----------------
গণশক্তিতে, আজ, আরও অনেক প্রসঙ্গ তুলে ধরলেন রাশেদ খান মেনন, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি।
বাংলাদেশে এবার শারদীয় দুর্গোৎসবকে কেন্দ্র করে অষ্টমী থেকে নবমী, দশমী এমনকি একাদশীতেও পূজামণ্ডপ-মন্দির আক্রমণ, প্রতিমা ভাঙচুর, এমনকি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের দোকানপাট, বাড়িঘরদোর আক্রমণ ছিল একটি অচিন্তনীয় ঘটনা। কারণ স্বাধীনতার পরপর সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার সংযোজনকে কেন্দ্র করে মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তিদের তরফ থেকে চট্টগ্রামে এমন একটি ঘটনার চেষ্টা হয়েছিল, কিন্তু সফল হয়নি। এবারের বিষয়টার সূত্রপাত কুমিল্লার নানুয়ার দিঘি পুজামণ্ডপে দুর্গা প্রতিমায় গণেশের মূর্তির পায়ের কাছে মুসলমানের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরান শরীফ পাওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে। জানা যায় যে কিছু প্রাতঃভ্রমণকারী বিষয়টি দেখে পুলিশকে খবর দেয়। ইতিমধ্যে জনৈক ব্যক্তি ফেসবুক লাইভে বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করে। এতে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে এবং কুমিল্লা, চাঁদপুরসহ দেশের কয়েকটি জায়গায় দুর্গামণ্ডপে কোরান অবমাননার অভিযোগ তুলে বিক্ষোভ ও মিছিল শুরু হয়। চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে ‘তৌহিদী জনতা’-র ব্যানারে মিছিল থেকে মন্দির আক্রমণের চেষ্টা হলে পুলিশ প্রথমে লাঠিচার্জ, টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। পরবর্তীতে শর্টগানের গুলি করলে ঘটনাস্থলে চারজন নিহত হয়।
পরদিন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্গোৎসব উপলক্ষে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে এ বিষয়ে সবাইকে সতর্ক করেন এবং বলেন এ ধরনের ঘটনার সাথে যে বা যারা জড়িত তাদের এমন শাস্তি দেওয়া হবে যাতে কেউই আর এ ধরনের ঘটনা ঘটাতে সাহস না পায়। এদিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকেও বর্ডার গার্ডসহ পুলিশকে দুর্গামণ্ডপসমূহে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা বিধানের নির্দেশ দেওয়া হয়। বাইশটি জেলার বর্ডার গার্ডকে টহলে নামানো হয়। কিন্তু ঘটনা থেমে থাকেনি। পরবর্তী নবমী ও দশমীর দিন দেশের বিভিন্ন স্থানে খণ্ড খণ্ডভাবে পূজামণ্ডপ আক্রমণের চেষ্টা, কোথাও পূজার গেট ভেঙে দেওয়া, মন্দির আক্রমণের ঘটনা ঘটে। তবে নোয়াখালির বেগমগঞ্জ থানার চৌমুহনীতে পুলিশের শৈথিল্য ও যথাসময়ে উপস্থিত না হওয়ার সুযোগ নিয়ে ইসকন মন্দিরের পূজামণ্ডপ ভাঙচুর ও ইসকনের উপস্থিত পূজারী-ভক্তদের ওপর দৈহিক আক্রমণে দুইজন নিহত হয়েছে। বিজয়ার পরদিন ফেনীতে হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতিবাদী মানববন্ধনের ওপর কিছু দুর্বৃত্ত ঢিল মারলে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয় এবং আশেপাশের কিছু মন্দির হিন্দুদের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে হামলা হয়।
বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছে যে ‘দুর্গাপূজায় দেশের বিভিন্ন স্থানে ৭০টি পূজামণ্ডপে হামলা-ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এর বাইরে ৩০টি বাড়ি ও ৫০টি দোকানে ভাঙচুর ও লুটপাট হয়।’ (প্রথম আলো-১৭ অক্টোবর) উল্লেখযোগ্য এবারের পূজায় বত্রিশ হাজারের ওপর পূজামণ্ডপে পূজা হয়।
দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে এই সাম্প্রদায়িক ঘটনাবলির বিস্তৃত বিবরণ দিলাম এ কারণে যে বাংলাদেশের এপার-ওপারে যোগাযোগ মাধ্যমে যে বিবরণ প্রচার করা হচ্ছে তাতে উভয়দেশেই চরম উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশে ‘হিন্দু নিধন যজ্ঞ’ চলছে এমন ধরনের প্রচার বিভ্রান্তিই বাড়াচ্ছে।
প্রথমেই দেশজুড়ে এই সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনাকে অচিন্তনীয় ছিল বলেছি এই কারণে যে সম্প্রতি বছরগুলোতে এভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ধর্ম নিয়ে কটূক্তিকে কেন্দ্র করে রামু বৌদ্ধবিহারের ঘটনা থেকে শুরু করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর, কুমিল্লার মুরাদনগর, সাতক্ষীরা, সুনামগঞ্জের শাল্লায় ও সর্বশেষ রংপুরের পীরগঞ্জে যে সাম্প্রদায়িক আক্রমণগুলো পরিচালিত হয়েছিল তা ছিল স্থানীয় ও সীমিত আকারে। সরকারের দ্রুত হস্তক্ষেপ ও অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহের প্রতিরোধের কারণে তা বিস্তৃত রূপ নিতে পারেনি। তাছাড়া অন্য সময় এভাবে মন্দির আক্রমণ, প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটলেও সেগুলি ছিল বিচ্ছিন্ন। কিন্তু শারদীয় উৎসবকে কেন্দ্র করে পাকিস্তান আমল থেকে শুরু করে এযাবৎ এ ধরনের ঘটনা বিশেষ ঘটেনি। বরং বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক প্রচার-প্রচারণার বিরুদ্ধে ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’ এই স্লোগানে প্রতিবারই উৎসবের পরিবেশে দুর্গাপূজা পালিত হয়ে আসছে। এই উৎসব আনন্দসহ সর্ব ধর্মের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে বাঙালীর সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে। সেখানে এবারের এই ঘটনাবলি অতি স্বাভাবিকভাবে কেবল সনাতনধর্মীদেরই নয়, সর্বস্তরের জনগণের বেদনা ও দুঃখের কারণ হয়েছে। বাংলাদেশে তো বটেই অন্য দেশের কাছে বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক ঐতিহ্যও চরমভাবে কালিমালিপ্ত হয়েছে।
এখানে যে কথাটি বলার তা’হল পাকিস্তানের দ্বি-জাতিতত্ত্ব ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে বাংলাদেশের বাঙালির যে অকুতোভয় সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে একটি অসাম্প্রদায়িক দেশের জন্ম দিয়েছিল সেই জন্মের শুরু থেকেই তাকে সাম্প্রদায়িক প্রচার-প্রচারণার মোকাবিলা করে এগতে হয়েছে। প্রথমদিকে বাংলাদেশকে ‘মুসলিম বাংলা’ হিসাবে প্রচার, সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতাকে ‘ধর্মহীনতা’ বলে চরম অপব্যাখ্যা, মুক্তিযুদ্ধে সহযোগী ও প্রাণদানকারী ভারতের বাংলাদেশ সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে অসন্তোষ ও বিক্ষোভ থেকে ভারত-বিরোধিতার আবডালে সাম্প্রদায়িকতা প্রচার এসব এদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির সামনে সমূহ সমস্যা হিসাবে থেকেছে। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ক্ষমতা দখলকারী জিয়ার সংবিধান থেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ বাদ দেওয়া, সংবিধানের প্রস্তাবনায় মুসলিম রীতির ‘বিসমিল্লাহ’ সংযোজন, আরেক সামরিক শাসক এরশাদের ইসলামকে রাষ্ট্র ধর্ম করে সংবিধানের বিধি সংযোজন—এসবই এই সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতিকে আরও গুরুতর করে তুলেছে।
