এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  বইপত্তর

  • টোবা টেক সিংঃ সাদত হাসন মন্টোঃ অনুবাদ

    Ranjan Roy লেখকের গ্রাহক হোন
    বইপত্তর | ১৫ অক্টোবর ২০১৩ | ২২৮২ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Ranjan Roy | ১৫ অক্টোবর ২০১৩ ২০:২২621059
  • [আবার ভারত পাকিস্তান সীমান্ত সংঘর্ষের সম্ভাবনা বাড়ছে। দু'পক্ষের শাসকদের লাভ গলায় চেপে বসা মূল্যবৃদ্ধি ও ক্ষমতায় আসীন কিছু লোকের লুঠের ছবির থেকে লোকজনের চোখ অন্যদিকে ফিরিয়ে দেওয়া। ম্যাঙ্গো পাব্লিকের লাভ পকেটে ফুটো ও হাতে হ্যারিকেন।
    এই সময় অত্যন্ত প্রাসংগিক মন্টোর নির্মাণ "টোবা টেক সিং" নামের পাগল চরিত্রটি। অনেকেই পড়েছেন তবু মূল ভাষার মন্টো থেকে সিধে অনুবাদের লোভ সামলাতে পারলাম না।]
  • Ranjan Roy | ১৫ অক্টোবর ২০১৩ ২০:২৪621060
  • টোবা টেক সিং
    দেশভাগের দুতিন বছর পরে পাকিস্তান ও হিন্দুস্তানের শাসকদের মনে হল যে কযেদিদের মত পাগলদেরও অদলবদল হওয়া দরকার।অর্থাৎ, যেসব মুসলমান পাগল হিন্দুস্তানের পাগলাগারদে আছে ওদের পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেওয়া হোক, আর যে সব হিন্দু বা শিখ পাকিস্তানের পাগলাগারদে রয়েছে তাদের হিন্দুস্তানে।
    এই সিদ্ধাল্তটি ঠিক কি ভুল তা জানিনে।তবে বড় বড় মাথা মিলে ঠিক করেছেন, তাই এদিক সেদিক উঁচুতলায় কনফারেন্স হয়ে শেষমেশ একদিন পাগলদের অদলাবদলি করার বিল পাশ হয়ে গেল।
    ভাল করে খুঁজেপেতে নেড়েচেড়ে দেখা হল। যেসব মুসলমান পাগলের আত্মীয়স্বজন হিন্দুস্তানে রয়ে গেল তাদের সেখানেই থাকতে দেওয়া হল আর বাকি সবাইকে সীমান্তরেখার ওপারে পাঠিয়ে দেওয়া হল।পাকিস্তান থেকে অধিকাংশ হিন্দু ও শিখ ইতিমধ্যেই চলে গেছল, তাই কাউকে রেখে দে্ওয়ার প্রশ্নই ছিল না। যে কয়টি হিন্দু বা শিখ পাগল ছিল তাদের সবাইকে পুলিশের জিম্মায় বর্ডার পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া হল।
    ওপারের খবর তো জানিনে কিন্তু এপারে লাহোরের পাগলখানায় ভারি মজার চিল পোঁ শুরু হয়ে গেল।এক বারো বছরের মুসলমান পাগল যে রোজ নিয়ম করে পড়ত তাকে ওর এক বন্ধু জিজ্ঞেস করল: মৌলবী সায়েব, এই পাকিস্তানটা কি বস্তু?
    তখন ও খুব ভেবে চিন্তে বলল: ও হিন্দুস্তানের ভেতরের একটা জায়গার নাম যেখানে ভাল ক্ষুর তৈরি হয়।
    উত্তরটি শুনে বন্ধুটি বেশ নিশ্চিল্ত হয়ে গেল।
    এক শিখ পাগল আর এক শিখ পাগলকে জিজ্ঞেস করল: সর্দারজি, আমাদের হিন্দুস্তানে কেন পাঠাচ্ছে? আমরা তো ওখানকার ভাষা জানিনা!
