এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • চেনা অচেনা রূপকথা

    sosen
    অন্যান্য | ১৭ মার্চ ২০১৪ | ১০৬৪ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • sosen | 111.63.***.*** | ১৭ মার্চ ২০১৪ ১৯:০৩630485
  • কিছুটা পরীক্ষামূলক চেষ্টা। রূপকথার অনুবাদ আক্ষরিক হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তবু, এই চেষ্টা করার মূল কারণ, কিছু কিছু রূপকথা/উপকথা পড়ে মনে হয়, তা না ছোটদের, না বড়দের। শুধু গল্পের টান নয়, সমাজের কিছু প্রতিবিম্ব ধরা রয়েছে এই ধরনের গল্পের মধ্যে, পৃথিবী জুড়েই। ভারী অদ্ভুত সব নীতিকথা, তার চেয়েও অদ্ভুত লোকজন নিয়ে এই সব কথা। এর পরতে পরতে সংস্কৃতি -সভ্যতার গঠনও মিশে আছে। কিছু কিছু তেমন গল্প, দেওয়ার ইচ্ছে রইলো। সবই ইংরেজি থেকে ভাবানুবাদ।
    *****************

    জ্ঞানী কচ্ছপ আর তার রূপসী মেয়েটি (ভাবানুবাদ)

    দক্ষিণ নাইজেরিয়া

    এক যে ছিলেন রাগী রাজা। জন্তু থেকে মানুষ, সব প্রজারাই তাঁকে বেজায় ভয় করত। রাজার একটি মাত্তর ছেলে।নাম তার রাজকুমার ইকপিনিওন। বিয়ের বয়েস হলে রাজা রাজকুমারকে পঞ্চাশজন অপরূপ সুন্দরী মেয়ে উপহার দিলেন। বাবার কথামত তাদের সকলকেই রাজকুমার বিয়ে করলো, কিন্তু একজন বউকেও তার মনে ধরলো না। ছেলের ওপর বেজায় রেগে গিয়ে রাগী রাজা হুকুম করলেন, কারোর ঘরে যদি রাজকুমারের বউদের থেকে বেশি সুন্দরী মেয়ে থাকে, আর তাদের উপর যদি রাজকুমারের চোখ পড়ে, তাহলে রাজকুমার, মেয়ে, তার বাপ-মা সব্বার গর্দান যাবে। ঢাকঢোল বাজিয়ে সেই নতুন আইন তো সারা দেশে জানিয়ে দেওয়া হল। প্রজাদের মনে আর শান্তি রইলো না। সবাই ভয়ে ভয়ে দিন কাটাতে লাগলো।

    প্রজাদের মধ্যে ছিল এক জ্ঞানী কচ্ছপ। তার ঘরে সদ্য জন্মেছে একটি পরম রূপসী কন্যা। কচ্ছপের বউ ভয়ে আধখানা হয়ে কচ্ছপকে বললে, এমন সুন্দর মেয়ে কি করে ঘরে রাখি? রাজকুমার তো একে দেখলেই বিয়ে করতে চাইবে, মাঝখান থেকে বেঘোরে আমাদের প্রাণটাও যাবে। তার চেয়ে এখনি মেয়েকে মেরে ঝোপের মধ্যে পুঁতে দিই।
    বৌয়ের কথা শুনে জ্ঞানী কচ্ছপ বললে "তাও কি হয়?" সাহস করে সে মেয়েকে লুকিয়ে রাখলো ঘরের মধ্যে। তিন বছর বয়েস অব্দি কেউ তাকে দেখতেই পেল না। কিন্তু একদিন, যখন কচ্ছপ আর তার বউ তাদের ছোট্ট ক্ষেতে কাজ করতে গেছে, রাজকুমার শিকার করতে করতে এসে পড়লো কচ্ছপের বাড়ির কাছাকাছি। বাড়ির ছাদে বসে ছিল এক পাখি। বাড়ির ভিতরে তখন কচ্ছপের মেয়ে "আদেত" খেলা করছিলো।পাখি তার দিকে এমনি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তাকিয়েছিল, যে রাজকুমারের আসার শব্দ সে টেরই পেল না। সেই সুযোগে দূর থেকে তীর ছুঁড়ল রাজকুমার। তীর বিঁধে বেচারা পাখি ধপ করে কচ্ছপ-মেয়ের পায়ের কাছে, বাড়ির ভিতর পড়লো।

