতলেই সে একটা ধুকপুকুনি শুনতে পায়‚ ক্ষীণ কিন্তু স্পষ্ট | নিশীথ রাতে যখন সবাই ঘুমিয়ে পরে তখন সে স্পষ্ট অনুভব করে বাড়িটার জ্যান্ত হয়ে ওঠা |

    খোকনকে এখন একদম সহ্য করতে পারে না আদিত্যনারায়ন | সবসময় ভাজছে কি করে জমিটা হস্তগত করা যায় | মাঝে মাঝেই মুচকি হেসে বলে ওঠে আদিত্যনারায়ন‚ আমার জিয়নকালে সেটি হতে দিচ্ছি না প্রদিত্যনারায়ন রায় | আর তারপরেই একটা ভয় চেপে বসে মনের ওপর | তার মৃত্যুর পর কি হবে এই বাড়িটার? আর তখনই ভীষন ভীষন রকমের অস্থির হয়ে ওঠে সে | খুব শ্বাসকষ্ট হয় তখন‚ বুকে ব্যাথা করে | অস্থির হাতে টুকরো ইঁট তুলে হিংস্র ভঙ্গীতে ছুঁড়ে মারে সামনের রাস্তায় | মারতেই থাকে | পথচলতি লোকের গায়ে লাগলে তেড়ে আসার বদলে আদিত্যনারায়নকে দেখে তারা পালিয়ে যায় | আর তখন তখন দারুন আত্মতুষ্টি হয় আদিত্যনারায়নের | চারিদিক কাঁপিয়ে আট্টহাসি করে সে |

    মাঝে মাঝে যখন খিদে পায়‚ তখন সে বাড়ি থেকে বেরোয় | তাও ভয় ভয়ে | শত্রুর তো শেষ নেই | সোজা চলে যায় খোকনের আবাসনে | আদিত্যকে এই আবাসনের সবাই চেনে | রক্ষীবিহীন আবাসনে সে বিনাবাধায় ঢুকে যায় | দরজায় বেল বাজায় না | বেল বাজানোতে কোন আভিজাত্য নেই | সে কড়া খোঁজে | আধুনিক ফ্ল্যাটে দরজার কড়া থাকে না | বাধ্য হয়ে সে দরজায় ধাক্কা দেয় | আগে আগে এদিক-ওদিকের ফ্ল্যাট থেকে কিছু কৌতুহলী‚ বিরক্ত মুখ বেরিয়ে আসত | এখন আর আসে না | সবাই জেনে গেছে প্রাদিত্যর পাগল বাপটা এসেছে | পাগল বলেই হা হা করে হেসে ওঠে | বেশ মজা না একটা সুস্থ লোককে পাগল বানিয়ে দিলে কত সুবিধা | সে পাগল সেজেই থাকতে চায় | তাতে যদি বাড়িটা বেঁচে যায় |

    রোজ যে সে আসে এমন না | যেদিন যেদিন তার খিদেতে পেটটা মোচড় দেয় সেদিন সেদিন সে চলে আসে | না হলে প্রাদিত্যর রোজগারের টাকায় খেতে তার ইচ্ছে করে না‚ তবু খায় | খিদে যে কোন ওজর-আপত্তি শোনে না | অবশ্য প্রতিমা আছে বলেই সে যায়‚ নচেৎ যেত না | না খেয়ে মরে যেতে সে চায়ও না | মরে গেলে তো কেল্লা ফতে | সে সুযোগ সে প্রদিত্যনারায়নকে দেবে না | ঘরের ভিতর ঢোকে না | দরজার সামনেই বসে খায় | পাছে ভেতরে নিয়ে গিয়ে যদি তাকে আটকে দিয়ে সব সই করিয়ে নেয় সেই ভয়ে সে ঘরের ভেতরে ঢোকে না কোন সময় | ভয়টা অবশ্য অমূলক নয় | নতুন ফ্ল্যাটটা কেনার পর বেশ কদিন নিয়ে গিয়ে রেখেছিল তাকে প্রদিত্য | সারাক্ষন লোহার দরজায় তালা ঝুলত | যেন সে চিড়িয়াখানার কোন জন্তু‚ আটকে রেখেছে তাকে | দম আটকে আসত | ফাঁক পেয়ে পালিয়ে এসেছে | তারপর থেকে শিক্ষা হয়েছে | খায় আর চলে আসে | খেতে যেতেও যে তেমন ইচ্ছে করে তা নয়‚ তবু মাঝে মাঝে খিদেবোধটা বড্ড জ্বালায় | আজকাল সে প্রতিমাকেও পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছে না |
  • Nina | 83.193.***.*** | ২৭ মার্চ ২০১৫ ০৭:৩০667402
  • সুন্দর হচ্ছে । সঙ্গে আছি
  • jol_dip | 233.29.***.*** | ২৮ মার্চ ২০১৫ ১৪:০২667403
  • (২)

