এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • ভালোবাসা / কাকের বাসা

    সবিতা সেন
    ২৯ অক্টোবর ২০২৪ | ১১৭ বার পঠিত | রেটিং ২.৫ (২ জন)
  • ভালোবাসার কিস্‌সা শুরু করার সময় নিজেকে দিয়ে শুরু করাই শ্রেয়। আমি তখন কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী – সবে শাড়ী। চারিদিকে নতুন অভিজ্ঞতার দিশা। সেই উতলা বেলায়, জীবনের প্রথম প্রেমপত্রটি পেয়েছিলাম সরাসরি প্রেমিকের হাত থেকে। ছেলেটি ধর্মে মুসলমান – একগাল দাড়ি, যেন ইতিহাস বইয়ের পাতা থেকে নেওয়া। স্বপ্নালু দুটি চোখ। আমারই কলেজের ছাত্র। চিঠিটি সুলিখিত। উদ্ধৃতিগুলি ব্যাতিক্রমীভাবে রবীন্দ্রনাথ নয়। ওমর খৈয়াম থেকে নেওয়া। আমার তৎকালীন উত্তেজনার কথা কহতব্য নয়। বাড়ীর চাকর মধুদা বাদে, আর সকলের হাত ঘুরে সেই চিঠি গিয়ে পড়লো আমার বাঘের মতো বাবার হাতে। বাকিটুকু আশাকরি বর্ণনার অপেক্ষা রাখে না। আমার প্রথম ভালোবাসার চারাগাছটি জল, মাটি না পেয়ে বেঘোরে মারা পড়লো।
    এই ঘটনার পর, খাব সাবধানী হয়ে গেলাম। প্রেমের সামান্যতম সম্ভাবনা থেকেও আমি সাত হাত দূরে। কিন্তু এমনই ভালোবাসার লিখন, যে আমি শেষ পর্য্যন্ত একজন বঙ্গসন্তানকে – প্রেমজ বিবাহ করি, এবং আমার বাবা নিজের হাতে আমাকে সম্প্রদান করেন। দীর্ঘ জীবনে অজস্র মানুষের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি। তাদের কথা, কাহিনী, যন্ত্রণা, সুখ – আমাকে অনেক অভিজ্ঞতা দিয়েছে, আলোড়িত করেছে। তাদের কথা বলতেই এই লেখা।
    প্রবচন বলে, ‘‘কানু বিনা গীত নাই’’। এখানে ‘কানু’ কথাটি, ভালোবাসার প্রতিশব্দ। জীবনের চালিকা শক্তি এই ভালোবাসা বা প্রেম। এই প্রেম মানুষের প্রতিভার স্ফূরণ ঘটায়, শিল্পী সাহিত্যিকের রচনা সার্থক করে তোলে। বড় ত্যাগ করতে শেখায়। মানুষকে দেয় শান্তি, গার্হস্থ্যসুখ, সন্তান – অমৃতের পুত্রদের ধারাবাহিকতা।
    কিন্তু সমুদ্র মন্থনের সময় অমৃতের সঙ্গে, হলাহলও উঠেছিল। প্রেম কোথাও কোথাও হলাহল হয়ে ওঠে। তাই উল্টোছবিটাও উল্লেখযোগ্য। গীতিকার সখেদে বলছেন, ‘‘কারা সেই সব ভাগ্যবানেরা যারা ভালোবাসা দিয়ে ভালোবাসাই পায়। আমি তো কেবল কাঁটার আঘাতই পেলাম।’’ শরৎবাবুর দেবদাসের গল্পও তো একই রকমের করুণ। দেবদাস বোঝেইনি প্রেম জিনিসটা কোথায় থাকে – মাথায় না বুকে! তীব্র না পাওয়ার বেদনায় প্রেমিকাকে আঘাত করেছে, নিজেকে হয়রান করেছে, তবু প্রেম এলো না। ওর আহত হৃদয়ের অবুঝ তোলপাড় আজও পাঠককে উতলা করে। এই গল্প নিয়ে বাংলা, হিন্দি দুই ভাষাতেই বহু চলচ্চিত্র তৈরী হয়েছে – ভবিষ্যতে হয়তো আরও হবে!
