প্রাকৃতিক বিপর্যয় রুখতে হলে বিশ্বস্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে মজবুত করতে হবে, এই হল বিল গেটস-র বার্তা। ২২শে ফেব্রুয়ারি একটি লেখায় উনি জানালেন উনি ভারতে ফিরে আসছেন (head back)। বিশ্বমহামারীর পর ওনার এই প্রথমবার ভারত যাত্রা। ভারত কতটা অগ্ৰগতি করেছে সেটা দেখার জন্য উনি আর অপেক্ষা করতে পারছেন না। ভারত প্রগতি করুক বা না করুক, শেষ ত্রিশ বছরে আপনাদের প্রগতির দ্বার দুই হাতে উন্মুক্ত করে দিয়েছে। ভারতে শ্রমিকদের সুরক্ষা সংক্রান্ত আইন যা কিছু ছিল সব বাতিল করে দিয়ে চারটি লেবার কোডে শ্রমিকদের বিপনন অর্থাৎ ব্যবসার বাতাবরন তৈরি সম্পর্কে উনি জানেন নিশ্চই। প্রগতি বলতে উনি হয়তো শ্রমিক আইন চূর্ণ করে সেই কোডগুলি কতটা কার্যকর হয়েছে সেই বিষয়ে জানতে উৎসুক হয়ে পড়েছেন।
মনে করিয়ে দিয়েছেন, কিভাবে উনি দুই দশক আগে ওনার সম্পদের (resources) বৃহৎ একটা অংশ সমাজে ফেরত দেওয়ার যাত্রা শুরু করেছিলেন। এখান ওনার কথার দন্দ্বটা একটু ধরিয়ে দেওয়া যাক, যে সম্পদ আসলেই সমাজের সেই সম্পদ 'আপনার সম্পদ হল কি করে! উত্তর একটাই উদ্বৃত্ত শ্রম আহরন করে ব্যক্তিগত পুঁজিতে রূপান্তর। সেই পুঁজিই ব্যয় করা হয়েছে আরও আহরনের উদ্দ্যেশ্যে। সমাজে সম্পদ ফেরত দেওয়ার কথা বলতে গিয়ে তার ওপর মুনাফার দরের কথাটা বলতে উনি বেমালুম ভুলে গেছেন। উনি জানিয়েছেন, শুরু থেকেই ওনার লক্ষ বিশ্বে অন্যায়/অসাম্যের বিভীষিকা কমিয়ে আনা। এখানে মজার ব্যপার হল পুঁজিপতিরা কিভাবে inequality-র পরিবর্তে inequity কথাটা ব্যবহার করে। এটা একটা শুভঙ্করের ফাঁকি। অসাম্য (inequality) কথাটা সমাজের বিভিন্ন শ্রেনীর মানুষের আয় ও আয়বৃদ্ধির বৈষম্য, সম্পদ ও সম্পদ বৃদ্ধির বৈষম্যকে তুলে আনে। তার পরিবর্তে একটা গোলগাল কথা অন্যায় (inequity) ব্যবহার করলে সমাজের যে কোন রকম শ্রেনী সম্পর্ক এমনকি মেডিওকার শ্রেনীর ধারনাকেও এড়িয়ে যাওয়া যায় এবং সমাজকে কেবল কয়েক ধরনের অ্যাসেট ও সম্ভাব্য অ্যাসেট হিসাবে ব্যখ্যা করা যায়।
উনি জানাচ্ছেন, উনি যখন কাজ করতে শুরু করেছিলেন ওনার প্রধান গুরূত্ব ছিল বিশ্বস্বাস্থ্য, কারন এই ক্ষেত্রে অসাম্য সবথেকে বেশি এবং এর সমাধান সম্ভব। এই পরিস্থিতি আজও বিদ্যমান। এর পর উনি এক প্রগতিশীল চিন্তানায়কের মতো বিশ্বউষ্ণায়ন সম্পর্কে উদ্বিগ্নতা দেখিয়ে জানিয়েছেন– এটা ওনার কাছে ক্রমশ প্রকাশ্য হয়েছে যে, জলবায়ু পরিবর্তনের শক্তির সাথে লড়াই (tackle) না করে বিশ্বের দরিদ্রতম মানুষের জীবন উন্নত করা সম্ভব নয়। