এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • আসামে বোড়ো মুসলিম দ্বন্দ্ব প্রসঙ্গে

    সৌভিক
    অন্যান্য | ১৪ মে ২০১৪ | ৪৬৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • সৌভিক | 24.99.***.*** | ১৪ মে ২০১৪ ১০:৩৮638640
  • জাতিদাঙ্গা বিধ্বস্ত আসাম খুঁজছে শান্তির আশ্রয়। সেখানে প্রায়শই আগ্নেয়গিরির অগ্নি উদগীরণের মতো বেরিয়ে আসে পারস্পরিক বিদ্বেষের বিষবাস্প। বোড়ো ও মুসলিম জনগোষ্ঠীর দাঙ্গায় সেখানে বহুবার বেদনাদায়ক প্রাণিহানির ঘটনা ঘটেছে। সাম্প্রতিককালে এবং অতীতেও। এই লোকসভা ভোট চলাকালীন এরকম ঘটনা ঘটার পর অনেকেই ভোট চলাকালীন উশকানিমূলক বিভিন্ন মন্তব্যকে এর জন্য দায়ী করেছিলেন। উশকানি থাকে, ছিল এটা স্বীকার করেও বলতে হয় বেশ কয়েক দশক ধরে বারবার ঘটা জাতিদাঙ্গা নেহাৎ উশকানি তত্ত্বের চেয়ে ঘটনার গভীরতর বিশ্লেষণ দাবি করে, দাবি করে এ অঞ্চলের ইতিহাস পর্যালোচনার। সেদিকে এগনোর চেষ্টা করা যাক।

    আসামের কোকরাঝার এলাকা ও সংলগ্ন অঞ্চলে উদ্বেগজনক জাতিদাঙ্গার ঘটনায় ২০১৩ র জুন জুলাই মাসে প্রায় ৬০ জন মারা যান, গৃহহারা হন ৪ লক্ষেরও বেশি। ১৯ জুলাই থেকেই দীর্ঘদিন ধরে তিরতির করে বয়ে চলা উত্তেজনা জাতিদাঙ্গার চেহারা নিতে শুরু করে। এর আগেই অবশ্য কোকরাঝার এলাকায় পরিস্থিতি উত্তপ্ত হতে শুরু করেছিল, যখন জুলাইয়ের প্রথম দিকে দুজন বাঙালি মুসলমান ওই এলাকায় খুন হন। ১৯ জুলাই আরো দুজন মারা যান। ২০ জুলাই বোড়ো লিবারেশন টাইগার এর চার প্রাক্তন সদস্য খুন হন। এর প্রতিক্রিয়ায় বোড়োরা বাঙালি অধ্যুষিত এলাকায় প্রত্যাঘাত করলে দাঙ্গা শুরু হয়।
    ১৯৭১ সালের আগে, বাংলাদেশ গঠনের আগেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্থান থেকে আসা বাঙালি মুসলিম অভিবাসীদের সঙ্গে বোড়ো আদিবাসীদের এই সংঘর্ষর প্রাথমিক কারণ জমি ও জীবিকার অধিকার নিয়ে বিরোধ। বোড়োদের পক্ষ থেকে প্রচারে বলা হয় ৯০ এর দশক পর্যন্ত কোকরাঝার এবং চিরাং এ বোড়ো আদিবাসীদের সংখ্যাই ছিল বেশি। কিন্তু গত দুদশকে এখানে অভিবাসী মুসলিমদের সংখ্যা বেড়েছে, যারা মূলত ক্ষেতমজুর এবং দিনমজুর। বিশেষত গোঁসাইগাঁও মহকুমার বিভিন্ন গ্রামে অভিবাসী মুসলিম জনসংখ্যার তুলনায় বোড়োরা সংখ্যালঘু হয়ে পড়েছেন। ধীরে ধীরে কোকরাঝার শহর এলাকাতেও অভিবাসী মুসলিমদের একাংশের প্রবেশ ঘটেছে। অন্যদিকে ‘বাংলাদেশ থেকে লক্ষ লক্ষ অনুপ্রবেশকারী ঢুকে পড়ায় এখানকার জনবিন্যাস বদলে যাচ্ছে’ – এই জনপ্রিয় প্রচারের বিরুদ্ধে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষজন জানিয়েছেন ১৮৫০ খ্রীষ্টাব্দের পর থেকেই তারা এখানে আসা শুরু করেন। বস্তুতপক্ষে ব্রিটিশদের আগ্রহেই ব্রক্ষ্মপুত্রের তীর বরাবর অভিবাসনের এই প্রক্রিয়াটি চলে। ব্রহ্মপুত্রের চর এলাকার জমি অত্যন্ত উর্বর, কিন্তু বন্যার জন্য সে জমিতে চাষাবাদের জন্য বিশেষ দক্ষতা দরকার ছিল। জলের মধ্যে চাষের প্রযুক্তি ময়মনসিংহ অঞ্চলের চাষিদের আয়ত্তে ছিল। ব্রিটিশ শাসকরা ওই এলাকাকে রাজস্ব আদায়ের যোগ্য করে তোলার জন্য ময়মনসিংহ ও অন্যান্য জেলা থেকে মুসলমান চাষিদের নিয়ে আসে। বিশ শতকের গোড়ার দিক থেকে এই অভিবাসনের মাত্রা আরও বাড়ে। আজকের অসমে ব্রহ্মপুত্রের চর এলাকায় কৃষি-সমৃদ্ধির পেছনে এই মুসলমান চাষিদের অবদান অসামান্য।এদেরই একটা অংশকে আবার বন্যার কারণে উত্তরে-দক্ষিণে অপেক্ষাকৃত উঁচু জায়গায় সরে যেতেও হয়েছে। ফলে রেল লাইনের উত্তরেও কিছু মুসলমান বসতি গড়ে উঠেছে।এটা নিয়ে বোড়োরা আপত্তি জানিয়েছেন।