    সেই পাগল মুচকি হেসে বলল: আমি তো জানি।হিন্দুস্তানী বড় শয়তান; ওরা শয়তানি ভাষায় আগড়ুম বাগড়ুম বলে।
    একদিন চান করতে করতে এক পাগল পাকিস্তান জিল্দাবাদ, পাকিস্তাল জিন্দাবাদ করতে করতে এমন চেঁচাল যে পেছল মেজেতে পা পিছলে পড়ে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেল।
    কিছু ছিল যারা আসলে পাগল নয়, বেশিরভাগই খুনি, আত্মীয়স্বজন অফিসারদের কিছু দিয়ে টিয়ে পাগলাগারদে পাঠিয়েছে যাতে ফাঁসির হাত থেকে বেঁচে যায়।এই পাগলগুলো একটু একটু বুঝতো যে কেন হিন্দুস্তান ভাগ হচ্ছে আর পাকিস্তান বস্তুটাই বা কী।কিন্তু বাস্তবিক পরিস্থিতির ব্যপারে এরাও কিছুই জানত না। খবরের কাগজ থেকে ওরা কিছু টের পেত না আর সেপাইগুলো নিরেট মূর্খ; ওদের কথাবার্তা থেকে কোন বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া অসম্ভব। ওরা খালি এটুকু জানত যে মহম্মদ আলি জিন্না নামে একটা লোক আছে যাকে কায়দে আজমও বলা হয়, সে মুসলমানদের জন্যে একটা আলাদা রাজ্য বানিয়েছে যার নাম পাকিস্তান। কিন্তু দেশটা ঠিক কোথায়, ভূগোলের কোন জায়গায় তা নিয়ে কোন জ্ঞানগম্যি ছিল না।
    তাই যাদের মাথা পুরোপুরি খারাপ হয় নি তারা রইল দ্বিধায়, ওরা কোথায় আছে? হিন্দুস্থানে কি পাকিস্থানে?যদি হিন্দুস্তানে তো পাকিস্তান কোথায়? যদি পাকিস্তানে তো এতদিন এখানে থেকেও ওরা হিন্দুস্তানে ছিল কি করে?
    এক পাগল তো হিন্দুস্তান কি পাকিস্তান, পাকিস্তান কি হিন্দুস্তান করতে করতে আরো পাগল হয়ে গেল। ঝাড়ু লাগাতে লাগাতে ও গিয়ে একটা গাছে চড়ে বসল। আর ডালে পা ঝুলিয়ে বসে হিন্দুস্তান পাকিস্তান নিয়ে ঝাড়া দু ঘন্টা রাজনৈতিক বক্তূতা দিয়ে চলল।রক্ষীর দল ওকে নীচে নামতে বলায় একেবারে মগডালে উঠে গেল।ওকে ভয় দেখানো ধমকানো সব হল, তখন ও বলল: আমি হিন্দুস্তান পাকিস্তান কোত্থাও যাব না, এই গাছের ডালেই থাকব।
    অনেকক্ষণ পরে পাগলামির ঘোর একটু কমলে ও নীচে নেমে ওর হিন্দু ও শিখ বন্ধুদের জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। ওরা যে ওকে একা ফেলে হিন্দুস্তানে চলে যাবে এই ভেবেই ওর বুক ফেটে যাচ্ছিল।
    এক পাগল এম এস সি পাশ রেডিও ইঞ্জিনিয়ার, মুসলমান। ও অন্য পাগলদের থেকে একদম সরে সরে থাকত, বাগানের একপাশে সারাদিন চুপচাপ পায়চারি করে বেড়াত।এই বদলে যাওয়া সমযের ঢেউয়ে হঠাৎ একদিন সমস্ত জামাকাপড় খুলে ফেলে দফাদারের হাতে ধরিয়ে দিয়ে উদোম ন্যাংটো হয়ে পায়চারি করতে লাগল।
