এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • নৃপেন্দ্র এন সরকারের লেখাজোঁকা

    Kulada Roy
    অন্যান্য | ২৫ নভেম্বর ২০১১ | ১৩১১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Kulada Roy | 74.72.***.*** | ২৫ নভেম্বর ২০১১ ২৩:০১500278
  • ইয়ানুসের বড়ভাই
    নৃপেন্দ্র সরকার
    ----------

    চক্রবত পরিবর্তন্তে
    সুখানিচ দুখানিচ:।অ।

    আমরা তৃতীয় শ্রেণী থেকে চতুর্থ শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হলাম। ইয়ানুস আমাদের ছেড়ে দুরের বড় শাহী স্কুলে চলে গেল। হাই স্কুলের সাথে প্রাইমারী স্কুল। প্রচুর নাম ডাক ওয়ালা স্কুল। তাছাড়া পঞ্চম শ্রেণী পাশ করে ঐ স্কুলেই তো যেতে হবে। আগে গেলে ক্যারিয়ারের জন্য ভাল হবে। আমার বাবার বিলাসিতা ছিল না। তাই আমরা পড়ে থাকলাম ভাঙ্গা স্কুলে। বসার বেঞ্চ আছে। কিন্তু কোন কোনটার পায়া নেই। ইটের পর ইট বিছিয়ে প্রতিদিন পায়া বানাই। স্কুলে শেষে ভেংগে ফেলতে ভারী মজা হয়। একদিকের প্লিন্থ নেই। দরজা না দিয়ে ওখান দিয়ে যাওয়া-আসার দারূণ মজা।

    পূজোর সময় বছরে আমরা একটা জামা পেতাম। ইয়ানুসের থাকত নিত্য-নতুন জামাকাপড়। ইস্ত্রীকরা জামা কাগজের মত খস্খস করত। ঘাড়ে পাউডার মাখত। আঁতর-গন্ধ মাখত। সাদা একটা রুমাল কলারের ভিতর গুজে দেওয়া থাকত। ইয়ানুসের কত স্বপ্ন, গল্প। সবই রেটেড-আর। ওগুলো বুঝার বয়স তখন আমাদের ছিলনা। তাই সব মনে নেই। কিন্তু মনে আছে, আমরা হাফ প্যান্ট পড়তাম। ইয়ানুস পড়ত লুঙ্গি। সেই লুঙ্গিটি কখনও আকাশে উড়াল দিত। আমরা দেখতাম ইয়ানুসের বয়স বিশ কি বাইশ বা আরও বেশী।

    ইয়ানুসের বাবাও নামকরা লোক ছিলেন – মোকদম ফকীর। সৌম্যকান্তি সুদর্শণ পুরুষ। স্যার সৈয়দ আমম্মদ খানের মত সারা বুক ভর্তি বিস্তৃত সাদা দাঁড়ি। প্রচুর তন্ত্র-মন্ত্র আর তাবিজ কবজ জানতেন। জমি নিয়ে মারামারির ওস্তাদ ছিলেন। ইয়ানুস বলত – বাজান যখন একা লাঠি ঘুরাতে থাকে, নিতাই কায়াদের চোখে ভাসে একশ জন লাঠিয়াল। আমার বাজানের মন্ত্র পড়া কাঁচা টাকা গোল পোস্টের নীচে মাটিতে পুতে রাখলে সেদিকে কখনও গোল হয়না। স্কুলের শিক্ষকরা ছিল দরিদ্র। মাস শেষে দুটাকা কি তিন টাকা বেতন। ধনুকের মত বক্রদেহী গজেন্দ্র চক্রবর্তীর মাথা এবং হাত কাঁপত। ইয়ানুস একদিন আট আনা দামের একখানা ফাউনটেন পেন তাঁকে উপহার দিয়ে বসল। গজেন্দ্র চক্রবর্তীর চোখ ছলছল হয়ে উঠল। আমরাও অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকলাম – বিত্তশালী বিখ্যাত বাবার উজ্জল ছেলের উপর আমাদের শ্রদ্ধা এবং সন্মানবোধ দিন দিন বেড়েই চলল।

