ট্রেনিং ও পরীক্ষা চমৎকারভাবে মিটে গেছে। আমি সন্ধেবেলা উপস্থিত হলাম জুরিখ এয়ারপোর্টে। শুক্রবারের সন্ধে। আমায় রিসিভ করতে এসেছে আমার প্রিয় মানুষটা। শনি রবি আমরা চিন্তা করেছি, আলোচনা করেছি কীভাবে মেয়েকে যত শীঘ্র সম্ভব এখানে নিয়ে আসব। সোমবারে কি দুজনেই ছুটি নিয়ে নেব? ঐ দিন চলে যাব ইমিগ্রেশন অফিসে দুজনে। ইনভিটেশনের কাগজ তো রয়েছে সঙ্গে। ওখানে জিজ্ঞাসা করে জেনে নেব, স্বামী নয়, শুধু মেয়েকে আনা যাবে কি না, ঐ কাগজের জোরে।
সোমবারে দুজনেই যাই ইমিগ্রেশন অফিসে। এক্কেবারে সকাল সকাল। সমস্ত প্রশ্ন একে একে করি ঐ কাগজ দেখিয়ে।
কিন্তু যা জানা যায়, তা মন খারাপ করে দেওয়া উত্তর। ঐ কাগজ ছমাসের বেশি আগে দেওয়া হয়েছিল, ওটা তামাদি হয়ে গেছে। দ্বিতীয়ত ফ্যামিলি রিইউনিয়ন বলতে বোঝায় গোটা পরিবারটাকেই নিয়ে আসার ব্যাপার, বেছে বেছে একজন দুজনকে নয়।
তাহলে উপায়? আমরা মরিয়া হয়ে আবারও প্রশ্ন করি, কোনও উপায়ই কি নেই?
—আছে। উপায় আছে। ডিভোর্স।
— সে তো অন্ক সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। আমার স্বামী যদি ডিভোর্স দিতে না চান, তখন তো মামলা চলতেই থাকবে।
এই প্রশ্নের উত্তর জানলার ওপারের ভদ্রমহিলাটির কাছে নেই। তাছাড়া উনি বুঝতেই পারছেন না, ডিভোর্স দিতে আপত্তি ব্যাপারটার কী তাৎপর্য। একজন যদি ডিভোর্স চায়, সেটাই যথেষ্ট। কারওকে জের করে বিবাহ বন্ধনে বেঁধে রাখা যায় নাকি?
আমি তো জানি, ভারতবর্ষে যায়। বছরের পর বছর সেদেশে ডিভোর্সের মামলা চলে, মানুষ মরে যায় ডিভোর্সের জন্য অপেক্ষা করতে করতে। তারপরে এত দূর দেশ থেকে মামলার শুনানির জন্য বারবার করে আমি কোলকাতা যেতেও পারব না। খরচ তো আছেই, আর আছে ছুটি পাবার ব্যাপার। সে লোক তো আমায় নাজেহাল করবার জন্য ক্রমাগত নানান ফিকির করবে।
ডিভোর্স পাবার পরেও সন্তানের কাস্টডি পাওয়া নিয়েও সমস্যা থাকবে। লিগ্যাল গার্জেন ও ন্যাচারাল গার্জেনের টানাপোড়েনে সারাটা জীবন আদালতের চক্কর কেটে মরব নাকি?
— আচ্ছা শুনুন, ডিভোর্স না করে অন্য কোনও উপায় কি আছে?
— আপনি চিঠি লিখতে পারেন। বুঝিয়ে লিখবেন আপনার সমস্যার কথা। যদি নাকচ না হয়, তবে আপনার বাচ্চাকে নিতে আসবেন স্বামী ছাড়াই। তবে, এতে কোনও গ্যারান্টি নেই। একবার নাকচ হয়ে গেলে পরে সে নিয়ে আবেদন করলেও সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হবার সম্ভাবনা কম।
আমরা দুজনেই এসব শুনে বেশ দমে গেছলাম।
তবে চেষ্টা তো করতেই হবে। এখন যেটা আমার দরকার, তা হচ্ছে একজন ভালো উকিল। চিঠিই বানাবো, তবে নিজে নয়, উকিলের সাহায়্যে।
কথা হচ্ছে যে ভালো উকিলের সন্ধান কে দিতে পারবে আমাদের?