ইতোমধ্যেই বিশ্বব্যাপী ইসলামী মৌলবাদের উত্থান, ধর্মের অপব্যবহারে পেট্রো-ডলারের অবাধ সরবরাহ, যুদ্ধাপরাধী জামাত ইসলামকে রাজনীতিতে পুনর্বাসন কেবল নয়, বিএনপি কর্তৃক ক্ষমতার অংশীদার বানানো অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশকে একটি ধর্মবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করার ষড়যন্ত্রকে অনেকখানি এগিয়ে দিয়েছিল। বহু আন্দোলন সংগ্রাম, জীবনদানের পর ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামি লীগের নেতৃত্বে ১৪ দলের বিজয় ও সরকার প্রতিষ্ঠা তাকে থামিয়ে দিতে সক্ষম হলেও ইতিমধ্যে রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার যে শিকড় শক্তভাবে বসে গেছে তাকে উপড়ানো যায়নি। শেখ হাসিনার সরকার সংবিধান সংশোধনীতে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ পুনঃসংযোজন করলেও ‘রাষ্ট্রধর্ম’ ইসলামের সাংঘর্ষিক বিধানকে রেখে দেয়। এক্ষেত্রে একমাত্র ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদ ঐ সংশোধনী গ্রহণের ভোটাভুটিতে ‘রাষ্ট্রধর্ম’ ইসলামসহ আদিবাসীদের সাংবিধানিক অধিকারের প্রশ্নে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছিল। সংবিধানের এই বৈপরীত্য ধর্মবাদী গোষ্ঠীকে সাম্প্রদায়িক প্রচার-প্রচারণা ও সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার ঘটাতে সুযোগ করে দেয়।
ইতিমধ্যে আরেকটি যে উপদ্রব উপস্থিত হয় তার নাম ধর্মীয় জঙ্গীবাদ। বিএনপি-জামাত আমলেই বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল সিদ্দিকুর রহমান বাংলা ভাইয়ের নেতৃত্বে জেএমবি নামে উগ্রপন্থী সংগঠন তাদের তৎপরতা শুরু করে এবং সারা দেশের ৬৩টি জেলায় একই সময় একযোগে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে তাদের শক্তির পরিচয় দেয়। ইতিপূর্বে আওয়ামি লীগের ১৯৯৬-২০০১ সালের শাসনামলে আফগান ফেরত ‘মুজাহিদরা-‘হুজি’ নামের সংগঠন করে দুই দফায় শেখ হাসিনার জীবন নাশের চেষ্টা নেয়। পরবর্তীতে বিএনপি-জামাত শাসনে শেখ হাসিনাসহ আওয়ামি লীগ নেতৃত্বকে হত্যা করতে ঢাকার সমাবেশে যে গ্রেনেড হামলা হয় তাতে ইসলামী জঙ্গীবাদী সংগঠন ‘হুজি’ কেবল নয়, খোদ বিএনপি নিজেই সংশ্লিষ্ট ছিল প্রমাণিত হয়েছে। ২০০৮ সালে আওয়ামি লীগ নেতৃত্বাধীন চৌদ্দদল ক্ষমতায় এলে ইরাক-সিরিয়ার ইসলামিক স্টেট (আইএস)-এর অনুপ্রেরণায় বিভিন্ন গোপন ইসলামী জঙ্গীগোষ্ঠী তাদের তৎপরতা বৃদ্ধি করে। আইএস অনুপ্রাণিত এসব জঙ্গীদের হত্যা হামলার মূল টার্গেট ছিল মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ, লেখক, প্রকাশক, ব্লগার, দরগার খাদেম, মন্দিরের পূজারী, মুসলিম শিয়া সম্প্রদায়ের ব্যক্তিরা। এর সর্বোচ্চ প্রকাশ ঘটে ২০১৬ সালের ২ জুলাই হলি আর্টিজান বেকারিতে আক্রমণ চালিয়ে তরুণ জঙ্গীবাদীদের দেশি-বিদেশি ব্যক্তিদের হত্যার ঘটনায়।
