যে কোনও বই পড়বার সময় ভূমিকাটুকু বাদ দিয়ে পড়া আমার বরাবরের স্বভাব। ঐটে মূল পাঠ্যাংশের তুলনায় কম আকর্ষণীয় লাগে। কিন্তু নিজে লিখবার বেলায় খেয়াল হলো যে কিছু কৈফিয়ৎ আগেভাগেই জানিয়ে না দিলে পাঠকদের ওপর অন্যায় করা হবে।
"কাপালিক" আমার নিজের জীবনের ঘটনা, যদিও চরিত্রদের নাম বদলাতে হয়েছে। এর সময়কাল উনিশশো ছিয়ানব্বই সালের মধ্যেই সীমিত। এই সময়টা আমার বিদেশ থেকে ভারতে ফিরে আসার সন্ধিক্ষণ।
আমি ভেঙে যাওয়া সোভিয়েত ইউনিয়নের তাশখন্দ থেকে ফিরেছিলাম কলকাতায়। যে কলকাতাকে ছেড়ে আমি দশ বছর আগে সোভিয়েত ইউনিয়নে গেছলাম উচ্চশিক্ষার্থে, ফিরে আসবার পরে সেই কলকাতাই কেমন যেন অচেনা ঠেকছিল। অথচ দশটা বছরে আমি কতবার ঘুরে গেছি আমার শহর থেকে, যদিও সেসব ছিল ছুটি কাটানোর মত শর্টট্রিপ, এবার এলাম পাকাপাকি থাকতে। অর্থাৎ আমার একটা উপার্জনের ব্যবস্থা চাই, অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের ব্যবস্থা না করা পর্যন্ত দম ফেলবার সময় নেই। না, আমার কাছে কোনও নিজস্ব সঞ্চয় ছিল না।তাশখন্দে আমি ছিলাম শুধুই ছাত্র, কোনও চাকরি করিনি সেখানে।আমার সঙ্গে ফিরেছিল আমার বয়ফ্রেণ্ড, সেও সবে পাশ করেছে, সেও ভারতীয়, সেও বাঙালী, তবে তার বাড়ি কলকাতা থেকে বহুদূরে পাহাড়ে ভরা মেঘালয় রাজ্যের শিলং শহরে। ছবছর আমরা একসঙ্গে থেকেছি তাশখন্দে। এই ছবছরে আমাদের একটা সন্তান জন্মেছে, মেয়েসন্তান, অবশ্য বিয়ে করি নি আমরা। আমাদের মেয়েকে কলকাতায় আমার মায়ের কাছে রেখে গিয়েছিলাম কিছু বছর আগে। তার বয়সও সবে পাঁচ হয়েছে। সে আমার মায়ের কাছেই থাকে। আমার বয়ফ্রেণ্ড তার বাড়িতে সব খবরই গোপন রেখেছিল। তাদের রক্ষণশীল পরিবার, তার দিদির তখনও বিয়ে হয় নি। ছোটভাই বান্ধবীর সঙ্গে থাকে, সে বিয়ে না করেই বাবা হয়েছে, এসব লজ্জার ঘটনা বলেই ধরা হয় তাদের পরিবারে, বলা হয় স্ক্যাণ্ডাল। এসব খবর জানাজানি হলে দিদির বিয়ে আটকে যেতে পারে। ভারতীয় অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ প্রথায় শুধু পাত্রপাত্রীই নয়, তাদের পরিবারের ব্যাকগ্রাউন্ড চেক বিরাট ভুমিকা পালন করে। অন্যদিকে, আমার মা আমার মেয়েকে নিজের কাছে রাখতে রাজি হলেও আমাদের দুজনের সম্পর্ককে মেনে নিতে পারে নি।এর পেছনে যে আমাদের দুজনের বিয়ে না করে একসঙ্গে বসবাস করাটাই একমাত্র কারণ, তা কিন্তু আমার মনে হয় না। আমরা দুইবোন, বাবা মারা গেছে শৈশবে, আমিই বড়। মা আমাকে কোনওদিনও আদর করেছে কি ভালোবেসে কিছু বলেছে বলে আমার মনে পড়ে না, আমার বোনের প্রতি অবশ্য তার ব্যবহার ছিল খুবই নরম। এর কারন ছিল স্পষ্ট। আমার গায়ের রং এজন্য দায়ী। বোনের তুলনায় আমার গায়ের রং বেশ কয়েক পোঁচ কালো। ছোটবেলা থেকেই গায়ের রং কালো হবার কারণে আমি তার কাছ অপ্রিয় হয়ে থেকেছি। আমাদের সমাজে এখনও ফর্সা মেয়ের চাহিদা বিয়ের বাজারে সবচেয়ে বেশি।