মনে পড়েছে, মিস্টার বোসের মেয়েই তো উকিল। ওর ছোট মেয়ে। রিকোয়েস্ট করলে কি সে আমায় সাহায্য করবে না?
মিস্টার বোসকে ফোন করে জানালাম ব্যাপারটা। উনি শুনেই আমাকে বকাবকি শুরু করলেন — আমি গোড়া থেকেই তোমাকে বলেছিলাম, বিয়েটা না করে এদেশে এলে তোমার এসব সমস্যা হতো না!
দুমিনিট বকুনি শুনে গেলাম চুপচাপ। তারপর জানা গেল ওঁর মেয়ে কোম্পানী আইনের উকিল, ফ্যামিলি বা ইমিগ্রেশন আইনের কাজ সে করে না। তবে চিন্তা নেই, তার বন্ধুবান্ধবরা আছে ওকালতির নানান শাখায়। ভালো একজন ইমিগ্রেশন উকিলের সন্ধান সে নিশ্চয় দিতে পারবে। ছোট মেয়ের ফোন নম্বর দিলেন, সরাসরি কথা বলতে বললেন।
ছোট মেয়ে চমৎকার বাংলা বোঝে, বলতেও পারে অল্প।
সে আমার চেয়ে বছর দুয়েকের ছোট। তার চেনা বান্ধবী আছে, সে বলে রাখবে। তবে সাবধান করে দিল কয়েকটা ব্যাপারে। প্রথমতঃ উকিলের সঙ্গে অল্প কথায় গুছিয়ে সমস্যা জানাতে, নইলে খরচের মিটার হু হু করে চড়বে। আলোচনা শুরুর আগেই তার ফি কত সেটা নিতে। দ্বিতীয়ত, এদেশে যদি মেয়েকে নিয়েও আসি, মেয়ের অসুখে বিসুখে আমি তো মা হিসেবে কোনও ছুটি পাব না। তদুপরি এদেশে মেয়েদের আলাদা ইস্কুল নেই, কোএডুকেশন স্কুল সবকটাই। সেখানে ছেলে মেয়ে সকলেই একত্রে সাঁতারের ক্লাসে যায়, সাঁতারের পোশাক পরতে হবে কিন্তু মেয়েকে।
তাকে অনেক ধন্যবাদ দিলাম। বললাম ইস্কুলের ব্যাপারে আমার বা মেয়ের উভয়েরই সমস্যা নেই। উকিলের কাছ থেকে একটা চিঠি চাই শুধু, খরচটা কোনও ফ্যাক্টরই নয়।
আমি ফুলস্কেপ কাগজে ইংরিজিতে লিখতে শুরু করলাম চিঠি। লম্বা ছিল চিঠিটা। প্রতিটি পয়েনিট ছিলো সময়ানুক্রমিক এমং যুক্তিযুক্ত। মূল বক্তব্যের সারাংশ বাংলা করলে দাঁড়ায়, এইরকম।
আমার পনেরো মাস যাবদ বিয়ে হয়েছে। আমার স্বামী সাতমাস আগে আমার মেয়্কে দত্তক নিয়েছেন। দুজনেই ভারতে একই বাসস্থানে থাকে, তবে তাদের মধ্যে বনিবনা হচ্ছে না এবং আমারও বৈবাহিক সম্পর্ক ভাঙনের দিকে। এই অবস্থায় অবিলম্বে আমার মেয়েকে আমার কাছে নিয়ে আসতে চাই। সে নিজেকে বিপন্ন বোধ করছে। আমার কাছে থাকলে সে যত্নে ও শান্তিতে থাকবে।
লম্বা চিঠিটা ইমেলে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম মিস বোসের চেনা উকিলকে। ইংরিজিতেই।
দিন তিনেক পরে পুরো চিঠিটা ডাকে এল। সঙ্গে শতিনেক ফাংকের বিল।
উনি আমার চিঠির সমস্ত বক্তব্য অপরিবর্তিত রেখে পুরো চিঠিটা জার্মানে অনুবাদ করেছেন এবং প্রত্যেকটা পয়েন্টের সঙ্গে সুইস আইনেরধারার কত নম্বর আর্টিকল. সেগুলো জুড়ে দিয়েছ্ন।
সেই চিঠি নিয়ে ইমিগ্রেশন অফিসে গিয়ে দরখাস্ত জমা দিয়ে এসে অপেক্ষায় দিন কাটে।