    রাজকুমারের অনুচরেরা ছুটল পাখি কুড়োতে। কিন্তু বাড়ির ভিতর উঁকি দিয়ে কচ্ছপের মেয়েকে দেখে তারা তো থ। এমন সুন্দর মেয়ে কি কেউ কোথাও দেখেছে? আর দেরী না করে, সঙ্গে সঙ্গে রাজকুমারের কাছে দৌড়ে এসে তারা সব কথা বলল। শুনে, কচ্ছপের বাড়ির বেড়া ভেঙ্গে রাজকুমার ভিতরে ঢুকলো। আর পরম রূপসী সেই ছোট্ট মেয়েকে দেখেই এক নিমেষে ভালোবেসে ফেলল।
    মাটির দাওয়ায় বসে, অনেক আদর করে, অনেক কথা কয়ে সে কচ্ছপ কন্যাকে জিগ্যেস করল, "তুমি আমার বউ হবে গো?" ছোট্ট মেয়ে ভারী খুশি হয়ে বলল "নিশ্চয়ই হব রাজকুমার"।

    এইভাবে কন্যাকে রাজি করিয়ে তো রাজার ছেলে বাড়ি ফিরে গেল। বাবার কাছে সে কিছু বলল না, পাছে তার ছোট্ট ভাবী বৌয়ের গর্দান যায়।

    পরের দিন রাজকোষের খাজাঞ্চিকে দিয়ে সে কচ্ছপের কাছে ষাট টুকরো দামী কাপড়, আর তিনশো পেতলের লাঠি পাঠালো। ওই দেশে এই সবই হলো টাকা পয়সা। এইসব দামী দামী উপঢৌকন পেয়ে কচ্ছপ তো অবাক। আরো অবাক, ভরদুপুরে যখন তার বাড়ি এসে রাজপুত্তুর ইকপিনিওন হাঁটু গেড়ে বসে বললে, সে কচ্ছপের মেয়েকে বিয়ে করতে চায়।

    কচ্ছপ দেখল, এতদিন ধরে সে যা ভয় করছিলো, তাই ঘটতে চলেছে। রাজকুমারকে যত্ন করে বসিয়ে সে বলল "বাবা, তোমার হাতে মেয়েকে দিতে তো আমার কোনই আপত্তি নেই। কিন্তু ভয় করি, রাগী রাজা জানতে পারলে যে আমাদের প্রাণটি যাবে।"
    রাজকুমার তো এইসব ভেবেই এসেছিল। সে বললে, "আমাকে আগে না মেরে আপনাদের কেউ মারতে পারবে না।" কচ্ছপের ভয় তবু যায় না।কিন্তু রাজকুমারও ছাড়ার পাত্র নয়। সাত পাঁচ ভেবে কচ্ছপ শেষে বললে "ঠিক আছে, আগে মেয়ের বিয়ের বয়স হোক, তারপর না হয় তোমার সাথেই তার বিয়ে দেব।"
    বাড়ি ফিরে রাজকুমার তার মাকে সব কথা জানিয়ে দিয়ে বললে "মা, এবার উপায়?" রাণীমা গালে হাত দিয়ে বসলেন। ছেলের পছন্দের মেয়ের বর্ণনা শুনে এদিকে তো তাঁর-ও মন ভারি খুশি, ওদিকে ভয়, জানতে পারলে রাজা নির্ঘাত সবারই গর্দান নেবেন। ভেবেচিন্তে রাণীমা মাথায় পাতার ছাতাটি দিয়ে, হাতে চামড়ার ঝোলা নিয়ে লুকিয়ে কচ্ছপের বাড়ির দিকে রওনা দিলেন।