    বাড়িটা

    **********

    প্রতিমার কথা
    **************

    এই ফ্ল্যাটটায় তিনটে বেডরুম‚ একটা ডাইনিং কাম ড্রয়িং ‚ একটা কিচেন‚ দুটো বাথরুম | আর আছে একটা চিলতে বারান্দা | এই বারান্দাটাই এই আবদ্ধ ফ্ল্যাটে একমাত্র প্রিয় জায়গা প্রতিমার | সারাদিন কাজ বলতে তেমন কিছু নেই | রান্নাবান্না বাদে সবই কাজ করে ঠিকের একটা মেয়ে | খোকনের কাজের কোন সময়-অসময় নেই | এই বলল মা আজ বেরোবো না‚ আর তারপরেই একটা ফোন আসলেই বেরিয়ে যায় | আবার কখনো কখনো খুব রাত করে ফেরে | একটা চাবি ওর কাছে আছে | ও নিজেই খুলে ঢোকে | আগে থাকতে বলে রেখেছে রাত বেশি হলে তোমার আর ওঠার দরকার নেই | দরকার যে কেন নেই সেতো এতদিনে ভালই বুঝে গেছে সে | একলা একলা কেমন যেন হাঁপিয়ে ওঠে প্রতিমা | এই ফ্ল্যাটবাড়ির লোকজন কেমন যেন সংকীর্ণ মানসিকতার | কথা বলতে চায় না | দেখা হলে হাই আর হ্যালো | শুধুই দেঁতো বা মুচকি হাসি | প্রাণ খুঁজে পায় না | ঢের ভালো ছিল তাদের ভাঙ্গা বাড়ি |

    মানুষ যখন কোন কিছুর সংস্পর্শে থাকে তখন সেই জিনিসের মূল্যায়ন করতে পারে না বা বলা ভালো করে না | সেই জিনিসটাই যখন তার থেকে দূরে চলে যায় তখনই বুঝি তার গুরুত্ব নিরুপণ করে | এ মানুষের এক স্বাভাবিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য | প্রতিমা যতদিন ঐ ভাঙ্গা বাড়িতে ছিল ততদিন ছেলের সাথে গলা চরিয়ে বলেছে দাও না বাপু বাড়িটাকে প্রমোটিং-এ‚ সারাজীবন এই ভাঙ্গা বাড়িতে কাটাতে ভালো লাগে নাকি? আজ এই সাজানো গোছনো ফ্ল্যাটে এসে মনে হয় অগেই তো বেশ ভালো ছিল |

    চিলতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে চুল আঁচরাতে আঁচরাতে গলিপথের দিকে তাকিয়ে থাকে প্রতিমা | মানুষটা গতকাল খেতে আসেনি | আজ আসবে তো? আগে আগে প্রতিমা গিয়ে খাবার দিয়ে আসত খেতে না আসলে | ইদানীং আর পারে না | তিনতলা থেকে নামা ওঠা করতে বেশ কষ্ট হয় | বাতে ধরেছে | পা ফুলে যায়‚ ব্যাথায় ছটফট করে | খোকনকে বলতে সাহস হয় ন | হয়তো যাবেই না | বাপের প্রতি বেশ ক্ষুব্ধ |

