এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  বইপত্তর

  • অর্ধেক জীবন আর অর্ধেক আকাশ

    Ishani
    বইপত্তর | ২৬ জুন ২০১৪ | ৫১১০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • পাতা :
  • Ishani | 116.216.***.*** | ০৫ জুলাই ২০১৪ ১১:৫০640721
  • এই লেখাটি অনেক পুরনো | বহুদিন আগে আমার প্রথম টই শুরু করি এই লেখাটি দিয়ে | তারপর হারিয়েই গিয়েছিল | কিছুদিন আগে খুঁজে পেয়েছি | ভাবলাম , নতুন করে যখন বইপর্ব শুরু করেছি ..তখন পুরনো প্রেমের দলিলও নাহয় এখানেই থাক !

    প্রথম শ্রাবণ , প্রথম প্রেম
    ........................................
    সেই রবিকিরণ | সেই প্রখর আলোয় চোখ ঝলসে যাওয়া | এবং ব্যতিক্রমী গদ্যরচনার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার এক দুর্বার তাগিদ | আলাপ হল | বর্ণমালার কনে-দেখা আলোয় | নরম , মায়াবী , অন্যরকম , উতল করা | বুদ্ধদেব বসু | আমার নবলব্ধ প্রেমিক |

    "তিথিডোর " উপন্যাসের রচনা সময় ১৯৪৬ থেকে ১৯৪৯ | তখন বন্দ্যোপাধ্যায় ত্রয়ী (বিভূতি , মানিক আর তারাশঙ্কর ) মধ্যগগনে | এঁরা বাংলা সাহিত্যের দিবাভাগে অকৃপণ হাতে আলো ছড়িয়ে যাচ্ছেন | রাতের আকাশেও আছে কয়েকটি উজ্জ্বল নক্ষত্র..যেমন প্রেমেন্দ্র মিত্র , অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্ত আর সতীনাথ ভাদুড়ি |

    সাহিত্যপ্রেমী বাঙালীদের মনন , চিন্তন , বোধ ,অনুভূতি … আচ্ছন্ন এই মনীষার আলোয় | গদ্য রচনা তখন যে ধারাটি আশ্রয় করেছিল , তাতে লেখকের হাত ধরে লেখকের চেনানো পথে পাঠক হাঁটছেন | তার মনোজগতের যা কিছু বিচরণ..তার নিয়ন্ত্রক লেখক নিজে | একের পর এক বন্যার মতো ঘটনাস্রোতে পাঠক ভেসে যাচ্ছেন | তাঁর ফুরসত কই ওই ঠাসবুনট ঘটনা প্রবাহে গা ভাসিয়ে না দিয়ে একটু অন্য পথে হাঁটার , অন্য কথা ভাবার , লেখকের সমান্তরালে নিজের মতো করে ঘটনা স্রোতে সাঁতার কেটে অন্য কোনো নিজস্ব সুখানুভূতির ? তিনি লেখকের হাতের ক্রীড়নক ; লেখকের সুতোর টানেই তালে তালে ওঠাবসা , হাসি কান্না | তবু হয়ত সামান্য ব্যতিক্রমী কথাকার ছিলেন সতীনাথ ; যিনি পাঠকের নিজস্ব বিচার , বিশ্লেষণ , কল্পনা বা অনুভবে কিঞ্চিত আস্থাশীল ছিলেন | আর সকলেই তাঁদের লেখনীর মোহময় জাদুতে সবাইকে সম্মোহিত করে রেখেছিলেন , পাঠকমনকে শতকরা একশ’ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করে |

    বুদ্ধদেব বসু প্রথা ভেঙে তৈরী করলেন এক পরীক্ষামূলক রচনা শৈলী | এতে কিছু বলা হল , কিছু বলা হল না | লেখক আর পাঠকের বিনিময়ের ক্ষেত্রটিতে কিয়দংশে আবছা আলোছায়া , দোলাচল... লেখক হাত ধরে পৌঁছে দিচ্ছেন চরিত্রগুলির চিন্তা ভাবনার দোরগোড়ায় ; কিন্তু পাঠক দরজা ঠেলে ঢুকবেন নিজে | শুধু নিরাপদ নিশ্চিন্ততায় পথ দেখানোর দায় লেখকের | টুকরো বাক্যবন্ধ , ধ্বন্যাত্মক শব্দের ব্যবহার , অন্যরকম যতিচিহ্ন , কালি কলমের আঁচড়ে বাহুল্যবর্জিত চিত্রায়ণ সাহিত্যের নাটমঞ্চে এক অন্য আলোকসম্পাত ঘটাল | চিত্রপটে রং ছড়ানো , কিন্তু কিছু শূন্যস্থানও আছে..ওটি মনের মতো রঙে রাঙিয়ে নেবেন পাঠক | এবং বিভিন্ন পাঠকের প্যালেটে ভিন্ন ভিন্ন রং | এ এক অভিনব অলীক রংমিলান্তি খেলা |

    কিছু বিরূপতা ছিল | আবার স্বাগত সম্বোধনও কিছু কম ছিল না | বুদ্ধদেব বসু অনুরাগী পাঠক পাঠিকার বৃত্ত নিজেই তৈরী করে নিলেন | নিজের মনের মতো করে |

    আমি তখন সবে যৌবনের চৌকাঠে , আনাড়ি পায়ে | টাকাকড়ি জমিয়ে বইপত্তর কিনি | কলেবর বৃহৎ হলে আহ্লাদ বেশি , বেশিক্ষণের রসদ | হাতে এলো "তিথিডোর" | এর আগে বুদ্ধদেবের কবিতার সঙ্গে পরিচয় ঘটেছে | ", কঙ্কাবতী , কঙ্কাবতী গো ..." | পড়েছি ছোটগল্প সংগ্রহ "ভাসো আমার ভেলা ", নাটক.."অনাম্নী অঙ্গনা ও প্রথম পার্থ" , অনুবাদ কবিতা .. শার্ল বদ্যোলেয়ার -এর "ক্লেদজ কুসুম" , অসামান্য বাংলা অনুবাদে কালিদাসের "মেঘদূত"| কাজেই নামটি পরিচিত | তবে উপন্যাস এই প্রথম |

    পঞ্চ কন্যার পিতা রাজেন | বিপত্নীক , কিন্তু পত্নীবিরহে কাতর নন | আর অবাক কান্ড , পাঁচ পাঁচটি কন্যা সন্তান(যতই তারা সুন্দরী হোক) নিয়ে ব্যতিব্যস্ত বা কুন্ঠিত নন | কিঞ্চিত শখ আহ্লাদও ছিল | স্ত্রী শিশিরকণা যৌবনকালে কিছু প্রশ্রয়ও দিতেন | ঝরা বকুল নিজের আঁচলে বেঁধে রেখে ," সুগন্ধ ভালো, সুগন্ধের উত্স আরও ভালো হ'তে দোষ কী !" প্রথা ভেঙেছিলেন রাজেনবাবু | তাঁর কন্যাসন্তানে বড় লোভ ছিল | পাঁচটি মেয়ে | শ্বেতা , মহাশ্বেতা , সরস্বতী , শাশ্বতী আর স্বাতী | শাশ্বতী আর স্বাতীর মাঝে আছে বিজন | নামের বাহার নেই , কারণ রাজেনবাবুর মতে , " পুরুষের সাধারণ নামই ভালো | কী হবে না হবে জানি না তো..মিছিমিছি একটা লম্বা চওড়া নাম দিয়ে ..." . এরপর শিশিরকণার রোগশয্যা | শ্বেতার তো বিয়ে হয়ে গেছে সেই কবেই | স্বাতী জন্মানোর আগেই | তারপর মহাশ্বেতাও চলে গেল বিয়ে হয়ে | এল অরুণ | সরস্বতীর সঙ্গে আলোছায়ায় হৃদয় বিনিময় এবং বিবাহ | স্বাতী এবার শাড়ী ধরল | আর সেই সময়ে শাশ্বতীর জীবনে এল হারীত |

    বিজনের পড়াশুনো গয়ংগচ্ছ | স্বাতী কিন্তু ভর্তি হলো কলেজে | ইংরিজির ক্লাসে এল সত্যেন রায় | তরুণ অধ্যাপক | সুদর্শন , পরিশীলিত | স্বাতীর প্রেম কবে জেগেছিল , তখন জানিনি | তবে আমি মনে মনে ছবিটি এঁকে আকন্ঠ নিমজ্জিত হলাম | স্বাতীকে বিষনজরে দেখি | বুদ্ধদেবের মতলবটা কী ? প্রেম ট্রেম নাকি ? সত্যেনে অনুরাগ , স্বাতীতে বিরাগ আর বুদ্ধদেবে প্রবল রাগ তখন ত্রিধারায় |

    বৃষ্টির পরে ঝিলমিলিয়ে রোদ্দুর | মাঠের গা ঘেঁষে সূর্যাস্তের মুখোমুখি পুরনো একটি দোতলা বাড়ির একতলায় সরু বারান্দায় রেলিঙে হাত রেখে দাঁড়িয়ে সত্যেন দেখে , " বেগনি রঙের শাড়ি পড়া একটি কালো চুলের মেয়ে যেন হলদে আলোর নদীতে নেয়ে উঠে এল |" সত্যেন দেখে , আমিও দেখি আর বুঝে যাই , প্রবল প্রতিপক্ষের সঙ্গে যুদ্ধে জেতা যায় না | আমি স্বাতীর দিকে সখ্যের হাত বাড়িয়ে দিই |

    স্বাতী ভালোবাসল সত্যেনকে | "আকাশে নীল ,মেঘ কালো , ছাই রং ছড়ালো , বৃষ্টি ঝমঝম, ঝমঝম | আলো কম , আরও ক'মে আসে , মরে যায় , আর পড়া যায় না , দেখা যায় না , বই খোলা, বই কোলে , ব'সে থাকে , ভাবে , আবছা , একলা , চুপ |"

    স্বাতী তখন সতেরো | সত্যেন স্বাতীকে বলে , "রবীন্দ্রনাথকে দেখনি ? কী আশ্চর্য !" স্বাতী এক নতুন জগত পেয়ে যায় | সাহিত্যের জগত | সত্যেন তাকে হাত ধরে নিয়ে গিয়ে সটান দাঁড় করিয়ে দেয় কুবেরের কোষাগারের আধভেজানো সিংহদুয়ারের সামনে | স্বাতী পড়ে বাংলা কবিতা , বিদেশী সাহিত্য , আর ততই বাড়িতে একা হয়ে যায় | দিদিরা দাদা সব ভিনজগতের বাসিন্দা | সত্যেন দেশভ্রমণে | চিঠি লেখে স্বাতীকে , " ফিরতি পথে এসেছি শান্তিনিকেতন | কবির কঠিন পীড়া , দেখা হবার আশা নেই | সোনার তরী ভেসে চলেছে আলোর নদী বেয়ে অন্ধকারের দিকে | কিন্তু সেটাই হয়ত আরও বড় আলোর সমুদ্র |" আমিও যেন চোখের সামনে দেখতে পাই সোনার তরী , আলোর দরিয়ায় | সত্যেনের চোখ দিয়ে , স্বাতীর চোখ দিয়ে , বুদ্ধদেবের চোখ দিয়ে |

    সন্ধেবেলাটা যেন মন কেমন করা | যখন আলো নিভে যায় , আবার অন্ধকারও ফোটে না | সেই ছাই রঙের ছায়া ঝরা সময়টায় কে যেন কাকে ছেড়ে চলে যায় চিরকালের মতো ...একলা থাকলেই কান্না পায় স্বাতীর , ইলেকট্রিকের আলো..আকাশ-ভরা ছায়ার কান্নাকে ঘর থেকে ঝেঁটিয়ে বের করে দেয় আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ |
    স্বাতীর দিন কাটে , রাত কাটে , সংসার চলে অভ্যস্ত নিয়মে | বাড়িতে রাজেনবাবু , বিজন আর স্বাতী | শাশ্বতী আসে যায় , স্বাতীর মনে সত্যেন প্রায় চোরা পায়েই জায়গা করে নেয় | স্বাতীর মন অজানা কারণেই মেঘলা হয়ে ওঠে , "এপ্রিলের রেশমি সন্ধ্যা মখমলের রাত হয় আস্তে আস্তে |’’ হারীত আর বিজনের এক বন্ধু মজুমদার জোরগলায় বিশ্ব রাজনীতি নিয়ে তর্ক করে , বিজন স্বাতীর ওপর জুলুম করে , ঝগড়াও..স্বাতী আপনমনে | মজুমদার স্বাতীতে অনুরক্ত হয় | কিন্তু নিষ্ফল |

    আর সত্যেন ? অল্প চেনা ছিপছিপে স্বাতী… কেন চিঠি লেখে ? “কেউ যেখানে আসেনি, সেখানেই শেষ পর্যন্ত পৌঁছবে নাকি এই মেয়ে ? পার হবে নাকি সীমান্ত ?"

    বাইশে শ্রাবণ | রবীন্দ্রনাথ চলে গেলেন | সত্যেন এল স্বাতীর কাছে | শুকনো মুখ , উশকো চুল , চাপা ঠোঁট আর না-কামানো গাল | স্বাতীর তখন শরীরে জড়িয়েছিল ঝিরঝিরে দুপুরের আরাম | সত্যেনের কাছে দু:সংবাদ পেয়ে তার মাথাটি নিচু , " যেখানে তখন সুখের সুষমা প্রায় কথা বলছিল..সেই সব রেখায় দু:খ আঁকলো সেখানে, স্তব্ধ আনতি, দু:খের আরও গভীর সুষমা. '’

    তারপরের বিশদ ছবিটি জোড়াসাঁকোর | এ ছবি এত স্বল্প পরিসরে আমি বর্ণনা করি কী করে ? তবে প্রতিটি ছত্রে আমিও সেদিন ওই শোকযাত্রায় সামিল হতে পেরেছিলাম | বৃষ্টি থেমে গেছে | সমস্ত রাস্তাটির ওপর কাঁপছে , দুলছে , জ্বলছে বৃষ্টি ধোওয়া হলদেসবুজ বিকেলের স্বচ্ ছ, সূক্ষ্ম আভার একটি পর্দা | আর কোনো তারা নেই | "রবীন্দ্ররহিত বাংলাদেশে শোকোচ্ছ্বাসী কলকাতার ওপর এই মুহূর্তে আকাশের বিকারহীন তোরণে নীলিমার নিশান উড়ল |”

    এর মধ্যেই পারিবারিক বিপর্যয় | বিধবা হলো শ্বেতা | নতুন করে মা চলে যাবার পর মৃত্যুকে চিনল স্বাতী | সে নতুন করে বুঝে ফেলল ইংরিজি কবিতাটা "আমরা সাতজন"|

    সত্যেন ভাবে , মানুষকে ভালোবাসতে সাবধান | কবিতা ভালোবাসো, প্রজ্ঞা, আকাশ..কিন্তু কোনো জীবন্ত মানুষকে ...সাবধান ! বাঁকা কুটিল পিছল জল , এখানে চাপ , ওখানে টান | সত্যেন জানত না ? জলের অত কাছে গেলে পড়ে যেতে হতে পারে ?

    সত্যেন চলে যাবে | বিদায় নিতে স্বাতীর বাড়ি | সিঁড়ির ওপর | " এলাম | মানে আসতেই হল | না এসে পারলাম না | তা..আমার বোধ হয় সময় হল এদিকে. ..আচ্ছা....."

