মূল লেখাটা কি খালি ট্যাব দেওয়া নিয়ে ছিল? আদপেই নয়। বরং লেখাটির একেবারে শুরুতেই ছিল - "ট্যাবের পেছনে ১৫০০ কোটি টাকা খরচ না করে শিক্ষার উন্নতিকল্পে আর কী কী করা যায়? এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য মনে হয়েছিল মিড ডে মিলের বরাদ্দ বৃদ্ধি।" অর্থাৎ বিকল্প ব্যবস্থা হিসাবে মিড ডে মিলের উল্লেখ ছিল।
শুধু তাই নয়, একই লেখায় এ কথাও উচ্চারিত হয়েছিল "...পশ্চিমবঙ্গের একটি প্রান্তিক এলাকায় অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত ছাত্রছাত্রীরা মিড ডে মিল খাচ্ছে স্কুলে আর সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত নবম ও দশম শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীরা সেই দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এই টাকার একটা ভগ্নাংশ খরচ করেই তাদেরকে মিড ডে মিলের আওতায় আনা যেত।" অর্থাৎ আরও দুটি বা ক্ষেত্রবিশেষে আরও চারটি শ্রেণিকে মিড ডে মিলের আওতায় নিয়ে আসা।
কিন্তু মিড ডে মিল আবার কী বস্তু? খায় না মাথায় দেয়? তার বরাদ্দ বৃদ্ধি কিংবা আওতা বৃদ্ধি করেই বা কী হবে? কারণ? কারণটা খুব সিম্পল। সেটা হল "যারা সাধারণত বাড়ি থেকে টিফিন নিয়ে স্কুলে যায় মিড ডে মিলের ডাল তরকারি খাবে না বলে" তাদের নিয়েই আমাদের মুল মাথাব্যথা। শ্রেণিবিন্যাসটা একেবারে জলের মতো স্পষ্ট। কাজেই মিড ডে মিল সংক্রান্ত যাবতীয় আলোচনা হল "কথা হচ্ছে ট্যাব দিলে কী লাভ বা কী ক্ষতি, এসে গেল কুমীরের পিঠে চাকা চাকা চাকা চাকা......." (ডট সংখ্যা অপরিবর্তিত)। মানে আমার বা আমাদের শ্রেণির ভাবনাটাই হচ্ছে আসল ভাবনা, বাকি সব তুশ্চু।
বেশ, এবারে তবে আমাদের শ্রেণির ভাবনটা একবার দেখা যাক। সেটা মোটামুটি এইরকম ---
১. সরকারী স্কুলে যারা পড়ায় তাদের লেভেল সম্বন্ধে ধারণা আছে? দুয়েকজনকে তো এই ফোরামেই দেখছেন। যারা এই ২০১১ র পর থেকে চাকরিতে ঢুকেছে তাদের কথা আর নতুন করে বলারও কিছু নেই। বাংলা ভাষায় উচ্চশিক্ষার বইপত্রের অবস্থা জানেন? সরকারী শিক্ষকেরা টিউশনি করাতেও পারেন না, আর স্কুলের অর্ধেক সময় তো মিডডেমিলের আলুপেঁয়াজআদারসুনমসলার হিসেব করতেই যায়। এবার সমস্ত গাঁ গঞ্জে তিনটি বিজ্ঞান বিষয়ে রাজ্যস্তরে জাতীয়স্তরের পরীক্ষার জন্য তৈরি করে দেওয়ার মত প্রাইভেট টিউটর থাকে বলে মনে হয়? [মিড ডে মিল যে নিছকই 'আলুপেঁয়াজআদারসুনমসলার' হিসেব করতে গিয়ে অর্ধেক কর্মদিবস নষ্ট বই অন্য কিছু নয়, সেটা ফের মনে করিয়ে দেওয়া]
২. আরে স্কুলে ১১/১২ এ কদিন কঘন্টা যায় বাচ্চারা। কেনই বা যাবে? কলেজ থেকে ১১/১২ সরিয়ে দিয়ে তো মোস্ট ইনকমপিটেন্ট কোটায় আর ঘুষে চাকরি পাওয়া জনতার হাতে তুলে দিয়েছে বাচ্চাদের। [জেনারাইলেজেশনটা বাঁধিয়ে রাখার মতো]
৩. পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা ব্যবস্থা গোটাটাই গত চোদ্দ বছরে চ'কারান্তের একশেষ করে গাধার ইয়েতে পাঠানো হয়েছে।