    দুপুরের রোদে যেন লু বইছে | রোদের দিকে তাকানো যায় না | রাস্তাটা জনশূন্য | তাদের এই পাড়াটা আবদ্ধ গলি বলে তেমন লোক চলাচল করে না | সবাই এ পাড়ারই বাসিন্দা | এই ফ্ল্যাটটা হবার পর বাসিন্দার সংখ্যা কিছু বৃদ্ধি পেয়েছে এই যা | ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে প্রতিমা | পাটা টনটন করে | আজও কি আসবে না খোকনের বাবা? বেলা তো বেশ হল | পাশের ফ্ল্যাটে টিভিতে দুপুর দেড়টার সিরিয়ালটার রিপিট টেলিকাস্ট শেষ হল এই মাত্র | এইসব সিরিয়াল দেখতে তার ভালো লাগে না. কি করে যে সবাই দেখে কে জানে? গল্পের কোন মাথামুন্ডু নেই |

    একটু বুঝি অন্যমনস্ক হয়েছিল সে | দরজায় দুম দুম আওয়াজ শুনে এগিয়ে যায় | এ শব্দ তার পরিচিত | খোকনের বাবা | গিয়ে দরজাটা খুলে দেয় | মানুষটা কিছুতেই ভেতরে এসে বসে না | বাইরে দাঁড়িয়ে খেয়ে চলে যায় | সবসময় সন্দেহ এই বুঝি খোকন তাকে আটকে রাখবে |
    দাঁড়াও ভাত নিয়ে আসছি আমি‚ বলে ডাইনিং টেবলের দিকে হেঁটে যায় সে | একটা থালায় তরকারি আর ভাত বাড়াই ছিল‚ থালাটা তুলে নিয়ে আসে | জানে মানুষটা ঝড়ের বেগে এসে একটুও দাঁড়াবে না | কোনরকমে খেয়েই নেমে যাবে | তাই রোজ ভাত বেড়ে রাখে সে | থালাটা হাতে ধরিয়ে দিয়ে সে জল নিয়ে আসে | গোগ্রাসে ভাতের দলা মুখে পোরে আদিত্যনারায়ন | চুপ করে দাঁড়িয়ে দেখে প্রতিমা | চোখ চিকচিক করে ওঠে | কি হাল হয়েছে লোকটার |

    বলাটা বৃথা জেনেও বলে নিজের দিকে একটু তাকিয়ে দেখেছো‚ কি হাল করেছ নিজের | কতকাল যে স্নান করনা সে খেয়ালও তোমার নেই | দাড়ি কাটো না‚ মাথার চুলটাও কাটো না | জামাকাপড়গুলো দেখেছো‚ কি অবস্থা হয়েছে | কতদিন বলেছি দুটো সেট এখানে আছে বের করে দিচ্ছি পাল্টে পাল্টে পরো‚ নোংরা হলে কেচে দেবে‚ তা সে কথাও কানে তোলো না |

    সত্যি কানে কোন কথা তোলে না আদিত্যনারায়ন | কোনদিন কোন কথাই কি কানে তুলেছে সে‚ যে আজ তুলবে? একমনে খেয়ে জলের গ্লাসটা হাত থেকে প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে ঢক ঢক করে জলটা খেয়ে এঁটো থালা-গ্লাসটা দরজার কাছে নামিয়ে দুপদাপ করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যায় | নিচের রাস্তাকলে গঙ্গার জল সারাদিন বয়ে যায়‚ ওখানেই হাত ধুয়ে ধুতিতে হাত মুছতে মুছতে চলে যায় আদিত্যনারায়ন |