    ‘‘স্বাতী বলল , ‘না’ | হাত থেকে কয়েকটা শিউলি তার পায়ের কাছে পড়ল | আবার বলল , ‘না | যেও না |' ভিতর থেকে দরজা খুলে গেল |”

    এই ছত্রটি আমায় আচ্ছন্ন করে দেয় আজও ..শুধুই কি বাড়ির দরজা ?

    পরিণয়কথা | বিবাহবাসর | মহাশ্বেতা | "গালের ওপর ছোট একটি নীল শিরা স্পষ্ট..অদ্ভূত ফর্সা , প্রায় হলদে , গায়ের রঙে শাড়ির রঙে মিশে আছে আর কালো ব্লাউজের ওপর দিয়ে ঝলমলিয়ে নেমেছে রুপোর পাতের মতো আঁচল |” সরস্বতী | "শাড়িটা নীল.. ময়ূরের গায়ের নীল..কচুরিপানার ফুলের রঙের জামা |" স্বাতী | "ঝকঝকে চঞ্চল চুড়িগুলির পাশে সুতো জড়ানো শাঁখাটা | কী সুন্দর , কী শান্ত..সাদা |” আর শ্বেতা ? সাদা থানপরা ,” স্বাতীর হাতের চুড়িগুলির পাশে শাঁখাটার মতোই . শান্ত, সুন্দর | “

    আমি এত ছবির মতো বর্ণনা , এত নিখুঁত , এত বিশদ , খুব কম পড়েছি | "মেজ বউ কথা না বলে হাত ওল্টালেন | তাঁর আংটির পাথর থেকে একদানা পোলাও ঝরে পড়ল | "

    রাজেনবাবু এলেন স্বাতীর কাছে | "পায়ের পাতা সোনালী পাড়ে ঢাকা , শুধু সিঁথির সরু রেখাটি যেন নতুন ফুটে আছে | স্বাতী | সোনার তারা জ্বলা লাল শাড়ি উঠে গেছে ঝিলিক তুলে তুলে , আবার নেমেছে সোনালী , কালো চুলের ওপর দিয়ে সাঁকোর মতো , তরুণ ঝিনুকের মতো যে কানদু’টি এইমাত্র পান্নার দুলে ভারী হল , তার পাশ দিয়ে অন্তরঙ্গ পদ্ম-লাল জামার পাশ দিয়ে উজ্জ্বল , পান্না চুনি মেশানো নেকলেসটিকে পাশ কাটানো , এখনকার মতো স্বাধীন -শক্তিহীন বাহুটির কম-ফর্সা বাইরের দিকটাকে ছুঁয়ে না ছুঁয়ে পড়ন্ত. ?

    " স্বাতী | তার মুখ | সুখ দু:খের ব্যস্ত সেই রঙ্গমঞ্চ..এতদিন পরে একটু যেন বিরতি পেল | আলো জ্বলে আছে , দৃশ্যপট সাজানো , কিন্তু কুশীলব নেই | ফাঁকা , চুপ | চোখের ওপর ভারী হয়ে নেমেছে একটু ফোলা ফোলা গোলাপী দু’টি পাতা , ভরা ভরা সজল ঠোঁট দুটি বোজা , নাকের একটি বাঁশির চোখে-না-পড়ার মতো ঈষৎ স্পন্দন ছাড়া সমস্ত মুখে আর ভাষা নেই |"

    বুদ্ধদেব খুব সূক্ষ্ম তুলির আঁচড়ে বা চিনে কালির কলমের টানে রঙে অথবা সাদা কালোয় ক্যানভাসে একটি মেয়ের পূর্ণাঙ্গ অবয়ব এঁকে চলেন | তার যাপনকথার | তার শরীরের বেড়ে ওঠা..প্রথম শাড়িতে সাজা প্রথম শ্রাবণে , মন আর চেতনাও পরিণতি পায়..তাদের রঙে পান্না হয় সবুজ আর চুনিও ওঠে দিব্যি রাঙা হয়ে | কন্যেটি আলতো লক্ষ্মীমন্ত পায়ে পেরিয়ে যায় সুখ দু:খের আলপনা আঁকা করুণ রঙিন পথ , নিজেকে খুঁজে পায় , চিনে নেয় নিজের চোখ দুটি দিয়ে | অন্যের চোখেও | যবনিকা কম্পমান | যবনিকা নেমে আসে পুরনো অভ্যস্ত জীবনের ওপর | যবনিকা উত্তোলিত হয় নতুন আলোমাখা দিগন্তরেখাটিকে স্পর্শ ক'রে |

    আমি বিহ্বল মুগ্ধতায় দেখি আমিও এই দীর্ঘ পথ স্বাতীর পাশে পাশেই কেমন হেঁটে গেছি , আমিও ওর সঙ্গেই কখনো থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছি সংশয়ে , দ্বিধায় , কখনো চিনে নিয়েছি আমার ভালোবাসাকে | একই সঙ্গে আমিও তো আঁচলে বেঁধেছি কল্পলোকের চাবির গোছা , আমিও দু'হাত দিয়ে ঠেলে সটান প্রবেশ করেছি মনোজগতের অন্ত:পুরে | স্বাতী আর আমি , আমি আর স্বাতী...নিজের ছায়ার সঙ্গে কি যুদ্ধ করা যায় ? সে যে পাশে পাশে থাকে | আলোয় আর অন্ধকারে |

    " হৃদপিণ্ড | স্পন্দনের পিণ্ড | চোখ নেই , চোখ খোলা ,খোলা জানালা কালো , বাইরে কালো , কালো আকাশে তারা ; দূরে , পারে , পরপারে ; হ'যে যাওয়া , না-হওয়া , হ'তে থাকা , চিরকালের ; আকাশ -ভরা স্তব্ধ তারা তাকিয়ে থাকলো |”
  • kiki | 127.194.***.*** | ০৬ জুলাই ২০১৪ ০৮:১৮640722
  • ঃ)
  • | ০৬ জুলাই ২০১৪ ১২:২৪640723
  • ঈশানীর লেখা অনেকটা প্রগতি জনরার
  • Ishani | 116.216.***.*** | ০৭ জুলাই ২০১৪ ১২:২২640724
  • ব্যথাপথের পথিক এবং ব্রাত্যজনের রুদ্ধসঙ্গীত
    ..........................................................................

    ১৭৪ ই , রাসবিহারী এভিন্যুর একটি ছোট্ট ঘর | সেখানে মাঝেমাঝে উড়ে আসে ময়মনসিংহের জলছাপ মেঘ | জানালা দিয়ে উঁকি দেয় কিশোরগঞ্জের রোদেলা দুপুর | ছোটবেলার বাড়ি | বাঁশের গেট পেরোলেই একটা ঝাঁপালো বকুলগাছ | চোখ বুজলেই আজকাল এইসব ভুলতে চেয়েও ভুলতে –না- পারা পুরনো ছবি ভীড় জমায় খুব | মা কি ডোয়ার্কিনের হারমোনিয়াম বাজিয়ে এবার ব্রহ্মসঙ্গীত ?

    দেবব্রত | চোখ দু'টি বোজা | জর্দাপান | পাশে রাখা হারমোনিয়াম | আর হারমোনিয়ামের ওপর একটা খোলা চিঠি | বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ড লিখেছে রেকর্ড কোম্পানির মালিককে | বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ড দুটি গানকে বাতিল করেছে | প্রথম গানটি হল "পুষ্প দিয়ে মারো যারে "| বাতিল করবার কারণ দর্শানো হয়েছিল প্রয়োজনাতিরিক্ত যন্ত্রানুসঙ্গ ব্যবহার এবং যার ফলে গানের সংবেদন ও আবেগ ক্ষুন্ন হয়েছে ! আর দ্বিতীয় গানটি হল " তোমার শেষের গানের "| এতে টেম্পো অনাবশ্যক দ্রুত , যন্ত্রানুসঙ্গ অত্যধিক আর গানটি নাকি স্বরলিপি অনুযায়ী গাওয়া হয়নি ! এই চিঠির তারিখ জুলাই ২৫, ১৯৬৯ |

    অথচ কী আশ্চর্য ! আজকেই তো আর গান গাওয়া শুরু হয়নি | প্রথম রেকর্ড সেই ১৯৬১ সালের ১ লা মার্চ | প্রকাশ করেছিলেন হিন্দুস্তান রেকর্ড কোম্পানি | গান দু'টি ছিল 'যেতে যেতে একলা পথে " এবং "আকাশভরা সূর্য তারা "| সেই তখন থেকেই তো একটানা | কতদিন হয়ে গেল ! কখনো এই অভিযোগ ওঠেনি তো ! না না ...উঠেছিল তো ! একটু অন্য সুরে | প্রথম চিঠি যেটি বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ড পাঠায় হিন্দুস্তান রেকর্ড কোম্পানিকে, তার তারিখ ৬ ই মার্চ , ১৯৬৪ | এতে ৪ টি গানের উল্লেখ আছে | দু'টি গান বিনা বাধায় অনুমোদিত | "শুধু যাওয়া আসা' আর " গোধূলিগগনে মেঘে"| আর অন্য দু'টি ? " এসেছিলে তবু আসো নাই "--- এটি নতুন করে রেকর্ড করতে হবে | কেন ? কারণ বারবার সতর্ক করা সত্ত্বেও অবাঞ্ছিত ও অনিয়ন্ত্রিত যন্ত্রানুসঙ্গ | ফলে গানের ভাব নষ্ট হয়েছে , তা বিকৃত হয়েছে | আর " মেঘ বলেছে যাব যাব" | এতে অসম্ভব নাটকীয়তার প্রকাশ | যে ধরনের প্রতিধ্বনি -কক্ষ রেকর্ডিং -এর জন্য ব্যবহৃত হয়েছে ; তা গানের সূক্ষ্ম কারুকাজগুলিকে নষ্ট করে দিয়েছে |

    দেবব্রত এই চিঠি নিয়ে বিশ্বভারতীর কলকাতা শাখার অফিসে দেখা করে জানতে চেয়েছিলেন , এই শব্দগুলির ব্যুত্পত্তিগত অর্থ ঠিক কী ! তিনি এও জানতে চেয়েছিলেন, গানের মাঝে মাঝে যন্ত্রানুষঙ্গের সময়সীমা ঠিক কতক্ষণ থাকবে, সে নিয়ে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের কোনো নির্দেশ আছে কিনা ! বলাই বাহুল্য , কোনো সন্তোষজনক উত্তর পাওয়া যায়নি |

    এর বেশ কয়েকমাস পর যখন এই "এসেছিলে তবু আসো নাই ' গানটি নিয়ে আর এক খ্যাতনাম্নী গায়িকা জর্জ বিশ্বাসকে বলেন যে রেকর্ডিং -এ সামান্য ত্রুটি তাঁর কানে বেজেছে এবং যেহেতু তিনিও বিশ্বভারতীর অনুমোদন বোর্ডের সদস্যা , তাই যদি গানটি আর একবার ঠিকঠাক রেকর্ড করা যায় ! কোথায় গলদ ? "চঞ্চল চরণ গেল ঘাসে ঘাসে" এই পংক্তিটির প্রথম "চন" কথাটি নাকি স্বরলিপি মেনে হয়নি ! জর্জ তখন ওই গায়িকাকে গেয়ে শোনাতে বলেন এবং তারপর খুব বিনীতভাবে জানান যে ওই গায়িকার গাওয়াও স্বরলিপি অনুসরণ করেনি কারণ " আপনি 'চন' কথাটি নীচের মধ্যম সুর থেকে চড়া কোমল গান্ধার পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ায় পুরো দুই মাত্রা লেগে যাচ্ছে, অথচ স্বরলিপির বইয়ে আছে শুধু একমাত্রা | তবে মধ্যম সুরটি গ্রেসনোট হিসেবে স্বরলিপির বইয়ে লেখা হয়েছে |"

    এরপর শান্তিদেব ঘোষের সঙ্গে দেখা করে দেবব্রত গানটির টেপ শোনান | তারিখ ছিল ১৯ /১/ ৬৫ | শান্তিদেব লিখিত ভাবে নিজের মতামত জানান , " এইভাবে সুর অবশ্যই হতে পারে এতে কোনো দোষ নেই" |

    এরপর কিছুদিন শান্তিতেই কেটেছিল | তবে একটি ব্যাপারে জর্জ বিশ্বাস খুব কঠোর নীতি নিয়েছিলেন | তা হল, তাঁর গানের রেকর্ডের প্রচারে কোনো আতিশয্য চলবে না | কোনো রেকর্ড কোনো পত্রপত্রিকায় সমালোচনার জন্য দেওয়া যাবে না | কোথাও কোনো রেকর্ডে গায়কের আলোকচিত্র দেওয়া যাবে না | তবে প্রথম যখন লং প্লেয়িং রেকর্ড হয়, তখন বহু অনুরোধ উপরোধের পর তিনি একটি ছবি দিতে স্বীকৃত হন |

    এরপর সেই চিঠি | যার উল্লেখ আগেই করেছি| আর সেই দুটি গান | "পুষ্প দিয়ে মারো যারে "আর "তোমার শেষের গানের |" কী কী কারণে অনুমোদন পায়নি, তাও লিখেছি | এই চিঠির উত্তরে জর্জ বিশ্বাস যে চিঠি দেন ইংরিজিতে, তার একটি ভাষান্তর দিই বরং | তারিখ ১৬/ ৮/১৯৬৯|

    " মাননীয় মহাশয় ,

    আমি খুব বিশদে রবীন্দ্ররচনা বিচার করে দেখেও কোথাও এই তথ্য পাইনি , যে যন্ত্রানুসঙ্গ বা টেম্পো নিয়ে স্বয়ং গুরুদেব কোনো বিধিনিষেধ আরোপ করেছিলেন | অত্যন্ত দু:খের সঙ্গে একথা বলতে বাধ্য হচ্ছি, যে , মিউজিক বোর্ডের পরীক্ষকেরা প্রত্যেকেই একনায়কতন্ত্রে বিশ্বাসী | অবশ্য এ বিষয়ে এখনো আমি ওয়াকিবহাল নই, এই একনায়কতন্ত্র ঠিক কবে থেকে চালু হয়েছে !

    আমি অনেক দিন রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে প্রত্যক্ষ চর্চায় রত এবং নিজের বোধ বুদ্ধি দায়িত্ব ইত্যাদি বিষয়ে পূর্ণমাত্রায় সচেতন | আমরা তো পশু পাখি কীট পতঙ্গ নই, যে নিয়মের বাইরে যেতে ভয় পাব | নতুন কিছু চাইব না বা পরীক্ষা নিরীক্ষা করব না | আমি নিজের মতো করে রবীন্দ্রনাথে আস্থা অটুট রেখে কিছু সামান্য চিন্তাভাবনার প্রয়াস করেছি | এখনো তো বাকি রয়ে গেছে কত কিছুই | এখন যদি আমাকে বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ডের নিয়মরীতি মেনে নিয়ে নিজেকে বদলাতে হয় , তার প্রস্তুতিপর্বেও কিছু সময় চাই |

    অনুগ্রহ করে যদি আমার গানগুলি অনুমোদন করেন , কৃতজ্ঞ থাকব | কারণ আমার বয়স হচ্ছে আর নতুন করে রেকর্ডিং প্রচুর অর্থ বিনিয়োগের ব্যাপার |"

    এই চিঠির কোনো জবাব আসেনি | এবং ওই দুটি গানের রেকর্ডিং প্রকাশিত হতেও পারেনি |

    এরপর কিছু রেকর্ড হয়েছিল বটে , কিন্তু জর্জ নিজেই আর খুব একটা উত্সাহী ছিলেন না |

    জর্জ প্রচারবিমুখ ছিলেন | তবুও জনপ্রিয়তা ছিল আকাশছোঁয়া | তাহলে কি এর পেছনে পেশাগত অসূয়া ? হিসেব বলে, রেকর্ড কোম্পানির মালিক খবরের কাগজে সাক্ষাত্কারে জানিয়েছেন , জর্জ বিশ্বাস যেখানে বছরে রয়ালটি পান আটত্রিশ হাজার টাকা, সেখানে তাঁর পরের নাম যে শিল্পীর , তিনি পান ষোলো হাজারের মতো ! মানে অর্ধেকেরও কম ! এরপরেও কি চলার পথে ফুল বিছানো থাকবে ?

