&/ এর প্রশ্নটা আমারো খুব মনে ধরেছে, তাই দু'পয়সা দিয়ে যাই জেন জি'র প্রতিনিধি হিসাবে। আমার গান শোনার শুরু, মানে গান শুনে মনে কিছু অনুভব করার সময় এসেছে অনেক দেরিতে। আমাদের বাড়িতে সেভাবে গানবাজনার সংস্কৃতির চর্চা নেই, তাই আমি এ কথাও অনেক পরে জেনেছি যে আমার গান শুনতে বা গাইতেও, গলা মেলাতে ভালো লাগে। আমার বাবা যেহেতু নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে উঠে এসেছেন আর কমিউনিস্ট আদর্শ অনুসরণ করে বড়ো হয়েছেন, তাই বাবার কাছে গানবাজনা বিলাসিতা বা সময় নষ্ট আমাদের বাড়িতে, একটা উদাহরণ দেওয়া যায়, আমার মা যেমন আগে, মানে ১০-১২ বছর আগেও, ফোনে এফএমে গান শুনতে ভালোবাসতো, তখন স্মার্টফোন আসেনি, ১০২.৬ আমার এফএম চ্যানেলে সকালের রবি বলে একটা অনুষ্ঠান হতো রবীন্দ্রসঙ্গীতের, সেটা সকালে রান্না করতে করতে হয়তো শুনছে মা স্পিকারে, বাবা এসে বলল "বাড়িটা তো চায়ের দোকান বানিয়ে ফেলেছ পুরো।" - তো এইরকম পরিবেশ। অন্যন্য বাচ্চাদের মতো আমাকেও কিছু কো-কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিতে জুতে দেওয়া হয়েছিল-সাঁতার কাটা (এটা আমার পছন্দ ছিল যদিও, বেশিদিন করা হয়নি পড়াশোনার চাপ বাড়ার সাথে সাথে), আঁকা (উদ্দেশ্য ছিল যাতে হাতের লেখা, জ্যামিতির সম্পাদ্য, ভূগোল বা জীবনবিজ্ঞানের আঁকা ভালো হয় - খুব উপকার হয়েছিল বলতে পারিনা), আবৃত্তি (বাবা নিজে ছোটবেলায় এটা করতো, তাই পরবর্তীকালে দাদা আর আমাকেও করতে হয়েছিল, কিন্তু আমি টিকে থাকতে পারিনি কারণ আমার ভালো লাগছিল না তখন) কিন্তু এগুলোর মধ্যে গান ছিল না। আমার গান শোনার একমাত্র নিয়মিত জায়গা ছিল স্কুলের প্রার্থনায়, যেমন সমবেত ভাবে ওই বেদমন্ত্র পাঠ, কয়েকটা রবীন্দ্রসঙ্গীত, রামকৃষ্ণ সারদা বিবেকানন্দ কেন্দ্রিক গান, এসো মা এসো মা বীণাপাণির মতো এরকম কিছু গান, স্ত্রোত্র পাঠ আর আমাদের আশ্রমে (এটা অন্যন্য রামকৃষ্ণ আশ্রমেও বোধহয় আছে) ছাত্ররাই প্রার্থনাসভা পরিচালনা করত, তো তাদের মধ্যেই কেউ কেউ অন্যন্য গান গাইতো প্রার্থনাসভার মতোন করে, অতো মনে দাগ কাটতো না। প্রথম যে গান মনে দাগ কেটেছিল তার গল্পটা একটু অন্যরকম, তখন কেবল টিভি ছিল, তো টিভি চলছে ঘরে, মা দেখছে স্টার জলসা, আর বাচ্চাদের বড়োদের অনুষ্ঠান দেখার অধিকার নেই, তো আমি লুকিয়ে ঘরের বাইরে পর্দার পেছনে দাঁড়িয়ে গিলছি টিভিতে যা হচ্ছে। দিনটা নববর্ষের ছিল, সন্ধ্যেবেলা বর্ষবরণ উপলক্ষে অনুষ্ঠান হচ্ছে (নাকি এটা গানের ওপারে সিরিয়ালের একটা অংশ ছিল আমার একটু খটকা হচ্ছে লিখতে গিয়ে) তো সেখানে নাচ হচ্ছে একটা অনুষ্ঠানে, মণিপুরী সাজে সেজে লাল কালো ছায়া ছায়া দৃশ্যে মেয়েরা ড্রাম পরে যেন নাচছে মনে হচ্ছে - গানটা হচ্ছে 'গহন কুসুম কুঞ্জ মাঝে।' এই ভার্সনটা একটু দ্রুত লয়ের ছিল সমবেত কন্ঠে, প্রমিতা মল্লিক ও ছিলেন বোধহয় গানের শিল্পীর দলে, একথা পরে জেনেছি। তো ওই গানটা আমার প্রথম সচেতন ভাবে গান শোনা, নাচের সাথে মিলে। এরপরের গান শোনার অভিজ্ঞতা, সেটা ক্লাস ফাইভে পড়ার সময়। তখন দাদার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সূত্রে বাড়িতে কম্পিউটার এসেছে, ২০১৪-১৫ সাল হবে। সেবার 'এই সময়' কাগজ প্রথম বেরোতে শুরু করে, আমরাও গ্রাহক হয়েছিলাম আর ওরা শারদীয়া সংখ্যার সাথে একটা সিডি দিয়েছিল আশা অডিয়োর "সকল খেলায় করবে খেলা এই আমি"। এর আগে আমাদের বাড়িতে টেপ রেকর্ডার প্লেয়ার ছিল, এমনকি বিভিন্ন টেপ সাজানো থাকতো বসার ঘরে একটা সিঁড়ি মতো স্ট্যান্ডের ধাপে ধাপে, কিন্তু দুঃখের বিষয় আমি মূর্তিমান কালাপাহাড়ের মতো সব টেপের ফিতে ছিঁড়ে নাশ করতাম ছোটবেলায়, তো সেগুলো শোনা হয়ে ওঠেনি। এর মধ্যে প্রহসন, কমিক নাটিকা র টেপ ছিল আবার হেমন্ত-সন্ধ্যা-আরতি-প্রতিমা-উৎপলা-গীতা দত্তদের গান, হিন্দি গান সবই ছিল। তো এরকম কিছু দিন আমার স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে, আমি তেতলায় দাদার ঘরে বসে চেয়ারে পা দোলাতে দোলাতে কাউন্টার স্ট্রাইক খেলছি বা ভার্চুয়া টেনিস বা মাইক্রোসফট পেন্টে হিজিবিজি দুর্গাঠাকুর আঁকছি, বাইরে ছাদে অফুরন্ত শরতের রোদ্দুর ঝিলমিল করছে, আর কম্পিউটারে ওই সিডিতে বাজছে - শানের "তোমার খোলা হাওয়া", বা তার পর অলকা ইয়াগনিক, কবিতা কৃষ্ণমূর্তির গানের পর লোপামুদ্রার গলায় "মোর বীণা ওঠে" এরকম। এই করে করে ইউটিউব ব্যবহার করতে শিখে পৌঁছোলাম রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার রবীন্দ্রসঙ্গীতে আর সেখানে থেকে তাঁর গুরু কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় গানের কাছে। এখান থেকে আমায় আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি।
এসময় স্কুলে আমার বন্ধুত্ব হয়েছে 'র'-এর সাথে, আসল নামটা নিলাম না কারণ ঘটনাগুলো সত্যি সব মোটামুটি, ও-ও একটু নিরীহ শান্ত প্রকৃতির বলে হেনস্থা হতে হয় ক্লাসের বাকি ছেলেদের কাছে ওকে, কিন্তু দারুণ গান করে, কারোর কাছে সেভাবে না শিখেই। ওর গাওয়া "মন মোর মেঘের সঙ্গী" আমার এখনো কানে লেগে আছে। আমরা গল্প করি, ও গুনগুন করে গান শোনায়, আমি তো গান শোনাতে পারিনা গলায় ব্যাং ডাকে তখন, তাই প্রশংসাই করি। ও শোনে বা গায় জয়তী, শ্রাবণী, মনোময়, শ্রীকান্ত আচার্য দের গান, বা স্বর্ণযুগের শিল্পীদের গান বা হিন্দি সিনেমার গান, আমি সেখানে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতেই বেশি স্বচ্ছন্দ - কণিকা, সুচিত্রা সবচেয়ে বেশি