এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • মোঘলদের বারুদ আর আগ্নেয়াস্ত্র

    upal mukhopadhyay লেখকের গ্রাহক হোন
    ২১ জুন ২০২৩ | ৬০৭ বার পঠিত
  • বাবর পনেরোশো ছাব্বিশে পানিপথের প্রথম যুদ্ধে অটোমান সম্রাটদের মতো বারুদ নির্ভর যুদ্ধকৌশলের সফল প্রয়োগ করে হিন্দুস্থানে মাথা গলালেন। তাহলে কি মোঘলরাই প্রথম যুদ্ধে বিরাট আকারে বারুদ ব্যবহার করে? একটা মত হল মোঘল, পারস্যের সাফাভিদ বা তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্য বারুদ ব্যবহারে দড় সাম্রাজ্য - গান পাউডার এম্পায়ার। সাম্প্রতিক গবেষণায় বার্টন স্টেইন বিজয়নগর সাম্রাজ্যের গঠনে আধুনিক বারুদের ব্যবহারের সাফল্যের কথা বললেন। একই সঙ্গে চূড়ান্ত সামরিক কেন্দ্রীভবন করার মতো আর্থিক সঙ্গতি সাম্রাজ্যের হাতে না থেকে, সম্পদের বন্টন শক্তিশালী স্থানীয় রাজাদের মধ্যে ভাগ হওয়ার অসুবিধের কথাও উল্লেখ করছেন। পনেরোশো ষাটের পরে ইউরোপে মান্ধাতার আমলের ছোটোখাটো ঘোড়সওয়ার দলকে হটিয়ে আধুনিক বারুদের ব্যবহার নির্ভর চূড়ান্ত কেন্দ্রীভূত আর শৃংখলাবদ্ধ বিপুল সংখ্যার ইনফেন্ট্রি ডিভিশনগুলোর আবির্ভাব এক সামরিক বিপ্লব ঘটালো। এর জন্য সাম্রাজ্যের আর্থিক সম্পদের চূড়ান্ত কেন্দ্রীকরণ দরকার - ভাঁড় মে যায় অর্থনীতি, আর, আম আদমির হাঁড়ির হাল হকিকত। সে হিসেবে দেখতে গেলে মোঘল ফৌজে পুরোপুরি বারুদ নির্ভরতা আসে নি, ঘোড়সওয়ার-তীরন্দাজদের উপস্থিতি ছিল ভালো মাত্রায়।

    সামরিক বাহিনীর এই বিপুল রূপান্তর করার আর্থিক সঙ্গতি মনসবদার নির্ভর সামরিক কাঠামোয় মূলত বিকেন্দ্রিত আঁতাতকামী মোঘল রাষ্ট্রের কতটা  ছিল সেটাও প্রশ্ন। হাতি-ঘোড়ার সঙ্গে তোপ-বন্দুক মিলিয়ে মিশিয়ে খোলা মাঠের লড়াইয়ে মোঘল ফৌজের শ্রেষ্ঠত্ব তাদের অনেক অসঙ্গতিকে ঢেকে দেয় পরে যা সমস্যার জন্ম দেবে। ইকতিদার আলম খান পঞ্চদশ শতকের ফার্সি ও মধ্যএশীয় সূত্রে কামান-ই-রাদ (বজ্রপাতের ধনুক) কথাটার উল্লেখ পাচ্ছেন। তাঁর গবেষণায় জানা যাচ্ছে তিমুরিদ আর বাহমানিরা হেভি মর্টার জাতীয় তোপ ব্যবহার করছে যা দিয়ে বারোশো কিলোর মতো ভারী পাথর ছোঁড়া যায়। বারুদের ব্যবহার শুধু বন্দুকে আটকে ছিল না, ক্রস বো দিয়ে ছোঁড়া গ্রেনেড-হুককা, রকেট-বান এসবকে অতিশবাজির সাধারণ সংজ্ঞায় ফেলা হতো, এসব শত্রুর সাপ্লাই লাইন ভাঙতে, অস্ত্রাগার উড়িয়ে দিতে কাজে লাগানো হতো। চীন থেকে এদের আমদানি করা হয় মোঙ্গলদের সাহায্যে, তারপর এখানেই বানাত অতিশবাজরা।