    চিঁয়োট থেকে আসা এক পাগল যে নাকি একসময় মুসলিম লীগের নিষ্ঠাবান কর্মী ছিল আর রোজ পনের ষোলবার স্নান করত, হঠাৎ অভ্যসটা একেবারে ছেড়ে দিল।ওর নাম মহম্মদ আলী। একদিন ও ঘোষণা করল যে ওই হল মহম্মদ আলী জিন্না।ব্যস্, অমনি এক শিখ পাগল মাস্টার তারা সিং হয়ে গেল।কোন রক্তারক্তি ঘটার আগেই ওদের বিপজ্জনক পাগল দেগে দিয়ে আলাদা আলাদা সেলে বন্ধ করে দেওয়া হল।
    লাহোর শহরের এক তরুণ হিন্দু উকিল প্রেমে ব্যর্থ হয়ে পাগল হয়ে গেছল।ও যখন শুনতে পেল যে অমূতসর হিন্দুস্তানে গেছে তখন খুব দু:খ পেল। আসলে অমূতসরের এক হিন্দু মেয়েকে ও ভালবেসেছিল আর মেয়েটি ওকে ফিরিয়ে দিয়েছিল।কিন্তু পাগল হয়েও তাকে ভুলতে পারেনি।এবার ও হিন্দুস্তান পাকিস্তানের সবকটা রাজনৈতিক নেতাদের কষে গাল পাড়তে লাগল, ওরা যে ফন্দি করে দেশটাকে দুটুকরো করে দিল! তাই আজ ওর প্রেমিকা হিন্দুস্তানী, আর ও হযে গেল পাকিস্তানী!
    শেষে যখন অদলবদলের কথাবার্তা শুরু হল, তখন অনেক পাগল সেই উকিলকে ধরে বোঝাতে লাগল যে মন খারাপ করতে নেই, ওকে যেখানে ওর প্রেমিকা থাকে সেই হিন্দুস্তানেই পাঠানো হবে।কিন্তু ও তো লাহোর ছেড়ে যেতে চায়না, ভাবে ওর অমূতসরে পশার হবে না।
    ইউরোপিয়ান ওয়ার্ডে জনাদুই অ্যাংলোইন্ডিয়ান পাগল ছিল। ইংরেজ যে হিন্দুস্তান থেকে কেটে পড়েছে তা জেনে ওরা ভারি আঘাত পেল; এখন পাগলাগারদে মানইজ্জত কদ্দূর বজায় থাকবে তা নিয়ে চুপিচুপি ঘন্টার পর ঘন্টা আলোচনায় ব্যস্ত রইল। অর্থাৎ, ইউরোপিয়ান ওয়ার্ড থাকবে না উড়িয়ে দেওয়া হবে, ব্রেকফাস্ট জুটবে কি না, শেষে কি বাধ্য হয়ে পাঁউরুটির বদলে ব্লাডি ইন্ডিয়ান চাপাটি খেতে হবে?

    একজন শিখ পাগল, এই পাগলাগারদে ওর প্রায় পনের বছর হতে চলেছে। আজকাল ওর মুখে এক বিচিত্র বাক্য শোনা যাচ্ছে: ঔপড় দি গড়গড় দি অনেক্স দি বেধ্যানাঁ দি মুংগ দি দাল অফ দি লালটেন ঃ। ও ব্যাটাকে রাত্রেদিনে কখনোই ঘুমুতে দেখা যেত না।পাহারাদারদের কথা শুনলে মানতে হয় যে গত পনের বছরে একবারও চোখের পাতা এক করেনি। ও শুত না, মাঝেমধ্যে কোন দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত। এভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওর পা ফুলে গেছল, কিন্তু শরীরের কষ্ট সত্ত্বেও একটু গড়িয়ে নিত না।
    যখনই পাগলখানায় হিন্দুস্তান পাকিস্তান, পাগলদের অদলবদল নিয়ে কোন কথাবার্তা হত, ও খুব মন দিয়ে শুনত; কেউ যদি জিজ্ঞেস করত ও কি ভাবছে তাহলে খুব শান্ত ভাবে বলত: ঔপড় দি গড়গড় দি অনেক্স দি বেধ্যানাঁ দি মুংগ দি দাল অফ দি পাকিস্তান গবর্নমেন্ট!