    আসলে প্রেম বস্তুটা ঠিক বোঝার জন্য নয়। এ এক আজব অনুভবের গজব পরিণতি। ডাক্তারী শাস্ত্র বলে এটা নাকি মানব শরীরে বিশেষ কিছু হরমোনের খেলা। যাদের শরীরে এই হরমোন বেশী থাকে, প্রেম তাদেরকে সারাজীবন জ্বালিয়ে মারে। আমার এতো স্পর্ধা নেই যে কলম হাতে পেয়েছি বলেই প্রেমের dissection করতে শুরু করবো। মোদ্দা কথা হলো, প্রেমে পড়তে বড়ো ভালো লাগে। প্রেমে ল্যাং খেলে বড্ড কষ্ট হয়, আরেকটা প্রেম না আসা পর্য্যন্ত।
    আমাদের দেশে প্রেমের দেবতা হচ্ছেন রাধা-কৃষ্ণ যুগল। স্বামী-সঙ্গ বঞ্চিতা সুন্দরী রাধার প্রেমে পড়লো দুর্দান্ত স্বভাবের কিশোর কৃষ্ণ। বেশ কিছুদিন চললো প্রণয়লীলা – বিরহ মিলন পর্ব। ইতিমধ্যে কৃষ্ণ যুবক হয়ে উঠেছে। তাকে এবার জীবনযুদ্ধে যোগ দিতে পাঠানো হোলো, মথুরা নগরীতে – কংস বধের project দিয়ে। কৃষ্ণ মেতে উঠলো জীবনের প্রথম project নিয়ে। এদিকে শ্রীমতী রাধিকার তো বিরহানলে প্রাণ যায়। যমুনাতীরে একা একা মন খারাপ করে ঘুরে বেড়ায়, বিরহিনী। অবস্থা ক্রমেই সঙ্গীন হয়ে উঠলো। সুবল-সখাকে শ্রীরাধিকার দূত হিসাবে পাঠানো হোলো মথুরা নগরীতে – নিঠুর কৃষ্ণ ব্রজধামে কবে ফিরবে তা জানতে। শ্রীকৃষ্ণ, যিনি প্রেমিক চূড়ামণি হিসাবে পূজিত হন, সাফ জানিয়ে দিলেন যে তিনি আর ব্রজধামে ফিরবেন না। তবে এটাও ঠিক যে, তিনি শ্রীমতীকে কখনো ভুলবেন না। তাহলে ব্যাপারটা কাকের বাসাই হোলো কিনা, দরদী পাঠক বিবেচনা করবেন। ‘হা কৃষ্ণ’, বলতে বলতে শ্রীরাধার মৃত্যু হয় যমুনার তীরে। মৃত্যু পরবর্তী পুরস্কারের মতো, কালক্রমে রাধাকৃষ্ণের যুগল প্রেমকে বিভিন্ন কবি এবং পদকর্তারা অমর করে তুললেন – কাব্যে, পদাবলীতে।
    রাধাকৃষ্ণের প্রেম বিষয়ে অনেক কথা বলেছেন বৈষ্ণব পদকর্তারা। ভক্তজনের মতে, রাধা-কৃষ্ণের প্রেম-স্বর্গীয়, দেহাতীত, কামগন্ধহীন – পুরুষ ও প্রকৃতির মিলনের দ্যোতক। তবে পদকর্তা জ্ঞানদাসের পদাবলীতে শ্রী রাধার পূর্বরাগের বর্ণনায় অন্যসুর দেখতে পাই।
    শ্রীরাধার পূর্বরাগ
    ‘‘রূপ লাগি আঁখি ঝুরে, গুণে মন ভোর।
    প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর।।
    হিয়ার পরশ লাগি হিয়া মোর কান্দে।
    পরাণ-পীরিতি লাগি, থির নাহি বান্ধে।।
    কি আর বলিব সই কি আর বলিব।
    যে পণ কর‍্যাছি চিতে সেই সে করিব।।’’
    এই পদটি পাঠ করলে, শ্রীরাধাকে বেশ পরিণতমনস্ক প্রেমিকা বলেই বোধ হয়। দেহাতীত প্রেমে – দেহ এসে পড়ে সঘন আবেগ আর স্থির চিত্ততায়।