    মোঘল ফৌজে রকেটের ব্যাপক ব্যবহার হতে থাকে - যুদ্ধে হাতি আর ঘোড়াদের ভয় পাইয়ে দিতে, আক্রমণ করতে। পনেরো থেকে পঁচিশ সেন্টিমিটার লম্বা আর পাঁচ থেকে আট সেন্টি মিটার ডায়ার দু থেকে তিন মিটারের বাঁশের সঙ্গে আটকে ছাড়া হতো। এই বানের কিছু উন্নত সস্করণ টিপু সুলতান ব্যবহার করলেন যা টুকে ইউরোপ বিস্ফোরক লাগানো কংগ্রেভ রকেট বানায়। ষষ্টদশ শতকে প্রথম তোপ-বন্দুকের ব্যাপক ব্যবহার ও তৈরি করা শুরু। পানিপথের যুদ্ধের আগেই পনেরোশো দশে পর্তুগিজ সূত্রে গোয়াতে এর উল্লেখ আছে। পর্তুগিজ অধ্যুষিত সমুদ্র বন্দর ছাড়াও হিন্দুস্থানের অনেক ভেতরেও এসব চালান হয়ে গিয়েছিল হয়তো। পানিপথের প্রথম যুদ্ধে বাবর ইউরোপে তৈরী তোপ-ই-ফিরিঙ্গি কামান আর হালকা জারবান কামান, কাজান-মর্টার ব্যবহার করেন। ম্যাচলক-আগুন দিয়ে জ্বালানো গাদা বন্দুক তো ছিলই। হুমায়ুন আর শের শাহ সুরির লড়াইয়ে জারবানের ব্যাপক ব্যবহার হয়। পর্তুগিজ আর অটোমানদের সাহায্যে গুজরাটের সুলতান রীতিমতো মাস্কেট বাহিনী বানিয়ে মোঘলদের কিছুদিন আটকে রাখেন। আকবর ম্যাচেলকের লোহার মান ইউরোপের সমতুল্য মানে নিয়ে গিয়ে ব্যারেল ফেটে যাওয়া অনেক কমিয়ে আনলেন। তবে মোঘলরা কামানের প্রযুক্তিতে ব্রোঞ্জেই আটকে ছিল, ইউরোপের মতো কাস্ট আয়রনের কামান বানাতে পারে নি। ঔরঙ্গজেববের সময় অনেক বড় তোপ বানালেও কখনই তা ইউরোপের মানের কাছাকাছি গেল না। বারুদ হিসেবে পঁচাত্তর ভাগ সোরা, পনেরো ভাগ কাঠকয়লা, আর দশ ভাগ গন্ধক মিশিয়ে তৈরি কালো বারুদই বরাবর ব্যবহার হয়ে এসেছে। আগুন না লাগানো  ঘোড়া- লকের  ফ্লিন্টলক বন্দুক মোঘল যুগে ছিল না। পরে ওই ফ্লিন্টলক আরো উন্নত হয়ে বারুদের বদলে কার্তুজ ব্যবহারের উপযোগী হল ইউরোপীয়দের হাতে । পিস্তল-তামাচার ব্যবহার করতে পেত অভিজাতরা যাদের হাতে বিদেশি উন্নত পিস্তলও থাকত।শাহাজাদা হিসেবে ঔরঙ্গজেবকেও ধারাবাহিক ভাবে ব্যবহৃত ও ক্রমোন্নত মুঘোল আগ্নেয়াস্ত্রের বিপুল সম্ভারের ব্যবহার শিখতে হয়েছিল।