    এই পরিপ্রেক্ষিতে পৃথক বোড়োরাজ্যের দাবী নিয়ে বোড়ো লিবারেশন টাইগার নামক বোড়োদের জঙ্গী সংগঠনের নেতৃত্বে চলা বোড়ো আন্দোলনের সঙ্গে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের সমঝোতা সূত্র হিসেবে ২০০৩ সালে বোড়োল্যাণ্ড টেরিটোরিয়াল কাউন্সিল (বিটিসি) তৈরি হয়। আসামের চারটি জেলা, কোকরাঝার, চিরাং, বকসা এবং উদালগুরু এর অন্তর্ভূক্ত হয়। সে সময়েই সংশ্লিষ্ট এলাকার অ-বোড়ো মানুষজন বিটিসি তৈরির বিরোধিতা করে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছিল এর ফলে এই এলাকায় অবোড়োদের নানা সমস্যর মুখোমুখি হতে হবে। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য ২০০১ সালের জনগণনা অনুযায়ী ওই এলাকায় বোড়ো ও অন্যান্য তফসিলি উপজাতির কিছু মানুষ মিলিয়ে উপজাতিদের মোট সংখ্যা ছিল ১৮ শতাংশ। বাকি ৮২ শতাংশ মানুষের মধ্যে ছিলেন বাঙালি হিন্দু, বাঙালি মুসলিম ও ভালো সংখ্যক সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মানুষ।
    বিটিসি তৈরির পর বোড়ো লিবারেশন টাইগার তাদের কার্যকলাপ গুটিয়ে নেয়। কিন্তু তাদের একদা প্রধান হাগ্রামা মাহিলারি একটি রাজনৈতিক সংগঠন তৈরি করেন এবং বোড়োকাউন্সিলের নির্বাচনে বিজয়ী হন। অ-বোড়োদের অভিযোগ কাউন্সিল তাদের প্রতি উদাসীন। অন্যদিকে বিটিসি তৈরির পরেও এই বিটিসি এলাকায় মুসলিম অনুপ্রবেশের সূত্রে বোড়োদের জমির অধিকার কমে যাওয়া এবং গোঁসাইগাঁও মহকুমার মতো অনেক জায়গায় তাদের তুলনায় বোড়োদের সংখ্যালঘু হয়ে পড়া তাদের মধ্যে একটা আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করে। দীর্ঘদিনের পারস্পরিক অবিশ্বাসের বাতাবরণই সাম্প্রতিক জুলাই দাঙ্গার মধ্যে দিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য এর আগেও এই অঞ্চল মারাত্মক কিছু জাতি দাঙ্গা প্রত্যক্ষ করেছিল। ১৯৮৩র ১৮ ফেব্রুয়ারী সংগঠিত নেল্লি গণহত্যায় ছয় ঘন্টার মধ্যেই দুহাজারের বেশি মুসলিমকে হত্যা করা হয়েছিল। এছাড়াও মাঝে মাঝে বিচ্ছিন্ন সংঘর্ষের ঘটনা ও চাপা উত্তেজনা এখানকার নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার।
    মনে রাখা দরকার জমি ও জীবিকার অপ্রতুলতার ক্রমবর্ধমান সমস্যাই এই জটিলতাকে প্রতিদিন বাড়িয়ে তুলছে, আর সেটাই আরো নানা বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পারস্পরিক জাতিবিদ্বেষের আকারে এখানে আছড়ে পড়ছে। শুধু বোড়োল্যাণ্ড টেরিটোরিয়াল কাউন্সিল গঠন করে যে সমস্যার মৌলিক কোন সমাধান করা যাবে না, সাম্প্রতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করে এটা স্পষ্ট হচ্ছে। দাঙ্গা প্রতিরোধে আশু সমস্ত ব্যবস্থার পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার ভিত্তিতে সমস্ত পক্ষের জীবন জীবিকার মৌলিক সমাধান ও পারস্পরিক সৌহার্দের সংস্কৃতি নির্মাণ করাই অশান্ত এই এলাকায় শান্তি স্থাপনের প্রকৃত রাস্তা হতে পারে।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। পড়তে পড়তে মতামত দিন