(এর লেখক আহমাদ ইশতিয়াক। লেখাটি ফেসবুকে প্রকাশিত। আমি শুধু এখানে ভাগ করে নিলাম মাত্র।)
অভিমান কতোটা প্রকট হয় দেখেছিলাম শিবনারায়ন দাসের কাছে।.
গত বছরের জুন মাসের শুরুর দিকের কথা। এক সকালে হঠাৎ মনে হলো যদি জাতীয় পতাকার নকশাকার শিবনারায়ণ দাসের সঙ্গে দেখা করা সম্ভব হয় তাহলে তাঁর সঙ্গে দেখা করে কিছুক্ষণ কথা বলে একটি সাক্ষাৎকার নিয়ে নিবো।
.
কিন্তু আমার জন্য সবচেয়ে ঝক্কির বিষয় ছিলো এটি যে, আমি তাঁর বাসা চিনিনা। আবার তাঁর ফোন নাম্বারও কারো কাছে নেই। কয়েকজন বন্ধু মারফতে কেবল এটাই জানলাম মানুষটি মনিপুরীপাড়ার একটি ভাড়া বাড়িতে পরিবার সমেত থাকেন।
.
কিন্তু মনিপুরী পাড়ায় তো হাজারের উপর বাড়ি। তিনি কোন বাড়িতে থাকেন এটি কি করে বের করবো! জানা নেই কিছুই। কেবল ভাবনা যদি কোনভাবে তাঁর সঙ্গে দেখা করার একটা সুযোগ মিলে। সেই চিন্তা থেকেই গেলাম মণিপুরীপাড়ায়। কয়েকজন বয়স্ক লোককে জিজ্ঞেস করলাম, সবার প্রতিউত্তর একটাই, এমন নামে তো কাউকে চিনিনা।
.
হঠাৎ মনে হলো আমি এলাকার সিকিউরিটি ইনচার্জের সাহায্য নিচ্ছিনা কেন! কারণ সিকিউরিটি ইনচার্জ হয়তো জানতে পারে। মণিপুরী পাড়ার সিকিউরিটি ইনচার্জকে ফোন দিয়ে পরিচয় বলে তাঁর নাম জানিয়ে বললাম যদি ফোন নাম্বার বা বাসার ঠিকানাটা পাওয়া যায়। সিকিউরিটি ইনচার্জ বললেন, ফোন নাম্বার আমার কাছে নেই, তবে বাসার ঠিকানাটা দিতে পারি। তিনি তো বাসা থেকে তেমন বের হননা। কারো সাথে দেখাও করেননা কথাও বলেন না। কারো সাথেই যোগাযোগ নেই। অতঃপর সিকিউরিটি ইনচার্জ মারফত বাসার ঠিকানাটা পাওয়া গেল।
.
ঠিক তখনই লোডশেডিং শুরু হওয়ায় এক ঘণ্টা তিনি যে বিল্ডিংয়ে থাকেন সে বিল্ডিংয়ের চারপাশে ঘুরঘুর করলাম। বিদ্যুৎ আসতেই বিল্ডিংয়ের সিঁড়ি বেয়ে উঠলাম চতুর্থ তলায়। মনে তখন ধুকধুক করছে। যদি একটাবার তাঁর সঙ্গে দেখা হয় তবে কি প্রথমে কি করবো তাই ভাবছি। ভাবলাম প্রথমে তাঁর পা ছুঁয়ে সালাম বা নমস্কার জানাবো।
.
চারতলায় উঠে কলিংবেল টিপতেই ভিতর থেকে প্রশ্ন এলো ' কে এসেছেন ? আপনি কে?' বললাম, 'একটা প্রয়োজনে আপনার সঙ্গে কথা বলতে এসেছি।'
.
জবাব পেয়ে দরজা খুলেই বললেন ‘কি প্রয়োজন? কোথা থেকে এসেছেন?’ বললাম, ‘অমুক পত্রিকা থেকে এসেছি একটা বিশেষ দরকারে। তিনি বললেন 'কি দরকার?' আমি বললাম, 'যদি অনুমতি দেন তো একটু আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাই।’ তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে এবার আপনি আসতে পারেন।’
.
বললাম, ‘ভিতরে আসবো?’ পুরোটা বলার আগেই আমার মুখের উপর দিয়েই দড়াম করে তিনি দরজা বন্ধ করে দিয়ে ভিতর থেকে ছিটকিনি লাগিয়ে বললেন, ‘আপনি চলে যান। আমি এসব বিষয়ে কথা বলিনা।'
.
আমার তখন কী যে অনুভূতি হয়েছিলো তা আমি আসলে ভাষায় বর্ণনা করতে পারবো না। আমার দেশটির উপর তীব্র ঘৃণা জন্মালো। মনে হলো আমি মাটি খুঁড়ে তখনই ঢুকে পড়ি। কিংবা মরে যাই। আর তীব্র এক লজ্জাবোধ আমাকে চরমভাবে গ্রাস করলো। তিনি শিবনারায়ণ দাস যাকে আমরা সামান্য স্বীকৃতিটুকু দিতেও চরম কার্পণ্য করেছি।
.
তিনি সেই শিবনারায়ণ দাস যার নকশাকৃত পতাকা আমরা গোটা মুক্তিযুদ্ধকালে ব্যবহার করেছি। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময় তাঁর নকশা করা পতাকাতেই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছেন মুক্তিযোদ্ধারা।
.
