আজ বিদ্যালয় হয়েই পুজোর ছুটি পড়ে গেল।বিদ্যাসাগরের ২০৬ তম জন্মদিন উদযাপনের অনুষ্ঠান শেষ করে আমার ঘরে এলাম। একমাস ছুটি। বকেয়া কাজগুলো একে একে গুছোতে হবে। ছাত্রছাত্রীরা ভিড় করে এসে শারদীয়ার শুভেচ্ছা জানিয়ে যাচ্ছে। শিক্ষকতার পেশায় এগুলোই বড় পাওনা। ছাত্রছাত্রীরা একে একে চলে যাচ্ছে। শিক্ষক শিক্ষিকারা কেহ চলে যাচ্ছে, কেহ স্টাফ রুমে বসে গল্প করছে। আমার ঘর ফাঁকা হতে দেখি বারান্দায় একজন পঞ্চাশোর্ধ মহিলা বসে আছেন। মাথায় ঘোমটা। গায়ে পুরু চাদর। পাশে একটা নাইলনের ব্যাগ।
আপনি কিছু বলবেন, জিজ্ঞেস করতেই মহিলা মাথার ঘোমটা ও গায়ের চাদর ঠিক করে ঝোলা হাতে ভিতরে প্রবেশ করলেন।
মহিলা - আমার ছোট মেয়ে এই স্কুলে পড়ে। ফরাম ভরে দিয়ে গেছে বুললো। টাকা ঢুকেছে?
আমি - কিসের টাকা বলুন। মেয়ে কোন ক্লাসে পড়ে?
মহিলা - এখন বারো ক্লাসে পড়ে। কন্যাশ্রী না কি বলছে। পঁচিশ হাজার টাকা দিবেন বলে।
আমি - বসুন আপনি। দেখছি। মেয়ের নাম কি?
মহিলা - আশমাতারা খাতুন। মেয়ে তোমার কথা বাড়িতে খুব বলে।
কন্যাশ্রী পোর্টাল খুলে দেখলাম ফর্ম আপলোড ও ফরওয়ার্ড করা হয়েছে। এখনও বিল জেনারেট হয়নি।
আমি - আসমাতারার ফর্ম পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। টাকা অ্যাকাউন্টে ঢুকে যাবে। মাঝে মধ্যে ব্যাঙ্কে গিয়ে পাশবই আপডেট করে দেখবেন।
মহিলা - টাকাটা আমার হাতে দিও বাপ। সেকথা বলার জন্যই আরও আনু।
আমি - টাকা হাতে দেওয়ার তো ব্যবস্থা নাই। আপনার মেয়ের অ্যাকাউন্টে ঠিক ঢুকে যাবে।
মহিলা - আমরা কেহ জানতু না, তখন মোবাইল কেনার দশ হাজার টাকা দিয়েছ। সেই টাকা হাতে পেয়ে মেয়েতে মোবাইল দুকানে ছুটল। ওঁর বাপ, আমি এত বারণ করনু, শুনল না। পিড়ের সমান মোবাইল কিনে ঘরে আনলো।
আমি : বড় অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল । মেয়ে খুব খুশি!
মহিলা : সে মোবাইল হাতে লিয়ে কি ত্যালছিটানি বাপ। মোবাইল লিয়ে খেছে, মোবাইল লিয়ে ঘুমাছে, একবার গান শুনছে, একবার লাচ্ছে। রাতদিন তেলেসমাতি করে বেড়াচ্ছে।
আমি - কেন, পড়াশোনা করছে না? সরকার তো পড়াশোনা করার জন্যই মোবাইলের টাকা দিয়েছে।
মহিলা - মোবাইল দিয়ে সর্বনাশ করেছ তোমরা। মেয়ে আমার সকাল বিকাল পড়তে বসত। দশ কেলাসে আশি আশি করে নম্বর পেয়েছিল। ঘোষপাড়ার রবিন পড়াতো। ঐ মোবাইল হাতে পেয়ে সব লষ্ট করে ফেলল।
আমি : বারণ করেন না? এত মোবাইল ঘাটলে পড়াশোনা করবে কিভাবে?