বাংলাদেশ সরকার ধর্মীয় জঙ্গীবাদীদের ব্যাপারে ‘জিরো টলারেন্স’ নিয়ে এই জঙ্গীবাদীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে তা নিয়ন্ত্রণে এলেও এবং বর্তমানে জঙ্গীবাদী তৎপরতা সেভাবে না থাকলেও এখনও দেশে বেশ কয়েকটি জঙ্গীবাদী আউটফিট সক্রিয় রয়েছে। আফগানিস্তানে তালিবানের বিজয়ে এসব গ্রুপ বিশেষ উৎসাহিত হয়েছে।
যুদ্ধাপরাধীর বিচারে জামাত ইসলামীর মূল নেতৃত্বের মৃত্যুদণ্ড, ফাঁসিদান ও সংগঠন হিসাবে জামাত ইসলামীকে যুদ্ধাপরাধী সংগঠন হিসাবে বিচারের রায়ে জামাত এখন কোণঠাসা। তাদের বিশেষ কোনও প্রকাশ্য তৎপরতা নেই। তবে আত্মগোপনে তারা সংগঠিত। এবং বিভিন্ন সংগঠন বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলে অনুপ্রবেশ করেছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে কওমী মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম। সরকারের নারী নীতি, শিক্ষানীতির ও বিভিন্ন প্রগতিশীল পদক্ষেপের বিরোধিতা করে গড়ে ওঠা এই সংগঠন ২০১৩ সালে ৫ মে ঢাকার কেন্দ্রস্থল মতিঝিলের শাপলা চত্বরে সমবেত হয়ে অভ্যুত্থানের অপচেষ্টা নেয়। সরকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে তাদের সেই অপচেষ্টা বন্ধ করে দিলেও, তারা আলেম-ওলামাদের হত্যা-গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে প্রচার আজও পর্যন্ত অব্যাহত রেখেছে। হেফাজতী নেতারা বিভিন্ন সভা-ওয়াজ মহফিলে কেবল সাম্প্রদায়িকতা প্রচার-প্রচারণা করেই ক্ষান্ত নেই, একই সময় বাংলাদেশের সংবিধান, জাতীয় সঙ্গীত, জাতীয় পতাকা নিয়ে বিরোধিতা করতে দ্বিধা করে না। কিন্তু সব চাইতে দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো শেখ হাসিনা সরকার ও আওয়ামি লীগ হেফাজতের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে তাদের মূল ধারার অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়াসে তাদের সর্বোচ্চ সার্টিফিকেটকে স্বীকৃতি দিয়েছে। তাদের দাবি অনুসারে পাঠ্যপুস্তকের বিভিন্ন প্রথিতযশা কবি সাহিত্যিকদের লেখা বাদ দিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে অবারিত ধর্মবাদী ও সাম্প্রদায়িক ঘৃণ্য প্রচার চলছে তাকে আমলে না নিয়ে বরং মুক্তবুদ্ধি সম্পন্ন ব্যক্তিদের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের টার্গেট করেছে।
এই অবস্থায় সমাজে যে সাম্প্রদায়িক মন ও মানসিকতার দ্রুত প্রসার ঘটেছে তাতে রাজনীতি ও সমাজে এক সাম্প্রদায়িক বিভাজন তৈরি হয়েছে। এবারের দুর্গোৎসবে পূজামণ্ডপে হামলা-মন্দির ভাঙচুরসহ সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে যে সব ঘটনা ঘটেছে এই বাস্তবতা হচ্ছে তারই প্রেক্ষাপট। এর সাথে জড়িত আছে রাজনীতি, এই সরকারকে অস্থিতিশীল করার রাজনীতি।
দুর্গোৎসবকে কেন্দ্র করে সাম্প্রতিক সাম্প্রদায়িক ঘটনাবলির প্রেক্ষাপট যেটাই হোক না কেন এটা স্পষ্ট যে দুর্গামণ্ডপে কোরান রাখার ঘটনাটি ছিল পূর্ব পরিকল্পিত ও ষড়যন্ত্রমূলক। দেশের মধ্যে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করা, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে ভীতির মধ্যে ঠেলে দেওয়া, এমনকি তাদের দেশ থেকে বিতাড়ন এবং সর্বোপরি বাংলাদেশের রাষ্ট্র চরিত্রকে সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী করার যে দীর্ঘ অপতৎপরতা এ যাবৎ চলে এসেছে তাকে আরও জোরদার করা, বাস্তবায়ন করা।