    যন্ত্রানুসঙ্গ ব্যবহার নিয়ে বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ড একটি নিয়মাবলীর খসড়া পাঠায় | তার সংক্ষিপ্তকরণ করেই বলি :
    ১| উপযোগী যন্ত্র : এস্রাজ, বাঁশি , সেতার , সারেঙ্গী , তানপুরা, বেহালা , দোতারা , একতারা , অর্গ্যান |
    পাখোয়াজ , বাঁয়া-তবলা, খোল , ঢোল , মন্দিরা |
    ২| গানের মূল আবেগ বজায় রাখতে হবে | সেইমতো অনুকূল আবহসঙ্গীত | যেখানে কন্ঠস্বরে বিশ্রাম আবশ্যক, সেটুকুই দেওয়া হবে |
    ৩| যন্ত্র ব্যবহারে সতর্কতা প্রয়োজন | গানের ভাব বুঝে যন্ত্র ব্যবহৃত হবে |
    ৪| যন্ত্র কখনোই কন্ঠকে অতিক্রম করবে না |
    ৫ | তালযন্ত্রের সঙ্গতকালে তালের ছন্দ বা বোল কথার ছন্দ ও লয়ের বিপরীত যেন না হয় |
    ৬| যে সব গানে কথার ওপর ঝোঁক আছে, সে সব গানে তালবাদ্যকেও ছন্দের অনুকূল থাকতে হবে |

    এত বিধিনিষেধ ? রবিগান কানের ভিতর দিয়া মর্মে পৌঁছবে, তবেই না প্রাণ আকুল করবে ! গান তো একাকী গায়কের নয় ! গাইতে হবে তাত্পর্য হৃদয়ঙ্গম করে, আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে | জর্জ বীতস্পৃহ | না :, আর প্রয়োজন নেই যুদ্ধের | অসম যুদ্ধ | প্রতিপক্ষ বড়ই সবল |

    এই যে এত কথা , স্বয়ং ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী কিন্তু তাঁর রবিকার গান নিয়ে পিয়ানো বাজিয়ে বহু পরীক্ষা নিরীক্ষা করতেন , ছাপানো স্বরলিপির অদলবদল করে গানও শেখাতেন | জর্জ বিশ্বাস এই একই ধরনের ভাবনায় ছিলেন | রবীন্দ্রনাথ স্বয়ংও তো এর বিপক্ষে ছিলেন না | তিনি নিজেই তো বলেছিলেন, " প্রথম ধাক্কাতেই মনে হয় , ইওরোপীয় সঙ্গীতের হার্মনি আমাদের সংগীতে চলিবে না | কিন্তু তাহা ইওরোপীয় সঙ্গীতে ব্যবহার করা হয় বলিয়াই কি একান্তভাবে ইওরোপীয় ? তাহা হইলে তো ইওরোপে রোগীর ওপর যে অস্ত্রচিকিত্সা চলে, তাহা বাঙালীর দেহে চালাইতে যাওয়া ভুল ! অর্থাত মূল বিষয় হইল আমাদের গানে হার্মনি ব্যবহার করিলে তার ছাঁদ স্বতন্ত্র হইবে | যৌবনের স্বাভাবিক সাহস যাহাদের আছে এবং লক্ষ্মীছাড়ার খ্যাপা হাওয়া যাহাদের গায়ে লাগিল, এই একটি আবিষ্কারের ক্ষেত্র তাহাদের সামনে পড়িয়া |"

    জর্জ বিশ্বাস এই নিয়েই ভেবেছিলেন | রবীন্দ্রসংগীতের যে স্বতন্ত্র এক আবেগ উত্সারী ক্ষমতা , তাকে আরও জোরালো করার বাসনায় এই যন্ত্রানুষঙ্গের ব্যবহারে পরীক্ষা নিরীক্ষা | রবীন্দ্রনাথ যে নিজেই একবার বলেছিলেন , '' গানের গতি অনেকখানি তরল | তাই গায়ককে খানিক স্বাধীনতা দিতেই হয় |"

    শ্রোতারাই তো গ্রহণ বা বর্জনকারী | জর্জ ভালো লাগা মন্দ লাগার বিচার তাঁদের ওপরেই ছেড়ে দিয়েছিলেন | তিনি এ বিষয়ে গুরুদেবকেই প্রথম ও শেষ কথা বলে ভেবে এসেছেন, যিনি বলেছিলেন , " আমার বিশ্বাস , সঙ্গীতেও সেই বাহিরের সংস্রব প্রয়োজন হইয়াছে | তাহাকে প্রাচীন দস্তুরের লোহার সিন্দুক হইতে মুক্ত করিয়া বিশ্বের হাটে ভাঙাইতে হইবে | "

    প্রথমদিকে যদি বা নিয়ম ভাঙার বা পাশ্চাত্য যন্ত্রানুসঙ্গ ব্যবহারের অনুকরণ প্রয়াস থাকে ,ধীরে ধীরে আমরা নিজেরাই তো ঠিক পথটি খুঁজে নিতে পারি | জর্জ ব্যতিক্রমী চিন্তাভাবনায় সেই উজ্জ্বল আলোর দিশা দেখিয়েছিলেন |

    তিতিবিরক্ত জর্জ চিঠিতে লিখেছিলেন , " আমাদের মাতামহীর আমলের জীর্ণ কাঁথা দিয়ে ঘিরে রাখলে এবং পলতে করে ফোঁটা ফোঁটা নিয়মের বিধান খাইয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীতকে টিকিয়ে রাখা যাবে , এমন কথা রবীন্দ্রনাথ নিজেই ভাবতে বা বলতে পারেননি | "

    রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন , " কন্ঠ গায়কের | গায়কের কন্ঠে গায়ক তো গোচর হবেই ! তাই প্রকাশের বা ভাবের প্রকারভেদও থাকবে | মূল কাঠামো ঠিক রেখে প্রকাশভঙ্গীর স্বাধীনতা মঞ্জুর |"

    সেই স্বাধীনতাটুকু মুঠিতে ভ'রে নিয়ে অকৃপণ ঔদার্যে তা আবার আমাদের বিলিয়ে দিয়েছিলেন জর্জ | তবুও কি বলব জর্জ বিশ্বাস বিতর্কিত শিল্পী ?

    জর্জ অনুধাবন করেছিলেন , ঐতিহ্য এক অন্য ব্যাপার | ঐতিহ্যমোহে আচ্ছন্ন লোকজনের পক্ষে নতুন কোনো ব্যাপার , রীতি মেনে নেওয়া শক্ত ও সময়সাপেক্ষ | শান্তিনিকেতনের ছাতিমতলার হাওয়া গায়ে লাগেনি জর্জ বিশ্বাসের | ওই হাওয়া গায়ে লাগিয়ে যাঁরা গান শিখেছেন , তাঁরা ভাবেন তাঁরাই ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক | তাঁদের পক্ষে অন্য কোনো দখিনা বাতাস বরদাস্ত করা শক্ত |

    জর্জের সামনে চলার পথে " শক্ত উঁচু একটি দেওয়াল " ছিল | তিনটি পথ খোলা |

    ১| নিজের রুচি, শালীনতা বিসর্জন দিয়ে দেওয়াল নির্মাতাদের সঙ্গে লাঠালাঠি ও তাদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার |
    ২ | দেওয়ালের কাছে নতি স্বীকার করে দেওয়ালের নীচে একটি সুড়ঙ্গ খুঁড়ে মাথা নীচু করে পথ চলা
    ৩| একটি সিঁড়ি বানিয়ে মাথা উঁচু করে ওই দেওয়াল অতিক্রমের চেষ্টা |

    ওই উঁচু দেওয়ালটি কী ? " শান্তিনিকেতনী সংস্কারের ভূত কাঁধে চেপে বসা কয়েকটি লোকের মস্তিষ্কপ্রসূত ভূতকালের ভূতে পাওয়া ধারণা "|

    কোন পথটি বেছে নিয়েছিলেন তিনি ?

    " যে মানসিকতা আমার ভেতরে জন্মেছে এবং বড় হয়ে উঠেছে , সেই মানসিকতা নিয়ে , তিন নম্বরের পথটি ছাড়া আর আমার কোনো উপায়ই নেই অর্থাত সিঁড়ি বানিয়ে মাথা উঁচু করে দেওয়ালটি টপকে যাওয়া | কিন্তু সিঁড়ি বানাতে সময় লাগবে |যদি বানাতে পারি , মাথা উঁচু করে আবার পথ চলা শুরু করব| যদি না পারি ,নিজের অক্ষমতাকেই দায়ী করব | "

    এই লেখা ১৭ ই নভেম্বর , ১৯৭৬ | এর পর আর মাত্র পৌনে চারবছর আয়ুষ্কাল অবশিষ্ট ছিল জর্জ বিশ্বাসের | তাতে ওই সিঁড়ি বানানোর কাজ তেমন করে আর করা হয়ে উঠল কই ! আমাদের চেতনার গর্ভগৃহটি শুধু অন্ধকার থেকে খানিক আলোয় এসেছিল |

    বৃষ্টিদিন ছিল | ১৯৮০ - র ১৬ ই অগাস্ট | জর্জ চলে যাচ্ছিলেন | একা | যদিও পাশে ছিল অনেক ভালোবাসার জন | জর্জের চোখ দুটি বন্ধ ছিল যদিও ...যদিও বা নীরব কন্ঠে ছিল ..."আমার জ্বলেনি আলো অন্ধকারে..." ....তখনও কিন্তু অন্ধকার হয়নি | অন্ধকার ছিলই না | একটা দুটো ফোঁটা বৃষ্টিও তো ছিল | সেই বৃষ্টিজলে কিশোরগঞ্জের মাদকগন্ধ | জর্জ চলে যাচ্ছিলেন | পেরিয়ে যাচ্ছিলেন অন্তবিহীন পথ | এক অভিমানের অন্ধকার থেকে অন্য এক অভিমানের আলোয় |

    অভিমানের অন্য নামটি যে অহঙ্কারও বটে !
  • Ishani | 233.18.***.*** | ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৭:০২640725
  • পরিমল রায় | জন্ম ২ রা অক্টোবর , ১৯০৯ | প্রয়াণ ১8 ই অক্টোবর, ১৯৫১ | আয়ুষ্কাল মাত্রই ৪২ বছর | মানুষের আয়ুর বিচার করা হবে কীভাবে ? সময়ের হিসেবে...দিন , মাস, বছর ? নাকি জীবনকালের সাফল্যের নিরিখে ? পরিমল রায় স্বল্পায়ু ছিলেন বটে ; কিন্তু মেধার ঔজ্জ্বল্যে , চিন্তাশক্তির দীপ্তিতে , লেখনীর তীক্ষ্ণতায় সেই সীমিত সময়্সীমাতেই সাহিত্যরসিক বিদ্বজ্জনমহলে রোশনাই ছড়িয়ে গেছেন | তিনি মনমর্জি লিখতেন | কখনো রম্যরচনা, কখনো বা ছড়া | অধ্যাপক ও পরবর্তী জীবনে রাষ্ট্রসংঘে কর্মরত পরিমল রায় নিছক সাহিত্যচর্চাকে জীবিকা হিসেবে একমাত্র সম্বল করার কথা ভাবেননি কখনো | যদি ভাবতেন , যদি দীর্ঘায়ু হতেন, তাহলে বাংলা সাহিত্যের শ্রীঅঙ্গ আরও কিছু মহার্ঘ অলংকারে ভূষিত হত, সন্দেহ নেই |

    তাঁর আসন্ন জন্মদিনে তাঁর রম্যরচনা সংকলন "ইদানীং " নিয়ে একটি লেখা লিখেছি | মুগ্ধ পাঠিকা হিসেবে আমার শ্রদ্ধা ও প্রণতি |

    অচেনা ক্যালাইডোস্কোপ
    .......................................

    পুরানা পল্টন | ঢাকা শহর | ছেলেপুলের দল যখন পড়ন্ত রোদ্দুর গায়ে পিঠে মেখে ইস্কুল থেকে হইহই করে বাড়ি ফিরত , তখন সেই রাস্তার একটি বাড়িতে একতলার বিশাল বড় ঢাকা বারান্দায় চায়ের আসর বসেছে | মহিলারা চা খেতে খেতে হাতের কাজ সারছেন , একজন দু'জন পুরুষও চোখে পড়ত কখনও কখনও ...হাসি গল্প আড্ডায় মশগুল | সে এক বর্ধিষ্ণু সংসার ছিল বটে ! মোরাম বিছানো পথ পেরিয়ে তবে বারান্দায় গিয়ে ওঠা | তার আগে পেরোতে হবে একটা বড় লোহার গেট | একপাশে পাথরের ফলকে বাড়ির নাম | “পরম ভবন” |

    আমার আজকের গল্প এই পরম ভবনের বাসিন্দা পরিমল রায়কে নিয়ে | যে পরিমল রায় প্রসঙ্গে তাঁর সুহৃদ বুদ্ধদেব বসু লিখেছিলেন , " তাঁর মেধা ছিল তীক্ষ্ণ , কণ্ঠস্থ ছিল রবীন্দ্রনাথ ও কালিদাস , বাংলা উচ্চারণ ছিল সেই পূর্ববঙ্গের পক্ষে আশ্চর্যরকম শালীন , এবং পরিহাসের দ্যুতি , দীপ্তি ও যাথার্থ্যে তিনি ছিলেন অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের ঈর্ষাভাজন | আমাদের মধ্যে একমাত্র তিনিই ছিলেন সমবয়েসীর প্রণয়ের ও গুরুজনদের অমিশ্র প্রশংসার যোগ্য |"

    ইদানীং | রম্যরচনা সংকলন | রচনাগুলি নানা পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছিল | লেখকের নিজ নাম ও ছদ্মনামে | বই হিসেবে প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৪৯ সালে এম . সি . সরকার থেকে | দ্বিতীয় সংস্করণ হয় ১৯৬১ তে | নিউ এজ থেকে | তার ৪৫ বছর পর বইটি আবার প্রকাশ করে বিকল্প | ২০০৬ সালে | এবং এখন আবার তা দুষ্প্রাপ্য |

    বইটি আমার হাতে এল পরিমল রায়ের পুত্র পৃথ্বীরাজ রায়ের কল্যাণে | হাতে এল বললাম বটে | আসলে হাতে এল না | আমার বাবা বইটির দখল নিলেন | বাবা , মায়ের হাত ঘুরে আমার হাতে এল যেদিন আমি কলকাতা ছাড়লাম..তার আগের দিন রাতে | আমি পড়লাম ফিরে এসে | এখনও পড়ছি..কারণ সফল রম্যরচনা কি মাত্র একবার পড়লে মন ভরে ?