    সেই ইয়ানুস একদিন আমাদের ছেড়ে চলে গেল। ইয়ানুসের তখনই দাঁড়ি গজিয়ে গেছে। দুতিন-দিন পর পর না কাটলে চলত না। থুতুনির দিকটা খুবই ঘন কালো। হাই স্কুলের চতুর্থ শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে ইয়ানুস সারা স্কুলে তাড়াতাড়ি পরিচিত হয়ে গেল। খবর রটে গেল, চতুর্থ শ্রেনীতে নতুন এক ছাত্র এসেছে, তার মুখে দাঁড়ি। নবম-দশম শ্রেনীর ছাত্ররা দলে দলে আসতে শুরু করল।

    আমরা ষষ্ঠ শ্রেনীতে একই হাই স্কুলে ভর্তি হলাম। আমি এ-সেকসন, ইয়ানুস বি-সেকসন। দাঁড়ির কারণে ইয়ানুস যে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল, তা বেশীদিন স্থায়ী হল না। হাই স্কুলে এসে ইয়ানুসকে কোনদিন দেখেছি বলে মনে পড়ে না। এস এস সি পাশ জুটেছে বলেও মনে পড়ে না।

    আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। হাটের ভেতর দিয়ে বাড়ি ফিরছি। দুপাশে মাটিতে বিছানো দোকান-পাট। তার একটি ইয়ানুসের। চারটি ফুট খানেক খুঁটির উপর একটি তক্তামত। তার উপর বিড়ি-সিগারেট। গায়ে সাদা জামা। তিলা পড়ে ঘোলা হয়ে গেছে। ঘষা খেয়ে খেয়ে ছিদ্র হয়ে গেছে। দুপাশের কাঁধ বেরিয়ে এসেছে। গাল ভেংগে গেছে। চোখ কুঠরাগত। ভাল খেতে পায়না বুঝাই যায়। আমার দিকে তাকাল। মুখে দুর্বল হাসি। ইয়ানুসের ইস্ত্রি করা জামাকাপড়ের কথা মনে পড়ল। ওর কাছ থেকেই জেনেছি – সমাজে ধোবা নামে এক শ্রেণীর লোক আছে যারা পয়সার বিনিময়ে অন্যের কাপড় ধুয়ে সংসার চালায়। হাটের দিন জামাগুলো বগল-তলা করে নিয়ে আসত, যেন ভাঁজ করা কাগজ।

    ১৯৮৯ সালের জানুয়ারী মাসে আমেরিকা চলে আসি। আসার চার দিন পর আমার বাবা ইন্তেকাল করেন। মাস খানেক মৃত্যু সজ্জায় ছিলেন। এবেলা মরেন ওবেলা বাঁচেন। শেষ দেখা দেখতে ময়মনসিংহ থেকে বাড়ি যাই। তখন সন্ধ্যা হয় হয়। নদী পার হয়ে রিক্সায় পাঁচ-ছয় মিনিটের রাস্তা। ভাড়া দশটাকা। দামাদামি নেই।

    এক রিক্সাওয়ালাকে বললাম – বৈন্যা যাবে?
    রিক্সাওয়ালাটি বলল – উঠেন।

    দশ টাকার নোট ছিল না। নেমে বিশ টাকার একটি নোট দিয়ে অপেক্ষা করছি। রিক্সাওয়ালাটি টাকাটি পকেটে ঢুকিয়ে রেখে দিল। একি ব্যাপার! ভাঙ্গা নেই। অনেক রিক্সাওয়ালা মিষ্টি হেসে আবদার করে। তা পর্য্যন্ত নেই। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি।

    তখন রিক্সাওয়ালাটি বলল – আপনে আমারে চিনবার পারেন নাই। আমি ইয়ানুসের বড় ভাই।
  • rupankar sarkar | 116.202.***.*** | ২৫ নভেম্বর ২০১১ ২৩:২০500279
  • কুলদাবাবু, গল্পটি খুব ভাল লাগল। পোস্ট করার জন্য ধন্যবাদ। নৃপেন্দ্রবাবুর পরিচয়টা আগে পাইনি।
  • Kulada Roy | 74.72.***.*** | ২৫ নভেম্বর ২০১১ ২৩:৩৯500280
  • প্রফেসর নৃপেন্দ্র সরকার বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহে আমার সরাসরি শিক্ষক ছিলেন। তিনি খুব ভালো লেখেন।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। হাত মক্সো করতে মতামত দিন