    কি গভীর আর বিনম্র আত্মনিবেদন ফুটে উঠেছে পদকর্তা চণ্ডীদাসের লেখা পদে –
    ‘‘বঁধু কি আর বলিব আমি।
    জীবনে মরণে জনমে জনমে
    প্রাণনাথ হৈও তুমি।।
    তোমার চরণে আমার পরাণে
    লাগিল প্রেমের ফাঁসি।।
    সব সমর্পিয়া একমন হৈয়া
    নিশ্চয় ইহলুঁ দাসী।।
    শ্রীরাধার প্রেমে কোন খাদ ছিলো না। ছিলো কেবল সপ্রেম বিহ্বলতা। পাতি বাংলায় যাকে বলে ঘাড় গুঁজড়ে প্রেমে পড়া। কৃষ্ণসখাও কম যান না – পদকর্তা জয়দেব তাঁর রচিত গীতগোবিন্দম্‌ কাব্যের ১১ নম্বর গীতম্‌ এ লিখেছেন –
    ‘‘রতিসুখসারে গতমভিসারে মদমনোহর-বেশম্‌।
    ন কুরু নিতম্বিনি গমনবিলম্বন মনুসর তং হৃদয়েশম।।
    ধীর-সমীরে যমুনাতীরে বসতি বনে বনমালী।
    পীনপয়োধরপরিসরমর্দ্দনচঞ্চলকরযুগশালী।।ধ্রু।।’’
    এই পদটির বিদ্যাপতি বিরচিত পদ্যানুবাদ অথবা বঙ্গানুবাদ (যদি এর ভাষাকে বাংলা বলা যায়।) :

    ‘‘বিলাসের সার যেই অভিসার
    আগুসার তায় নাগর নিজে;
    করো না বিলম্ব, ওলো নিতম্বিনি
    অনুসর সেই হৃদয়-রাজে।
    ধীর সমীরণে যমুনা-পুলিনে
    বসিয়া কেশব কানন মাঝে;
    গোপিনি-নিকর-পীন-পয়োধর
    সে চারু চিকণ করেতে রাজে।’’
    এই পদটি পড়লে মালুম হয় শ্রীকৃষ্ণও বেশ আগ্রহী প্রেমিক ছিলেন। পদকর্তারা সুন্দর ভাবে বর্ণনা করেছেন, আকাশে কালো মেঘের উদয় হলে শ্রীরাধিকা গৃহকর্ম ভুলে উন্মনা হয়ে যেতেন কৃষ্ণভাবনায়। রাতের অন্ধকারে অভিসারে যাবার সময় রাধা পায়ের নূপুর খুলে ফেলতেন পাছে কোন শব্দ হয়। কোন এক তমসা রজনীতে রাধা সঙ্কেত কুঞ্জে কৃষ্ণের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। শেষরাতে হাজির হলেন রতিক্লান্ত কৃষ্ণ সর্বাঙ্গে গোপিনী চন্দ্রাবলীর সুগন্ধ মেখে। এতো সব সয়েও শ্রীরাধা কৃষ্ণপ্রেমে অটল ছিলেন। কিন্তু শ্রীমতীকে ছেড়ে কৃষ্ণ যখন মথুরায় গমন করলেন, তখনই সিগারেটের ছাই বেরিয়ে পড়লো। কীরকম? ইংরাজী ভাষায় একটা কথা আছে – 'Love starts with fire and ends in smoke.' রাধাকৃষ্ণের প্রেমের অধ্যায়টি এই কথার যথার্থ উদাহরণ। তবে এটা এই পর্য্যন্তই থাক। কানুকথায় আরও ঢুকলে অন্যকথায় যেতেই পারবো না।