    কচ্ছপ রানীমাকে খাতির যত্ন করে বসালো। ঝোলার ভিতর থেকে একগোছা নতুন কাপড়, কয়েকখানা নতুন আলু, আর মুখবন্ধ মাটির সরা ভরে নারকেল তেল বার করে রাণীমা কচ্ছপকে বললেন, “এই দিয়ে তোমার মেয়েকে আমি আমার ছেলের জন্য পছন্দ করলুম। কথা দাও, তুমি আর কারুর সাথে মেয়ের বিয়ে দেবে না।”
    প্রাণের ভয় সত্ত্বেও রাণীমার এমন সাহস দেখে কচ্ছপের মনেও জোর এলো। সে জোড়হাতে বললে, "কথা দিলুম রাণীমা। রাজকুমার যখন আমার আদেতকে ভালোবেসেছে, তখন তার সাথেই মেয়ের বিয়ে দেবো।"
    কথা আদায় করে তো রাণীমা রাজবাড়ি ফিরে গেলেন। তারপর সময় কাটতে থাকে। পাঁচ বছর ধরে রাজকুমার লুকিয়ে লুকিয়ে কচ্ছপের বাড়ি যাওয়া আসা করে। কচ্ছপের মেয়েও বড় হয়ে ওঠে, আরো সুন্দর হয়। অবশেষে একদিন কচ্ছপ রাজকুমারকে বললে, আদেতের তো বিয়ের বয়েস হয়ে গেল। এবার তো ওকে মোটা হওয়ার ঘরে পাঠাতে হবে।

    ঐ দেশে এমনি নিয়ম। বিয়ের কনে মোটা না হলে সবাই ভারী নিন্দেমন্দ করে। তাই বিয়ের বয়েস হলে মেয়েকে একখানা ঘরে রেখে অনেক অনেক ভালো খাবার খাওয়ানো, আর তেল মাখানো হয়, বিয়ের আগে অব্দি। তাতে করে কনে বেশ মোটাসোটা গোলগাল হয়ে ওঠে, আর সবাই খুব খুশি হয়। রাজপুত্তুরের কথা শুনে কচ্ছপ আর তার বউ এবার আদেতকে গাঁয়ের মোটা হওয়ার ঘরে রেখে এলে।

    রাজকুমার ভাবতে ভাবতে বাড়ি ফিরল। এবার তো রাজাকে সব বলতেই হয়। তারপর, কয়দিন ধরে সাহস সঞ্চয় করে, অবশেষে সে রাজাকে শুরু থেকে সব কথা জানালো। সব শুনে রাগী রাজা তো তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন। তাঁর বানানো আইন কিনা তাঁরই ছেলে ভাঙছে! তক্ষুনি লোক পাঠিয়ে গাঁয়ে গাঁয়ে খবর দেওয়া হলো, বাজারের মধ্যে রাজকুমারের বিচার হবে। দোকানদারেরা ভয়ে ভয়ে দোকান সরিয়ে নিলে, রাজার অনুচরেরা রাজা-রানীর বসার জন্য মাঝ-বাজারে পাথর পেতে দিল, কলাপাতার ছাউনি করে দিল।সব প্রজারা কাজকর্ম ফেলে সেখানে এসে জড়ো হলো। সে কি হইহট্টগোল!

    যথাসময়ে রাগী রাজা রানীমাকে নিয়ে এসে বিচারসভায় বসলেন। সবার বুক দুরুদুরু। রাজার লোকজন রাজকুমার আর কচ্ছপ-মেয়েকে এনে বিচারসভায় দাঁড় করালে।

    এই ক'বছরে কচ্ছপ-মেয়ে তো আরো অনেক সুন্দর হয়েইছিল, তারপর কয়দিন মোটা হওয়ার ঘরে থেকে ভালো ভালো খেয়েদেয়ে, তেল মেখেটেখে তার গায়ের চামড়া আরো ঝকঝকে কালো হয়েছে, আরো গোলগাল হয়েছে সে। তাকে দেখে সারা রাজ্যের প্রজারা তো বটেই, রাজা পর্যন্ত অবাক হয়ে গেলেন। এমন সুন্দর কি কেউ হয়?

    প্রজারা তখন সবাই মিলে রাজার কাছে কেঁদে পড়লো, রাজা যেন এদের শাস্তি না দেন। রাজা রাগী হলে কি হবে, কচ্ছপ-মেয়েকে দেখেই তাঁর রাগ জল হয়ে গিয়েছিল। তিনি হেসে বললেন, রাজকুমার তো ভারী বুদ্ধিমান, নৈলে এমন বউ খুঁজে বার করা কি যার-তার কাজ!