    লেখার বাঘ একবার কামড়ে দিলে সে ক্ষত সহজে নিরাময় হয় না | সেই ক্ষত স্বল্পায়ু পরিমল রায় সানন্দে বহন করতে স্বীকৃত হয়েছিলেন | তাঁর লেখনীর জাদু এমনই , যে বৈদগ্ধ্য আছে , তির্যকতা আছে ..আবার রমণীয়তাও অপ্রতুল নয় একেবারেই | এ লেখা গুরুভার নয় , দুষ্পাচ্য নয় | বরং অম্লমধুর | পরিশীলিত বুদ্ধিমত্তায় ভরপুর | বুদ্ধদেব বসুর কথা ধার করেই বলি , " পরিহাসে না আছে পিত্তের প্রকোপ , না আছে বিদূষকের মুখবিকৃতি | "
    কল্পনার মিশেল আছে এতই নিপুণ চাতুর্যে , যে তা কোথাও না কোথাও বাস্তবকেই রঙিন করে তোলে |

    আমি যেমন..এই বই পড়েই প্রথম জানতে পারলাম এবং ভরসা পেলাম যে "পাগলের কোনো নিরপেক্ষ সংজ্ঞা নাই | উহা নিতান্তই একটা মতামতের ব্যাপার |" শুধু আমি কেন, আমার মা-ও দেখলাম এরপর থেকে মায়ের মস্তিষ্কের সুস্থতা সম্পর্কে বাবার বিশেষ বিশেষণ তুচ্ছ করছেন |

    পূজার ছুটি | বাবা দেখি পড়ছেন আর হাসছেন |
    " অধ্যাপকদের কর্মজগতে ছুটিটা একটু বেশি | অধ্যয়ন ও অধ্যাপনা দুই-ই অত্যন্ত কঠিন কাজ | ভয়ানক মাথার খাটুনি | সেজন্য বিশ্রামগুলিও লম্বা | একবার আরম্ভ হইলে ...শখের থিয়েটারের বিরামের মতো ..আর শেষ হইবার নাম নাই | " এটি গৌরচন্দ্রিকা মাত্র | আসল গল্প এরপর | পাড়ার অধ্যাপক - গৃহিণী মহলের প্রতিযোগিতামূলক খবর বিনিময় | কে কোথায় যাবেন | গিরিডি, না শিলং ? যাঁর ছেলে অসুস্থ , তাঁকে সপরিবারে হাওয়াবদল তো করতেই হবে !|
    এবার লেখকের কথা |
    " আমাদের ছেলেটি দুর্ভাগ্যক্রমে ভুগিতেছে না ; এবং আমার স্ত্রীর দু:খ ওখানেই |"
    পরিমল-জায়া জিজ্ঞেস করেছিলেন..সবাই তো এদিক সেদিক যাচ্ছে | তাহলে তাঁরা কোথায় যাবেন ?
    লেখকের জবানীতে ফিরে আসি |" আমরা কোথায় যাব জানো ? আমরা যাব...আমরা যাব..আমরা কোথাও যাব না !"
    এরপর অবশ্য বাড়িতে ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি জেগে ওঠে , বলাই বাহুল্য | কিন্তু লেখকের যুক্তি শুনুন , " স্থান পরিবর্তনের উদ্দেশ্য হইল নিত্য পরিচিত পরিবেশ হইতে কিছুকালের জন্য মুক্তি | তা সেই পরিচিত পরিবেশের সামগ্রীগুলিই যদি স্থানান্তরিত হয়ে যায়..তাহা হইলে আমাদের আর অর্থব্যয় ও পথশ্রম সহ্য করিয়া অন্যত্র যাইবার কী কারণ থাকিতে পারে ?" অকাট্য অজুহাত ! আমি নিশ্চিত, পুরুষকুল যারপরনাই খুশি হয়ে এই যুক্তি মগজস্থ করলেন | আর এই এই নিবন্ধে পুংকুলের আনন্দদায়ক আর একটি মন্তব্য উল্লেখ না করলে পরে এই বইটি এখানকার কোনো পাঠকের হস্তগত হলে তিনি নিশ্চিত এ নিয়ে বাক্যবাণ বর্ষণ করবেন এবং কটাক্ষ করে বলবেন , আমি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তথ্য এবং তত্ত্ব গোপন করেছি |
    " স্ত্রীলোকের ব্যক্তিত্ত্ব-বোধ প্রবল নহে | প্রত্যেকে একটি প্রকাণ্ড কোলাহলমুখর জনতাপিণ্ডের অংশ মাত্র | বিচ্ছিন্নভাবে কাহারও বিশেষ অস্তিত্ব নাই |"
    এই নিবন্ধের শেষ অংশটি আমার বড়ই মনের মতো |
    " নিজেকে লইয়া অবসর-ভুঞ্জনের মতো উৎকৃষ্ট জিনিস আর নাই |"
    কী যে সত্যি কথা !

    এরপর যুদ্ধ | দু'শো টাকা আয়ের সংসারে তিনশো সাতাত্তর টাকার বাজেট | এবং অথৈ জল ! খোকা বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিল ..বাবা কি বাঘ মারতে পারে ? উত্তর ইতিবাচক ছিল , বলাই বাহুল্য | সংসার সমরাঙ্গনে ভাঙা ঢাল আর ভোঁতা তলোয়ার নিয়ে সংসারী পুরুষের নিত্যদিনের যুদ্ধ ...সেকাল ও একালে একইরকম |

    প্রবাসে থাকি | “আত্মীয়স্বজন” কথাটি অনবরত মুখে মুখে ফেরে | দু’টি কি সমার্থক ? লেখকের উত্তর নেতিবাচক | ‘স্বজন’ কথাটি অনেক আপন , অনেক গভীর | স্বজন মানে আমার নিজের লোক | যেখানে আমি আমার মতো হয়ে কোনো বাহ্যিক আড়ম্বরের চোগা-চাপকান না চাপিয়ে আটপৌরে সাজে আসতে পারি | এই বোধ রক্ত -নিরপেক্ষ |
    আর ‘আত্মীয়’ ? রক্ত বা সামাজিক কারণে একসঙ্গে জুড়ে থাকা | কিন্তু অনেক আত্মীয়ই সেই অর্থে স্বজন নন | "অথচ স্বজনসুলভ অন্তরঙ্গতা প্রদর্শন সামাজিক কর্তব্য | নহিলে লোকে মনে করিবে কী ! অথচ মন অতখানি অগ্রসর হইতে প্রস্তুত নহে | এই অন্তর্বিরোধই আত্মীয়তার মৌল পদার্থ |"

    আরও আছে | " সম্পর্ক যত শিথিল , অভিমান তত বেশি | মানসিক দূরত্ব যত বেশি , অভিযোগ অনুযোগের দৌরাত্ম্য তত প্রবল | উহারা আপনার প্রতি অতি স্নেহশীল | আপনি নিজেই অতিশয় বর্বর , অসামাজিক এবং স্বজন -বিমুখ | তাই এই সকল স্বজাতীয় স্নেহ-সরোবরগুলি এড়াইয়া ইয়ার বন্ধু সমাজের বিদেশী কলের জলে গাত্র মার্জনা করিয়া ফিরিতেছেন | "

    পড়ছি আর ভাবছি ...যে কথাগুলো মনে মনে সহস্রবার ভেবেছি , মুখে বলে ওঠার সাহস সঞ্চয় করে উঠতে পারিনি...আজ থেকে কয়েক দশক আগে আর একজন মানুষ কত অনায়াসে কোনো কিছুর পরোয়া না করে এই কঠিন সত্য কলমের খোঁচায় প্রতিষ্ঠিত করে গিয়েছিলেন |

    দাম্পত্য কলহ | সেও লেখনীর গুণে এক অন্য মাত্রা পায় ; যখন " একাদিক্রমে ব্যঙ্গ , শ্লেষ , তাড়না , তিরস্কার ইত্যাদির ছোটখাটো স্টেশনগুলি পার হইয়া ভাষা স্রেফ গালাগালির জংশনে পৌঁছায় |"

    বইটি এগোয় নিজস্ব গতিতে | লেখক এমন সুচারু ভঙ্গিতে লেখেন , যে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় আমাদের আমোদ জোগানোই তাঁর মূল উদ্দেশ্য | এবং আমরা সাগ্রহে পড়তেই থাকি , পড়তেই থাকি | কিন্তু কখন যেন আমাদের অজান্তেই তিনি চলে যান খেলাচ্ছলে..গভীরতর প্রসঙ্গে |
    " উপভোগ শব্দটির মধ্যে ভোগের একটি মুখ্য রূপের ইঙ্গিত আছে | ভোগ্যের মধ্যে একটি প্রধান হইলেই অপরগুলি উপভোগ্য পর্যায়ে পড়ে | উপভোগ সেখানে উদ্বৃত্ত প্রাণশক্তির পরিচয় ; প্রাচুর্যের নিদর্শন | ..... যেখানে এক মুষ্টি মনোহীন সজীবতা হাজারখানেক বদ্ধ জলাশয়ে ব্যাঙের ন্যায় লাফালাফি করিতেছে মাত্র , সেখানে হৃদয়-দিগন্তে সমুদ্র-রেখার ইঙ্গিত কোথায় ? এ ধরনের সর্বগ্রাসী উৎসাহে কোনো মনের পরিচয় পাওয়া যায় না | কোনো মূলের সন্ধান নাই | "

    বিকিকিনির গল্প আসে | লেখক খোকনের ধারাপাত কিনতে গিয়ে খোকনের মায়ের সেলাই শেখার বই কিনে ঘরে ফেরেন | এও বিজ্ঞাপনের পরোক্ষ অবদান | প্রয়োজনের বোধ সৃষ্টি করা | বিক্রেতার দোষ দিয়ে লাভ কী ! সে তো জবরদস্তি করেনি ! আপনারই খানিক পরে মনে হয়েছিল , সীবন শিক্ষা কিনে ফেলতে পারলে একটা কাজের কাজ হয় বটে !

    আর পছন্দসই কেনাকাটা ? ও ব্যাপারে তো মা লক্ষ্মীদের জুড়ি মেলা ভার | তাঁরা কী চান..জানেন না | কী চান না….কেবল সেটুকুই কোনোরকমে বলতে পারেন | তাই পর্বতপ্রমাণ শাড়ির ভেতর থেকে একটি শাড়িও পছন্দ করা যায় না..কারণ কোনো শাড়ির পাড় বোকা বোকা , কোনোটিতে রঙের বোকামি দোকানিকেও লজ্জা দেয় | আর সত্যিকারের চতুর শাড়ি যে কোন গভীর অরণ্যে আত্মগোপন করে মুচকি হাসি হাসে..কে জানে !

    নারী ও পুরুষ ক্রেতা | খুব কিছু ফারাক নেই কিছু কিছু জিনিসে | স্নো ক্রীম হেজলীন পমেটম ? সেও তো কৌটো খুলে পট করে একটি খাবলা তুলে নেওয়া ...পুরুষ হলে ; আর স্ত্রী হলে অল্প করে মেখেও নেওয়া | চিরুনির ধার মাথায় চালিয়ে পরখ করা , ব্লেড কিনতে গিয়ে পটাং করে মোড়ক খুলে মরচে খোঁজা , টুথ ব্রাশ কয়েকবার হাতের তালুতে ঘষে নেওয়া | বিক্রেতার ব্যাজার মুখ | খদ্দের যে লক্ষ্মী !

    কোন পাষণ্ড বলে বাঙালি সম্প্রদায়ের সাহিত্যপ্রীতি নেই ? কেউ কেউ তো রীতিমতো লেখক হওয়ার সাধু প্রচেষ্টায় রত | এইসব রচনা মূলত দুই ধরনের | ভ্রমণকাহিনী ও কবিতা সমালোচনা | আর এ কথা বলেছেন লেখক নিজে | জনসাধারণ শীর্ষক রচনায় |

    ভ্রমণ বৃত্তান্ত | কে না জানে যে তার মানেই সপরিবার দার্জিলিং ভ্রমণ | সেই বিরাট নিবন্ধে সেজবৌদি , রানুপিসি আর রাঙাদিদি বৃত্তান্ত | সেজবৌদির পা মচকানো থেকে রাঙাদিদির হারানো জর্দার কৌটো ঘুরে ফটক থেকে অন্দরমহল | আবার ফটক | মাঝেমাঝে ভ্রমণ কথাটা মনে পড়ে গেলে নিতান্ত অপরাধবোধে চারটি ভুলভাল উদ্ধৃতি | ফটো ? বাতাসিয়া লুপ, টাইগার হিল..বাজারে মেলে | আর অন্য ছবি ? ঝর্ণার সামনে রানুপিসি , রুগ্ন ঘোড়ার পিঠে ভাগ্নে নন্তু আর পাহাড়ের গায়ে সেজবৌদির তন্বী সুশ্রী ছোট বোন...বকুল ...ইয়ে ...মন্দ লোকে পাঁচ কথা তো বলবেই ! বয়েই গেল ! এই গোটা বর্ণনা ছবির মতো স্পষ্ট আর নিখুঁত |

    আবার ফিরে যাই সহজ ভাষায় সহজ উদাহরণের মধ্যে দিয়ে গভীর তত্ত্বকথা এসেছে যেখানে | ঘটনা খুব সাধারণ | লেখকের চোখের খেয়াল কম | ঘরের পাশেই ডাকঘর | নজরে পড়ে না | কোথাও গেলে বাড়ি ফেরার পর গৃহিণী সেখানকার কথা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চাইলে কর্তা নিতান্ত নাচার | কেন ?