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই করা সম্ভব নয় সেটাকে আটকানো সম্ভব একমাত্র অতিরিক্ত পরিমান কয়লা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও অতিরিক্ত সংখ্যায় ব্যক্তিগত যানবাহন চালানোর মতো পরিবেশের সক্রীয় ধ্বংসক্রীয়া ত্যাগ করে। তবে যতই inequality কে inequity বলে এড়িয়ে যান না কেন, যেভাবে পুঁজির চরিত্রের মধ্যেই তার সঙ্কটের (crisis) বীজ বপিত রয়েছে ঠিক একইভাবে গেটসের উন্নয়নের ধারনাতেও সমাজের শ্রেনীচরিত্রের প্রকৃতি ক্ষীনভাবে হলেও অনতিক্রম্য হয়ে দেখা দিয়েছে। পৃথিবীর দরিদ্ররাই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের প্রথম ও প্রধান ভুক্তভূগী এই সত্যকে এড়িয়ে যাওয়া তার পক্ষেও সম্ভব হয়নি। যদিও তার উদ্দ্যেশ্য এই সঙ্কটের মধ্যে পুঁজির নতুন বিনিয়োগ ও মুনাফার সম্ভাবনা খুঁজে বার করা।
এরপর তিনি জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে বিশ্বস্বাস্থ্যের অবিচ্ছেদ্দ্য সম্পর্ক নিয়ে বলেছেন। গেটসের ধারনায়, গরম আবহাওয়ার এক ভৌতিক শক্তি আছে যা খাদ্যের অসুরক্ষা এবং সংক্রামক সংক্রামক রোগ বর্ধিত করে সম্পদকে দরিদ্র মানুষের থেকে বিপথগামী করে দারিদ্রদূরীকরনে প্রতিকুলতা সৃষ্টি করে। গেটস মহাশয় বোধ হয় মনে করেন আফ্রিকার স্বর্ণখনি, হীরকখনি, লিথিয়ামখনি ও কয়লাখনির শ্রমিকরা খনিজদ্রব্য মাটির ওপর তুলে আনার পর খনিজদ্রব্য গরম সহ্য করতে না পেরে আমেরিকা ও ইউরোপের মনোরম আবহাওয়ার উদ্দ্যেশ্যে অথবা দেশীয় পুঁজিপতিদের ঠান্ডাঘরের দিকে পাড়ি দেয়, ফলে শ্রমিকদের দারিদ্র্য আর দুর হয় না। আফ্রিকা, যেখানে প্রতি তিনজনে একজন অপুষ্টিতে ভোগে সেখানে কি গরমের কারনে ইথিওপিয়া সহ কয়েকটি দেশ টমেটো ও লেটুস চাষ করছে? প্রভাত পট্টনায়ক বোধ হয় তার প্রতি তিনটি লেখায় একবার করে লেখেন কিভাবে বর্তমান সাম্রাজ্যবাদে আমেরিকা ও পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলো তাদের অর্থনৈতিকভাবে নিয়ন্ত্রিত তথাকথিত তৃতীয়বিশ্বের দেশগুলিকে মেট্রোপলিটানগুলোর চাহিদার ভিত্তিতে চাষ করতে বাধ্য করে, ঠিক যেভাবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ নীল, আফিম, চা ও কফি চাষ করতে বাধ্য করত। বর্তমান ভারতের ক্ষেত্রেও এই কথা প্রজোয্য। তবে সেটা গরমের ভৌতিক শক্তি নয় পুঁজির ভৌতিক শক্তি ও ভৌতিক চক্র। উনি ঠিকই বলেছেন, দরিদ্ররাই জলবায়ু পরিবর্তনের ভুক্তভূগী তবে তার কারন গরম নয় সাম্রাজ্যবাদী পুঁজি দ্বারা সম্পদের নির্গমন। বিল গেটস দুই ফ্রন্টে যুদ্ধ ঘোষনা করেছেন– দারিদ্র্য ও জলবায়ু পরিবর্তন। আসলে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ডাভোস সম্মেলনেও কোন পন্ডিত বলেলনি যে পথ একটাই সুষ্ঠ ও সার্বিক উন্নয়ন। কিন্তু লড়াইটা দুটি ফ্রন্টেই– প্রথম ও প্রধান পুঁজির (প্রাথমিকভাবে একচেটীয়া পুঁজি) বিরুদ্ধে ও অসম উন্নয়ন তত্ত্বের বিরুদ্ধে।