    কিন্তু কিছুদিন পরে অফ দি পাকিস্তান গবর্নমেন্ট হয়ে গেল অফ দি টোবা টেক সিং গবর্নমেন্ট! এবার অন্য পাগলের দলের কাছে ও জানতে চাইতো যে টোবা টেক সিং জায়গাটা এখন কোথায়,মানে যেখানকার ও বাসিন্দে । কেউ জানে না টোবা টেক সিং কোথায় গেছে, হিন্দুস্তানে কি পাকিস্তানে? এই নিয়ে বলতে গেলে লোকে খেই হারিয়ে ফেলত: সিয়ালকোট তো আগে হিন্দুস্তানে ছিল, কিন্তু এখন নাকি পাকিস্তানে? কি জানি আজ যে লাহোর পাকিস্তানে আছে কাল যদি হিন্দুস্তানে চলে যায়,অথবা গোটা হিন্দুস্তানই পাকিস্তান হয়ে যায়! আর হিন্দুস্তান পাকিস্তান দুটোই যে কাল দুনিয়া থেকে উপে যাবে না তাই বা কে দিব্যি গেলে বলতে পারে!
    এই শিখ পাগলের চুলটুল পড়ে গিয়ে সামান্য একটু বেঁচে ছিল।চানটান কমই করত, তাই চুলে দাড়িতে জট পাকিয়ে এক বীভৎ্স চেহারা! কিন্তু মানুষটা বড় শান্ত স্বভাবের, পনের বছরে একদিনও কারো সঙ্গে ঝগড়া টগড়া করে নি। পুরনো কয়েদিদের থেকে জানা গেছে যে পাকিস্তানের টোবা টেক সিং নামের ছোট শহরে ওর অনেক জায়গাজমি ছিল; বেশ বিত্তশালী জমিদার। হঠাৎ একদিন মাথাটা গেল খারাপ হয়ে, আর আত্মীয়স্বজন ওকে মোটা মোটা শেকলে বেঁধে এই পাগলাগারদে ছেড়ে দিয়ে গেল।
    ওরা মাসে একবার দেখা করতে আসতো, খোঁজখবর নিয়ে ফিরে যেত। এভাবেই চলছিল, কিন্তু এই হিন্দুস্তান পাকিস্তান বখেড়া শুরু হতেই আসাযাওয়া বন্ধ হয়ে গেল।
    ওর নাম বিশন সিং, কিন্তু লোকের মুখে হয়ে গেল টোবা টেক সিং। ও জানত না এটা কোন বার, কী দিন, কোন মাস; অথচ আত্মীয়স্বজনের দেখাসাক্ষাতের দিন কাছে এলেই টের পেত। তখন ও প্রহরীদের বলত ওর ভিজিটর আসছে।সেদিন ও সাবান ডলে ডলে ভাল করে স্নান করত, চুলে তেল লাগিয়ে চিরুনি চালাত, তুলে রাখা জামাকাপড় বের করে পরে সেজেগুজে বাড়ির লোকজনের সঙ্গে দেখা করতে যেত।ওরা কিছু জিজ্ঞেস করলে হয় চুপ করে থাকত, নয় কখনো কখনো বলত: ঔপড় দি গড়গড় দি অনেক্স দি বেধ্যানাঁ দি মুংগ দি দাল অফ দি লালটেন!