আপাতত এটুকু বিশ্লেষণ করে যা যা পাওয়া যাচ্ছে, তা হল - ক) স্কুলের সমস্ত শিক্ষক হয় ইনকমপিটেন্ট নয় ঘুষদাতা; খ) কলেজ থেকে এগারো-বারো স্কুলে চলে আসায় তার আরও বারোটা বেজেছে; গ) গত ১৪ বছরে গোটা শিক্ষাব্যবস্থাটাই গাধার ইয়েতে চলে গেছে এবং ঘ) রাজ্যের সমস্ত উমা স্কুলের এক ও একমাত্র দায়িত্ব ও পবিত্রতম কর্তব্য হচ্ছে আমার ছেলে/মেয়েটিকে তিনটি বিজ্ঞান বিষয়ে রাজ্যস্তরে কিংবা জাতীয় স্তরের পরীক্ষার জন্য তৈরি করে দেওয়া। তাতে উচ্চ মাধ্যমিকের সিলেবাস শেষ করা গেল কি গেল না (যেটা কি না সরকারি উমা স্কুলগুলোর মুল কাজ), তা দেখে লাভ নেই। কারণ আমার প্রায়োরিটি তা নয়।
এরই অনুষঙ্গ হিসাবে তাই দিব্যি উচ্চারণ করা যায়-
১. ১১-১২ এর সায়েন্স টেকস্ট আর রেফারেন্স বইপত্রের যা দাম হয়েছে আর IIT JEE mains advance NEET এসবের জন্য সব সাবজেক্টের এত বেশি রেফারেন্স বই বাজারে আছে, যার বেশিটাই খুব জরুরি, এমনকি FIITJEE, RESONANCE, ALLEN এসবের সম্পূর্ণ মেটেরিয়াল থেকে শুরু করে প্রায় সমস্ত সাবজেক্টের সব বই সফট কপি পাওয়া যায় বলে, স্টুডেন্টরা নিজেরাও বই যা কিনতে বাধ্য হচ্ছে, মোবাইলে স্ক্যান করে জনহিতার্থে পিডিএফ করে দিচ্ছে বলে, একটু বড় স্ক্রিনে ব্যবহার করলে প্রায় কাগজের বইয়ের মতই এই সফট কপি বইগুলো ব্যবহার করা যায় বলে ট্যাব এখন ১০ পাস করার পর মাস্ট।
একেবারে জলবৎ তরলং যুক্তি। রাজ্যের এবং রাজ্য সরকারি স্কুলগুলির একমাত্র মাথাব্যথার কারণ হবে জেইই মেন বা অ্যাডভান্স কিংবা নিট পরীক্ষায় সাফল্যলাভের জন্য সেই ছেলেমেয়েদের (সংখ্যায় যারা সাকুল্যে ৫০ হাজার বা তারও কম অর্থাৎ মোট পড়ুয়ার ৫%) ট্যাব দেওয়া। সরকারের একমাত্র মোক্ষ হবে কতগুলো কর্পোরেট শিক্ষা হাঙরের আনুকূল্য লাভ করা। তাতে বাকি ৯৫% গাধার ইয়েতে গেলে যাক।
২. ব্যাপারটা যেহেতু মারাত্মক রকমের দৃষ্টিকটু (শ্রুতিকটু তো বটেই), তাই সেটাকে খানিক মোলায়েম করতে এর গায়ে একটা ওয়েলফেয়ারের পাতলা চাদর জড়িয়ে দাও। সেই চাদর জড়ানোর জন্য উচ্চারণ করতে হবে যে ক) শিক্ষক বা প্রধান শিক্ষকদের আলুপেঁয়াজআদারসুনমসলার হিসেব রাখা অবান্তর এবং সময়ের চূড়ান্ত অপব্যয়। কিন্তু আমার প্রয়োজনীয় ওয়েলফেয়ারটির জন্য ওই একই প্রধান শিক্ষকরা বরং 'সব স্টুডেন্টের বিল ও ট্যাব হাতে নাতে সিরিয়াল নাম্বার মিলিয়ে দেখে নিলে' অনেক উবগার হবে। এবং খ) যদিও নিজেই বলে ফেলেছি যে ১১-১২তে বাচ্চারা মোটে স্কুলে যায় না কারণ যাওয়ার কোনও কারণই নেই, কিন্তু ওয়েলফেয়ারের চাদরটাকে অক্ষত রাখার জন্য 'রোজ স্কুলে প্রত্যেকের নিজস্ব ট্যাব সহ হাজিরা বাধ্যতামূলক'-টাও টুক করে বলে দায় সেরে ফেলব।
দেখার চোখে নিজের আর্থসামাজিক অবস্থানের রঙিন চশমা এমন সেঁটে গেছে যে আর সেটাকে আলাদা ভাবে বোঝা যায় না, চোখ চশমা গুলিয়ে এক হয়ে যায় - এহেন নির্জলা সত্য উচ্চারণের এমন উদাহরণ খুব বেশি পাওয়া যায় না বলেই আমার ধারণা।