    কিন্তু শাস্তি মকুব করতে গেলে তো আইন নাকচ করতে হয়। সেই যে রাজা আইন করেছিলেন, রাজকুমারের পঞ্চাশ বউয়ের থেকে সুন্দর মেয়ে জন্মালেই গর্দান নেওয়া হবে। প্রজারা হইচই করে বলতে লাগলো, সেই আইন তুলে নেওয়া হোক। এদিকে আইন কি আর তুলব বললেই তোলা যায়! সে আইন হলো ইগবো আইন, ভারী সাংঘাতিক। সাত জন ইগবো নেতাকে ডেকে ইগবো আইন বানানো হয়। ইগবো নেতাদের নাম জুজু, তাদের হাতে থাকে চাবুক, গলায় মরা মানুষের খুলি আর মুখে মুখোশ। তাদের সকলে ভয় পায়। তাদের আইন না মানলেই প্রাণটি গেল।

    যাই হোক, রাজা ইগবোদের ডেকে, অনেক অনেক নারকোল তেল আর টাকা পয়সা দিয়ে তাদের আইন তুলে নিতে রাজি করিয়ে ফেললেন। আইন উঠে যাওয়াতে প্রজারা বেজায় খুশি হলো। আরো খুশি হলো, যখন বিয়ের ভোজের ঘোষণা হলো। পঞ্চাশ দিন ধরে সে কি খাওয়াদাওয়া! পাঁচখানা বড় বড় গরুর মাংস, যত খুশি ফু-ফু (মিষ্টিআলু সেদ্ধ) আর নারকোলের চপ যত চাই। তার সাথে রইলো খেজুর আর নারকেলের মদ, বাজারের যেখানে সেখানে জালা জালা। যে যত খুশি খায়, নাচে আর ফুর্তি করে।

    বিয়ের পর রাগী রাজা কচ্ছপকে ডেকে বললেন, বেয়াই, পণ হিসেবে আমার অর্ধেক রাজ্য তোমাকে দিলাম, আর কাজকর্ম চালানোর জন্য ৩০০ হৃষ্টপুষ্ট ক্রীতদাস। সুন্দরী বউ পেয়ে মহাখুশি রাজকুমারও শ্বশুরকে দুশো মোটাসোটা মেয়েমানুষ আর একশোটা ছোট্ট মেয়ে পাঠিয়ে দিল। তাদের দিয়ে অনেক চাষবাস করে কচ্ছপ বেজায় বড়লোক হয়ে উঠলো, তাদের আর কোনো দু:খ রইলো না। রাজ্যের লোকজনও কচ্ছপকে জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান বলে সম্মান করতে লাগলো, মেয়েকে সাহস করে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। এমনি করে কচ্ছপ যে সবার চেয়ে বুদ্ধিমান, তা প্রমাণ হলো।
    ______________________________________________

    নীতি: যত গরিবই হও না কেন, ঘরে সুন্দর মেয়ে জন্মালে খুশি হয়ো। কে বলতে পারে, রাজার ছেলের চোখে ধরে যেতে পারে তোমার মেয়ে, আর তোমার ভাগ্যও ফিরে যেতে পারে হঠাত।
    _______________________________________________
  • sosen | 111.63.***.*** | ১৭ মার্চ ২০১৪ ১৯:৪৬630487
  • এই টইতে লিখলে কি অসুবিধা আছে?
  • π | ১৭ মার্চ ২০১৪ ১৯:৫১630488
  • অসুবিধের কিছু নেই তো। একই বিষয় নিয়ে টই থাকলে সেখানেই সচরাচর লেখা হয়, এক জায়গায় থাকলে সুবিধাও হয়। এরপরে যার যার নিজের ইচ্ছা।
  • Atoz | 161.14.***.*** | ১৮ মার্চ ২০১৪ ০২:০১630489
  • নাইজিরিয়ার গল্পটা দিব্যি।
    তবে গল্পের আসল নীতি হলো- হুঁ হুঁ, তেলের অনেক গুণ, সে নারকেল তেলই হোক আর অন্য তেলই হোক-
    ঃ-)
  • sosen | 125.242.***.*** | ১৮ মার্চ ২০১৪ ০৯:৫৬630490
  • ***********************************************
    এখন, এই লেখায় এই বিশেষ গল্পটা বেছে নেওয়ার পিছনে কয়েকটা কারণ আছে। গল্পটার কয়েকটা বিশেষত্ব আছে, সেরকম আরো অন্যান্য গল্পেও থাকবে বৈকি, একে একে ছুঁয়ে যাবার চেষ্টা করব সরল ভাবে, খানিকটা পর্দা খোলার চেষ্টা, উন্মোচন। জনগোষ্ঠী, সভ্যতা এবং নীতির বুনোটকে পড়ার চেষ্টা। ।