    ওর একটা মেয়ে ছিল যে প্রত্যেক বছর এক আঙুল করে বাড়তে বাড়তে পনের বছরে জোয়ান হয়ে উঠেছে।বিশন সিং ওকে চিনতই না। মেয়ে যখন বাচ্চা ছিল, বাপকে দেখে কাঁদত, এখন জোয়ান হয়েও কাঁদে।
    হিন্দুস্তান পাকিস্তানের গল্পটা শুরু হতেই ও অন্য পাগলদের কাছে জানতে চাইত যে টোবা টেক সিং কোথায় গেছে; কিন্তু স্পষ্ট জবাব না পেয়ে ওর কষ্ট দিন প্রতিদিন বাড়তে লাগল।আজকাল কেউ দেখা করতেও আসে না যে! আগে তো আত্মীয়দের আসার খবর ও আপনাআপনি টের পেত, ইদানীং বোধহয় ওর আত্মার স্পন্দনও বন্ধ হয়ে গেছে।ওর বড় ইচ্ছে যে ওরা আসুক, আগে যেমন আসত জামাকাপড়, ফল, মিষ্টি নিয়ে আর কেমন খোঁজখবর নিত! ওরা এলে ও ঠিক জেনে নেবে টোবা টেক সিংহ কার ভাগে পড়েছে, হিন্দুস্তান না পাকিস্তান? সঠিক খবর ওদের কাছ থেকেই পাওয়া যাবে, ওরা যে আসে ওই টোবা টেক সিং থেকে, যেখানে ওর জমিজমা রয়েছে।
    পাগলাগারদে আরেকজন ছিল যে নিজেকে খোদা বলত। একদিন ওর কাছে বিশন সিং জানতে চাইল যে টোবা টেক সিং কোথায়? হিন্দুস্তান না পাকিস্তান? ৱ্যস, পাগল ওর স্বভাবসিদ্ধ অট্টহাসি হেসে বলল : না হিন্দুস্তান, না পাকিস্তান; কোথাও না। কারণ, আমি এখনও আদেশ দিইনি।
    বিশন সিং কতবার কাকুতিমিনতি করল যাতে ও হুকুমজারি করতে দেরি না করে আর ঝামেলা মিটে যায়। কিন্তু খোদার শুনতে বয়েই গেছে। ওর যে আরো অনেক আদেশ জারি করা বাকি!
    একদিন তিতিবিরক্ত হয়ে বিশন সিং খোদার উপর চড়াও করল: ঔপড় দি গড়গড় দি অনেক্স দি বেধ্যানাঁ দি মুংগ দি দাল অফ বাহে গুরুজী দা খালসা অ্যান্ড বাহে গুরুজী দি ফতে!
    এর মানে বোধহয় : তুমি তো মুসলমানের ভগবান, শিখদের নও, নইলে আমার কথা নিশ্চয়ই শুনতে।
    অদলবদলের কদিন আগে টোবা টেক সিং গাঁ থেকে বিশন সিং এর এক মুসলমান বন্ধু ওর সাথে দেখা করতে এল, এ আগে কখনও আসে নি। বিশন সিং ওকে দেখে আর এক দিকে সরে গেল, তারপর ফিরে যাচ্ছিল কিন্তু সেপাইয়ের দল ওকে আটকাল; বলল : আরে ও তোমার সংগে দেখা করতে এসেছে, তোমার দোস্ত ফজলদিন।
    বিশন সিং ফজলদিনের দিকে তাকিয়ে দেখে কিছু একটা বিড়বিড় করতে লাগল।
    ফজলদিন এগিয়ে এসে ওর কাঁধে হাত রেখে বলল: কবে থেকে ভাবছি তোমায় দেখতে আসব কিন্তু সময় করে উঠতে পারিনি।তোমার ঘরের সবাই নিরাপদে হিন্দুস্তানে পৌঁছে গেছে। আমি যা পেরেছি, করেছি। তোমার মেয়ে রূপকৌর ঃঃ, বলতে বলতে ও থেমে গেল।
    বিশন সিংয়ের যেন কিছু মনে পড়ল: মেয়েটা? রূপকৌর?
