এই লেখাটা প্রচণ্ড প্রাসঙ্গিক।দেখতে ‘নারী’ তার চলন বাঁকা
কারণ প্রথমত ও প্রধানত, সে নারী। মহিলা। মেয়েমানুষ। যার জায়গা ঘরে। যে বাচ্চার জন্ম দেবে, লালনপালন করবে, রেঁধেবেড়ে খাওয়াবে। দক্ষ, সফল, আত্মবিশ্বাসী নারীর নাকে যেমন করেই হোক ঝামা ঘষে দিতে পারলে বাঁচে সমাজ।
মেয়েরা সব কাজে হাত লাগাবে, বরাবর এ নিয়ে লোকসমাজের ভারী আপত্তি। মেয়ে ঋজু, স্পষ্টবক্তা, প্রতিবাদিনী হলে তাকে পছন্দ করা মুশকিল। নিজ মত প্রতিষ্ঠিত করতে চাওয়া আজও কোথাও কোথাও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তুমি মেয়ে, তুমি বোঝোটা কী। মেয়ে যদি সমাজ, রাজনীতি, কিংবা বৃহৎ প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতার অধিকারিণী হতে চায়, তবে দশহরায় রাবণ জ্বালানোর মতো ক্রোধ জন্মায় সমাজের এক বৃহৎ অংশের। ক্রোধ? না ঈর্ষা? নাকি ত্রাস?
এই জ্বলনের গন্ধ সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় ভোট এলে। প্রচারে ও অপপ্রচারে ছড়িয়ে যেতে থাকে কুৎসা, অপবাদ, খিস্তি, খেউড়, ব্যঙ্গ, অসম্মানের বিবিধ উপকরণ। নারীর প্রতি সমধিক, পুরুষের প্রতি সামান্য।
কেন? প্রথমত ও প্রধানত, সে নারী। মহিলা। মেয়েমানুষ। যার জায়গা ঘরে। যে বাচ্চার জন্ম দেবে, লালনপালন করবে, রেঁধেবেড়ে খাওয়াবে, বরের যৌনক্ষুধায় খাদ্য হবে, যে হবে সংসারী। গৃহিণী। অর্থাৎ, সমাজের এক বিশাল অংশের কাছে নারী আজও শুধুই জৈব উৎপাদন যন্ত্র, যার মূল কর্ম পুরুষের যৌনতৃপ্তি ও গর্ভধারণ।
কিংবা এখানেও নারীর প্রতি পুরুষের আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠার সব ক’টি কারণ ব্যাখ্যাত হয় না। কার হিংসার বীজ কোথায় প্রবিষ্ট, নির্দিষ্ট করে বলা যাবে না। ব্যক্তি সমাজের একক। প্রত্যেক এককে জড়িয়ে আছে পৃথক মানসিকতা, পরিবেশ, পরিবার, সংস্কৃতি, শিক্ষা। এগুলির সমষ্টিগত ফলাফল দ্বারা আচরণ নিয়ন্ত্রিত হয়। তারই কিছু লক্ষণ প্রকাশ পায় লিঙ্গমাত্রিক দর্শনে। জীবনের একেবারে গোড়াতেই মেয়েদের প্রতি যে মানসিকতা তৈরি হয়, তা পুরুষতন্ত্রের দৃষ্টি। যা দেখিয়ে ছাড়ে মেয়েরা দুর্বল, সিদ্ধান্ত নিতে অপারগ, আত্মরক্ষায় অক্ষম, পুরুষের অধীন। তা আরও শেখায়, যৌন নির্যাতন, হেনস্থা, বলপ্রয়োগ ও সন্ত্রাস— এগুলিই নারীকে নিষ্ক্রিয় করে রাখার অস্ত্র।
*****
নারীজাতি ও পুরুষজাতির মধ্যে বিভাজন ও নীতিবোধ গড়ে দেয় যে সমাজ, ক্ষমতার সমীকরণ সে কখনও ঘটতে দেয় না। সব কালেই ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির অসাম্য সমাজের কাম্য। রাজনীতি যে হেতু সমাজের ছত্রধর, সে হেতু এক জাতি শাসন করে, অপর জাতি শাসিত হয়।