    " দৃষ্টিশক্তি নির্ভর করে দৃষ্টিকোণের উপর | হয়ত আমার দৃষ্টিকোণ চক্ষুষ্ম|নের দৃষ্টিকোণ হইতে বিভিন্ন | স্বভাব , শিক্ষা ও রুচি অনুযায়ী এক এক জনের দৃষ্টি এক এক দিকে | স্ত্রীলোকের দৃষ্টি ও পুরুষের দৃষ্টি সম্পূর্ণ পৃথক | একটি ভদ্রমহিলার সহিত আপনার আলাপ হইল | বাড়ি ফিরিয়া বলিতে পারেন , তিনি কী রকম শাড়ি পরিয়াছিলেন , কিংবা তাঁহার কর্ণে স্বর্ণাভরণ ছিল কিনা ? আপনি যদি পুরুষ হন , কিছুতেই পারিবেন না ..যতই চক্ষুষ্ম|ন হন না কেন | কারণ পুরুষের দৃষ্টি সমগ্র মানুষটির উপর , যেমন স্ত্রীলোকের দৃষ্টি মানুষ ব্যতীত আর সমস্ত কিছুর উপর | ভদ্রমহিলাটি চলিয়া গেলে মেয়েমহলে তাঁহার বেশভূষা লইয়া তুমুল আলোচনা আরম্ভ হইয়া যাইবে | আপনার হয়ত কেবলমাত্র মনে হইবে , মহিলাটি কথা বলেন ভারী চমৎকার |"

    মিথ্যাবাদী বালক | “আত্মরক্ষার প্রথম ও আদিমতম অস্ত্র হইল মিথ্যা বলা | যে বালক বেগতিকে পড়িয়াও মিথ্যা বলিতে পারে না , তাহার সম্বন্ধে চিন্তিত হইবার কারণ আছে | তাহার আত্মরক্ষার সহজ প্রবৃত্তিটি সম্যক পরিস্ফুট হয় নাই , নিজের ভালো মন্দ বিচার করিবার জ্ঞান হয় না , কল্পনাশক্তিও দুর্বল | ...একাধারে বুদ্ধিমান , সপ্রতিভ এবং প্রত্যুৎপন্নমতি না হইলে বানাইয়া বলিবার ক্ষমতা থাকিতে পারে না | আপনার ছেলেটি সত্যবাদী বলিয়া আপনি গর্বিত হইতে পারেন , আমি কিন্তু শুনিয়া দু:খিতই হইব | আমার ছেলেটির মতো উহার বানাইয়া বলিবার ক্ষমতা নাই | "

    এরপর সেই জর্জ ওয়াশিংটনের গল্পটি | খুব চেনা | গল্পটি শুনে আমার পুত্র বলেছিল " ওয়াজ হী নরম্যাল ?" আর এখানেও লেখক দেখি লিখেছেন , " কুঠার হাতে পাইয়া যে বৃক্ষ ছেদন করিয়া কিংবা ছেদন করিয়া সেই দুষ্কর্ম অস্বীকার না করে , সে বালকের চিকিৎসার প্রয়োজন আছে |"

    আনন্দ এক আলোকমঞ্জীর | তাকে দেখা যায় না | অনুভব করতে হয় তার নি:শব্দ শিঞ্জিনী , তার উজ্জ্বল উপস্থিতি | তাই " পঞ্চেন্দ্রিয় উত্তীর্ণ হইয়া প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা যখন মানসিক অনুভূতিতে রূপান্তরিত হয় , তখনই উহা আনন্দ |"

    আবার ফিরি প্রচ্ছন্ন কৌতুকে | বাড়ি খুঁজতে বেরিয়েছেন লেখক |

    'নিতান্ত আপনজনের মতো আবদারের সুরে নিবেদন করিলাম , 'একখানি ভালো বাসা খুঁজছি |'
    'ভালোবাসা খুঁজছেন ?'
    ... কী সর্বনাশ ! আমার কি মতিভ্রম হইয়াছে ? আজ বাদে কাল রিটায়ার করিব , এই বয়সে একটি ভদ্রপল্লীর মধ্যখানে রাজপথে দাঁড়াইয়া ভালোবাসা খুঁজিয়া ফিরিতেছি ! গৃহিণী জানিলে কি আর রক্ষা আছে ?

    ...সর্বনাশা শব্দ দুইটির মধ্যে উপযুক্ত 'সম ' ফেলিতে না পারিয়া কী কেলেঙ্কারীটাই না বাধাইয়া তুলিয়াছিলাম !"

    হাস্যকৌতুকের মোড়কে আসে শিউপূজনের থিসিস লেখা | পদটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিশনেয়ারের | তাঁর কর্মের মধ্যে চাপরাশি সম্প্রদায়ের ওপর ছড়ি ঘোরানো এবং কর্তৃপক্ষের তাঁবেদারি | বেতন ৪৫ টাকা | ফ্রি কোয়ার্টার | কিন্তু শিউপূজন দেখেছে পি এইচ ডি না হলে আর কলকে পাওয়া যায় না | তাই সে গোপনে গোপনে থিসিস লেখে | থিওরি অফ গেট -কিপিং উইথ স্পেশাল রেফারেন্স টু ইণ্ডিয়া | আহা, এত বছর বাদেও..সেই ট্র্যাডিশন সর্বত্র বিদ্যমান | ক্ষমতার বলে অধস্তনের ওপর ছড়ি ঘোরানো এবং উর্ধ্বতনের পায়ে তৈলমর্দন | এবং এই রচনার শেষে যোগ্যতর প্রার্থী হয়েও শিউপূজনের চাকরি হয়নি | কার্য নির্বাহক সিণ্ডিকেট বিশেষ কাজকর্ম না করা সত্ত্বেও বড় সাহেবের চাপরাশিকে নির্বাচন করে | যথারীতি !

    "দেখা" আর "দেখা এবং বোঝা "| যদি শুধু দেখাই সার হয়, তবে একবার দেখলেই শেষ ! আর যদি তা বোঝার জায়গায় নিয়ে আসা যায়..তবেই প্রতিবারের দেখা নতুন নতুন ভাবে উপস্থাপিত হতে পারে |
    " যাহা বুঝি না , তাহা দেখিবার সার্থকতা যৎসামান্য , এবং সে বিবেচনায় না দেখিলেও বিশেষ ক্ষতি নাই | .... আমি কোনদিন আর্ট একজিবিশন দেখিতে যাই না | কারণ আমার চিত্রবোধ নাই | কেবলমাত্র চোখের দৃষ্টিতে যাহা গ্রহণ করিতে পারিব , তাহা তো আর গ্রাহ্য নয় ! পঞ্চেন্দ্রিয় আমাদের পাঁচটি ভৃত্য বটে , কিন্তু সেই পঞ্চ ভৃত্যের নিপুণ পরিচর্যা শিক্ষাসাপেক্ষ | ছবি দেখিলেই ছবি দেখা হয় না |...আমাদের সব কিছুতেই অধিকার , আমরা সবই দেখিয়া ফিরিতেছি !"

    আবার দাম্পত্য কলহ | এবং তারপরে মধুর বচন | লেখক স্ত্রীর প্রতি ক্রুদ্ধ হলে তাঁকে 'ইডিয়ট' বলে সম্ভাষণ করেন কখনো সখনো | কেন ? "উহাতে অপরপক্ষ অপমানে এত গর্জাইতে থাকে যে দেখিয়া বড় আনন্দ হয় !"

    আলাপচারিতার দু'টি ধারা | জানা এবং জানানো | লেখক কোনোটিতেই গা ভাসাতে অনিচ্ছুক | কারণ তিনি সব কিছু জানতে চান না | এমনকি যা জানতে চান ..তা আর যাই হোক, চায়ের টেবিলে বা নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গিয়ে নয় | আর জানাবে যে..তার জ্ঞানের পরিধি বিচার করবে কে ? লেখক নিজের জানাবার ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা সম্পর্কেও সন্দিহান | " আমি এমন কী জানি , যাহা অন্যকে না জানাইলেই নয় ?"

    দুপুর গড়িয়ে যখন বিকেল আসে বয়সে , তখন ঠিক কেমন লাগে ? সে এক আশ্চর্য গোধূলিবেলা | আকাশের অদৃশ্য সীমারেখার এপারে ঝলমলে রোদ , ওপারে মেঘলা আকাশ | মধ্যবর্তী স্থানে রঙের হোরিখেলা | শুধু দেখবার চোখ চাই |
    " একালের তরুণ তরুণীগণ যৌবনের কাঁচা রঙে ঝলমল করিয়া ফিরিতেছে | বয়সের রোদ লাগিয়া আমাদের অবশ্য সে রঙ নাই | কিন্তু যে রংবেরঙের সেকেলে শাড়ি আমাদের মুগ্ধ স্মৃতিকে বেষ্টন করিয়া আছে , কোনো দু:শাসন নবযৌবনের দর্প তাহাকে বিস্রস্ত করিতে পারে এমন সাধ্য নাই |"

    বাল্যসখী নিবন্ধে লেখকের বাকচাতুর্য |
    " ইদানীং লজ্জা , নম্রতা, স্থিরতা ইত্যাদি সেকেলে সদগুণগুলি শিশুদের উপর আরোপ করিলে তাহাদের মাতাপিতাগণ অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হন | দুষ্টামিটা বুদ্ধির লক্ষণ | ছেলেটি ধীর স্থির প্রকৃতির হইলে আশংকা থাকিয়া যাইত , উহা হয়ত আসলে বুদ্ধিহীনতারই নিদর্শন | "
    লেখক এই দুরারোগ্য মানসিক অবস্থার নাম দিয়েছেন" দুষ্টু কমপ্লেক্স" | এ রোগটি সাধারণত "মায়েদেরই" নাকি হয় | তবে ক্ষেত্রবিশেষে "বাপেদেরও " |

    স্বামীনিন্দা প্রসঙ্গ | এ নাকি কিছুই নয় , " নিন্দার ভান করিয়া স্বামীর উৎকর্ষ প্রমাণের প্রয়াস বিবাহিতাদের একটি বিশেষ দুর্বলতা"মাত্র ! এক সখী বড় দু:খে বলেন , স্বামীটি নিতান্ত নিষ্কর্মা | সংসারে সন্ন্যাসীর ভূমিকা | এই উক্তির "কালীপক্ষে ও বিদ্যাপক্ষে দুই তাৎপর্য | প্রথম অর্থের পিছনে অনতিপ্রচ্ছন্ন দ্বিতীয় অর্থ, ‘আমার স্বামী তোমারটির মতো সংসারের আলু পটল গুনিয়া সময় কাটান না | তাঁহার বিদ্যা ও রুচি উচ্চশ্রেণীয় ও ভিন্নধর্মী |’ “
    তখন অপর সখীরও বক্তব্য একই | অর্থাৎ বিবাদ করে কাজ নেই | দুই পুরুষই অতি উচ্চকোটির ! এবং অবশ্যম্ভাবী উপসংহার ... এমন স্ত্রী রত্ন আছে বলেই না ছাইয়ের সংসার আজ সোনার সংসার !
    পড়ছি আর প্রমাদ গণছি | আহা , সত্যি কথা বুঝি এমনি করে বলে দিতে আছে !

    দাম্পত্য | এবং কলহ | কলহ ..অর্থাৎ দুই পক্ষের কোলাহল |
    " আমাদের বিসম্বাদে আমার দিকটা নিতান্তই কোলাহলশূন্য | যেটুকু উষ্মা উক্ত বিসম্বাদের জীবনীশক্তি , তাহার জন্ম এবং অবস্থান চিরকালই স্ত্রীর অন্ত :পুরে | আমার মানসিক বহির্বাটি সর্বদা পরিচ্ছন্ন |
    .... আমি মনে করি , তর্জন প্রবণতার দিক হইতে স্ত্রী জাতির 'তর্জনী' নাম অতি প্রশস্ত | আমাদের নাসাগ্রে উহারা উদ্যত হইয়াই আছে |
    .... আমার স্ত্রী প্রত্যহ অন্তত একবার হুহুঙ্কারে ঘরে প্রবেশ করিয়া কিঞ্চিৎ উচ্চ কন্ঠে ঘোষণা করেন , মনু আর খোকন ..এই দুই দস্যির তাণ্ডবে তিনি সর্বদা অস্থির | ... আমি কিঞ্চিৎ নিম্নভাবে নিবেদন করি , তাঁহার যেখানে দুই , আমার সেখানে তিন |"

    এক ছত্র থেকে পরের ছত্রে যাই, এক নিবন্ধ থেকে অন্য নিবন্ধে ..আর অন্ত:সলিলা ফল্গুর মতো তিরতিরে ভালোলাগা ছড়িয়ে যায় শিরায় ধমনীতে | এবং পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে বুঝে যাই শুধু মনুষ্যচরিত্র ও পারিপার্শ্বিকতা "দেখলেই " হয় না...সম্যক "অনুধাবন" করতেও জানতে হয়... লেখার আগে ! তা না হলে কি এমনভাবে "নখদর্পণ " লেখা যায় ?

    যে ব্যক্তির পৃথিবীর যাবতীয় বিষয় নখদর্পণে , তাঁকে দেখে লেখকের মনে হয় , " সমস্ত জ্ঞানের পিণ্ড দুই হাতে চটকাইয়া হাত দু’খানি ধুইয়া রাখিয়াছেন | এখন অগণিত তত্ত্বতালাশের সৌগন্ধ দশ আঙ্গুলের বিবিধ মুদ্রায় নিরন্তর উৎসারিত হইতেছে | ..যেন গোটা পৃথিবীকে বাটিয়া চাটিয়া খাইয়া তর্কের ও সন্দেহের মশামাছি তাড়াইয়া নিশ্চিন্ত মতামতের মশারির তলায় অবসর লইয়াছেন |"

    এবার ভেগোলজি | সন্ধ্যাবিদ্যা | মনের কিংবা জ্ঞানের রাজ্যে আলো-আঁধারির জগত | অর্থাৎ বুঝি বুঝি বুঝি না | জিজ্ঞাসার সংকীর্ণতা থেকে বাঁধনছাড়া হয়ে যথেচ্ছ বিহারের আনন্দ | গন্তব্যবিহীন গমন, ক্ষুধাবিহীন ভুঞ্জন , বক্তব্যবিহীন বাক্য | একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ রাখি | লেখকের জবানীতে |
    " আপনারা এদিক থেকে এই করতে থাকুন | আর আমরা ওদিক থেকে ওই করতে থাকি | আপনারা যদি এটুকু করেন , তাহলে আপনাদের কাছ থেকে আমাদের এতে একটা সত্যিকারের সাহায্য হবে | এখন আমরা যদি এটা না করি..মানে এদের ব্যাপারটি তো বুঝতে পারছেন ? এরা দেবে না | কিন্তু দেবে না বললেই তো আর আমরা এ করতে পারি না | আমাদের কেড়ে নিতে হবে | আর তাহলেই বুঝতে পেরেছেন, ওটা বিশেষ দরকার |"

    কী সংকেতময় ভাষা ! কী বিভ্রম ছড়িয়ে গেল ! এ সব বুঝতে হলে বহুকালের সাধনা চাই | কত কিছুই যে বলা হল ...বোঝানোর দায় তো ভেগোলজিস্ট-এর নয় ! বোঝার দায় যে শুনছে তার ! একবার আয়ত্ত করতে পারলেই কেল্লা ফতে !