    ফজলদিন একটু থেমে থেমে বলল: হ্যাঁঃঃঃঃ, ও ঃঃ ও ভালই আছে। সবার সাথে ওপারে চলে গেছে।
    বিশন সিং চুপ।
    ফজলদীন ফের বলতে শুরু করল।
    ঃ ওই আমায় বলেছিল আমি যেন তোমার খোঁজখবর নিই। এখন জানতে পারলাম তুমি নাকি হিন্দুস্তানে চলে যাবে! ঃঃ ভাই বলবীর সিং ও ভাই বধাওয়া সিং কে আমার নমস্কার, আর হ্যাঁ, বোন অমূতকৌরকেও। ভাই বলবীর কে বোল যে ফজলদীন রাজি আছে।দুটো পাটকিলে মোষ ও ছেড়ে গেছল, ওদের একটা এঁড়ে বাছুর বিইয়েছে, অন্যটা বকনা। কিন্তু ওটা ছদিনের মাথায় মারা গেল। আর আমাকে দিয়ে যা কাজ হবে, বোল, আমি সবসময় তৈরি। আর এই দেখ, তোমার জন্যে কী এনেছি!
    বিশন সিং উপহারের পুঁটলিটা পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সেপাইয়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে ফজলদীন কে জিজ্ঞেস করল: টোবা টেক সিং কোথায় গেছে?
    ফজলদীন হতভ্ম্ব: কোথায় গেছে মানে? আগে যেখানে ছিল, সেখানেই আছে।
    বিশন সিং কড়া স্বরে বলল: পাকিস্তানে? না হিন্দুস্তানে?
    : হিন্দুস্তানে, না না পাকিস্তানে! ফজলদীনের মাথাখারাপ হওয়ার জোগাড়।
    বিশন সিং বিড়বিড় করতে করতে চলে গেল:ঔপড় দি গড়গড় দি অনেক্স দি বেধ্যানাঁ দি মুংগ দি দাল অফ দি পাকিস্তান অ্যান্ড হিন্দুস্তান অফ দি দুর ফিটে মুঁহ্।
    পাগলদের দেশান্তরী করার আয়োজন সম্পূর্ণ হল। এপার থেকে ওপার আর ওপার থেকে এপার যারা হবে সেসব পাগলদের লিস্টি তৈরি হয়ে দুটো দেশে পৌঁছে গেল আর অদলবদলের দিনটিও পাকাপাকি হল।
    সেদিন বড্ড ঠান্ডা পড়েছিল। লাহোরের পাগলাগারদ থেকে হিন্দু ও শিখ পাগলে ঠাসা একগাদা লরি পুলিসের কড়া পাহারায় হিন্দুস্তানের দিকে রওনা হল, বেশ কিছু ভারপ্রাপ্ত অফিসারও সঙ্গে চললেন।বাঘা সীমান্তে এসে দুই তরফের সুপারিন্টেন্ডেট মুখোমুখি বসে নিয়মকানুন মেনে যা যা কাগজপত্তর সইসাবুদ দরকার সব করে ফেললেন।এবার শুরু হল অদলবদল আর চলল সারা রাত ধরে।
    পাগলদের লরি থেকে নামিয়ে আনা আর ওদের অন্য দেশের অফিসারের দায়িত্বে ছেড়ে দেওয়া বেশ কঠিন কাজ। একে তো ওরা নামতে চাইছে না, আর যদিবা রাজি হচ্ছে তো ওদের সামলানো মুশকিল হয়ে যাচ্ছে।কেউ এদিক ওদিক দৌড়ে পালাচ্ছে; ন্যাংটোদের কাপড় পরালে সঙ্গে সঙ্গে ছিঁড়ে ফেলে দিচ্ছে।কেউ সমানে গাল পাড়ছে, কেউ গান গাইছে, কাঁদছে, ঝগড়া করছে।বিলাপের স্বর এত চেঁচামেচির মধ্যে কারও কানে যাচ্ছে না। পাগলীদের চ্যাঁ ভ্যাঁ আবার আলাদা; আর এমন কড়া শীত যে ঠকঠকিয়ে দাঁতে দাঁত লেগে যাচ্ছে।