শাসক-শাসিত সম্পর্কদীর্ণ রাজনীতি আছে সমাজের সব স্তরে। সব ক্ষেত্রে। নানা রূপে তার অধিষ্ঠান। গার্হস্থ ক্ষেত্রে এক রকম, শিক্ষাকেন্দ্রে আর এক, কর্পোরেটে অন্যতর, ধর্মে ভিন্ন, রাষ্ট্রচালনায় অনন্যরূপ। তবে এই সব জটিল মারপ্যাঁচ নীতির মধ্যে একটি অভিন্ন বিষয় নারী। প্রত্যেক ক্ষেত্রে মেয়েরা শোষিত, নিপীড়িত, বঞ্চিত ও ব্যবহৃত। একে বলা চলে অন্তর্লীন হিংসা। সব সময় বাইরে থেকে দেখা যায় না, বোঝা যায় না, কিন্তু রাষ্ট্র ও সমাজের শিরা-উপশিরায় তা সেঁধিয়ে থাকে। স্বার্থসাধনের লক্ষ্যে বঞ্চিত করে দুর্বল ও অনগ্রসর শ্রেণিকে, তাদের প্রাপ্য অধিকার ও উন্নতি থেকে। এবং, আজও, ভারতীয় সমাজে মহিলারা সব জাতি, সব ধর্ম, সমস্ত পিছিয়ে পড়া বর্গের মধ্যে দুর্বলতম, প্রবঞ্চিত জাতি। নারীজাতি।
কতিপয় নারী প্রাগ্রসরের আলোকিত আত্মনির্ভর স্বাধীন পথের অধিকারিণী হলে, তাঁরা যে দুর্বলের মধ্যে দুর্বলতম হয়ে নেই আর, এই সত্য মেনে নিতে বহু জনে নিজের মধ্যে নিজেই প্রতিবন্ধক হয়ে ওঠেন। দক্ষ, সফল, আত্মবিশ্বাসী নারীর নাকে যেমন করেই হোক ঝামা ঘষে দিতে পারলে বাঁচেন তাঁরা।
এমন অপ্রত্যক্ষ, অন্তর্লীন হিংসা অনেকটাই চাপা, অনুদ্ঘাটিত, অগ্রন্থিত, কারণ সমাজ এমন ভাবেই ভাবিয়েছে যাতে শরীরে মারের দাগ না পড়লে হিংসার অস্তিত্ব নেই বলেই মনে করা হয়। অথচ হিংসা অতি জটিল বস্তু। তার প্রকৃতি নির্ণয় ও প্রমাণ অত্যন্ত কঠিন। কখনও কখনও অসম্ভব। আবার হিংস্রতার কারণ খুঁজে পাওয়া একই রকম দুরারোহ। জন্মকাল থেকে পরিণত বয়ঃক্রম পর্যন্ত মানবশিশুর যে জীবনযাপন— আঘাত, অবহেলা, দুঃখ, সুখ এবং জিনবাহিত গুণাগুণ তার হিংস্রতার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। যে হিংসা নারীকে শরীরে মনে আঘাত করে, সেই হিংসা নিজেও সুখী নয়। কিন্তু হিংসা, প্রভুত্ব, রিরংসার দ্বারা তৃপ্ত হতে পারলে নিজস্ব সুখহীনতা, ক্ষোভ, হতাশা ভুলে থাকা যায়। চরিতার্থ হয় পৌরুষের অর্থহীন অহঙ্কার।
ক্ষমতায়নের এই জটিল ও বিচিত্র সূত্রে নিজের সুবিধা অনুযায়ী অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ার পর কখনও যদি অভ্যাসের খোলে নতুনত্ব টোকা দেয়, দুর্বার হয়ে ওঠে ত্রাস। ত্রাসের কারণের প্রতি আসে ক্রোধ, ঘৃণা, হিংসা। মানুষ সব সময় বুঝতেও পারে না, ব্যক্তিগত জীবনও নিয়ন্ত্রিত হয় ক্ষমতারঞ্জিত সম্পর্কের দ্বারা। তার মধ্যে লিঙ্গ-রাজনীতি ও যৌনতা নানা ভাবে কলকাঠি নাড়ে। কারণ, আজও পর্যন্ত, সমাজের যে বিন্যাস, তার মধ্যে মানবশিশু প্রথম বুঝে নেয় নিজের লিঙ্গভিত্তিক পরিচয়। যত ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক নিয়মকানুনের মধ্যে দিয়ে সে যায়, যত আদবকায়দা দেখে শিক্ষা নেয়, তার সবটাই লিঙ্গভিত্তিক রচনা। এই চেতনা পরিবাহিত হতে থাকে সামাজিক পরিচিতি পর্যন্ত। এর মধ্যেই পুং ও স্ত্রীজাতির দেনাপাওনার তালিকা নির্ধারিত হয়ে যায়। শুধুমাত্র পুং লিঙ্গবিশিষ্ট হয়ে জন্মেছে বলেই বহু জন নিজেকে শক্তিমান ও অহঙ্কারের অধিকারী মনে করতে পারে। ভাবতে পারে, এই পৃথিবী শুধু তারই।