    অনেকগুলি নিবন্ধের উল্লেখ করলাম | অনেকগুলি বাদও গেল | মোট ৩৫ টি নিবন্ধ আছে বইটিতে | প্রতিটি বিষয়বস্তুর নির্বাচনে চমক জাগিয়েছে আমার মনে | রম্যরচনা এক সরস উপস্থাপনা , যেখানে বিদ্যার আলো আছে..কিন্তু তা লেখনীর জাদুতে এমনই যে অকারণ বাগাড়ম্বর বলে মনে হয় না | সুকৌশলে নিজের মত জনসমক্ষে প্রকাশ করা যায় এবং তা বিড়ম্বনার সৃষ্টি করে না | সাধুভাষায় লেখা | কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যও পাঠকের কাছে তা গুরুভার নয় | সাধুভাষায় লেখা বলেই হয়ত রচনার প্রাণপ্রতিষ্ঠা হয়েছে যথাযথ...কারণ রম্যরচনার প্রধান গুণটি হল ছদ্ম -গাম্ভীর্যে হাস্যরসের বাতাবরণ সৃষ্টি করে নিজস্ব মতামত প্রতিষ্ঠা করা |
    " শব্দের দ্যোতনা , অক্ষরের ভঙ্গি , বাক্যবিন্যাসের কৌশল এবং সর্বোপরি পাঠকের একান্ত নিভৃত মনোরাজ্য "..এর সব ক'টিকে সুনিপুণ দক্ষতায় নিয়ন্ত্রণ করেছেন যে মানুষটি..তিনি পরিমল রায় |

    "পরম ভবন " দিয়ে এই লেখা শুরু করেছিলাম | ওই যে শ্বেতপাথরের ফলক | যাতে নাম লেখা ছিল "পরম ভবন" | দেশভাগের পর আর তো তেমন কিছুই আনা যায়নি , পরিমল রায়ের পরিবার বুকে করে ওই ফলকটি নিয়ে এসেছিলেন তাঁদের দক্ষিণ কলকাতার আবাসে | তারপর তো মাত্র ৪২ বছর বয়সে চলেই গেলেন পরিমল রায় | সময়ের ঘূর্ণিপাকে কোথায় যে হারিয়ে গেল ওই ফলক | কিন্তু সব হারিয়েও কিছু রয়ে গেল | পরিমল রায় রয়ে গেলেন তাঁর খোকন আর মনুর কাছে |
    আর সেই অকালপ্রয়াত লেখকের তরুণী স্ত্রী ? শত দু:খেও যাঁর মুখের হাসিটি অম্লান , কন্ঠে গান ... শুধু চোখ দু’টিতে এক বিধুর মায়া জড়িয়ে থাকত নাবালক সন্তানদের জন্য | অসম্ভব মনের জোর না থাকলে আজ থেকে ৬৩ বছর আগে একা হাতে দুটি অবোধ অসহায় শিশুকে সর্বার্থে মানুষ করে তোলা নিতান্ত সহজসাধ্য ছিল না | দুটি অবোধ শিশু..তারা রক্তমাংসের বাবাকে খুব বেশি দিন পায়নি | স্মৃতিও বড়ই আবছা ...তবু আবার পেয়েওছে | কিছু উত্তরাধিকার | তীক্ষ্ণ ধীশক্তিতে , লেখনীর জাদুতে, কৌতুকপ্রিয়তায় , অমলিন চরিত্রগুণে |

    খোকন | স্টেটসম্যানের পৃথ্বীরাজ রায় |
    মনু | মণিকুন্তলা সেনগুপ্ত |

    ওই শ্বেতপাথরের ফলক ...তাই আজও ঝকঝক করে | আলো ছড়ায় | নির্মল আনন্দের |
  • ঐশিক | 132.18.***.*** | ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ১৮:১৩640726
  • বড় ভালো এ লেখনী, আলাপের ইচ্ছা রইলো
  • nina | 78.37.***.*** | ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৫:০৯640727
  • পড়শিRC
    সব কাজ তাকে তুলে পড়তে এলুম---বেশ কয়েকবার পড়ে ফেলেও মন বলছে---আবার আবার--------
    পরিমল রায়ের বই খুঁজে বার করতে হবে----কিম্বা তাঁর মেয়ের কাছে ধর্না দেব----
  • D | 24.96.***.*** | ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ১১:৩৩640728
  • প্রথম লেখাটি পড়লাম। বলতে পারছি না কিছু। সেলাম।
  • Ishani | 131.244.***.*** | ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ১২:৪৮640729
  • ছড়া আঁকা , ছবি লেখা
    ....................................
    "পদ্য যদি লিখতে তুমি , পরিমল
    মুগ্ধ হতাম সকলে ,
    হার মানাতে নামজাদা সব কবিদের
    ছন্দ মিলের দখলে |
    যত কথা -- আজগুবি আর অসম্ভব
    ঘুরছে তোমার মগজে ,
    দয়া করে কলম নিয়ে একটানা
    লিখতে যদি কাগজে ....."

    এই ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন পরিমল রায়ের সুহৃদ বুদ্ধদেব বসু | তাঁর লেখা থেকেই জানতে পারি যে পরিমল রায়ের মেধা ছিল ক্ষুরধার | তিনি ধনবিজ্ঞান না পড়ে যদি সাহিত্য পড়তেন , অধ্যাপক না হয়ে হতেন ডাক্তার..তাতে সাফল্যের কিছু ইতরবিশেষ ঘটত না | সত্যকারের মেধা এক এমনই সম্পদ, যা থাকলে সিদ্ধিলাভ অনায়াসেই হয় |

    পরিমল রায়ের পাঠক্রমে মুখ্য বিষয়টি ছিল ধনবিজ্ঞান | গৌণ বিষয় গণিত ও ইংরাজি | এদিকে তাঁর কণ্ঠস্থ ছিল বাংলা ও সংস্কৃত সাহিত্য | ধাঁধা সমাধানে ক্ষিপ্র , সাহিত্যে স্বচ্ছন্দবিহারী |

    ছাত্রাবস্থায় পরিমল রায় যে সব পদ্য রচনা করেছিলেন , তার কিছু কিছু "প্রগতি"পত্রিকায় প্রকাশিত হয়ে থাকলেও প্রধান প্রচার ছিল বন্ধু ও আত্মজনের মুখে মুখে | এরপর অবশ্য অনেক ছড়া কবিতা পত্রিকায় বেরিয়েছে | প্রকাশিত হয়েছে শনিবারের চিঠিতে আর রংমশালে | দুটি প্রকাশ পেয়েছে চতুরঙ্গে | ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা পত্রিকাতেও বেশ কিছু |

    ছড়া | খামখেয়ালী কৌতুক আর ছন্দ-মিলের গৌরবে গরীয়ান | এই সব পদ্য লেখা ইচ্ছেসুখে , ক্ষণিকের প্ররোচনায় বা আড্ডার আসরে | পদ্য লেখা এক বিষম ব্যাধি | একবার এর সংক্রমণ হলে তা নিতান্ত দুরারোগ্য | সেই ব্যাধির সানন্দ বাহক পরিমল রায় | তাঁর অধুনা -দুষ্প্রাপ্য ছড়ার বইটি সব বয়সের পাঠকের জন্য | তাতে আছে ছড়াকারের নিজের হাতে আঁকা ছবিও | ছান্দসিক পরিমল রায় স্বভাবসুলভ কৌতুকপ্রবণতায় পরিণত বয়সেও যে সব পদ্য লেখেন , তা বাংলাভাষায় কৌতুক-কবিতার জগতে রত্নবিশেষ |
    এই বইটিও আমার হস্তগত হয় পৃথ্বীরাজ রায় ( তিলকদা) মারফত |

    ছড়ার বইটি কয়েকটি ভাগে ভাগ করা | প্রথম ভাগে লিমেরিক | একটি নমুনা দিই |

    কনে সদ্বংশের , বসু ওরা বন-গাঁর ,
    দোষ শুধু রংটায় , একেবারে অঙ্গার |
    হায় পিস-শাশুড়ীক
    চিকিৎসা আসুরিক
    অবিরল গায়ে জল ঢালে আদি গঙ্গার |

    এই শ্রেণীর লিমেরিক একেবার নিয়মমাফিক | প্রথম , দ্বিতীয় ও পঞ্চম পংক্তি সমান দৈর্ঘ্যের ও পরস্পর অন্ত্যমিলযুক্ত | তৃতীয় ও চতুর্থ পংক্তি দৈর্ঘ্যে বাকি তিনের অর্ধেক , কিন্তু পরস্পরের সঙ্গে অন্ত্যমিলযুক্ত |

    এরপর কিন্তু অন্যরকম লিমেরিক এসেছে |

    বৌ পেয়ে মন-মতো
    ভারী খুশি মন্মথ |
    বলে, এ তো হবারই
    জানা ছিল সবার-ই
    মাহেন্দ্রক্ষণে মোর জন্ম তো |

    এখানে ৮ /৮ /৮ /৮ /(৮ + ৮ / ২ ) | কিন্তু অন্ত্যমিল এসেছে লিমেরিকের নিয়ম মেনেই |

    এবার আর একটি নমুনা | এখানে অন্য হিসেব | যদিও অন্ত্যমিলের ধারাটি নিয়ম মেনেই |

    রাগের চোটে নৌকো থেকে বৌকে দিল ফেলে ,
    এক নিমেষে স্রোতের টানে কোথায় নিল ঠেলে |
    এখন শুধু কপাল ঠোকে
    বলে , মশাই , মরছি শোকে ,
    গয়নাগুলো সঙ্গে গেল , কাজ হত আজ পেলে |

    এখানে ৫/৫/৫/২ এই হিসেবে প্রথম , দ্বিতীয় ও অন্তিম পংক্তি আর মাঝের দুটিতে ৫/৫ অক্ষরবৃত্ত হিসেবে লেখা হয়েছে |

    এই শেষের "নিষ্ঠুর" ধরনের লিমেরিক রুথলেস রাইমস অনুসরণে লেখা | বিংশ শতকের প্রথমদিকে হ্যারী গ্রাহাম ও অন্য অনেকে এই ধরনের "মরবিড পোয়েমস" লিখেছেন |

    এবার দেখা যাক এডওয়ার্ড লিয়ার কেমন প্রভাবিত করেছিলেন পরিমল রায়কে |

    লিয়ারের ছন্দ অনুসারী একটি নমুনা :

    ভাগ্যিস থুতনীটা ছিল অত ছুঁচলো ,
    তাই তো মিসেস জে-র
    উৎসাহ হল ঢের ,
    সঙ্গীত না জানার দু:খটা ঘুচলো |

    রামী -চণ্ডীদাস | সেই যে .. রজকিনী প্রেম নিকষিত হেম কামগন্ধ নাহি তায় ....সেই রামীর গল্প...নব আঙ্গিকে |

    এক যে আছে রামী নামে ধোপানী ,
    পুকুরের সিঁড়িঘাটে সে কী তার ফোঁপানি !
    চণ্ডীবাবু তাই না দেখে
    কাছে তাকে আনল ডেকে ,
    লোকে বলে সিঁড়িখানা অধ:পাতের সোপান-ই |

    এর পরের পর্বে আছে ছোটদের জন্য কিছু ছড়া |

    আমাকে বড্ড টানল নব্য রামায়ণ "হনুমান যদি " ( ১ আর ২ ) | মূল ছড়াগুলি একটু বড় , তাই দুটি দুটি করে পংক্তির উল্লেখ করব |
    হনুমান যদি লঙ্কার থেকে ফিরিয়ে আনতো সীতাকে
    আজো ধিকিধিকি জ্বলতে হতো না রাবণ রাজার চিতাকে |

    এবং

    হনুমান যদি লঙ্কার থেকে জানকীরে ধরে আনতো
    তাহলে তো সব রাঘব রাজারে অতি ভীতু বলে জানতো |

    এর পরে যে ছড়াটি বলব , তার নাম "কী বিপদ "| একজনকে ষাঁড়ে তাড়া করেছে | সে ভগবানকে ডাকছে প্রাণপণ | ভগবান বেপাত্তা | তাহলে উপায় কী ! গলকম্বলে কাতুকুতু , নাকি ভীষণ রেগে শিং দুটোকে ঠেসে ধরা ? তার চেয়ে বরং...

    " ফিক করে যেই ফেলবো হেসে মনটা যাবে গলে ,
    লক্ষ্মীছাড়া তাইতে যদি গুঁতিয়ে দিতে ভোলে !"

    এরপরের যে ছড়ার বিভাগ , সেটি অভিনব | কিছু শব্দ কীভাবে বিভিন্ন বাক্যে বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয় , তা নিয়ে লেখা | যেমন "ধরা ", "ওঠা ", "তোলা "| একই পদ কখনো বিশেষ্য, কখনো বা ক্রিয়া | ছড়াগুলি পুরোপুরি না দিয়ে বরং প্রতিটি শব্দের জন্য দুটি করে ছত্র উদাহরণ হিসেবে দিই |

    ১ ) কান্না -ধরা কন্ঠে তখন বল , হুজুর, শুনুন
    দুদিন ধরে রান্নাঘরে ধরছে না যে উনুন |

    ২ ) কথা ওঠে মেলা , চাঁদা ওঠে কম ,
    চুল ওঠা ব্যামো রোগের অধম |

    ৩ ) একটি ফোঁটা যায় না পেতে , কেবই দুধ তোলে ,
    ছেলেটা যে তুলবে পটল এমনটি রোজ হলে |

    এরপর একটি ছড়া আছে বাংলায় ধ্বন্যাত্মক শব্দের বাহার নিয়ে | এটি থেকেও শেষ দু'ছত্র লিখি |

    হৈ হৈ করে ঐ এলো বুঝি ঝড়
    পৈ পৈ করে ক'ই,, ছাতা খুলে ধর |

    আবার ফিরি ওই একই শব্দের বিবিধ অর্থের ব্যবহারে | শব্দটি হল "ভাঙা"| আমি শুধু শেষ কয়েক ছত্র লিখি |
    আড্ডা ভাঙে , সভা ভাঙে ,
    হঠাৎ ভাঙে ভুল ,
    আকাশ ভেঙে বৃষ্টি পড়ে
    মন ভেঙে আকুল |
    সিঁড়ি ভেঙে ছাতে উঠে
    ঘুড়ি ওড়ায় ছেলে ,
    পুঁজি ভেঙে ঘরকন্না
    টাকা ভেঙে জেলে |

    এই ৮ পংক্তি নিয়েই ভাবা যাক | হালকা চাল থেকে অভিমান আর দু:খ ছুঁয়ে আনন্দ পেরিয়ে বাস্তবের মুখোমুখি এবং তারপর তৃতীয় রিপু বিষয়ে পরোক্ষ সতর্কবাণী | কত রকম রংবেরঙে মনের টানাপোড়েনের ছবি আঁকা !

    এরপর একটি অন্য ধাঁচের ছড়া | পরপর প্রতি দুটি পংক্তির শেষ বর্ণ বা শব্দ এক | কিন্তু বর্ণ যখন শব্দ গঠন করছে , দুটি আলাদা শব্দ | যেখানে দুটি শব্দ এক , সেখানে ভিন্নার্থক শব্দ | কখনো বা প্রায় সমোচ্চারিত ভিন্নার্থক শব্দ | এটি অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ কবিতা | আমি বর্ণ আর শব্দ নিয়ে ঠিক কী বোঝাতে চাইছি..তা দুটি দুটি ছত্র দিলেই স্পষ্ট হবে | মজা হল , সব মিলিয়ে এটি একটি আখ্যান কবিতাও বটে |

    ক ) ভারী ভালো মেয়েটি সে মীনু সেন নামেতে
    রোজ করে লেখাপড়া বাজে কাজে না মেতে |

    খ ) বোধোদয় ছেড়ে মীনু যবে ধরে ধারাপাত
    দু চোখ ভাসায়ে আহা কী ভীষণ ধারাপাত !

    গ ) দু-গাছা কাচের চুড়ি বেগুনী ও সোনালী
    তাই নিয়ে মিছিমিছি এত কথা শোনালি !

    এরপর সেই আমলের বিখ্যাত দীর্ঘ ছড়া "মেয়ে মহল " | এখানে স্বল্প পরিসরে সম্পূর্ণ ছড়াটি লেখা অসুবিধাজনক | তাই আমি সামান্য নমুনা পেশ করব | নারীদের উদ্দেশ্যে অত্যাবশ্যক অমৃতবাণী | তাঁদের স্বভাবের বিবিধ "গুণ" | প্রতিটি স্তবকে চারটি পংক্তি | প্রথমে কোনো কোনো স্তবকে একটি পংক্তি কিঞ্চিদধিক প্রশস্তিসূচক | পুলকিত হতে না হতেই মূর্ছা !

    তোমার খোকার আহা বুদ্ধির বহর
    শুনিয়া স্তম্ভিত হোক বেবাক শহর
    যদ্যপি এমন ইচ্ছা মায়ের স্বভাব ,
    তথাপি সে অতি বড় রুচির অভাব |

    এমনই কথার পিঠে কথা | গান গাইবার অনুরোধ এলে ন্যাকামির বাই থেকে গয়না বিনে কোত্থাও না যাই ...পর্যন্ত | দোকানে শাড়ি কেনার নাম দোকানীর হেনস্তা থেকে সিনেমা হলে ছিঁচকাঁদুনে খোকার সম্যক ব্যবস্থা পর্যন্ত | আর পতি ? সে তো পরম গুরু !