উনি যখনই এই দুটো বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন, প্রায়সই অন্যদের বলতে শুনেছেন, " দুটোর একত্রে সমাধানের জন্য সময় অথবা টাকা কোনটাই নেই।" ওনার মনে হয়েছে একটা নিয়ে কাজ করা এবং অন্য সমস্যাটাকে ফেলে রেখে দেওয়া ভূল। কিন্তু উনি জানাচ্ছেন উনি ওনার বিশ্বাসে দৃঢ়। উনি মনে করেন বর্তমান দুর্বিষহ সময়ে, যখন আমরা অনেকগুলো বড়ো বড়ো সঙ্কটের সম্মুখীন তখনও সঠিক কৌশল উদ্ভাবন ও বন্টনশৃঙ্খল প্রতিষ্ঠা করে অভাবী মানুষের কাছে রসদ পৌঁছে দেওয়া সম্ভব। দারিদ্র্য ও খাদ্য সমস্যা কি আসলে নতুন উদ্ভাবন ও বন্টনশৃঙ্খলের অভাবে? দারিদ্র্য একটি জাতীয় সমস্যা। কিন্তু তার আগে বুঝতে হবে দারিদ্র্য এলো কিভাবে। বিভিন্ন ভৌগলিক পরিস্থিতিতে জীবনযাপনের বিভিন্ন সমস্যা থাকলেও সেটা দারিদ্র্যের কারন নয়। একদল ধনী না হলে দারিদ্র্যের আবির্ভাব অসম্ভব। একদল মানুষের ধনী হওয়ার ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার ফলেই অসাম্য ও ক্রমে দারিদ্র্য সৃষ্টি হয়েছে। ফলে, দারিদ্র্যকে কোন বিচ্ছিন্ন সমস্যা হিসাবে দেখলে হবে না শ্রেনী শোষনের অবশম্ভাবী ফল হল দারিদ্র্য। দারিদ্র্য একটা মাপকাঠি, ফলে ভালো করে দেখলে দারিদ্র্য কথাটির মধ্যেই দন্দ্ব লুকিয়ে আছে। কেইনসীয় অর্থনীতিবিদরা সার্বিক উন্নয়নের পরিবর্তে কয়েকটি কেন্দ্রে অসম উন্নয়নের কথা বলেছেন। ভারতবর্ষে স্বাধীনতার পর অম্লান দত্তের মতো অর্থনীতিবিদরা সেই তত্ত্বের কথাই বলেছেন। ১৯৮০ বিশেষ করে ১৯৯০-র দশকে চীনে দেং জাওপিং-র নেতৃত্বে শ্রেনী সংগ্ৰামকে সরিয়ে দ্রুত উন্নয়নের এই তত্ত্বকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়। ১৯৭০-এর দশকের গোড়ার দিকেও একজন কৃষক ও একজন স্কুল শিক্ষকের গড় আয় প্রায় সমান ছিল এখন সেই বৈষম্যটা কোথায় দাঁড়িয়েছে। তারপরেও সরকার ফিসকল পলিসি ও ডেফিসিট ব্যয়ের মধ্যদিয়ে নতুন কোন উদ্ভাবন বা বন্টন শৃঙ্খল তৈরি না করেই এর বৃহৎ অংশের সমাধান করতে পারে। কিন্তু ১৯৯১-র (তথাকথিত) অর্থনৈতিক মুক্তিকরন, ১৯৯৪-র ওয়াশিংটন কশসেনসাস এবং আন্তর্জাতিক লোন ও বানিজ্যের ওপর ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক, আই এম এফ, ডব্লু টি ও-র ক্রমাগত শর্তস্থাপনের মাধ্যমে সরকারের ফিসকল পলিসিকে বিকল করে দেওয়া হচ্ছে। এইক্ষেত্রে সরকারগুলিকে নিরীহ ভাবলে হবে না তারাও এই (তথাকথিত) অর্থনৈতিক মুক্তিকরনের জয়গান গেয়ে চলেছে। চীন এক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠা করেছে। পুঁজিবাদীরা ক্রমাগত ৮০০ মিলিয়ন ৯০০ মিলিয়ন মানুষকে