    অধিকাংশ পাগল এই অদলাবদলি পছম্দ করছিল না।ওরা বুঝতেই পারেনি কেন ওদের জবরদস্তি লরিভরে তুলে এনে এক অজানা মুলুকে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। হাতে গোণা যে কয়জন বুঝতে পেরেছে তারা হয় পাকিস্তান জিন্দাবাদ নয় পাকিস্তান মুর্দাবাদ করতে ব্যস্ত । কয়বার তো দাংগাফ্যাসাদ হতে হতে বেঁচে গেল, কারণ গড়পড়তা মুসলমান ও শিখ ওসব স্লোগান শুনলেই উত্তেজিত হয়ে পড়ছিল।
    যখন বিশন সিংয়ের পালা এল আর বাঘা সীমানার ওপারের ভারপ্রাপ্ত অফিসার ওর নামধাম রেজিস্টারে লিখতে লাগল তখন ও জিজ্ঞেস করল: টোবা টেক সিং কোথায়? হিন্দুস্তানে না পাকিস্তানে?
    অফিসারটি মুচকি হেসে বললেন: পাকিস্তানে।
    শোনামাত্র বিশেন সিং দৌড়ে ওর পুরনো সাথীদের কাছে ফিরে গেল। পাকিস্তানী সেপাইয়ের দল ওকে চেপে ধরে উল্টোদিকে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে লাগল কিন্তু ও কিছুতেই রাজি হল না। বলে উঠল : টোবা টেক সিং এখানে!
    তারপর জোরে জোরে চেঁচাতে লাগল:ঔপড় দি গড়গড় দি অনেক্স দি বেধ্যানাঁ দি মুংগ দি দাল অফ দি টোবা টেক সিং অ্যান্ড পাকিস্তান!
    ওকে অনেক বোঝানো হল: দেখ, টোবা টেক সিং এখন পাকিস্তানে চলে গেছে, আর যদি এখনো না গিয়ে থাকে তো শিগগিরই পাঠিয়ে দেওয়া হবে।
    কিন্তু ভবি ভুলবার নয়।
    শেষে ওকে জোর করে ওদিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হলে ও এক জায়গায় নিজের ফুলে ওঠা পায়ের উপর জোর দিয়ে এমন ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে পড়ল যেন দুনিয়ার কোন শক্তির সাধ্য নেই ওকে নড়ায়।
    যেহেতু মানুষটা বড় শান্ত নিরীহ প্রকূতির ছিল তাই ওকে আর তেমন জোর করা হল না। ওকে ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকতে দিয়ে অদলাবদলির বাকি কাজকম্ম চলতে লাগল।
    সূর্য ওঠার ঠিক আগে শান্ত নিরীহ বিশন সিংয়ের কণ্ঠভেদ করে বেরিয়ে এল এক গগনবিদারী আর্তনাদ।দুপাশ থেকে দৌড়ে এলেন জনাকয় অফিসার আর দেখলেন যে পনের বছর ধরে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা মুখ থুবড়ে পড়ে আছে।
    কাঁটাতারের বেড়ার এপাশে হিন্দুস্তান আর ওপাশে পাকিস্তান; মাঝখানে নামগোত্রহীন একটুকরো জমির উপরে শুয়ে আছে টোবা টেক সিং।
    ঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃ
  • ঐশিক | 213.2.***.*** | ১৬ অক্টোবর ২০১৩ ১৭:৫৭621061
  • রঞ্জনদা খুব ভালো লাগলো,
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। বুদ্ধি করে প্রতিক্রিয়া দিন