    স্বামী যবে ব্যস্ত হয়ে রহে নিজ কাজে
    গভীর নিমগ্ন কোনো সমস্যার মাঝে ,
    তখন আসিয়া কাছে কর্ণের কুহরে
    ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করিও না চীৎকারের স্বরে |
    দিনে আর রাতে মিলে চব্বিশ প্রহর,

    বাজে কথা শোনাবার বহু অবসর |
    শান্তিতে থাকিতে দাও দু-দণ্ডের তরে
    তারপর বাকীটা তো তোমারি খপ্পরে !

    আমি নিশ্চিত , সম্পূর্ণ ছড়াটি পড়লে পুরুষ সম্প্রদায় ছড়াকারের জয়ধ্বনিতে আকাশ বাতাস মাতিয়ে তুলবেন |

    এরপরের পর্বে বিচার বিচিত্রা | বিচারক, উকিল , জুরি , বাদী , প্রতিবাদী | আসর সরগরম |

    ছেলে বলে , ছিলাম আমি ঢাকাতে ,
    সেই সুযোগে বৌকে আমার ধরলে
    এসে ডাকাতে |
    হাজার পাঁচেক নিয়ে গেছে গয়্নাতে
    ও টাকাতে |

    পরের পর্ব পাঁচমিশেলি | নাম ''নানাবিধ "| একটি দু পংক্তির কৌতুকী ছড়ার উল্লেখ করি |

    " কেটে কুটে মাসকাবারে মাইনে এলো তিনশ' তিন ,
    কর্তা পেলেন তিনটি টাকা , একশ' করে তিন সতীন |

    এতে আবার সেই দারুণ চাতুরী করে শব্দের ব্যবহার | তিনশ ' তিন এবং সমোচ্চারিত তিন সতীন |

    এরপর হরেকরকম ছন্দে কিছু ছড়া পেরিয়ে আমার যে ছড়াটিতে চোখ আটকে গেল , সেটি হল "মজার দেশ"| সত্যিই আমাদের দেশ একই রকম রয়ে গেল !

    দোকান ভরা খাবার তবু
    মানুষ মরে পথে ,
    দেশের লোকেই দেশটাকে ভাই
    করে দিচ্ছে ফতে !
    রোগে ভুগে ছেলে বুড়ো
    মরছে লাখে লাখে
    বলছে সবাই , মারলে কৃষ্ণ
    কে -ই বা তারে রাখে !

    এভাবে এগোতে এগোতে শেষ চার পংক্তি...

    মজার দেশের মজার কথা
    বলবো কত আর
    অধ:পাতের লম্বা সড়ক
    হচ্ছে পরিষ্কার |

    কবি অজিত দত্তর সেই বিখ্যাত লাইন মনে পড়ে ? "তুমিও বিখ্যাত হলে , সেই দু:খে লিখি না কবিতা "|

    পরিমল রায়ের "বলীবর্দ্দ" ছড়ার শেষ দু'পংক্তি লিখি :

    কোন মহা জেনাস -এর কহ তুমি লিডিং স্পিশিস ,
    তুমিও পি -এইচ ডি হলে সেই দু:খে লিখি না থীসিস |

    এটি ব্যঙ্গ কবিতার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ | এক অল্পবুদ্ধি পণ্ডিতম্মন্য অধ্যাপকের প্রতি |

    স্বভাব-রসিক পরিমল রায়ের লেখা তথাকথিত একটিমাত্র "বিমর্ষ"কবিতা হল "দৈনন্দিন "| ছাপা হয় "বাসন্তিকায় ", ১৩৫১ সালে | এই

    সংকলনে আছে দুটি শীর্ষকহীন গদ্য-কবিতাও | "কবিতা "পত্রিকার পৌষ ১৩৪৪ সংখ্যায় প্রকাশিত |

    রবীন্দ্রনাথের একটি দীর্ঘ কবিতা আছে | "নিমন্ত্রণ " | নতুন বৌঠানের উদ্দেশ্যে লেখা তরুণ কবির ডাকে না দেওয়া চিঠি | একই ছন্দে পড়লাম পরিমল রায়ের লেখা "একাল কবিতাটি | বা বলা ভালো , একালের চিঠি | শুরুটি লিখি | এবং শেষটি | দুটি কবিতার | প্রথমে থাক" নিমন্ত্রণ" |

    মনে পড়ে বুঝি এককালে লিখিতাম
    চিঠিতে তোমারে প্রেয়সী অথবা প্রিয়ে
    একালের দিনে শুধু বুঝি লেখে নাম
    থাক সে কথায় , লিখি বিনা নাম দিয়ে .....
    ..... তোমাতে আমাতে মিলিত নিবিড় একা
    স্থির আনন্দ , মৌনমাধুরীধারা ,
    মুগ্ধ প্রহর ভরিয়া তোমারে দেখা
    তব করতল মোর করতলে হারা |

    এবার "একাল "|

    তোমায় পত্র লিখেছি ক'দিন আগে
    হয়তো সে চিঠি হয়েছে হস্তগত ,
    সযতনে তারে রেখেছ তো অনুরাগে
    অথবা ধূলায় ফিরিছে ইতস্তত ?.....
    ............ এ কালে প্রণয় চলে এই ভাষা দিয়ে
    সোজাসুজি চালে চলে একই চতুরালি ,
    স্বপ্নের জাল একেবারে ছিঁড়ে নিয়ে
    তারপর বুঝি চলে এই জোড়াতালি |

    সত্যি ! দুটি কবিতা পাশাপাশি রেখে মনে হল, কত দ্রুত আমরা স্বপ্ন দেখতে ভুলে গিয়ে মধুর বৃত্তি ভুলে গিয়ে ছলচাতুরীর যাপনকে আশ্রয় করেছি |

    প্রথম জীবনে অর্থনীতির অধ্যাপক ছিলেন পরিমল রায় | পরে রাষ্ট্রসংঘের সঙ্গে যুক্ত | সমাজ সচেতনতার অন্তর্দৃষ্টি ছিল | কবির দিব্যদৃষ্টিও তো ছিল ! তাই লেখা হয়েছিল কালোবাজার নিয়ে পদ্য | তার দেখে চার ছত্র উল্লেখ করি |

    খুলে এক কম্পনী ধরিয়েছ কম্পুনি
    কানাকড়ি সবই নেবে হাতড়ে,
    শেখালো এ টোপ কে ? মানুষের লোভকে
    বিঁধে সবই টানো নিজ পাত্রে |

    পরপর এসেছে সোশালিস্টিক ছড়া, ইনফ্লেশন , মহাযুদ্ধকালীন ছড়া , স্বাধীনতা-উত্তর , ছেচল্লিশের দাঙ্গাও | বঙ্গভঙ্গের পর লিখেছিলেন ,

    ফুরিয়ে গেল রঙ্গ ,
    বঙ্গ হল ভঙ্গ |
    এই তো ছিল পণ গো ,
    চল বৃন্দাবন গো |

    মহাযুদ্ধকালীন অবসরে লেখা :

    চীনে সেনা ঘর্ম্মায়
    বলে, ওরে জাপানী
    মিছে তোর দাপানি
    শুনে তাহা চুপি হাসে ইংরেজ শর্মায় |

    এমন কি একটা দুটো ? অনেক | যত লিখি এ নিয়ে, মনে হয় আরও লেখা বাকি রয়ে গেল |

    ছড়া | আয়তনে লঘু ; কিন্তু অর্থবহতায় গুরু | ছড়া আনন্দ দেয় , তির্যক বাক্যে শরাহত করে ; আবার চিন্তার ভুরিভোজ সরবরাহ করে স্বল্পসময়ের পরিবেশনে অসীম দক্ষতায় | পরিমল রায়ের ছড়া আজ এত বছর পরেও আমাদের চমকে দেয় তাদের রসিকতার রাংতায় মোড়া ব্যঙ্গে , সমকালীন রাজনীতি ও অর্থনীতির ওপর বুদ্ধিদীপ্ত মতামতের প্রাচুর্যে , সমাজ ও পরিবারকেন্দ্রিক মানসিকতার স্ফুরণে বা নির্ভেজাল হাসিঠাট্টার উদ্ভাসে | বিষয়বৈচিত্র্যগুণে , অচিন্ত্যনীয় রসবোধে ছন্দের জাদুকরী পারঙ্গমতায় পরিমল রায় বাংলা সাহিত্যের এক নক্ষত্রবিশেষ ...শুধু যা হারিয়ে গিয়েছে অকালে , নি:সঙ্গ তমসাচ্ছন্ন মধ্যরাতের আকাশে |

    শেষের এ আলোচনা বড় গুরুপাক হল কি ? তাহলে মেঘ কাটাতে একটি হাস্যরসে সিক্ত পদ্য | পরিমল রায়ের এই "পদ্য পদ্ধতি (২)" প্রকাশিত হয়েছিল "শনিবারের চিঠি"তে |

    এমন লেখো পদ্য , মানে , এমনতরো গদ্য
    বাংলাদেশের কারুর বাবার হয় না যেন বোধ্য |
    সেখালে ভাই ছেলেরা সব লিখতে বসে কাব্য,
    ভালোবাসাবাসির কথা লিখতো অসম্ভাব্য |
    এম-এ পড়তে আসতো যারা , প্রেমে পড়তোই বেশি ,
    পতন এবং মূর্ছা নিয়ে ছন্দে রেষারেষি |
    তাই না দেখে বাপের সব হতেন খড়্গহস্ত
    কবিত্বটা ফোটার মুখেই শুকিয়ে যেতো ত্রস্ত |
    ছেলেরা তাই জটলা করে করলো পরামর্শ,
    মেয়েরা আর কাব্যলোকের রবে না আদর্শ |
    লিখতে হবে এমন কিছু , এমনতরো তত্ত্ব,
    বাপের যার বুঝবেই না ষত্ব কিংবা ণত্ব |
    সেই থেকে ভাই বাপখুড়োদের ব্যাবসা গেছে থেমে ,
    একালেতে ছেলেরা আর কেউ পড়ে না প্রেমে |
    কিন্তু ভায়া, সেই থেকে যে উধাও কাব্যলক্ষ্মী,
    আসন জুড়ে রাজ্যই করে হুতুম প্যাঁচা পক্ষী |

    এই সব ছড়া এদিক ওদিক প্রকাশিত | এবার আমি দুটি ব্যক্তিগত ছড়ার উল্লেখ করে এ আলোচনার ইতি টানব | প্রথম ছড়াটি পেয়েছি বুদ্ধদেব বসুর কনিষ্ট কন্যা রুমিদির (দময়ন্তী বসু সিং ) আনুকূল্যে | ছোটবেলায় রুমিদি আর তাঁর ছোটভাই পাপ্পার (শুদ্ধশীল বসু) একটি অটোগ্রাফ খাতার যৌথ মালিকানা ছিল | বাড়িতে স্বনামধন্য অতিথি এলেই তাঁরা ভাই বোন খাতা এগিয়ে দিতেন | পরিমল রায় বন্ধুকন্যার উদ্দেশ্যে সেই খাতায় লিখেছিলেন,

    ছোট্ট মেয়েই বড় হয়ে শেষকালে হয় বুড়ি
    বাপ মায়ে যে জানে না তা দৈব বাহাদুরি |

    রুমিদির ভাষা ধার করেই বলি, " আবাল্য বন্ধুটির প্রতি বাবার ভালোবাসা এবং গুণগ্রাহিতা আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছিল পরিমল রায় নিকটজন | কিছু মানুষকে আমরা জন্মসূত্রে পাই | সে সব সম্পর্ক চাক্ষুষদর্শননির্ভর নয় |আমার কাছে পরিমল রায় তেমনই একজন |"

    পরের ছড়াটি মণিদি ( মণিকুন্তলা সেনগুপ্ত , পরিমল রায়ের কন্যা )-র কাছ থেকে পাওয়া | এই ছড়াটির এক অন্য মূল্য আছে | মণিদির জন্ম উপলক্ষ্যে পিতা পরিমল রায় ছড়াটি লিখেছিলেন | কিন্তু নিজের কথা , নিজের আবেগ নিয়ে নয় | মণিদির খুদে দাদা তিলকের (পৃথ্বীরাজ রায়ের জবানীতে )| পুত্রের আনন্দের অভিব্যক্তির সাক্ষীও পিতা এবং সেই শিশুপুত্র তো তার পুতুলের মতো বোনটার কথা ভেবে পদ্য লিখতে পারে না ...তাই সেই দায়িত্বও সানন্দে বহন করেন পিতাই | তখন তাঁরা ঢাকার পুরানা পল্টনের বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র; তবে ওই
    জেলাতেই |

    এগারো নম্বর বাড়ী, র‍্যাঙ্কিন স্ট্রীট
    ওয়ারীতে পোস্টাপিস, ঢাকা ডিস্ট্রিক্ট।
    তের-শো বাহান্ন সন, চব্বিশে শ্রাবণ,
    ন-মিনিট গত বেলা বারোটা তখন ।
    যতদূর মনে পড়ে- বৃহস্পতিবার,
    সকলের সবে শুরু মধ্যাহ্ন আহার ।
    এ হেন মুহূর্তে এক মহা চীৎকার -
    অচেনা অচেনা লাগে , কণ্ঠখানি কার ?
    আরে এ যে রাধুমণি তুই কোথথেকে?
    বোন নাকি? ব'লে দাদা হেঁকে ওঠে ডেকে।
    বাবা বলে, ওর নাম মণিকুন্তলা --
    দেখেছিস চুলে ওর মণি উজ্জ্বলা ।