    এবার একটা অন্য গল্প বলি। এ গল্প পৃথিবীর সব দেশের অগনিত মেয়ের কষ্টের গল্প। কোন এক মফঃস্বল শহরে, একটি ধনী অভিজাত পরিবারের ছেলের সঙ্গে সাধারণ পরিবারের এক মেয়ের প্রণয় সঙ্ঘটিত হোলো। ছোট শহরে, চারদিক কাঁপিয়ে সেই ঘটনার চর্চা শুরু হোলো। অভিজাত পরিবার এই অসম বিয়েতে অরাজী। প্রেমিক যুগল অগত্যা বাড়ী থেকে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে সংসার পাতলো। কিছুদিন বাদে ওদের একটি পুত্র সন্তান জন্ম নিলো। এবং এর কিছু দিন পরেই অবস্থা বদলাতে শুরু করলো। অভিজাত তনয় তার স্ত্রীর প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে ফেলতে লাগলো। সন্তানের যখন তিন বছর বয়স, স্বামীর মারধরে অতিষ্ঠ হয়ে মেয়েটি বাচ্চাকে নিয়ে বাপের বাড়ী চলে আসে। বাবা ততোদিনে গত হয়েছেন, তাই সেখানে জায়গা হোলো না। তাই মেয়েটি এসে দাঁড়ালো শ্বশুর বাড়ীর দরজায়। নাতির মুখ দেখে আশ্রয় দিলো শ্বশুর বাড়ী। মেয়েটি নতুন করে ভর্তি হলো স্কুলে – পড়াশুনা শুরু করলো।
    এর পর বেশ কিছুদিন আমার যোগাযোগ ছিলো না মেয়েটির সঙ্গে। হঠাৎ খবর পেলাম, মেয়েটি গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দিয়ে নিজেকে পুড়িয়ে মেরেছে। সেই চিরকালীন ভালোবাসার চিতাভস্ম।
    বিখ্যাত রাশিয়ান লেখক দস্তয়ভ্‌স্কি ছিলেন এক গ্রাম্য জমিদারের ছেলে। সেই সময় ইওরোপ জুড়ে ক্ষয়রোগ বা টিবির তাণ্ডব চলছে। দস্তয়ভ্‌স্কি ক্ষয়রোগে আক্রান্ত হন। চিকিৎসায় খানিকটা সুস্থ হবার পর – ডাক্তাররা বায়ু পরিবের্তনের পরামর্শ দিলেন। জমিদারীর প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেখনে বায়ু নির্মল, লোকজনেরা সহজ সরল, সেখানে দস্তয়ভ্‌স্কিকে পাঠানো হোল স্বাস্থ্যোদ্বারের জন্য। প্রজারা খুব আনন্দিত নবীন জমিদারের পুত্রের আগমনে এবং আন্তরিকতাপূর্ণ ব্যবহারে। গ্রামের প্রতিটি যুবতী মেয়ে বল নাচে কি পোষাক পরবে, সে চিন্তায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো। দস্তয়ভ্‌স্কি সবার প্রতি সদয়, কিন্তু ছেলেটির নজর কাড়লো এক জেলের মেয়ে। সেই মেয়ের কোমল লাবণ্য ভরা সৌন্দর্য্য, প্রেমের আকুলতা – সব জমিদার তনয়কে মুগ্ধ করলো। তর তর করে এগোতে লাগলো প্রেমের শাম্পান। এই অসম ভলোবাসার বার্তা পৌঁছে গেলো জমিদারমশাই এর কানে। চিন্তিত পিতা অনেক ভেবে চিন্তে ছেলেকে বললেন ‘‘এখন তো তুমি সুস্থ হয়েছো। এবার তোমাকে উচ্চশিক্ষার জন্য প্যারীতে যেতে হবে।’’ তাই সিদ্ধান্ত হোলো।