দেশ স্বাধীনের পর সে পতাকা থেকে মানচিত্র ছিঁড়ে তুলে পটুয়া কামরুল হাসানকে নিয়ে আমরা পতাকা সংশোধন করিয়ে শিবনারায়ণ দাসকে ইতিহাস থেকে পুরোপুরি মুছে দিয়েছি। মূল পতাকার নকশা করেও আজ অব্দি কোন প্রকার স্বীকৃতি পাননি শিবনারায়ণ দাস।
.
তিনি সেই শিবনারায়ণ দাস যিনি ১৯৭০ সালে ছিলেন কুমিল্লা জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং কেন্দ্রীয় ছাত্রনেতা। ডাকসাইটে এই ছাত্রনেতা মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গণেও প্রাণ বাজী রেখে যুদ্ধ করেছেন। তাঁর স্ত্রী গীতশ্রী চৌধুরীও নিজেও ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা।
.
তাঁর বাবা শহীদ বুদ্ধিজীবী চিকিৎসক সতীশচন্দ্র দাস মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়ার পরেও শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে স্বীকৃতিটুকুও পাননি।
.
কেন তাঁদের অভিমান হবেনা বলতে পারেন? কেন তাঁর আমাদের উপর রাগ হবেনা? আমার ভাগ্য ভালো যে তিনি আমার মুখের উপর দরজা আটকে চলে যেতে বলেছিলেন। অন্তত জুতাপেটা করেননি।
.
শিবনারায়ণ দাসের সঙ্গী ছাত্রনেতারা মন্ত্রী হয়েছেন, নেহাতই হয়েছেন এমপি। কেউ পেয়েছেন দলের সর্বোচ্চ পদ, রাজপথে পাজেরো হাঁকিয়ে বেড়িয়েছেন। এটি হওয়াটাই তো স্বাভাবিক ছিল। কারণ তাঁদের ত্যাগের ফলেই তো নির্মিত এই স্বদেশ। অথচ শিবনারায়ণ দাসকে আজ ধুঁকে ধুঁকে শ্বাসকষ্টে ভুগতে হয়।
.
আজ শিবনারায়ণ দাস একটি ভাড়া বাসায় আশ্রয়ী হয়ে থাকেন। সেই বাড়ির প্রতিবেশীদের কাছেই শুনেছি চিকিৎসা করতে হলে আজো চারবার করে ভাবতে হয় শিবনারায়ণ দাসকে।
.
শিবনারায়ণ দাস যেন আজ এক বিস্মৃত ইতিহাস। যাকে আমরা স্রেফ ভুলে গেছি। আমাদের এক অনন্য কারিগরকে আমরা স্রেফ উচ্ছেদ করেছি। পাঠ্যপুস্তকে জাতীয় পতাকার ইতিহাস লেখা হয়েছে তাঁকে বাদ দিয়েছি।
সর্বত্র জাতীয় পতাকার ডিজাইনার হিসেবে পটুয়া কামরুল হাসানের নাম। নেই কোথাও শিবনারায়ণ দাসের নাম।
.
এসব ক্ষোভ অভিমান আর প্রচণ্ড কষ্টবোধ থেকেই পুরোপুরি নিভৃতচারী হয়ে গিয়েছিন শিবনারায়ণ দাস। প্রচার বিমুখ শিবনারায়ণ এড়িয়ে চলেছেন সমস্ত কিছু।
.
এই মানুষটিকে পদে পদে আমরা অপমান করেছি। লাঞ্ছিত করেছি, অপদস্ত করেছি। কিন্তু এরপরেও কি আমাদের বিন্দুমাত্র আত্মসমালোচনা হবেনা? এভাবেই শিবনারায়ণ দাস চলে গেছেন। আমরা কখনোই তাঁকে স্পর্শ করার সুযোগটুকুও পাইনি।
.
আজ সকালে চির ঘুমের দেশে পাড়ি জমালেন শিবনারায়ণ দাস। আমৃত্যু শিবনারায়ণ দাস সেই অভিমানটুকু জিইয়ে রেখেছিলেন।
.
কেনইবা রাখবেন না, আমাদের ইতিহাসের অনন্য সেই কারিগরকে যে আমরা তীব্র অবহেলিত, অবাঞ্চিত করে রেখেছিলাম। কি অদ্ভুত আমাদের জাতিগত বৈশিষ্ট্য ভাবতেই ভীষণ লজ্জা লাগে।
আজ মৃত্যুর পর হয়তো শিবনারায়ণ দাস পুষ্পস্তবক পাবেন। তাঁর কফিন হয়তো ফুলে ফুলে ঢেকে যাবে। নানাজন নানা বিবৃতি দিবে। প্রধানমন্ত্রী কিংবা মন্ত্রীরাও শোকবার্তা পাঠাতে পারেন। কিন্তু মৃত্যুর আগে যে শিবনারায়ণ দাস ধুঁকতে ধুঁকতে বেঁচেছিলেন, সেই হিসেব টার কি হবে? হয়তো কখনো শিবনারায়ণ দাস মরণোত্তর রাষ্ট্রীয় পদক পাবেন, তাতে আদৌ শিবনারায়ণ দাসের কি হবে?
বেঁচে থাকতে যে মানুষটিকে আমরা মূল্যায়ন করিনি, স্রেফ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিতেও কার্পণ্য করেছি, সেই মানুষটার সামান্য পচা ফুলের স্তবকে কি আসে যায়?