মেয়েদের দৈহিক সৌন্দর্যের মাপকাঠিতে অগ্রাধিকার পেত গায়ের রং, সেই প্রথম রাউন্ডেই আমি ফেল মেরেছি। আর কে না জানে, যতই পড়াশোনা করে চাকরি বাকরি নিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াই না কেন, বিয়ে তো একসময় করতেই হবে। এ সমস্তই আমার অবচেতনে গেঁথে গেছল স্বতঃসিদ্ধের মত। কিন্তু সব কিছু আমূল পাল্টে দিল আমার সোভিয়েত ইউনিয়নে যাওয়া। সিলেবাসের পড়ার থেকেও অনেক বেশি শিখেছি সেখানে পারিপার্শ্বিক থেকে। এ কেবল অন্য দেশে যাওয়া নয়। এ ছিল টাইম ট্র্যাভেল। টাইম মেশিনে করে যেন কোন এক স্বপ্নের মত ভবিষ্যতে চলে যাওয়া। যেখানে গিয়ে জানলাম আশৈশব জেনে আসা অনেক স্বতঃসিদ্ধ আসলে ভুল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমি দ্রুত বদলে যেতে থাকি। গায়ের রং সম্পর্কে, বিয়ে সম্পর্কে, জীবনের নানান ব্যাপারে আমার চিরাচরিত ধারণা এবং সংস্কার টুপটাপ খসে খসে পড়ে যেতে থাকে, যেমনটা সীতাহরণের ঘটনায় পুষ্পক রথে করে লঙ্কার পথে উড়ে যেতে যেতে সীতা তার সমস্ত অলংকার এক এক করে ত্যাগ করেছিল। জীবনে প্রেম এসেছে একের পর এক। বিয়ে সম্পর্কে প্রথমে দোটানায় থাকলেও ক্রমশ বিয়ে আমার কাছে আর আকর্ষণীয় মনে হয় নি। অবিবাহিতা মা দেখলে সেই সময়ে অনেকেই মনে করত এ সন্তান কোনও দুর্ঘটনার পরিণতি। নিরাপত্তাহীন যৌন জীবনের জ্যান্ত দলিল। এই সন্তান যেন একটা দায়, একটা লজ্জার ব্যাপার। বিয়ের অপশন থাকা সত্ত্বেও কেন তুমি বিয়ে না করে মা হবে? এ তোমার কেমন বেয়াড়া আবদার, এত বড়ো দুঃসাহস! সকলেই এর পেছনে একটা বঞ্চনার ইতিহাস খুঁজতে চেয়েছে, দেখতে চেয়েছে একটা করুণ কাহিনি। এটা যে আমার নিজের পছন্দে, চয়েসের ফলেই হয়েছে, তা আমার সমাজের অধিকাংশ মানুষই মেনে নেয় নি। তারা ভাবত, আমি মিথ্যে বলছি, প্রেমে ঠকে গিয়ে লজ্জায় আঙুর ফলকে টক বলে চালাতে চাইছি। যদি তখন তাদের কথাই শিরোধার্য করে মাথা নুইয়ে বলতাম যে তাদের গণনাই ঠিক, আমি সত্যিই অভাগিনী, তাহলে হয়ত তারা সন্তুষ্ট হতো। দেশে ফিরবার পরে তাই প্রথমে নিজের মায়ের কাছে উঠলেও সেখানে বেশিদিন ঠাঁই হয় নি। ঘনিষ্ঠ আত্মীয় স্বজন সব রাতারাতি পর হয়ে যাচ্ছিল। কলকাতা শহরে আমাদের থাকবার কোনও জায়গা ছিল না। পর্য্যাপ্ত টাকার অভাবে কোনও ফ্ল্যাট ভাড়া নিতে পারি নি, ফলে বাধ্য হয়ে নিজেদের স্বামীস্ত্রী হিসেবে পরিচয় দিয়ে একটা বস্তিতে ঘর ভাড়া নিই। জীবনে সেই প্রথম বস্তিতে বাস করা। যারা আগে কখনও বস্তিতে থাকে নি তাদের জন্য