দারিদ্র্য থেকে তুলে আনার জয়গাথা শোনায় যার অধিকাংশটাই চীনের নিজস্ব অর্জন, চীন সরকারের ব্যতিক্রমী পলিসির ফল। ২০১৯ এর থেকে ১১৮ মিলিয়ন অধিক মানুষ খাদ্যাভাবের সম্মুখীন হয়েছে ২০২০ সালে। ভারত বিশ্বমহামারীতে হাঙ্গার হটস্পট হওয়ার দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে ছিল। যখন দাভিন্দর শর্মা, প্রভাত পট্টনায়ক ও জয়তী ঘোষের মতো অর্থনীতিবিদরা প্রতিবছর ভারতে মানুষের কনজাম্পশন ও পুষ্টির মাত্রা কমে যাওয়া নিয়ে উদ্বিগ্ন প্রকাশ করছেন, সেই সময়ে বিল গেটস বলছেন ভারত দারিদ্র্য দূরীকরনে প্রগতিশীল পদক্ষেপ নিয়েছে। উনি তো বলবেন অবশ্যই, ঠিক যে বছর ফুড সামিট ঘোষনা হল এবং মাল্টিন্যশনাল কর্পরেশনগুলো খাদ্যবন্টন শৃঙ্খল বেসরকারীকরনের রব তুলল। তার এক বছরের মধ্যেই অর্থাৎ ফুড সামিট আয়োজিত হবার এক বছর আগেই ভারত সরকার তিনটি কৃষি আইনের মধ্য দিয়ে শস্য ক্রয় বৃহৎরূপে বেসরকারীকরনের দিকে ঠেলে দিল, সেটা প্রগতিশীল পদক্ষেপ তো বটেই। সৌভাগ্য এই যে, ভারতের কৃষকেরা সরকারকে এই আইন রদ করতে বাধ্য করেছে। কিন্তু তারপরেও আমাদের মনে রাখতে হবে তিনটি আইন আসার আগের যে পরিস্থিতি সেই পরিস্থিতিতেই গড়ে দশ হাজারের বেশি কৃষক আত্মহত্যা করেছে এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই আত্মহত্যারর সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। এর সাথে সাথে শ্রমিক সুরক্ষার ক্রমশ অবনমন ও চুক্তিভিত্তিক শ্রমের বৃদ্ধির ফলে শেষ তিন-চার বছরে দিনমজুর ও চুক্তিভিত্তিক মজুরদের আত্মহত্যার সংখ্যা প্রতিবছরই ত্রিশ হাজার ছুঁইছে। চুক্তিভিত্তিক শ্রমিকদের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভিন্ন রাজ্যে গিয়ে কাজ করতে হয়, সপ্তাহের পর সপ্তাহ মজুরি না দিয়ে জোরপূর্বক কাজ করানোর দৃষ্টান্তও উঠে এসেছে। অথচ আমাদের বড়ো টিভি চ্যানেল ও বড়ো সোশ্যাল মিডিয়া প্লাটফর্মগুলিতে আত্মহত্যা প্রতিরোধের হেতু মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা প্রোগ্ৰামগুলোতে বোরডম কিভাবে কাটাবেন সেই আলোচনা করেই সারলেন।
ভারতে দারিদ্র্যদূরীকরনের অবস্থাতো বোঝা গেল, এবারে গেটসের আরেকটি যুদ্ধের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করা যাক– জলবায়ু পরিবর্তন। সেক্ষেত্রেও সম্প্রতি মিশরের শার্ম-এল-সাইখ শহরে ঘটে গেল জাতিপুঞ্জের এইবছরের জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক সম্মেলন COP27। সেই সামিটে অংশগ্ৰহনকারী খনিজ তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানীগুলির প্রতিনিধিদের সংখ্যা ৬৩৬ জন। ২০২০ সালে সাসটেনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল প্রস্তাবের পাঁচ বছর পূর্তিতে ইউ এন বিবৃত দিল, "মনে হচ্ছে, মানুষ আমাদের লক্ষগুলো উপলব্ধিই করতে পারছে না।" এখানে মানুষ বলতে ইউ এন কাদের কথা বলছে, গেটস-বেজোসদের কথা নয় কি? সত্যিই কি তারা বুঝতে পারছেন না? তাহলে একটা ঘটনা বলা যাক। নেদারল্যান্ড ২০৩০ নাগাদ কার্বন নিউট্রাল হওয়ার পলিসি ঘোষনা করায় সেই দেশে বিদ্যুৎ সরবরাহকারী জার্মানির এক বড় কয়লা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী কোম্পানি আর.ডব্লু.ই নেদারল্যান্ড সরকারের কোল নিউট্রাল পলিসির জন্য তার মুনাফার যে ক্ষতি হবে তার দরুন ১.৪ বিলিয়ন ইউরো জরিমানা চেয়েছে নেদারল্যান্ডের সরকারের কাছ থেকে। ৫৩টি দেশ একসাথে যুক্ত হয়ে ১৯৯১ সালে করা এনার্জি চার্টার ট্রিটি নামক এক দলিলের ভিত্তিতে তারা এই ক্ষতিপূরন চেয়েছে। ১৯৫০ সালে যখন তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে মুক্তিসংগ্ৰাম চরম রূপ ধারন করেছে সেই সময় ওই দেশগুলিতে ইউরোপীয় পুঁজির ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিত করার জন্য সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি প্রথম এই নীতির আবিস্কার করে। ১৯৯০-র দশকে ইউরোপীয় দেশগুলি যুক্ত হয়ে সেই ট্রিটি একটি চুক্তিপত্রের মধ্য দিয়ে ইউরোপে লাগু করে। এই চুক্তিপত্র অনুযায়ী কোম্পানীগুলির চাওয়া জরিমানার বিরুদ্ধে কোর্টেও যেতে পারবে না। ঠিক যেভাবে আমাদের দেশের কৃষিআইনে কৃষকদের থেকে কোর্টে যাওয়ার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। ইনভেসটিগেট ইউরোপ নামের একটি সংস্থা দেখিয়েছে এই চুক্তি অনুসারে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলি, ইউকে ও সুইৎজারল্যান্ড মিলিয়ে মোট ৩৫৪ বিলিয়ন ইউরো জরিমানা হতে পারে, যা সমগ্ৰ ইউরো জোনের বাজেটের দ্বিগুন। সম্ভাবনার ভূত-ই পুঁজির ভিত্তি। সুতরাং, শুধু মুনাফা অর্জন নয় ভবিষ্যতে মুনাফা অর্জনের সম্ভাবনাকে পুজির অনুকুলে নিয়ে আসা অর্থাৎ পরিস্থিতির উৎপাদন ও পুনরুৎপাদনের মধ্য দিয়ে মুনাফা বৃদ্ধি ও মুনাফা বৃদ্ধির হার বৃদ্ধি। ফলে ব্যক্তিগত মালিকানায় পরিবেশবান্ধব বিকাশ সম্ভব নয়। তার কারন পুজির একমাত্র লক্ষ নিজেকে বৃদ্ধি করা ও বৃদ্ধির হার বৃদ্ধি করা। পুঁজি সাসটেনেবিলিটির ধার ধারে না।
এরপর গেটস মহাশয় ইন্ডিয়ান এগ্ৰিকালচার রিসার্চ ইন্সটিটিউট-এর বর্তমানে গবেষনা চলা কড়াই গাছের কথা বলেছন। সেই গবেষনায় গেটস ফাউন্ডেশনের সাহায্যের কথা উনি সগর্বে ঘোষনা করেছেন। ঠিক যেভাবে প্রধানত সরকারি ফান্ডে গবেষনাপ্রাপ্ত কোভিড ভ্যাক্সিনে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে অ্যাস্ট্রাজেনিকা-র নামে পেটেন্ট হস্তগত করেছিলেন ঠিক সেইভাবেই সাহায্য করার সুপরিকল্পনা করে রেখেছেন। কোভিড ভ্যাক্সিনের মতোই বীজ মনোপোলাইজ করে কৃষকদের ওপর লক্ষ লক্ষ টাকা জরিমানা করবেন। তারপর উনি জানিয়েছেন জলবায়ু পরিবর্তন, খাদ্যাভাব ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সমস্যাগুলো অনতিক্রম্য মনে হয় তার কারন এই সমস্যাগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই করার যথেষ্ঠ অস্ত্র আমাদের হাতে নেই। সত্যিই কি আসলে অস্ত্রের অভাবে আমাদের এই দুরবস্থা? শেষ কয়েক বছরে স্বাস্থ্য খাতে খরচ ক্রমশ কমিয়ে দেওয়া, আঞ্চলিক সরকারি হাসপাতালগুলোর দুরবস্থা। বেসরকারী হাসপাতাল নার্সিংহোম ও ওষুধ কোম্পানীগুলিকে বেলাগাম করে দেওয়া। পরিবেশ বিধ্বংসকারী প্রোজেক্ট পাশ করা। শস্যের সরকারী মান্ডিতে ক্রয় কমিয়ে বিদেশ থেকে শস্য ক্রয় করা। এই সমস্ত সংগঠিত পদক্ষেপগুলো মানুষকে জঘন্য স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও খাদ্যাভাবের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। গত মার্চ মাসে ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি রিপোর্টে জানা গেছে ২০১০ থেকে ২০২০তে পাঁচটি ক্লোরোফ্লুরো কার্বনের নির্গমন ২.৬ গুন বৃদ্ধি পেয়েছে, এই পাঁচটি ক্লোরোফ্লুরোকার্বনের চারটি CFC112a, CFC113a, CFC114a, CFC115 শিল্পায়নের বিভিন্ন প্রক্রিয়ার ফলে উৎপন্ন এবং ওজনস্তর ছিদ্র করার ক্ষমতা রাখে। অস্ত্রের অভাব নাকি ইচ্ছাকৃত অবহেলা আসলে এই বিপর্যয়গুলোর কারন।
তারপর উনি জানাচ্ছেন, ভারত নাকি ওনাকে আশার আলো দেখায়। ভারত শীঘ্রই পৃথিবীর সর্বোচ্চ জনসংখ্যার দেশ হতে চলেছে সেই দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে গেটস বলছেন, বড় আকারে ছাড়া ভরতের সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। আসলে ক্ষুধাতুর কর্মহীন মানুষের মুনাফাজনক ব্যবসায়িক সম্ভাবনায় গেটস মহাশয়ের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। উনি ভারতের পোলিও মুক্তিকরন, এইচ.আই.ভি সংক্রমন হ্রাস, শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস ও শৌচালয় গঠনের কাজের প্রশংসা করেছেন। এক্ষেত্রে গেটস মহাশয়কে মনে করিয়ে দিতে হয় যে, এই সমস্ত কাজ সফল হয়েছে সরকারি উদ্যোগে। তার সাথে ওনাকে প্রশ্ন করতে করা প্রয়োজন, আমেরিকাতে কেন শিশুদের বিনামূল্যে টিকাকরনের ব্যবস্থা নেই? বৃহৎ উদ্যোগ অবশ্যই প্রয়োজন, বৃহৎ সরকারি উদ্যোগ ছাড়া ক্রমবর্ধমান মুনাফাখোর ব্যবস্থায় মানুষের সার্বিক উন্নতিসাধন সম্ভব নয়।
উনি মনে করেন ভারত প্রযুক্তির এমন এক যাদু কাঠি খুঁজে পেয়েছে যাতে সমাধানগুলো প্রয়োজনীয় মানুষের কাছে পৌঁছোয়। তিনি বিস্ময় বোধ করছেন, কিভাবে এটা সম্ভব হয়েছে? এক্ষেত্রে জানিয়ে দেওয়া দরকার প্রযুক্তি ও পদ্ধতিগত সমস্ত দিক থেকেই আমেরিকা এগিয়ে কিন্তু তা সত্ত্বেও কেন তা বৃহত্তর সংখ্যায় মানুষের কাছে পৌঁছোয় না। উত্তরটা খুব সহজ। এই সমস্ত প্রযুক্তির পেটেন্ট রাইট কয়েকটি পরিবারের হাতে বন্দী এবং চরম মুনাফাতে তারা সেগুলো বিক্রি করে। যদিও আমেরিকা, ব্রিটেন ও পশ্চিম ইউরোপের শ্রমিকরা সাম্রাজ্যবাদের দৌলতেই (তথাকথিত) তৃতীয়বিশ্বের শ্রমিকদের থেকে বেশ কিছুটা সুবিধা ভোগ করে কিন্তু তার পরেও সাধারন শ্রমিকদের পক্ষে সেগুলো কিনতে পারা বেশ কঠিন হয়ে যায়। টিকার অভাবে বৃহৎ সংখ্যক মানুষের অসুস্থতা স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে মুনাফার সুযোগকে আরও বৃহৎ করে তোলে। অতীতের উন্নয়নমূলক কর্মসূচীর যে সামান্য লিগেসি এখনও রয়েছে তার ফলেই ভারতের শিশুরা বিনামূল্যে সরকারি খরচে টীকাগুলি পায়। ভারতের স্বাস্থ্য ক্ষেত্রকেও বেসরকারী বিনিয়োগ ক্রমশ গ্ৰাস করছে। কোভিডকালে চিকিৎসার ভিত্তিহীন, লাগামহীন অস্বাভাবিক খরচ তার বাস্তবতা দেখিয়ে দিয়েছে।
গেটস মনে করেন বর্তমান পরিস্থিতি আমাদের অকপটতা ও সহযোগীতার সীমাকে পরিক্ষা করবে, বৃহত্তর স্কেলে উন্নয়নের কথাও তিনি বললেন। এখানে সহযোগিতার সীমা বলতে সেবি যেভাবে বিগত বছরগুলোতে আদানি ও অম্বানি-র মতো দেশীয় বুর্জোয়াদের মুনাফা বৃদ্ধিতে সহযোগিতা করেছে তার সাথেও সেই ধরনের সহযোগিতার কথা বলছেন নাকি দেশীয় বুর্জোয়াদের যাতে এই ধরনের সহযোগিতা না করা হয় সেই ইঙ্গিত করছেন! ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে কোভিড়ের চূড়ান্ত দুর্বিষহ সময়ে যোগানের শৃঙ্খল বাঁধাহীন করে তোলার নামে ডব্লু.টি.ও যেভাবে সদস্য দেশগুলিকে ১২৪টি ওষুধ ও চিকিৎসার যন্ত্রাদি ও সহায়ক পণ্য এবং ১৮০টি কৃষি সম্পর্কিত পণ্যের ওপর টেরিফ শূন্য করার শর্ত চাপিয়ে দেশগুলিকে পশ্চিমী পুঁজির বশবর্তী করতে চেয়েছিল ঠিক সেই ধরনের অকপট সহযোগিতার কথাই আসলে গেটস বলতে চাইছেন। কিন্তু ঐতিহাসিক সত্য হচ্ছে টেরিফ কমিয়ে বিদেশী পুঁজির সস্তা শ্রমিক ও গ্ৰাহক হওয়া যায় শিল্পোন্নত দেশ হওয়া যায় না। বৃহত্তর স্কেলে পদক্ষেপ তো অবশ্যই দরকার। ব্যক্তিগত কার্বন ফুটপ্রিন্টের মতো ফাঁকি দিয়ে বর্তমান সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। মুনাফা তাড়িত ব্যক্তিগত উদ্যোগ নয়, জনকল্যানের যে কোন বৃহত্তর উদ্যোগই হতে হবে সরকারী উদ্যোগ তবেই বর্তমান স্বাস্থ্য ও জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্কট থেকে উদ্ধার পাওয়া সম্ভব।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।