বৌটি গপাগপ খেয়ে নিয়ে তখনই বাসন ধুতে শুরু করে দিল। ছেলেও খেয়ে দেয়ে থালা সিঙ্কে রেখে উঠে কোথায় চলে গেল। বাবু এবং সেই লোকটি তারও একটু পরে খাওয়া শেষ করে উঠে গেছে পাশের ঘরে বই হারমোনিয়াম এসব নাড়াচাড়া করতে। কিশোরী মেয়েটি থালায় খাবার নিয়ে নাড়াচাড়া করছে, তাকে একা পেয়ে দুটো কথা নরম সুরে বলতেই সে হু হু করে কেঁদে ওঠে। কিছু একটা সমস্যা তার রয়েছে, যা সে কারোকে বলতে পারছে না, বা হয়ত এতদিন কারোকেই বলেনি।
আমরা জেনেছি যে, তার ভাই অন্য স্কুলে পড়ে, সেকেন্ডারি স্কুলে। দুজনেরই বয়স দুবছর করে কমিয়ে ক্লাস সিক্সে ভর্তি করা হয়েছিল। মেয়েটি পড়াশোনায় ভাল ফল করায় তাকে গিমনাজিউম (গ্রামার স্কুল) এ পাঠিয়ে দিয়েছে স্কুল কর্তৃপক্ষ। এই দুজনের দুরকম স্ট্যান্ডার্ডের জন্য ওদের মধ্যে নিয়মিত মারপিট লাগে, ভাইবোনের মধ্যে রেষারেষির কারনে।
মেয়েটিকে তার ইস্কুলের বন্ধুবান্ধব, পড়াশুনোর কথা জিজ্ঞাসা করতেই সে এত কাঁদল কেন বুঝলাম না। কিন্তু ব্যাপারটা স্বাভাবিক নয়। বাবা মা ভাই সবাই রয়েছে, সে আর যাই হোক হোমসীক নয়।
আরেকটু নাড়া দিতেই বলল যে ইস্কুলে তার ভাল লাগে না, শিক্ষক শিক্ষিকারা ভাল না, বন্ধু নেই।
— কেন ভাল নয়? কীরকম সমস্যা?
সে গুছিয়ে বলতে পারছে না।
তখন পাশের ঘর থেকে ওর বাবাকে ডেকে বললাম, কিছু একটা সমস্যা আছে।
ওর বাবাকে দেখে বা আগে যেটুকু পরিচয় ফোনের মাধ্যমে কথা বলে, মনে হয়েছিল শান্ত লোক।
বাবা দুটো একটা কথা বলতেই মেয়ে ফোঁস করে উঠে চিৎকার করে হিস্টেরিক হয়ে গেল। হাত পা ছুঁড়ে বাবাকে গালি দিতে লাগল — তুই কথা বলবি না! বদমাইস লোক, অন্য মাগীর সঙ্গে থাকিস!