শুনি (এখনো), সমকালীন শিল্পীদের মধ্যে বন্যা, মিতা হক, পাপিয়া সারোয়ার, শ্যামা রহমান, সঞ্জিদা খাতুন, ওয়াহিদা রহমান, বা এপারের স্বাগতালক্ষ্মী, ইন্দ্রাণী সেন হয়ে সেকালের রাজেশ্বরী-সাহানা দেবী-অমিতা সেন-শৈল দেবী-রেণুকা দাশগুপ্ত-পঙ্কজ মল্লিক-কে এল সায়গল সবার গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীতই ইউটিউব ঢুঁড়ে শুনছি। তারপর ক্লাস টেনে উঠে কোচিংয়ের একটি ছেলের প্রতিও ভালোলাগা এসেছে, কিন্তু সে তো বলার উপায় নেই কাউকে। তাই নিজের মধ্যে নিজেই গুমরে থাকি আর রাত্রিবেলা বালিশের তলায় ফোন রেখে ইয়ারফোনে গান শুনতে শুনতে কাঁদি। এবার লকডাউনের মধ্যে দিয়ে কলেজে উঠে নিজস্ব স্মার্টফোন পেলাম। মাঝখানে এক-দেড় বছর, আমার এতো গান শেখার ইচ্ছে দেখে, মায়ের পরিচিত এক মাসিমা, আমার গানদিদার কাছে গান শিখতে যেতাম ইলেভেন-টুয়েলভে পড়ার সময়। গলা খুব তৈরি হয়নি বলে তেমন কিছু শেখা হয়নি গাইতে, কিন্তু একটু খুঁটিনাটি জেনেছি, হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত সম্বন্ধে সেই প্রথম জানা। ইউটিউব আর স্পটিফাই থেকে গান শুনি, এবার শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের জগত ও, ভারতীয় বা পাশ্চাত্য, তার স্বর্ণ ভাণ্ডার উন্মোচিত করে দিচ্ছে কানের কাছে। কৌশিকী চক্রবর্তী থেকে শুরু করে দরবার সংগঠনের ইউটিউব চ্যানেলের সূত্রে আরো বহু গুণী শিল্পীদের গান শুনতে শুরু করেছি তখন থেকে, আবার ভাতখন্ডের বই পড়ে ভারতীয় মার্গ সঙ্গীতের জগতের প্রাথমিক পরিচয় হলো। কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের "কুদরত রঙ্গিবিরঙ্গি"র পড়ার সূত্রে শোনা হল কেশরবাই কেরকার, গিরিজা দেবী, সিদ্ধেশ্বরী দেবীদের গান, পুরোনো কিশোর ভারতীর পাতায় পড়েছিলাম প্রভাতী মুখোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকার, সেই সূত্র ধরে তার পাঁচ বছর পরে প্রথম শুনলাম বেগম আখতারের গজল, তারপর আবিদা পারভিন, এ লিস্ট ক্রমশ লম্বা হবে এরপর। এখনো প্রিয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিল্পীদের তালিকায় রয়েছেন বীণা সহস্রবুদ্ধে, "গান সরস্বতী" কিশোরী আমোনকর, প্রভা আত্রে, শোভা গুর্তু, অশ্বিনী ভিঢ়ে দেশপান্ডে বা এখনকার কৌশিকী বা মহারাষ্ট্রের শাওনি শিন্ডে সেই প্রথম পরিচয়ের দিন থেকে। অন্যদিকে ওয়েস্টার্ন ক্লাসিকাল শুনি মূলত অপেরা ধরনের কম্পোজিশন বা পিয়ানো বা ভায়োলা-ভায়োলিন-চেলো- শোঁপ্যা, ভিভালডি, বাখ বা মেনুহিন- সব পরিচয় ইউটিউবের বা স্পটিফাইএর সূত্রেই। কিন্তু বিভিন্ন ধারার গান শোনার অভ্যাসটা চালু হয়েছে এই নিজস্ব ফোন পাওয়ার আগে, কম্পিউটারে সিডি চালিয়ে বা ইন্টারনেটে গান শোনার মাধ্যমেই।