    ক্ষোভে চোখ ফেটে জল আসে প্রতিমার | দিন দিন লোকটা কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে | একটা অব্যক্ত যন্ত্রণায় আর ক্ষোভে ভিতরটা জ্বলেপুরে যায় | এঁটো থালা-গ্লাসটা তুলে সিঙ্কে রেখে দেয় | ন্যাতা দিয়ে এঁটো জায়গাটা মুছে দরজা বন্ধ করে তার ঘরে এসে বিছানায় বসে | হু হু করে কান্নারা নেমে আসে | নিজেকে বড় অবহেলিত মনে হয় | লোকটা এটুকু ভাবে না‚ যে একটা মানুষ তার জন্য ভেবে হদ্দ হয়ে যায় | তার খাবার বেড়ে রেখে দেয় | তার আসার পথের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে | লোকে যখন তাকে পাগল বলে বড্ড কষ্ট হয় এসব কি কিচ্ছু বোঝে না লোকটা | শুধু বাড়ি আর বাড়ি | শুধু ঐ লোকটাই বাড়িটাকে ভালোবাসে আর সে‚ সে বুঝি ভালোবাসে না ? চোখের জল গড়িয়ে পড়তে থাকে | সেও তো ভালোবসে তার মত করে | কি করে ভুলে যায় ঐ বাড়িতেই তো সে বিয়ে হয়ে এসে উঠেছিল |

    তার বিয়েটা ছিল যতটা না দুটো নারী-পুরুষের তার থেকেও অনেক বেশি ছিল দুটো পরিবারের বন্ধন | রায়পরিবারের অবস্থা তখন পরে গেছে | একটা সময় এই পুরো রায়পাড়াতে যতগুলি বাড়ি আছে তার বেশিরভাগটাই ছিল রায়পরিবারের | জমিদারী চলে যাবার পর অলস‚কর্মবিমুখ উত্তরসূরীদের হাতে পড়ে একদা ফুলেফেঁপে ওঠা রায়পরিবারের অবস্থা দিন কে দিন খারাপ হতে শুরু করল | সম্পত্তি বাড়াতে না জানলে একসময় কলসীর জলের মতই সম্পত্তিও লোপ হতে বাধ্য | জমিদারী না থাক জমিদারীর থাঁটবাট রাখতে গিয়ে একের পর এক বাড়ি বিক্রি হয়ে গেল একদা তাদেরই প্রজা ছিল যে মিত্তির‚ দত্ত‚ ঘোষেদের হাতে | প্রতিমা যখন এ বাড়ির বউ হয়ে এলো তখন বসতবাড়িটি বাদ দিলে আর কিছু অবশিষ্ট ছিল না | বসত বাড়িটিও স্থানে স্থানে ভেঙ্গেচুরে গেছিল | তার বাবা বংশ দেখে বিয়ে দিয়েছিলেন | জানত রায়পরিবারের পুরু ষরা কোনদিন চাকুরী-বাকুরী করে না | সেটা তাদের কাছে অপমানজনক | বাবা মাসোহারার ব্যবস্থা রেখে প্রতিমার এখানে বিয়ে দিয়েছিলেন | তাদের বংশে কেউ কখন জমিদার বাড়িতে পরেনি কিনা | চোখ মুছতে মুছতে একটা হাসি ঠোঁট ছুঁয়ে যায় প্রতিমার | জমিদার বাড়ি বলে কথা |

    একটা দীর্ঘশ্বাস বুক ফুড়ে বেরিয়ে আসে | কি এক অদ্ভুত জীবন সে কাটিয়েছে | তালপুকুরে ঘটি ডোবে না‚ অথচ মানসন্মানের অত্যাধিক্য | সে চেয়েছিল আদিত্যনারায়ন নিজের পায়ে দাঁড়াক | চাকুরী না হয়ে পরের গোলামী‚ কিন্তু ব্যবসা সে তো করাই যেত | বাড়ি-ঘর চলে গেলেও তখনও গহনা ছিল অনেক | কারও কাছে হাত না পেতেও করা যেত | কিন্তু না একের পর এক পারিবারিক গহনা বিক্রি করতে বাঁধেনি শ্বশুরমশায় প্রতাপাদিত্যনারায়ন ও স্বামী আদিত্যনারায়নের | নিজেদের প্রয়োজনে একের পর এক বাড়ি- অলঙ্কার যখন বিক্রি করে দিয়েছে তখন কোন ব্যাপার ছিল না‚ আর আজ একটা ভাঙ্গা বাড়ির জন্য লোকটার কি পাগলামো |
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা খুশি মতামত দিন