    এই সংবাদে পুরো গ্রাম বিষাদে আচ্ছন্ন হয়ে গেলো। যাবার আগে জমিদারতনয় সব মেয়েদের কথা দিলেন, আবার ফিরে আসবেন এখানে। জানতে চাইলেন কার জন্য কি উপহার নিয়ে আসবেন। সব মেয়েরা উচ্চগ্রামে জানালো তাদের উপহারের আব্দার। মুশকিল হোলো ধীবর কন্যাকে নিয়ে। তাকে যাই প্রশ্ন করা হয়, সে তো খালি কাঁদে। কেঁদে ভাসায়। অনেক বোঝানোর পরে রুদ্ধ স্বরে বললো –
    ‘‘তুমি তো আমার হাতে চুমু খেতে ভালোবাসো কিন্তু আমার হাত থেকে মাছের গন্ধ যে যায় না। আমার জন্য একটা সুগন্ধি সাবান এনো।’’
    তারপর কতো বসন্ত চলে গেলো – হায়, সে তো আর ফিরলো না। পড়ে রইলো সিগারেটের ছাই।
    আমাকে এতক্ষণে পাঠক নিশ্চয় কট্টর নারীবাদী ভাবতে শুরু করছেন। ব্যাপারটা ঠিক তা নয় আসলে। মানব সমাজে যতো অশ্রুপাত হয়, অধিকাংশই প্রেমঘটিত। যতো প্রেমের সূচনা হয়, তার বেশীর ভাগ মাঝপথে বিলীন হয়ে যায়। যে কটি বিয়ের ফাঁদ পর্য্যন্ত পৌঁছায় সেখানে তৈরী হয় প্রেমের সমাধি। কথাটা আমার নয় – বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কলমে পেয়েছি। তবু দেবদাসের দুঃখে আমাদের বুকে ফাটে। পদকর্তার কথায় –
    `‘‘সুখের লাগিয়া যে করে তিয়াস,
    দুঃখ যায় তারি ঠাঁই।’’
    এবার কাকের বাসা বিষয়ে কিছু বলতে চাই। এতে পঞ্চশরের ভূমিকা আছে। কিন্তু প্রেম সর্বদা একবগ্‌গা তিরন্দাজীর নিশানায় চলে না। একাধিক মহিলা একই পুরুষকে ভালবাসলে, অচিরেই প্রেমের উপবনটি কাকের বাসায় পরিণত হয়। যাচ্ছেতাই কোন্দল এবং অধিকারবোধ হৃদয়ের জমির দখল নেয়।
    যদি একজন সুন্দরীর প্রেমে একাধিক পুরুষ আসক্ত হন এবং যদি উভয়েই যথেষ্ট বলশালী হন – তাহলে তর্জন, গর্জন, লড়াই, রক্তপাত – সব মিলিয়ে কাকের বাসার চেয়েও খারাপ অবস্থা হবে।
    চাঁদের একপিঠের মতো এতোক্ষণ কেবল মাত্র মেয়েদের বঞ্চনার কথা বলা হয়েছে। এর উল্টো দিকটিও ভাবা দরকার। বহু সময় এমনটাও হয়ে থাকে, কোন সরল হৃদয় পুরুষ কোন মক্ষীরানীর প্রেমে নিজেকে হারিয়ে ফেলে। ছলাকলাকে ভালোবাসা ভেবে নিয়ে, নিজের মনে স্বর্গখেলনা তৈরী করে। মক্ষীরানীর নিজের প্রয়োজন ফুরালে, রিক্ত পুরুষকে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। সেও তো কম বেদনার নয়। যারা বাংলা সাহিত্যের অনুরাগী, বিনয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের ওরফে যাযাবরের লেখা ‘দৃষ্টিপাত’ পুস্তকটি নিশ্চয়ই পড়েছেন। সেই উপন্যাসের শেষ কয়েকটি লাইন উদ্ধৃত করছি – ‘‘প্রেম জীবনকে দেয় ঐশ্বর্য্য, মৃত্যুকে দেয় মহিমা। কিন্তু প্রবঞ্চিতকে দেয় কি? তাকে দেয় দাহ। যে আগুন আলো দেয় না, অথচ দহন করে, সেই দীপ্তিহীন অগ্নির নির্দয় দহনে পলে পলে দগ্ধ হলেন কাণ্ডজ্ঞানহীন হতভাগ্য চারুদত্ত আধারকার।’’’