    উপল মুখোপাধ্যায়ের আলমগীর উপন্যাসের অংশ
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • সেখ আসাদ আলি | 103.17.***.*** | ২১ জুন ২০২৩ ০৮:২৫520598
  • বিজয়নগরে যে বারুদের ব্যবহার ছিল (হাত কামান ব্যবহৃত হতো) তা শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় তুঙ্গভদ্রার তীরে উপন্যাসে বলেছিলেন। বর্ধমানের ছেলে হিসেবে পড়তে ভালোই লেগেছিল এই কারণে যে সেই হাত কামান তৈরি করছে বর্ধমানের কাঞ্চননগরের একজন কর্মকার! অসংখ্য ধন্যবাদ এইটা আবার মনে করিয়ে দেবার জন্য।
  • Upal Mukhopadhyay | 116.193.***.*** | ২১ জুন ২০২৩ ০৮:৫০520599
  •  আমি মূলত গমন্স, গার্জা আর প্রত্যয়নাথের দেওয়া তথ্যের ওপর ভিত্তি করে লিখেছি। আমার প্রতিপাদ্য হল মোঘলরাই কি প্রথম যুদ্ধে বারুদ ব্যবহার করে ? অথবা না। আমি তুঙ্গভদ্রার তীরে পড়িনি। আপনার মন্তব্যে জানানোর জন্য ধন্যবাদ । 
  • lcm | ২১ জুন ২০২৩ ০৯:১৮520600
  • বারুদ বা গানপাউডার আবিষ্কার করে চিনেরা। চিনাদের "Four Great Inventions" এর মধ্যে এটা পড়ে, অন্য তিনটে হল - কম্পাস, কাগজ, প্রিন্টিং। বারুদ আবিষ্কার মোটামুটি ৯০০ খৃঃ নাগাদ বলছে।

    চিনেরাই প্রথম যুদ্ধে বারুদ ব্যবহার করে, দশম শতাব্দী (৯০০-১০০০ খৃঃ) তে। কিন্তু তার কোনো ডকুমেন্ট নেই। প্রথম ডকুমেন্টেড বারুদ যুদ্ধ হয় ১১৩২ সালে যখন সং ডিন্যাস্টির রাজা হান সিজহং দক্ষিণপূর্ব চায়নায় ফুজিয়ান শহর দখলের জন্য যুদ্ধে নামেন। এর পরে ১২৮৮ সালে নাগাদ তৈরি মোঙ্গলদের হস্তচালিত কামান পাওয়া যায় মাঞ্চুরিয়া থেকে।

    ইউরোপে যুদ্ধে ব্যবহার শুরু হয় ১৩০০-১৩৫০ সময়কালে।
  • প্রশ্ন | 193.108.***.*** | ২১ জুন ২০২৩ ০৯:২১520601
  • উপলবাবু কি ব্রিপুসোভা?
  • মোগলদের | 117.194.***.*** | ২১ জুন ২০২৩ ১৩:২৪520604
  • শাসনব্যবস্থা,ধর্ম, গোলাবারুদ, বাইনারি  এসব তো অনেক হল,  এবার  পরোটা সম্পর্কেও একটু লিখুন। 
     
    (ডিসক্লেইমার: নিতান্ত পিজে। এড়িয়ে যেতে চাইলে  এড়িয়ে যান )। 
  • হীরেন সিংহরায় | ২১ জুন ২০২৩ ২১:৪০520610
  • বারুদ শব্দটা এসেছে বারুত থেকে, তুর্কিক অরিজিন  , যেটা বাবরের মাতৃভাষা ! 
  • Upal Mukhopadhyay | 116.193.***.*** | ২২ জুন ২০২৩ ০৮:৫৭520624
  • মোঘলদের ফুড হিস্ট্রি নিয়ে মানে পরোটা নিয়েও লিখব। সব মত সম্পর্কে অবহিত হই আগে। আরে বাবা পরোটাও দ্বিমতে টুকরো টুকরো। রীতিমত পরোটা ছেঁড়াছেঁড়ি!
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঝপাঝপ মতামত দিন