মহিলা : ওরে আল্লা, সে আবার বলি না? শুনলে তো। বই একজায়গায়, খাতা একজায়গায় পড়ায় সে ভক্তি নাই। টাকাটা আমার হাতে দিও বাপ। মেয়ে আর ঘরে রাখবো না। তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দিব।
আমি : পড়া শেষ করার আগে বিয়ে দিবেন কেন? সামনে পরীক্ষা আছে। পড়াশোনা করুক।
মহিলা : শোনো বাপ, আমি মা, সব বুঝি। মেয়ে সারারাত মোবাইলে কার সাথে ফুসুর ফুসুর গুজুর গুজুর করে। বাড়িওয়ালা কানে খাটো। কিছু বুঝে না। আমার মানসম্মান কখন মাটিতে মিশিয়ে দিবে।
আমি : কন্যাশ্রীর ক'টা টাকায় বিয়ে হবে কিভাবে?
মহিলা : হবে বাপ। ঘরে একটা গাই গোরু ছিল। দুবার পাল লিল, ভরণ হলো না। ও গাই বেচে দিয়েছি। টাকা ক'খান খরচ করিনি। এই টাকাটা পেলেই বিয়ে লাগাবো। ওতে খানাপানি হয়ে যাবে।
আমি - সরকার কন্যাশ্রীর টাকা দিচ্ছে মেয়েদের পড়াশোনা করার জন্য। আপনি বলছেন টাকা হাতে পেলেই বিয়ে দিব। বাড়ির কাছে কলেজ। মেয়েকে কলেজে পড়াবেন। এত সুযোগ কোথায় পাবেন।
মহিলা - সে ওঁরা পড়ালে পড়াবে। আমাদের আপত্তি নাই। মেয়ে ঘরে রাখা যাবে না বাপ। দিনকাল খারাপ। মোবাইলে আমার মেয়ে লষ্ট হয়ে গেছে।
আমি - ছেলে দেখেছেন নাকি? কোথাকার ছেলে?
মহিলা - পাশের গাঁয়ের। বাপবেটা কাঠের কাজ করে। পরহেজগার। খুব ঠাণ্ডা ছেলে। মনে মনে দেখাশোনা করে রেখেছি। টাকাটা আমার হাতে দাও না বাপ। খুব ভালো হয়। মেয়ে ও টাকা হাতে পেয়ে কি করবে ঠিক নাই। ভয় লাগে খুব। আমার বাপ মোড়ল ছিল। পাঁচ গাঁয়ের বিচার করত। ছয় মেয়ের বিয়ে দিতে দিতে বাপ ফকির হয়ে গেল। ভালো ঘরে আমার বিয়ে দিতে পারলো না। ঐ ঠসা বহরা লিয়ে সংসার করনু। এই মেয়ের বিয়ে দিতে পারল বাচি। কোন ছোঁড়ার সাথে কি করে বসে, ঠিক নাই।
আমি - এত ভয় পাচ্ছেন কেন? আপনার মেয়ে পড়াশোনায় ভালো। নিজের ভালোমন্দ নিশ্চয় বোঝে। টাকাটা মেয়ের অ্যাকাউন্টে ঢুকবে, সেটাই নিয়ম। হাতে দেওয়ার কোনো ব্যবস্থা নাই। আমাকে ভুল বুঝবেন না। এক দুমাসের মধ্যে ঢুকে যাবে। মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট চেক করবেন। টাকা ঢুকে গেলে মেয়েকে বুঝিয়ে সুজিয়ে আপনার হাতে নিবেন।
মহিলা : হাঁটুতে খুব দরদ হয়েছে। উঠতে বসতে জান বেরিয়ে যেছে। হাসপাতালে ওষুধ লিয়ে বাড়ি যাব। বসো বাপ।
মহিলা মাথার ঘোমটা টেনে, গায়ের চাদর ঠিক করে ঝোলা হাতে চলে গেলেন। মাথার মধ্যে সরকার, শিক্ষা, বিয়ে, কন্যাশ্রী, বিষয়গুলো কিলবিল করতে লাগলো। "মোবাইল দিয়ে সর্বনাশ করেছ তোমরা"। মহিলার সরাসরি অভিযোগে রক্তাক্ত হতে থাকলাম। মনে হলো চিৎকার করে সরকারের প্রতি ধিক্কার জানাই।
ধন্য শিক্ষাব্যবস্থা!
লিখেছেন শ্রদ্ধেয় প্রধানশিক্ষক আবদুল হালিম বিশ্বাস।