    পরিমল রায় প্রয়াত হন মাত্র বিয়াল্লিশ বছর বয়সে | তাঁর স্মৃতি ধীরে ধীরে আবছা হয়ে আসে সাহিত্যিক মহলে , পাঠক মহলে | এই বইও আর এখন পাওয়া যায় না | যদিও আমার হাতে যে সংস্করণ আসে , তা বিকল্প থেকে প্রকাশিত..২০০৯ সালে এবং এখন নি:শেষ | বাংলা সাহিত্যের এক অকালপ্রয়াত প্রতিভার যথার্থ মূল্যায়ন আমার অতি সীমিত ক্ষমতার বাইরে | তবুও আজ এক অবোধ্য তাগিদে কিছু পছন্দের ছড়া সকলের সঙ্গে ভাগ করে নিলাম |
  • Ishani | 131.244.***.*** | ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ১৩:৫৯640731
  • একটি ফোঁটা যায় না পেটে , কেবলই দুধ তোলে *
  • ranjan roy | 132.176.***.*** | ০৬ অক্টোবর ২০১৪ ২৩:৪৫640732
  • অনেক ধন্যবাদ।
    সবগুলো লেখার জন্যেই। কিন্তু বিশেষ করে পরিমল রায়ের লেখার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্যে।
  • Ishani | 116.216.***.*** | ০৪ নভেম্বর ২০১৪ ১৮:১৬640733
  • ব্রজবুলি
    ……………….
    সদ্য কিশোরীটি ঘরের এক কোণে বসেছিল চুপটি করে | লীলা মজুমদারের ভাষায় "নেই" হয়ে | পত্রিকার অফিস | সে এসেছে "দাদাগিরি" দেখতে | সে টেনিদাকে চেনে , ঘনাদাকেও | আজ ব্রজদা | ব্রজরাজ কারফর্মা |
    গুল +গল্প = গুল্প | ব্রজদার খুব আফশোষ | বাঙালির হজমশক্তির নিতান্ত দুরবস্থা | কোনো কিছু প্রাণে ধরে বিশ্বাস করতে পারে না | আর তাই তার আজ এই অধ:পতন |
    ব্রজদাকে হেলাফেলা করা যায় না | রবীন্দ্রনাথ নোবেল পেয়েছিলেন ব্রজদার পরামর্শে | অন্নদাশঙ্করের বাংলা শেখা ব্রজদার কাছে | দেশবন্ধু যে কলকাতার মেয়র, নেহেরু যে প্রধানমন্ত্রী , গান্ধী যে মহাত্মা..এর পেছনে কে ? ব্রজদা | ব্রজদাকে চিনতে না পেরে আজ বাঙালির ইতিহাস ধুঁকছে | সেই ব্রজদার মুখোমুখি এই মেয়েটি আজ |
    প্রথম গুল্প | প্রথম মোলাকাত | বড়লাটের জাঁদরেল এডিকং কর্নেল ক্লিম্যান্ট (যাঁর আদলে নাকি রবি ঠাকুর গোরাকে আঁকতে চেয়েছিলেন ; কিন্তু পারেননি | কারণ ক্লিম্যান্ট যদি ক্যানাডিয়ান ইঞ্জিন , গোরা তবে হাওড়া -আমতা রেলের ধুকুস ধুকুস ) | এই ক্লিম্যান্টকে স্রেফ ল্যাং মেরে কুস্তিতে ধরাশায়ী করেছিলেন ব্রজদা | ব্রজদার বাণী :" এই ল্যাং মারার ঐতিহ্য বাঙালি যতদিন বজায় রাখতে পারবে, ততদিন..হোয়াট বেঙ্গল থিঙ্কস টুডে , ইন্ডিয়া উইল থিঙ্ক টুমরো |" আর হ্যাঁ , কুস্তিতে জেতার পর বড়লাটের মেম ব্রজর গালে চুমু খেতে চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হন | কারণ , "ওটা ফরেন গুডস | এখন স্বদেশী আন্দোলন চলছে | বিলাতী মাল আমরা বয়কট করেছি |"
    মেয়েটা তাজ্জব | লোকটা বলে কী ! রবি ঠাকুর নাকি গীতাঞ্জলির ইংরিজি অনুবাদে হাত দিয়ে ব্রজদাকে ভয়ে ভয়ে পড়ে শোনাতেন !
    ব্রজদার এফিসিয়েন্সি ? যখন বিদেশী বিমা কোম্পানির রমরমা , ব্রজদা কী করেছিলেন ? স্বদেশী কোম্পানির মান বাঁচাতে ? একদিন এক বিলিতি বীমা কোম্পানির সাহেব আর ব্রজদা ঘরে বসে কফি খেতে খেতে আড্ডা দিচ্ছেন..এমন সময় পাঁচতলার ছাদ থেকে এক পলিসি হোল্ডার প্রিমিয়াম জমা দিতে এসে পা ফসকে পড়ে গেল | রাস্তা থেকে 'গেল গেল ' রব উঠেছে | লোকটা পাঁচ হাজার টাকার বীমা করেছে ব্রজদার কোম্পানিতে | ব্রজদার ঘর তিনতলায় | লোকটা জানলার পাশ দিয়ে পড়বার সময় তার হাতের মুতী পুরো পাওনার বেয়ারার চেক গুঁজে দিলেন ব্রজদা | পুরো টাকা হাতে নিয়ে সে ব্যাটা আছাড় খেয়ে মরল |
    মেয়েটার চোখ গুল্লি গুল্লি হয়ে উঠল | লোকটাকে তো কাল্টিভেট করতে হচ্ছে ! সে চেয়ার টেনে নিয়ে এল আড্ডার কাছাকাছি | কী ভাগ্যিস , তাকে কেউ দেখতে পাচ্ছে না ! ঘরে মেলা লোক | সুনীত ঘোষ , সুনীল বোস , যদুদা , প্রেস ফটোগ্রাফার বিশু আর একটা মোটা কালো গুঁফো লোক | চোখে চশমা | এ লোকটা মনে হয় ব্রজদার পেয়ারের খুব | যা বশংবদ হাবভাব ! লোকটার নামটা জানতে হবে পরে |
    ব্রজরাজ কারফর্মা | পেঁয়াজি নয় ! জাতীয় বাহিনীর হাজার হাজার ছেলেকে প্যারেড করিয়েছেন | সেই কানকে ফাঁকি দেওয়া সোজা ? এই যে লর্ড কিচেনারের রেজিমেন্টের এক মক্কেলের জুতোর ভেতরে মোজার আড়ালে কবেকার চিবোনো চুইংগাম আটকে ছিল বলে প্যারেডে পা মিলছিল না ..কই...ব্রজ ছাড়া কেউ কি ধরতে পেরেছিল ?
    কেউ কি জানে যে ফোর্ট উইলিয়াম থেকে সাবমেরিনে চেপে এই ব্রজরাজ কারফর্মা সটান পৌঁছে গেলেন ফ্রান্সের ক্যালেতে ? ফরাসী স্থলবাহিনীর চিফ জেনারেল ফুসফুসিয়ের মান বাঁচাতে ? যেখানে সেই বিখ্যাত বা কুখ্যাত মহিলা গুপ্তচর মাতাহারি সুন্দরী মাদি কুকুরের ছদ্মবেশে স্রেফ লিপস্টিক চিবিয়ে সব প্ল্যান শত্রুশিবিরে ফাঁস করে মিত্রশক্তির হাড়ে দুব্বো গজিয়ে দিচ্ছিল ? এ সব বাঙালির লুপ্ত ইতিহাস | মেয়েটার ততক্ষণে মাথা ঘুরতে শুরু করেছে | আবার আড্ডার আকর্ষণ এতই তীব্র, যে উঠেও আসতে পারছে না | যা অবস্থা, তাতে ব্রজদাকে না জানা মানে বাংলার ইতিহাস সম্পর্কেই অন্ধ হয়ে থাকা | ব্রজদার মতে " ইতিহাস ঠিক যেন মহাসমুদ্রে ভাসমান বরফের স্তূপ , যার ন'ভাগের একভাগ মাত্র ওপরে ভেসে থাকে; আর আট ভাগই থাকে জলের তলায় |" ব্রজদা .. বাংলার ইতিহাসের ওই তলানি |
    ব্রজদা বঙ্কিমকে কপালকুণ্ডলার আইডিয়া দিয়েছেন , বসন্ত কেবিনে আইনস্টাইন -সত্যেন বোসের দোস্তি করিয়ে দিয়েছেন , বিদ্যাসাগরের বিধবা বিয়ের আন্দোলনে সাহায্য করেছেন | রামমোহনের বিলেত যাবার টিকিট কার টাকায় কেনা ? এখনো বলে দিতে হবে ? কেরী সাহেবকে বাংলা টাইপের নক্সা এঁকে দিয়েছেন..জব চার্ণককে ...না:..এখন থাক..একসঙ্গে যদি হজম না হয় ?
    ব্রজদা যখন রিপোর্টার ? " হিজড়ের যেমন স্ত্রী পুরুষ হয় না , খবরেরও তেমন সত্য মিথ্যা হয় না | রিপোর্টাররা যা পাঠায়, তাই খবর |" আর ব্রজদার সমসাময়িক রিপোর্টারদের নাম ? মিস্টার রিউমার মঙ্গার , গুল মার্চেন্ট ...সবক'টা ঘাঘু মাল | এদের সঙ্গে কম্পিট করে ব্রজদাকে জায়গা করে নিতে হয়েছে | খবর শুরু করতে হবে কীভাবে ? " বিশ্বস্তসূত্রে প্রাপ্ত একটি নির্ভরযোগ্য গুজবে প্রকাশ..." এইভাবে | রিপোর্টের মধ্যে যত বেশি "প্রকাশ", "আরও প্রকাশ", "নাকি"..এইসব ঢুকবে , তত সেফ রিপোর্টিং | এই ধরুন যুদ্ধের রিপোর্টিং | দরকার হলে মৃত সৈনিকদের জনৈক মুখপাত্রর সঙ্গে সাক্ষাত্কার ছেপে দিতে হবে | স্কুপ ইজ স্কুপ | দরকার হলে কাগজ ছাড়াই টাইপ করতে জানতে হবে | কী করে ? শত্রু শিবিরে বন্দী | টাইপরাইটার আছে, কাগজ নেই | টাইপরাইটারের বারের ওপর ছোট্ট একটা দাড়ি কামানোর আয়না ফিট করে নিতে হবে | যেন তার ওপর রোদ্দুর পড়ে চিকচিক করে | তারপর আয়নার মুখটা বেস হেড কোয়ার্টারের দিকে ফিরিয়ে চাবি টিপে টিপে খবর পাঠাও আর তোমার সহযোগী ষোল মাইল দূরে বসে সেই তেজি রোদের রিফ্লেকশন দেখে দেখে সেগুলো টুকে নিক | ব্যস , কেল্লা ফতে !
    রাধানাথ শিকদার এভারেস্টের উচ্চতা মাপলেন আঁক কষে | ২৯০০২ ফুট | কিন্তু সেটা ঠিক কিনা দেখবেন কে ? ব্রজদা | তবে সে এক কেলোর কীর্তি | ২৮৯৯০ ফুট ওঠার পর অলটিমিটার বিগড়ে গেল | তখন সেখান থেকে এক হাই জাম্প | ফুল ফোর্সে | ব্রজদা ম্যাক্সিমাম ক্লিয়ার করতে পারতেন ১২ ফুট | তাহলে কত হল এভারেস্টের উচ্চতা ? ২৮৯৯০ +১২ = ২৯০০২ ফুট | রাধানাথ সেদিন ব্রজকে বুকে টেনে নিয়েছিলেন |
    মেয়েটা বই পড়ে | পড়াও তো আসলে একরকম শোনাই | এবং দেখাও | যদি তেমন কলমের জোর থাকে লেখকের | মেয়েটা গল্প শোনার ঘোরে বসে থাকে | ব্রজদার সেই মন্ত্রপূত মাদুলি...যা দিয়ে তিনদিনে হাজার হাজার টন বরফ গলে জল হয়ে যায়, যে মাদুলি হাতে বেঁধে আদ্দির পাঞ্জাবি পরে এভারেস্টের মাথায় হাওয়া খাওয়া যায় |
    মেয়েটা চমকে ওঠে শুনে যে শার্লক হোমস আসলে এই ভেতো বাঙালি ব্রজদা | ব্রজরাজ কারফর্মা প্রথম মহাকাশচারী যিনি ইউরেনাস , নেপচুন আর প্লুটোতে বেড়াতে গিয়েছিলেন |
    এত সব হজম করতে কষ্ট হচ্ছে ? সবে তো কলির সন্ধে | সেই যে বিজয়সিংহ লঙ্কা করিল জয়...তার বাড়ি তো শান্তিনিকেতনের কাছেই ..সুরুলে | ব্রজদার পারিবারিক বন্ধু | সে তো লর্ড সিনহা ফ্যামিলির ছেলে ! ব্রজদা আলাদা জিনিস..ব্যাক গিয়ারে প্লেন চালিয়েছেন | ব্রজদা চালের গাছ চাষ করেছিলেন | সে চালের নাম ব্রজশাল | এক্কেবারে গাছ থেকে সটান ঢেঁকি ছাঁটা সেদ্ধ চাল |
    তিনদিন টানা বসেছিল মেয়েটা | মোট ১৮ +১= ১৯ টা গল্প | থুড়ি , গুল্প | শেষের দিন দেখা গেল..ব্রজদাকে বাঘে খেয়ে ফেলেছে , তাও ব্রজদা চালিয়ে যাচ্ছেন | ব্রজদা মরে বেঁচে গেছেন , নাকি বেঁচে মরে আছেন ? এই যে বাঙালির ছেলে চারদিক থেকে মার খেয়ে পালিয়ে বাড়ির দরজায় এসে নেড়িকুত্তার মতো কেঁউ কেঁউ করছে আর ব্রজদাকে তা চোখে দেখতে হচ্ছে ....একে কি কেউ বাঁচা বলে ?
    তিনদিন ধরে বসে থেকে থেকে মেয়েটা ততদিনে সেই ব্রজদার পেটোয়া লোকটার নাম জেনে ফেলেছে | ওই মত কালো গুঁফো লোকটা | ওর ছদ্মনাম রূপদর্শী | আসল নাম ..গৌরকিশোর ঘোষ | সেই প্রথম এই মানুষটার লেখার সঙ্গে কিশোরীর পরিচয় | তারপর একে একে রূপদর্শীর সংবাদভাষ্য, উপন্যাস, ছোট গল্প ..তবে সে আলাদা ধরন | আজগুবী গল্প ফাঁদা মোটেই সহজ কাজ নয় | কারণ তাকে বিশ্বাসযোগ্যভাবে পরিবেশনের ( অন্তত পড়ার সময়টুকুতে ) কায়দাকানুন ঠিকঠাক জানতে হয় | ব্রজদা যদিও টেনিদা বা ঘনাদার মতো তুমুল জনপ্রিয়তা পাননি ..তবু কোথাও না কোথাও লেখনীর প্রসাদগুণ নেহাত কম কিছু ছিল না | টেনিদা আর ঘনাদার গল্পের বা গল্পের সংখ্যা অনেকই বেশি | প্রচারের আলোও বেশি | তিন কলমচির কলমের জোরে গল্পের গরু গাছে উঠেই ক্ষান্তি দেয়নি..একেবারে মগডালে বসে লেজ নেড়ে নেড়ে হাওয়াও খেয়েছে | তবে ব্রজদার গল্প কোথাও যেন সূক্ষ্ম স্যাটায়ার অদ্ভুত আর বুদ্ধিদীপ্ত নকশাও এঁকেছে জায়গায় জায়গায় | যেখানে গৌরকিশোরের স্বাতন্ত্র্য ঝিলিক দিয়ে যায় |
    গৌরকিশোরের ভাষায় বলা যাক |
    " শ্রীরামকৃষ্ণের যেমন শ্রীম , ডা: জনসনের যেমন বসওয়েল , ব্রজদার তেমন আমি | ব্রজদার মুখের বুলি | তাই ব্রজবুলি |"
    আর ব্রজদা কী বলেন ?
    " ফ্যাক্টটুকু যা বলেছি , তার সিকিটুকুও ও ফোটাতে পারেনি | এর ওপর যদি একটু গুল চড়াতুম , তবে সে তো ওর কলমের রেঞ্জেই পৌঁছত না !"
    আর সেই মেয়েটি ? তার কী হল ? সে বড় হল | স্কুল পেরিয়ে কলেজে ঢুকে তার প্রিয় বন্ধুকে একবার জন্মদিনে খুব কষ্ট করে জমানো ৬ টাকা দিয়ে আজ থেকে তিন দশক আগে উপহার দিয়েছিল "ব্রজদার গুল্পসমগ্র "| আচমকা সেই বাড়িতে গিয়ে পুরনো বইয়ের স্তূপ থেকে বেরোল সেই বই | সে ভাবল , দেখি তো ! সেই প্রথম পড়ার আনন্দের রেশ আজ শেষ বেলাতেও আছে কিনা ! সব সময় তো থাকে না ! সে বইটা হস্তগত করল | আবার পড়ল |
    আর এই প্রথম ... বই চুরি করল সে | কাউকে না বলে নিয়ে এল বইটা নিজের সংগ্রহে | আর বুঝল , মার্ক টোয়েন ঠিকই বলেছিলেন | বই চুরি করলে ..প্রিয় বই চুরি করলে আদৌ তেমন পাপ হয় না !
  • Ishani | 24.96.***.*** | ০৪ নভেম্বর ২০১৪ ২০:১৯640734
  • গোরাকে * , হাতের মধ্যে *
  • পাতা :
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঠিক অথবা ভুল প্রতিক্রিয়া দিন