একটি আধুনিক তঞ্চকতা
কাঁটা গাছে
কেবল জীবন ই ভরে আছে
অন্য কিছু নয়
অন্য কিছু হলে পরে
জীবনের হতো পরাজয়।
গ্রামের নাম দলপতিপুর। নামতে হবে দ্বীপে রথতলায়। আমাদের তিনজনকে নামিয়ে দিয়ে বাসটা চলে গেল চাঁপাডাঙার দিকে। রথতলা ঠাকুরবাড়ি ছাড়াতেই উন্মুক্ত হল ধানক্ষেত। ধানকাটার মরশুম চলছে। কোথাও জমি তৈরি হচ্ছে আলুর জন্য। মিঠেকড়া রোদে মন্দ লাগছে না। আমাদের লক্ষ্য দলপতিপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়, উপলক্ষ্য ছাত্রছাত্রীদের অর্জিত বিদ্যার মান পরীক্ষা করা।
এসে গেলাম। খড়ে ছাওয়া মাটির ঘর। মাঝে আলমারির পার্টিশন। বাচ্চা বাচ্চা ছাত্ররা মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। দুজন মাষ্টারমশাই আমাদের দেখে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। পাশের ক্ষেতে স্যালোর ভ্যাট ভ্যাট শব্দ। স্যাম্পলে যে সব স্কুল উঠেছে এটা তাদের একটা। ব্যানার্জিদা দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণীর রেজিস্ট্রি দেখে ছেলেমেয়েদের নির্বাচন করে দিলেন শিক্ষক মদন চন্দ্র ঘোষকে। আমি দেখছি মাটির দেওয়ালে মনীষীদের ছবি। বিধান রায়, রবীন্দ্রনাথ, এক হাতে লাঠি নিয়ে অন্য হাতে চড় দেখানো গান্ধীজি। তার পাশে একটা ছবি ছিল, এখন নেই। আছে ফ্রেমে বাঁধানো কাঁচ।
পাশের ঘরে নাম ডাকা চলছে, তছলিমা খাতুন, নিতাই ভড়, নন্দ পাখিরা, অপর্ণা হাতি, সুষমা মাকাল, পম্পা শবর।.. এরা হবে আমাদের সাবজেক্ট। statistics এর ভাষায় ইভেন্ট। এদের পরীক্ষা করা ডেটা সিট চলে যাবে কম্পিউটার ফ্লোরে। বেরিয়ে আসবে রেজাল্ট। Ravens Progressive Metrics নিয়ে একে একে পরীক্ষা সেরে বাইরে এসে হাত পা গুলো ছাড়াচ্ছি। মদনবাবু র সঙ্গে কাশিনাথ মুখার্জি এসে জিজ্ঞেস করলেন, 'কেমন দেখলেন?' বললাম খুব খারাপ। তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র ছাত্রীরদের অক্ষর পরিচয় ই হয়নি। অনেকে তো রঙ ই চেনেনা।
লক্ষ্য করলাম মাস্টারমশাইদের মুখ শুকিয়ে গেলো। কাশিনাথবাবু বললেন, 'দেখুন তৃতীয় শ্রেণীতো নামেই। পরীক্ষা নেই, মূল্যায়ন পদ্ধতি গোলমেলে। আগের দিন যে প্রশ্নপত্র দিয়ে গেলেন তেমন ছাপা প্রশ্নে তো ওরা অভ্যস্থ নয়। একবার আমরা পরীক্ষা চালু করেছিলাম। সে কী কান্ড। ডাক্তারবাবু ছাপা খরচ দেওয়ায় তাঁকে অপমানিত হতে হলো।
জানতে চাইলাম এর মধ্যে ডাক্তারবাবু কেনো?
কাশি বাবু বললেন চিকিৎসার জন্য নয়। আসলে ওনার জমিতেই তো এই স্কুল। স্কুলটা হওয়ার কথা ছিল পাশের গ্রামে। ডাক্তারবাবু বললেন, না ওখানে হাই কাস্টের বাচ্চাদের সুযোগ আছে। এখানেই হবে। তাই মায়া পড়ে গেছে। এই সব দুঃখে উনি ভিটেটুকু রেখে পাকাপাকি ভাবে শ্যামবাজারে থাকেন।
জানতে চাইলাম এখানে মিড ডে মিল দেওয়া হয় না?
বললেন হ্যাঁ দেয় বছরে তিন মাস। গড় হাজিরা দেখে। যখন দেয় হাজিরা বেড়ে যায়। মাথা পিছু ৫৫ থেকে ৬০ গ্রাম পাউরুটি। তাও চালের গাদ পাইল করা। ওজনে বাড়ে। তার ওপর বাড়তি ছাত্ররা আসে। এখানে যারা আসে তারা এক বেলা খেতে পায়।
আমি চমকে উঠে ঘড়ি দেখলাম। দুটো বাজে। এতক্ষন এরা আমাদের গবেষণার গিনিপিগ হল। আমাদের ইনস্টিটিউট সেন্ট্রালি এ সি হচ্ছে। বুঝি শিক্ষা কাঠামো জাপানে কেনো পিরামিড আকৃতির আমাদের কেনো উল্টো।
কাজ শেষে উঠতে যাব এমন সময় মুড়ি দানদার এলো। ক্ষিধে পেয়েছিল ভালোই। তৃপ্তির সাথে নরক গুলজার হচ্ছে।ব্যানার্জিদাকে প্রশ্ন করলাম দেওয়ালে এত ছবি থাকতে গান্ধীজির লাঠির অর্ধেক উই এ খেল কেন বলতে
পারেন? দানাদার মুখে ফেল তিনি বললেন উনি রাজনীতির লোকদের বেশী পছন্দ করে।দেখবেন এর পর ডাক্তার রায়কে খাবে।মদনবাবুর কাছে জানতে চাইলাম যে ফ্রেমে ছবি নেই সেখানে কার ছবি ছিল ?উনি বললেন নেতাজীর। সঙ্গে সঙ্গে ব্যানার্জিদা বললেন দেখলেন উই দের পছন্দ। ওখানে স্বামীজী থাকলে খেতো না।
শেষ দানাদার টা তখন গলা দিয়ে নামছে ঠিক তখন ডালিয়া খাতুন নামের দ্বিতীয় শ্রেণী র মেয়েটি দু হাতে ধরে আমাকে এক গ্লাশ জল দিয়ে গেল। অনাহারে আক্রান্ত একটি কচি বালিকার থেকে জল পান করে আমি তৃপ্তির ঢেঁকুর তুললাম। জীবনে কখনো কোন দিন নিজেকে এমন ধিক্কার দিইনি।
দারিদ্র্য যেখানে যত প্রকট আপ্যায়নের বহর সেখানে তত বেশি ও উষ্ণ।
রকট