    তেল দিয়েই শুরু করা যাক। আমি এখানে প্রতিশব্দ খুঁজে না পেয়ে, নারকোল তেল লিখলেও, আসলে এই তেল হলো " রেড পাম অয়েল"। এই পাম গাছ পশ্চিম আফ্রিকার উপকূলবর্তী সমভুমিজাত, আর আস্তে আস্তে ভিতরের অনেকটা অংশে ছড়িয়ে পড়েছে। আফ্রিকান অর্থনীতিতে তেলের ভূমিকা বিরাট । পরম্পরাগতভাবে মেয়েরাই প্রত্যেক ঘরে এই তেল বানাতে পারে, পা দিয়ে ফলের শাঁস ঘষে ঘষে। তিন বা চারটে গাছ থেকে প্রায় ২০ লিটার তেল পাওয়া যায়, যা নিত্যদিনের রান্না থেকে গায়ে মাখা সব কাজেই ব্যবহার হয়। এ ছাড়া ওই ফলের বীজ থেকে একধরনের তেল হয়, যার ওষধি হিসেবে ব্যবহার আছে। তেলকে বিনিময়ের কারেন্সি হিসাবে ব্যবহার করা উপকূলবর্তী আফ্রিকার সাধারণ ঐতিহ্য।

    এই গল্পটা এফিক উপজাতির গল্প। নাইজেরিয়ার কালাবার এবং ওয়োনো নদীর মোহনা জুড়ে, যাকে ব্রিটিশরা ক্রস রিভার বলে থাকে, ক্যামেরুনের পশ্চিম দিক ঘেঁষে এফিকদের এখনকার বসত। এখনকার বসত বলার কারণ, মনে করা হয়, আফ্রিকায় এই উপজাতির উদ্ভব হয়নি। ক্যামেরুন থেকে উদ্গত বিরাট চওড়া ওয়োনো নদী, বেশি দৈর্ঘ্য নয় যদিও, প্রস্থে বিরাট, প্রায় আশি কিলোমিটার ধরে একটা বাঁকানো হুকের আকারে বয়ে গেছে বৃষ্টিস্নাত বনের মধ্য দিয়ে। হুকের মধ্যে রয়েছে কালাবার নদী। আর কালাবার আর ওয়োনো নদীর জোড়া বদ্বীপ, তিনধরনের বিশেষ অরণ্য বা ইকোসিস্টেমকে আলাদা করেছে যেমন, তেমনি স্থান দিয়েছে বিভিন্ন সভ্যতাকে। এফিক, নাইজেরিয়ার বহু পুরনো উপজাতি হলেও অনেকেই বলেন, তাদের মূল নাকি প্যালেস্টাইনে। সেখান থেকে খ্রীষ্টপূর্ব ৬৩ -এ, পম্পেই দ্য গ্রেট জেরুজালেম অধিগ্রহণ করার সময়, তারা আফ্রিকার দিকে এগোতে থাকে।

    প্রায় হাজার বছর পর, জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের দশম শতাব্দীতে কালাবারের কুলে ইবম প্রদেশে বারোটি এফিক গোষ্ঠির প্রাথমিক বসতি স্থাপনের নজির মেলে। সত্যিই যদি প্রাচ্যে এই উপজাতির উত্স হয়ে থাকে, এই হাজার বছরের প্রব্রজনে এফিক উপজাতি পেরিয়ে এসেছে প্রাচীন মিশর, নীলের দুকুল, নিউবিয়া। এর পরে পুরনো কালাবার থেকে তারা আরো সরে যায়, ছড়িয়ে পড়ে, সেসব কথায় আসছি। এফিক উপজাতি দাবি করে প্রাচ্যের ঐতিহ্য তাদের মধ্যে বহমান তাদের ইহুদী নামে,তাদের মৃতদেহ সত্কারের প্রাচ্যপন্থায়,তাদের ভাষায় রয়েছে সংস্কৃত থেকে মিশরের ভাষার স্বাক্ষর। তাদের প্রাচীন লিখিত ভাষায় রয়েছে মিশরের হায়রোগ্লিফিক স্ক্রিপ্ট-এর সাদৃশ্য। যাই হোক, এই মতামত বিতর্কিত, এর আলোচনায় পরে আসা যাবে। তেলের কথায় ফিরি। ইবম প্রদেশ, অর্থাত কিনা এই এফিক উপজাতিরা যেখানে এসে আস্তানা গেড়েছিল, সেই জায়গাটা হলো তেল-পাম চাষের স্বর্গ। স্বভাবতই, এই অঞ্চলের সমস্ত উপকথা-রূপকথায় পাম-তেলের উল্লেখ পাওয়া যাবেই।