একেবারেই সহজ নয় সেই নতুন পরিবেশে বসবাস করা। সেখানে জলের কল থেকে শুরু করে বাথরুম টয়লেট সমস্তই কমন। একটি মাত্র আসবাবহীন স্যাঁৎসেতে ড্যাম্প ধরা ঘরের মেঝেয় চাদর পেতে শোবার ব্যবস্থা। টাকা পয়সার তাৎক্ষণিক প্রয়োজনে নানান ধরণের চাকরি করেছি ন্যূনতম খরচ জোটাতে। আমার বয়ফ্রেণ্ডের পরিবারকেও ক্রমে জানানো হয় সব। আমরা চলে যাই শিলং এ। কিন্তু সেখানে পরিস্থিতি আয়ত্ত্বের বাইরে চলে যায়। তারা আমাকে দুটো অপশনের মধ্যে একটা বেছে নিতে বলে। এক, ঐ সম্পর্কের ইতি টেনে কলকাতায় একা ফিরে যাওয়া, দুই, ওখানে থাকতে চেয়ে খুন হয়ে যাওয়া। ওখানে জোর করে থাকবার চেষ্টা করলে আমাকে তারা মেরে ফেলে ওয়ার্ডস লেকের গভীর জলে বস্তায় পুরে ফেলে দেবে। আমার পায়ে বেঁধে দেবে ভারীভারী বাটখারা। আমার মৃতদেহ অদূর ভবিষ্যতে ভেসে উঠবে না কিছুতেই। হয়ত এটা ভয় দেখানোর জন্যই তারা বলেছিল। কিন্তু প্রতিদিন ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে শহর গ্রাম নির্ব্বিশেষে কোনও না কোনও বিবাহিত মেয়ের অস্বাভাবাবিক মৃত্যু ঘটে চলেছে, সেসব খবর তো আমাদের অগোচরে থাকে না। আর এক্ষেত্রে আমি বিবাহিত মেয়ে না হলেও এই বাড়ীর ছেলের সঙ্গে আমার সম্পর্ক স্থাপন হয়েছে যা তাদের মনোনয়ন পায় নি, পাবেও না, সেক্ষেত্রে আমার প্রাণেরও বেশ ঝুঁকিই রয়েছে তা বুঝে ফেলি। বুঝি প্রাণ নিয়ে পালানো ছাড়া খুব বেশি অপশন আমার হাতে নেই। জনবল নেই, লোক নেই। আমি প্রথমটাই বেছে নিয়েছিলাম। কারন সেই প্রেমটার মৃত্যু ঘটেছে তখনই। জোর করে সেই মৃত প্রেমের কাছ থেকে কিছুই পাওয়া যাবে না, বরং নিজের প্রাণটিও খোয়া যেতে পারে।ফলে ভাগ্যের এই বিড়ম্বনায় পুরোপুরি নিঃস্ব হয়ে নিজের জন্মভূমিতেই নির্বাসিতের জীবন বেছে নিয়েছি। আমার সন্তানকেও নিজের কাছে এনে রাখতে পারিনি। মধ্যনব্বইয়ের সেই দিনগুলোয় অবিবাহিত মায়েদের জন্য এই ধরণের শাস্তিই হয়ত বরাদ্দ ছিল। আমাদের এই নীল গ্রহটায় অনেকগুলো পৃথিবী আছে, সেই পৃথিবীগুলোয় যেতে হলে সবসময় যে টিকিট কেটে যেতে হবে তেমন নয়। আমাদের চারপাশেই রয়েছে সেই সব পৃথিবী। তাদের একটার সঙ্গে অন্যটার ব্যবধান সময়ে, ভাবনায়, মূল্যবোধে, শিক্ষায়, ভালোবাসায়, নিষ্ঠুরতায়, আরও অনেক কিছুতে। স্রোতের বিপরীতে চলার কারণে বিভিন্ন জীবিকার পেছনে ছুটতে হয়েছে। ফলতঃ বেঁচে থাকার চেষ্টায় একের পর এক নানান জীবিকা নিতে হয়েছে। কখনও পড়ানোর কাজ নিয়েছি, তো কখনও মডেলিং করেছি। টাকার অঙ্কে মজুরি পড়তায় না পোষালেও অভিজ্ঞতার ঝুলি এমন ভরেছে, যে হিসেব কষলে সব মিলিয়ে লাভের অঙ্কই বেশি মনে হয়। এমনি নানান সব চাকরির মধ্যে একটা চাকরির কিছু অভিজ্ঞতা ধরা রইল এইখানে।