এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • কোমল ধৈবত ও এক কবি 

    সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায় লেখকের গ্রাহক হোন
    ১২ নভেম্বর ২০২৩ | ৫১৪ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • কয়েক বছর আগের কথা। শীতশেষের বিকেল। শ্মশ্রুময় এক প্রখ্যাত কবির সঙ্গে কথা হচ্ছে। নেহাৎই কেজো কথা। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হবে-হবে, বিষণ্ণ যে সব সন্ধ্যায় কৈশোরের কথা মনে পড়ে যায়, হঠাৎই কবি বললেন, ওই গানটা একটু করুন তো। ওই পৌষ-ফাগুনের মেলা। 
    উনি চিরকালই এভাবে দ্রুত প্রসঙ্গান্তরে যান। এছাড়াও আমাকে আপনি বলেন, কেন কে জানে। যা হোক, গান করতে আর কী আছে। আমি শুরু করে দিলাম, কান্না হাসির দোল দোলানো পৌষ ফাগুনের পালা।
    এক লাইন বা আধ লাইন করতেই উনি থামিয়ে খুব বিনীত ভাবে বললেন, এবার নোটেশনটা বলুন।
    কুইজ নাকি? আমি একটু চমকে গিয়ে আমতা আমতা করে গুণগুণ করে বললাম, সা নি ধা পা।
    - শুদ্ধ ধা তো? এবার পরের টা? 
    আমি আবার একটু গুণগুণ করে বললাম, কোমল ধা।
    উনি তারপর যা বললেন, তার মর্মার্থ এই, যে, দুলকি চালে কান্না-হাসির-দোলদোলানোটা চলছে শুদ্ধ স্বরে, যেন কোনো ব্যাপার না। কিন্তু আসলে ওর মধ্যে তো বিষণ্ণতাটা ঢুকে আছে। তাই আচম্বিতে তার ঝাঁপিয়ে পড়া কোমল ধৈবত হয়ে। সঙ্গে একটা তীব্র মধ্যমও আছে। তারপরই আবার আততায়ী লুকিয়ে ফেলে তার ছুরি। আবার শুদ্ধ স্বরে ফিরে আসা। তারই মধ্যে চির জীবন ইত্যাদি। পুরোটা অনেকক্ষণ ধরে বলে বললেন, ব্যাপারটা বুঝতে পারছেন তো? 
    পাশ্চাত্য যন্ত্র বাজালে না বুঝে উপায় নেই। কারণ মেজর স্কেলের সঙ্গে এখানে একটা মাইনরে জাম্প আছে। কান্না-হাসির-দোলদোলানো যদি সি-মেজর কর্ডে বাজানো হয়, তো পরের লাইনেই একটা এফ-মাইনর বাজবে। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি এতটা গুঢ় স্কেলের বিশ্লেষণ, তাও বাণীর সঙ্গে মিশিয়ে, আমি এই গান নিয়ে আগে তো ভাবিইনি, এরকম আলোচনা প্রত্যাশাও করিনি।
    এরপর যেটা হল, উনি গানের নেশায় ঢুকে গেলেন। রবীন্দ্রগানের। একটা করে গান বলেন, গাইতে বলেন, নোটেশন জিজ্ঞাসা করেন। আমি সাক্ষাৎ রবিশঙ্কর না হওয়ায়, মাঝেমধ্যেই এক আধটা ভুল করি। উনি শুধরে দেন। এবং তারপর ব্যাখ্যা করেন। যেকোনো সুর নিয়ে নয়, স্রেফ কোমল ধৈবত। কোন গানে কীভাবে বিষণ্ণতা বা ভাববদল আনার জন্য কোমল ধৈবত ব্যবহার করা হয়েছে, তার বিশদ বিশ্লেষণ। একটু আমি গাই, একটু উনি নিজে গেয়ে দেখান। এইভাবে। 
    এই কোমল ধৈবতের সেশনটা কতক্ষণ চলেছিল মনে নেই, তবে পুরোটার পর, রবীন্দ্রনাথের শুদ্ধস্বরের গানগুলো আমি খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করি, আগে যা দেখিনি। যেমন 'বাংলার মাটি বাংলার জল'। পুরোটা শুদ্ধস্বরে চলছে, হঠাৎই হে ভগবানে কড়ি-মা। বই খুলে দেখি, রাগ কীর্তন। এবং ঠিক ওই একটা কড়ি-মা যে অর্কেস্ট্রেশন এবং চিন্তভাবনার কত দিগন্ত খুলে দিয়েছে, তা অকল্পনীয়। ওসব আর এখানে লিখছিনা। এসব নিয়ে আমার প্রচুর দাবী আছে, সে অন্যত্র বলা যাবে, এখানে কথাটা হল, আমি রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে কখনও এভাবে ভাবিনি। ওই ঘন্টাখানেকের বা আরেকটু বেশি সরাসরি সম্প্রচারে আমি এইভাবে ভাবতে শিখি। সেকথা কবিকে বলেওছিলাম। তিনি যথারীতি বিনয়ের সঙ্গে 'কী যে বলেন' বলে হেসে কাটিয়ে দিয়েছেন।
    কবির নাম? জয় গোস্বামী। কাল ওঁর জ্নমদিন গেল। অনেকেই লিখেছেন। কিন্তু সবই কবিতা নিয়ে। কবিতা নিয়ে নতুন আর কী বলার আছে। কিন্তু এই সঙ্গীতের ব্যাপারটা, হয়তো কেউ কেউ জানেন। চৈতালিদিকে বোধহয় এর পরে একটা অনুষ্ঠানে এই গানটাই গাইতে বলেছিলেন। কিন্তু কী বলেছিলেন শুনিনি। হয়তো এই কথাগুলোই। তবুও বলা উচিত মনে হল, তাই লিখে ফেললাম।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • সুদীপ্ত | ১২ নভেম্বর ২০২৩ ০৮:৫৫525952
  • ভালো লাগলো! এরকম আরও গল্প আসুক, জয় গোস্বামীর কবিতার বাইরের লেখাগুলোও অনন্য। সেদিন পড়ছিলাম 'রৌদ্রছায়ার সংকলন' - বিভিন্ন কবির কবিতা নিয়ে কি আশ্চর্য কাটাছেঁড়া, বিশ্লেষণ, কবিতাগুলো বহুবার পড়া, কিন্তু মনে হলো, ঠিক এমনটা ক'রে ভাবিনি তো! 
  • Arindam Basu | ১২ নভেম্বর ২০২৩ ১০:২৭525954
  • "এবং ঠিক ওই একটা কড়ি-মা যে অর্কেস্ট্রেশন এবং চিন্তভাবনার কত দিগন্ত খুলে দিয়েছে, তা অকল্পনীয়। ওসব আর এখানে লিখছিনা"
     
