গণশক্তি র মূল প্রবন্ধ ৩০ অক্টোবর অর্চি নিয়োগীর লেখা
‘নো দুরানি, নো টেস্ট!’
ব্র্যাবোর্ন স্টেডিয়ামের বাইরে প্ল্যাকার্ডে লেখা। সময়টা ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৩। দুরানি মানে, সেলিম দুরানি। লেফট আর্ম অর্থোডক্স। লেফট হ্যান্ডেড মিডল অর্ডার ব্যাটার।
১৯৬২-র ক্যারিবিয়ান সফরে ওয়েসলি হল, চেষ্টার ওয়াটসন, চার্লি স্টেয়ারের আগুনে পেসের সামনে প্রথম তিন টেস্ট ধরাশায়ী ভারতের ব্যাটিং লাইন আপ। চতুর্থ টেস্টের আগে বার্বাডোসে চার্লস গ্রিফিথের বাউন্সারে রক্তাক্ত হয়ে ক্রিকেট ক্যারিয়ার শেষ ভারতের অধিনায়ক নরি কনট্রাক্টরের। ত্রিনিদাদে বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ অধিনায়ক হিসেবে টস করতে মাঠে নামলেন পতৌদি। আগের টেস্ট পর্যন্ত ব্যাটিং লাইন আপে দশে ব্যাট করা দুরানি অধিনায়ক কে অনুরোধ করে দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে এলেন ফার্স্ট ডাউনে! শুধু এলেনই না, রূপকথা লিখলেন কুইন্স পার্ক ওভালের সবুজ গালিচায়! আউট হলেন যখন, তখন ভারত ২২১। সেলিম দুরানি ১০৪!
১৯৭১-এ পোর্ট অফ স্পেনে দ্বিতীয় ইনিংসে আর্ম বলে প্যাভিলিয়নে ফিরিয়ে দিলেন উইকেটে থিতু হয়ে যাওয়া ক্লাইভ লয়েড কে। পরের বল ব্যাট-প্যাডের মাঝে ছিটকে দিল গ্যারি সোবার্সের মিডল স্ট্যাম্প। ওয়েস্ট ইন্ডিজে ভারতের প্রথম টেস্ট সিরিজ জয়ের চিত্রনাট্য সাজালেন দুরানি। জয়সূচক রান এলো সেই সিরিজে অভিষেক হওয়া সুনীল গাভাস্কারের ব্যাটে। ১৯৭৩-এ এমএমসি একাদশের বিরুদ্ধে কানপুর টেস্টে বাদ পড়েন এই দুরানি। বোম্বে টেস্টের আগে ব্র্যাবোর্ন স্টেডিয়ামের বাইরে প্ল্যাকার্ড লেখা, ‘নো দুরানি, নো টেস্ট!’ নির্বাচকরা বাধ্য হয়ে টিমে নিলেন দুরানি কে!
ক্রিকেট ইতিহাস সেলিম দুরানি মনে রেখেছে, আনপ্রেডিক্ট্যাবেল জিনিয়াস হিসেবে। ক্যারিশামাটিক, খামখেয়ালি, ড্যাশিং ম্যাচ উইনার হিসেবে। দুরানির জন্ম কাবুলে। বাবা আজিজ দুরানি ১৯৩৭-এ ভারতে আসেন। দুটো আনঅফিসিয়াল টেস্ট ম্যাচে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেন এবং দেশভাগের পর পাকিস্তানে চলে যান। সেলিম দুরানি ও তার মা থেকে যান রাজস্থানেই।
আচ্ছা আজকের দিনে, ভারতের কোন ক্রিকেটারের যার জন্ম কাবুলে, যিনি ধর্ম বিশ্বাসে মুসলমান, যারা বাবা পাকিস্তানে থাকেন তার জন্য এমন নিখাদ ক্রিকেটীয় আবেগ দেখালে আপনাকে ‘দেশদ্রোহী’ দাগিয়ে দেওয়া হবে না তার গ্যারেন্টি দিতে পারেন? সেই ক্রিকেটারের একদিনের খারাপ পারফরম্যান্সে মহঃ শামির মত অনলাইন গালাগালির মধ্যে পড়তে হবে না তার গ্যারেন্টি দিতে পারেন? এই যে গ্যারেন্টি দিতে পারছেন না, এটাই পার্থক্য, ঐ ভারতের আর এই ভারতে! ঐ ভারতে সেলিম দুরানির একমাত্র পরিচয় তিনি জাতীয় দলের ক্রিকেটার! ২০১৪-র পর এই ভারতে মহঃ শামিদের পরিচয় তিনি মুসলমান! তারপর জাতীয় দলের ক্রিকেটার।
সিম্পলি, এটাই পার্থক্য, ঐ ভারতের আর এই ভারতে!