    লেখক আর এক জায়গায় বলেছেন, ‘‘যে নারী, প্রেম তার পক্ষে একটা সাধারণ ঘটনামাত্র, আবিস্কার নয়, যেমন পুরুষের কাছে। মেয়েরা স্বভাবতঃ সাবধান, তাই প্রেমে পড়ে তারা ঘর বাঁধে। ছেলেরা স্বভাবতই বেপরোয়া, তাই প্রেমে পড়ে তারা ঘর ভাঙ্গে। প্রেম মেয়েদের কাছে একটা প্রয়োজন। তাতে না আছে বিস্ময়, না আছে উচ্ছ্বলতা। প্রেম ছেলেদের পক্ষে জীবনের দুর্লভ বিলাস, গরীবের ঘরে বেনারসী শাড়ীর মতো ঐশ্বর্য্যময়, যে পায় সে অনেক দাম দিয়েই পায়। তাই প্রেমে পড়ে একমাত্র পুরুষেরাই করতে পারে দুরূহ ত্যাগ এবং দুঃসাধ্যসাধন।’’ এইসব ত্যাগ তপস্যার পরেও কিন্তু পড়ে থাকে ‘কাকের বাসা’। এই প্রসঙ্গে আর একজন চারু দত্তের কথা মনে পড়ছে। শূদ্রক রাজার রচিত ‘মৃচ্ছকটিক’ নাটকে দেখতে পাই, উচ্চশিক্ষিত, সম্ভ্রান্ত পুরুষ চারুদত্ত, বসন্তসেনা নামে একজন নগরনটীর প্রেমে পড়ে, শূলে মৃত্যুর মুখোমুখী হয়েও বেঁচে যান ভাগ্যক্রমে।
    প্রথম প্রেমে ব্যর্থ দেবদাস জীবনে না পেলো ভালোবাসা, না পেলো সংসার। প্রদীপের আলোয় আকৃষ্ট পতঙ্গের মতো বারাঙ্গনার প্রেমে ধাবিত হয়েছিলো – তাকেও পায়নি। শেষ পর্য্যন্ত প্রথম প্রেমের অট্টালিকার সামনে, দেবদাস একটি গরুর গাড়ীতে হতভাগ্যের মৃত্যু বরণ করে। মুখে জল দেবারও কেউ ছিলো না অন্তিম কালে -
    ‘‘আশার ছলনে ভুলি’
    কি ফল লভিনু হায়!’’
    আমি প্রেমের বাবদে এতক্ষণ যা যা বললাম, এগুলো সবাই জানে। তবু মানুষ প্রেমে পড়ে, কবিতা লেখে, চাঁদের দিকে বিভোর হয়ে চেয়ে থাকে এবং বিফলে পস্তায়।
    তবু ভালোবাসা জেগে থাকে বসন্ত বাতাসে, গোধূলির অস্তরাগে, শ্রাবণের কালো মেঘে, বৃষ্টির অঝোর ধারায়, মনের আনাচে কানাচে, হৃদয়ের গভীরে। কতো না শত্রু প্রেমের – যতো প্রেমহীন মানুষ, অতি কঠোর অভিভাবক, ঈর্ষা পরায়ণ পাড়াপড়শী, কালের অমোঘ গতি, এরা মহাপরাক্রমে প্রেমের ক্ষতি করতে চায়। তবু প্রেম জেগে রয়। প্রেম মৃত্যুহীন।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • বিপ্লব রহমান | ০৪ নভেম্বর ২০২৪ ০৬:৫১539090
  • অসংখ্য গল্পের প্লট ঠাসাঠাসি করে যেন এক বয়ামে ভরা, পড়তে হাঁফ ধরে যায়। 
     
    বিভিন্ন পর্বে রয়েসয়ে লিখতে পারতেন ভাই। শুভ 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। হাত মক্সো করতে মতামত দিন