    সৈকত, লিখুন, একান্ত আবদার রইল।
    না, দাবী করলাম।
    এই লেখাটা একটা অমূল্য সংযোজন।
  • সৃষ্টিছাড়া | 103.85.***.*** | ১২ নভেম্বর ২০২৩ ১১:৪০525956
  • ধান্দা আর লোভের অন্ধকারে চাপা পড়ে যাওয়া কাব্য সুষমা আর বেঁকে যাওয়া মেরুদন্ড।
  • ইন্দ্রাণী | ১২ নভেম্বর ২০২৩ ১২:১৫525957
  • জয় গোস্বামীর গান নিয়ে লেখাগুলি অনন্ত কৌতূহল নিয়ে পড়ি। গান নিয়ে জয় গোস্বামীর লেখা আছে -সংকলনও। সে সব পড়ে বহু চেনা গানও নতুন ভাবে শুনেছি।
    সৈকতের কোমল ধৈবত পড়ে কোমল নি মনে পড়ে গেল। জয় গোস্বামী লিখেছিলেন, আলাহিয়া বিলাবলে বাঁধা "কবল বটরিয়া গৈলো মাই, দে হো বাতায়ে"... যতবার মিনতি করা হচ্ছে, দে হো বাতায়ে বলা হচ্ছে, ততবার "একটা কোমল নি এমনভাবে এসে লাগছে যে কী এক আকুতি ফুটিয়ে তুলছে ঐ গায়ন! মুখে সে মনের অবস্থা বলতে পারব না। কে চলে গেল পথ দিয়ে!আমার সর্বস্ব যেন চুরি করে নিয়ে চলে গেল! যেন পথ দিয়ে কে যায় গো চলে, ডাক দিয়ে সে যায়। আমার ঘরে থাকাই দায়।"

    গতবছরের শেষে ওঁর কথা শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল। একটি উপন্যাস পাঠ কে সঙ্গীতের অনুষঙ্গে আলোচনা করছিলেন তন্ময় হয়ে। আশ্চর্য , বিরল অভিজ্ঞতা। এই সব সন্ধ্যা একটি মানুষের সমস্ত অপমান সমস্ত অপ্রাপ্তি মুছে দেয়, আমৃত্যু সঙ্গে থাকে। সে কথা থাক।

    গান নিয়ে একটি ছোট্টো সংকলনে আশ্চর্য কটি কথা বলেছিলেন। লিখেছিলেন, একটি গানের হৃদয় মানুষের হৃদয়ে প্রবেশ করে তাকে আলাদা মানুষ করে তোলে। আর লিখেছিলেন, অয়দিপাউস আর চন্দ্রগুপ্ত নাটকের অন্ধ ভিক্ষুকের কথা যে চরিত্রটি নাটকের শেষে " ঘন তমসাবৃত অম্বরধরণী" গাইতে গাইতে মঞ্চে আসে। লিখেছিলেন দুটি চরিত্রের মিলের কথা-একজন রাজা, একজন প্রাক্তন দস্যু। দুজনেরই সমস্ত প্রতাপ অন্তড়িত। দুজনেই কন্যার হাত ধরে রয়েছে। "দুই অন্ধকেই হাত ধরে ধরে নিজের নিজের পথে চালনা করেছিল তাদের কন্যারা। ... গানই আমাদের কন্যা। গানই তার হৃদয় দিয়ে আমাদের সম্পূর্ণতার পথে হাত ধরে ধরে নিয়ে যাক।"
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভেবেচিন্তে মতামত দিন