এমনিতে দেখতে ভালো লাগে, শুনতে ভালো লাগে, বলতেও ভালো লাগে যে শচিন তেন্ডুলকার সহ ভারতীয় ক্রিকেট জগতের কিছু তারকা মহঃ শামির পাশে দাঁড়িয়েছে। বিসিসিআই দুদিন পরে নাম কে ওয়াস্তে হলেও মহঃ শামির পক্ষ নিয়েছে। সৌরভ গাঙ্গুলি ৫ দিন পর মুখের লিউকোপ্লাস্ট খুলে সাত চড়ে রা কেটেছেন। কিন্তু এনাদের প্রত্যেকের প্রতিক্রিয়ার অভিমুখ একটু তলিয়ে বিশ্লেষণ করলে বুঝতে পারবেন যে, তারা বলতে চেয়েছেন, মহঃ শামি দুর্দান্ত ক্রিকেটার। বহু পরিশ্রম করে তিনি এই জায়গায় পৌঁছেছেন। বহু ম্যাজিকাল মুহূর্ত ভারতীয় ক্রিকেট কে উপহার দিয়েছেন। তাই একদিনের খারাপ পারফরম্যান্সের জন্য তাকে এই অনলাইন আক্রমণ করা ঠিক হচ্ছে না। আজ্ঞে না মিস্টার, একদিনের খারাপ পারফরম্যান্সের জন্য মহঃ শামিকে আক্রমণ করা হচ্ছে না। একদিনের খারাপ পারফরম্যান্সের জন্য আক্রমণ করতে হলে, রোহিত শর্মাকেও করা যেত, সূর্যকুমার যাদবকেও করা যেত, হার্দিক পান্ডায়াকেও করা যেত। কোনদিন পারফর্ম করতে না পারার জন্য ভরুন চক্রভর্তী কেও করা যেত। সব ব্যাটাকে ছেড়ে মহঃ শামি কে ধর অ্যাপ্রোচের কারণ তিনি মুসলমান। আর খেলার প্রতিপক্ষ পাকিস্তান। একমাত্র বুকচিতিয়ে সেই কথাটা বলে প্রতিবাদ করতে পেরেছেন ইরফান পাঠান। অন্য কেউ না।
এমনিতে দেখতে ভালো লাগে, শুনতে ভালো লাগে, বলতেও ভালো লাগে যে ভারতীয় ক্রিকেটাররা ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার প্রতিবাদে হাঁটু গেড়ে প্রতীকী প্রতিবাদে অংশগ্রহণ করেছেন। কিন্তু ভারতীয় ক্রিকেটাররা কি ৩১বছরের দলিত যুবক সুধাকরকে চেনেন? তামিলনাড়ুর তিরুভান্নামালাই জেলার প্রত্যন্ত গ্রামের সুধাকর একটি গর্হিত অপরাধ করেছিলেন। কী জানেন? ভালোবেসে বিয়ে করেছিলে 'উঁচু' জাতের যুবতীকে। লকডাউনের শুরুতেই কাজ হারিয়ে সুধাকর গ্রামে ফিরতেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে কসুর করেনি গ্রামের সরপঞ্চের লেঠেল বাহিনী। রড দিয়ে পিটিয়ে খুন করা হয় সুধাকরকে।
সুধাকরের গায়ে রংও কালোই ছিল। গায়ে রং কালোই ছিল বিদর্ভের দলিত শ্রমিক বাপুরাও তাজনেরও। ‘উচ্চবর্ণ’র দুয়ারে জল আনতে গিয়ে, অপমানিত, লাঞ্ছিত স্ত্রী'র চোখের জল মুছতে যিনি টানা ৪০ দিন, ৬ ঘণ্টার অক্লান্ত পরিশ্রমে আস্ত একটা কুয়ো খুঁড়ে তাঁর প্রেম প্রতিজ্ঞার তৃষ্ণা মিটিয়েছিলেন। করোনা প্যাণ্ডেমিকেও এই অভাগা দেশে লকডাউন নেই বর্ণবিদ্বেষে। লকডাউন নেই অস্পৃশ্যতায়। ঠিকই, মিনিয়াপলিসের জর্জ ফ্লয়েডের অস্বাভাবিক মৃত্যুতে গর্জে ওঠাই তো সভ্যতা। কিন্তু ভারতীয় ক্রিকেটাররা কি পারবেন একি ভাবে প্রতিটা সাফুরা জারগারের গ্রেপ্তারে, প্রতিটা নাজিবের বেমালুম গায়েব হয়ে যাওয়াতে, প্রতিটা রোহিত ভেমুলার মৃত্যুতে, প্রতিটা গৌরী লঙ্কেশের হত্যাতে, প্রতিটা সতেন্দ্র দুবের খুন হয়ে যাওয়াতে প্রতিবাদ করতে? পারবেন দেশের দলিত এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক ভাবে ঘটে চলা রাষ্ট্রীয় মদতপুষ্ট অত্যাচারের প্রতিবাদ করতে!