আমরা বেশিক্ষণ থাকিনি। বেরিয়ে এসেছিলাম। মেয়েটার মনের কষ্ট, বিশেষ করে একটা টিনেজার মেয়ে কী অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে তা বুঝবার অবস্থায় আমরা নেই।
ওদের মায়ের সেদিন বিকেলে ডিউটি। দূরে এক উকিলের অফিসে কাজ করে সে। বাথরুম পরিষ্কার, অফিসে ঝাড়া মোছা, ডিশওয়াশারে বাসন ধুয়ে গুছিয়ে রাখা। এই কাজের জন্য স্কিল্ড লেবার হবার যোগ্যতা লাগে না। এসব কাজ উদ্বাস্তু মহিলারাই বেশিরভাগ করে থাকে।
ওখান থেকে বের হয়ে আসার পর, সেই লোকটি আমাদের তার প্রেমিকার বাড়ি নিয়ে গেল।
প্রেমিকা বাড়ি ছিল না, তবে এর কাছে অ্যার্টমেন্টের চাবি ছিল।
অপেক্ষাকৃত ছোট অ্যাপার্টমেন্ট। ছিমছাম, সাজানো। মস্ত বাথরুমে বিশাল বাথটাব। বসবার ঘরে ফুলদানিতে ফুল। টেবিলের ওপরে তার পাসপোর্ট পড়ে আছে। আমরা ওখানে বসে বিয়ার খেলাম তিনজনে। লোকটি মেয়েটির ঘরে টুকটাক কাজ করছিল। পাসপোর্ট খুলে দেখালো। কয়েকটা চিঠি এসেছে, সেগুলো নাড়াচাড়া করল। পাসপোর্টে মেয়েটির নাম ও পদবী দুটোই ভিন্ন।
রান্নাঘরের ওপারে ব্যালকনিতে সিগারেট খেতে গিয়ে লোকটি আমাকে হঠাৎ জিজ্ঞাসা করেছিল গর্ভধারণ না করবার পিল এদেশে কেমন করে কিনতে হয়। মেয়েটি যত পিল এনেছিল সব শেষ হয়ে গেছে।
বোঝা যাচ্ছে, সে চিন্তিত। এবং এসব কথা নিজের বাড়িতে জিজ্ঞাসা করতে পারবে না বলেই এখানে নিয়ে এসেছে।
আমার জায়গায় অন্য কেউ হলে বিরক্তিতে এই প্রশ্নের উত্তরই দিত না। কিন্তু আমি বাবুকে ডেকে ওর কথাগুলো আবার বললাম। আমার নিজের এ ব্যাপারে অভিজ্ঞতা নেই।
বেশিক্ষণ থাকি নি ওখানে।
ওখান থেকে বের হয়ে স্টেশনের দিকে যেতে পথে একটা ফার্মাসি পড়ে। সেখানে ঢোকা হলো। এই লোক যেহেতু জারমানে বোঝাতে পারবে না, তাই আমরাই ওর হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম।
সেখানে জানা গেল পিল দুই প্রকার। এক ধরণের পিল গর্ভধারণের সম্ভাবনা ঘটে গেলে চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে খেতে হয়, তাতে শরীরের ক্ষতির সম্ভাবনা আছে। অন্যটা নিয়মিত খেতে হয়, তবে সেই গোত্রের পিলেরও রকমফের আছে, ডাক্তার যেটা বলবে সেটা খেতে হবে।
কিন্তু যার প্রয়োজন, সে না এলে এসব পিল পাওয়া যাবে না।
লোকটি মুখ ব্যাজার করে থাকে।
আমাদেরও মেজাজ বিগড়ে যায়। নেহাৎ জন্মদিনের জন্য ব্যবস্থা করব বলে কথা দিয়েছি, তাই কটু কথা বলি না।
দোকানের বাইরে বের হতেই দেখি সে মেয়েটিকে নাম ধরে ডাকে। মেযেটি স্টেশনের দিক থেকে আসছে। তার সঙ্গে আমাদের আলাপ করায়। মেয়েটি কেমন যেন বিরক্ত হয়। দায়সারা হাতজোড় করে ওখান থেকে পালাতে চায়। কিংবা খুব ক্লান্ত। জারমান ক্লাস করে সে ফিরছে। তার ঘরে এক টুকরে খাবার নেই।
লোকটা তড়িঘড়ি একটা টার্কিশ টেক অ্যাওয়ে থেকে ওকে একটা র্যাপ কিনে দেয়। মেয়েটা চলে যায়।
আমরা ট্রেনে উঠি, সে আমাদের সঙ্গে চিড়িয়াখানার স্টপ অবধি আসে। আমরা সান্ধ্য বের্লিনের পরিবেশ উপভোগ করতে একটা বারে ঢুকি, সেখানে সেই বৃদ্ধ নির্বাসিত বাঙালি কবিও আসেন। টুকটাক গল্প আড্ডার মধ্যেও আমার চিন্তা হয় লোকটি টিনেজার কন্যাটির জন্য, ওর কী এমন সমস্যা? কেন এত কাঁদল?