    অন্য আরেকটা জিনিসের প্রতি দৃষ্টি ফেরানো যাক। গল্পে, তেলের পাশাপাশি কারেন্সি হিসেবে কাপড় আর পিতলের রডের উল্লেখ রয়েছে। প্রি-কলোনিয়াল আফ্রিকায় প্রচলিত ছিল বিভিন্ন রকম কারেন্সি। প্রাথমিক, আর সবচেয়ে পুরনো কারেন্সি হলো সাদা কাপড় আর নুন। নুনকে ছোট ছোট কোণের আকারে গড়ে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হত। নুনের মূল অসুবিধা ছিল, জল লাগলেই সে গলে গিয়ে বিনিময়্মাধ্যম হিসাবে আর তার উপযোগিতা থাকত না। এইসময় কারেন্সির উদ্দেশ্য ব্যক্তিগত প্রয়োজন মেটানোই ছিল বলে মনে হয়। এর পরে এলো পিতল আর তামার রড আর কড়ি। দেখা যাচ্ছে, বিনিময় মাধ্যমের ব্যবহার-উপযোগিতা কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এই ধরনের কারেন্সি তৈরী হয়। তা হলে, এই উপকথা যখন তৈরী হয়েছে, তখন কোনো না কোনো ভাবে উপজাতিগুলির মধ্যে, বা বহির্জগতের সঙ্গে একটা ব্যবসায়িক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, যাতে এই ধরনের সর্বজনমান্য টাকাপয়সার দরকার পড়ে । কি সেই ব্যবসা?

    গল্পে এও দেখা যাচ্ছে, যে ক্রীতদাসের উল্লেখ রয়েছে। আসলেই, এই গল্পে যে বাঁকানো লোহার রডের কথা বলা হয়েছে, তাকে ম্যানিলা বলা হয়, এবং ক্রীতদাস কেনাবেচার ক্ষেত্রে এই ম্যানিলাই পশ্চিম আফ্রিকায় প্রধান কারেন্সি ছিল। বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে ক্রীতদাস কেনাবেচার ব্যবসার প্রাথমিক সময় মোটামুটি ১৫০০ খ্রিষ্টাব্দের মাঝামাঝি ফেলা যায়। কিন্তু, এই গল্পটির গঠনের সরলতা দেখে অত নতুন বলে মনে হয় না। গল্পে বলা হচ্ছে যে ক্রীতদাসের বিনিময় এক ভূস্বামীর থেকে অন্য ভূস্বামীর কাছেও হচ্ছে। এই বিবৃতির ক্ষেত্রে বলা যায়, যে সম্ভবত আফ্রিকার অন্তর্বতী ক্রীতদাসপ্রথার কথাই এখানে হচ্ছে, যা প্রায় প্রত্যেক উপজাতির মধ্যে প্রি-কলোনিয়াল যুগেও ছিলই। এই উপকথার গঠনসময়, অতএব, মোটামুটিভাবে ১০০০ থেকে ১৫০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ফেলা যেতে পারে, এফিক উপজাতির বসতি স্থাপন থেকে আফ্রিকার উপকূলে প্রথম আন্তর্জাতিক ক্রীতদাসবাজারের শুরু অবধি।

    *****************************************************
  • achintyarup | 103.186.***.*** | ১৮ মার্চ ২০১৪ ১৩:০৩630491
  • বাঃ! তারপর?
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। দ্বিধা না করে প্রতিক্রিয়া দিন