এটা স্বস্তির যে, ক্ষমতাসীন সরকারের তাৎক্ষণিক পদক্ষেপে এর পরিসর বিশেষ বাড়তে পারেনি। কিন্তু প্রশাসনিক শৈথিল্য, বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শৈথিল্য, তাদের মাঝে সাম্প্রদায়িক মানসিকতার অনুপ্রবেশ একাজকে অনেক কঠিন করেছে। কিন্তু তার চাইতে বড় কথা যে রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তি অতীতে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের কঠিন সময়েও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকেছে, প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে তাদের সাংগঠনিক সীমাবদ্ধতা, আদর্শগত অবক্ষয়ের কারণে বিশেষভাবে দুর্বল। তার উপর রয়েছে দুটি বড় দলের দোষারোপের রাজনীতি—একে অপরকে অভিযুক্ত করে দায় এড়ানোর চেষ্টা। বাংলাদেশের বাম প্রগতিশীল শক্তিগুলো একইভাবে বিচ্ছিন্ন, বিভক্ত। অতীতে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে যে প্রতিরোধ গড়ার ক্ষেত্রে তাদের সর্বপ্রথম প্রচেষ্টা থাকত তা অনুপস্থিত। এটা সংখ্যালঘুদের মনঃপীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্যে প্রকাশ পেয়েছে।
শারদীয় দুর্গোৎসবকে কেন্দ্র করে সংঘটিত এই ঘটনাবলিতে বাংলাদেশের জনগণও ক্ষুব্ধ। যে সব জায়গায় ঘটনাবলি ঘটেছে সেখানে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সম্মিলিত প্রতিরোধের ঘটনা ঘটেছে। সরকারের প্রশাসনিক ব্যবস্থার পাশাপাশি রাজনৈতিক দল, সামাজিক-সাংস্কৃতিক শক্তিরাও মাঠে নেমেছে। এই ঘটনাবলিতে সংখ্যালঘুদের মনে ক্ষোভ ও দুঃখ থেকে গেলেও এদেশের সকল গণতান্ত্রিক শক্তির সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই বেগবান হচ্ছে। তবে এক্ষেত্রে উভয় দেশের বাম গণতান্ত্রিক অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্যবদ্ধতা ও তাদের সম্মিলিত প্রয়াস জরুরি। কারণ বাংলাদেশে কোনও সাম্প্রদায়িক ঘটনা ঘটলে যেমন ভারত, বিশেষ করে পশ্চিমবাংলা, ত্রিপুরা, আসামে উদ্বিগ্নতা সৃষ্টি হয়, সেভাবে ভারতের সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনাবলির প্রতিক্রিয়াও বাংলাদেশে আছে। সম্প্রতি সময়ে বিশেষ করে ভারতের এনআরসি, নাগরিকত্ব সংশোধন আইন ও রাজশক্তির বাংলাদেশ বিরোধী বক্তব্য এদেশের মানুষের মধ্যে এক ধরনের অস্বস্তিবোধ ও অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে। আবার বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী বিভিন্ন ঘটনা ভারতের মানুষের মধ্যে অস্বস্তি ও উদ্বেগের জন্ম দিচ্ছে। এই অবস্থায় বাংলাদেশ-ভারত উভয় দেশের অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্যবদ্ধতা, বিশেষ করে বাম গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহের ঐক্যবদ্ধতা ও ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সাম্প্রতিক ঘটনাবলি সে বিষয়টি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে।