১
মেলায় গিয়েছিলাম, জানো? কতজনের সঙ্গে দেখা হ’ল। মনে আছে তোমার, ওই যে নিশীথ দা গো — যাকে তোমরা “নিষিদ্ধ” ব’লে ডাকতে কলেজে, আর সে বেচারি কী অপ্রস্তুত হয়ে তোতলাত — তার সঙ্গে প্রায় মুখোমুখি। খুব চেনাচেনা লাগছে অথচ মনে পড়ছে না, শেষে ওই থুতনির কাছের কাটা দাগে মনে পড়ল — আমাকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতে দেখে সেও কিছুটা থমকে চেনার চেষ্টাতে ছিল মনে হ’ল - সেই চিনতে পারল, মুচকি হেসে বলল - "সুলগ্না না? অঙ্কের?" আমার তো এদিকে আসল নাম মনে পড়ে না শুধু মাথায় "নিষিদ্ধ" ঘুরছে, দাদা দাদা করেই কথা চালালাম। কী করব, যা সব নাম দিয়ে রেখেছ আমাকে অপ্রস্তুতে ফেলবে বলে।
একটু মোটা হয়েছে, সেই উদাসপানা ক্যাবলামি একদমই নেই। সঙ্গে পুরো পরিবার। বউটা বেশ মিষ্টি, জানো। দুই ছেলে মেয়ে, পিঠোপিঠি। বছর দশ-বারো। মেয়ে বড়। আমিই হড়বড়িয়ে কথা বলে গেলাম, যেমন স্বভাব আমার। সে তো নিজে থেকে কিছুই জিজ্ঞেস করে উঠতে পারে নি কখনও। মজা লাগল জানো বউটির কাণ্ড দেখে, হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে থাকলেও বেশ অবাক হয়েছে যেন কিছুটা — তার অমন ভিজে-বেড়াল স্বামীর এমন মুখরা কলেজ বান্ধবীর কথা সে আগে শোনে নি। বেচারীকে বাড়ি গিয়ে ঝাড় না খেতে হয়।
না, তোমার কথা একবারও জিজ্ঞেস করে নি সে। বোধ হয় ইচ্ছে করেই বিব্রত করতে চায় নি।
২
সমুদ্রের ডাকনাম কখনও "পাখি" হয় না কি? বল তো? এমন উদ্ভট কথা বলে না স্বাগতাটা। আজ দেখা হ'ল তো বাড়ি ফেরার পথে — কী চেহারা করেছে, চুলে তেল নেই, শরীর বেশ ভেঙেছে। চাকরি করত তো শুনেছিলাম, কে জানে এখনও না আছে না গেছে। মুখের ওপর তো আর জিজ্ঞেস করা যায় না।
ও নাকি খুব লিখছে আজকাল, নিজেই বলল কবিতার বই নাকি দু'টো বেরিয়েছে এর মধ্যে আর একটা সামনের বইমেলায় বেরোবে। আমি ওসব আবার বুঝি নাকি? নিজে থেকেই দু'একটা পড়ে শোনাল। বুঝি না বুঝি — যত্ন করে শোনাল। খারাপ লাগল না, তা আমি ভালো হয়েছে বলাতে — সে কী খুশি তুমি চিন্তা করতে পারবে না। আমার ভালো লেগেছে বলে সে বইয়ের পাতা থেকে ছবি তুলে পাঠাল। বই দিল না, ওই একটাই পড়ে আছে ওর। দেখো দিকি তুমি যদি এর মর্মোদ্ধার করতে পার — খুব তো দু'জনে মিলে দেওয়াল পত্রিকা করতে —
বিষাদপ্রতিমা, এসো
ঘিরে থাক প্রচ্ছায়াটুকু সর্বত্র
আলোর কুহক যেন কিছুতেই ছিদ্র না পায়।
মোজা পায়ে হাঁটাহাঁটি করি কিছুক্ষণ
গায়ের চামড়া থেকে সময়েরা দেখি
কী অসম্ভব গলে গলে যায়।
পার, তো আঁকড়ে থেকো
মানচিত্র ধরে গাড়ি ছুটে যাবে
রেলপথ, নদনদী, নালার ওপর কালভার্ট
ঝুঁকে দেখে ছোট ছোট মাছেদের খেলা সারাক্ষণ।
আরও কিছু অনর্থক চিহ্ন, শব্দাবলী
বহুদিন পর কানে এলে গল্প করা যায়।
বিষাদপ্রতিমা, তোমার কাছে স্বাভাবিক পৃথিবীর
বিন্দুমাত্র অনিশ্চিত নয়।
৩
এই কাজটাও যাবে মনে হচ্ছে শিগগিরই। ঠারেঠোরে যা কানাঘুষো শুনলাম দিল্লির একজন নাকি এমন জালিয়াতি করেছে যে কোম্পানির গণেশ উল্টোল প্রায়। এদিকে তো ব্যবসার সম্ভাবনা কম তাই পাঁচটা শহরের মধ্যে কলকাতাকেই কোপ। অবশ্য নাকি এও বলবে আমাদের অন্য শহর বেছে নেওয়ার জন্য — যাওয়া যায় বল?
বাড়িতে কিছু বলিনি। বলার কিছু নেইও। কথাবার্তা বলার মতো আছেই কে আর শোনেই বা কে? বেশির ভাগ দিনই খাবার চাপা দিয়ে চলে যায় ঝর্ণামাসী। মা টিভি আর পুজো নিয়ে ক্রমান্বয়ে।
এক-পা নড়বে না জানো। এত রাগ হয় আমার মাঝে মাঝে। রাস্তায় তো দেখি মায়ের চেয়ে কত বেশি বয়স্করা রোজ বেড়াতে বেরোচ্ছে সকাল-সন্ধ্যায়। বাজার-হাট করছে, লাঠি হাতেও কয়েকজনকে দেখেছি একা একা রাস্তায় বেরোতে। বললেই সেই এক কথা — বেরোতে হবেই, একেবারেই বেরোব। মাঝে মাঝে মনে হয় ফেরার পথে হাওড়ায় গিয়ে কোনও এক রাতের ট্রেনে চেপে পড়ি ফোন বন্ধ করে।
তুমি কী সহজে চলে গিয়েছিলে? খুব কষ্ট দিয়েছিল তোমার শহর ছাড়ার খবর জানানোর নির্লিপ্তি। চিঠি তুমি দিয়েছিলে, তাতে তোমার নতুন ঠিকানাও ছিল। আমি জানি — বিশ্বাস করো। তখনই আমাদের বাড়িওলা এত ঝামেলা শুরু করল যে আধখেঁচড়া তৈরি হওয়া নতুন বাড়িতে উঠে আসতে হ'ল প্রায় রাতারাতি। কতবার ভেবেছি তোমার মেসে গিয়ে দেশের বাড়ির ঠিকানা নিয়ে যোগাযোগ করি — যদি ওরা তোমার নতুন ঠিকানা বলতে পারে। পারিনি। আমাদের ছেড়ে আসা বাড়িতেও লজ্জার মাথা খেয়ে জিজ্ঞেস করেছি কোনও চিঠি এসেছে কি না — ওরা দেয়নি। দেবে না জানতাম।
৪
ওই রেলগাড়ি আঁকা খাতা
সেই শিমূলতলা ভ্রমণ
টিলা, ছমছমে রাস্তাটি
কিছু কলারতোলা বাড়ি
তাদের বাগানবিলাস দ্বারে
তোমার চৌকো এক্কাগাড়ি
বোধ হয় থামল খানিক হেসে —
আমি দৌড়ে পেরোই মাঠ
ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপট লাগে
বিকেল চারটে বাজল প্রায়
পিওন, যদি আজকে আসে?
স্বাগতা পাঠাল ফের। তোমার ঠিকানা চায় নি যদিও। কী বলব বল তো, যদি চেয়ে বসে?
নিশীথ দা ফোন করেছিল। সেদিন নম্বর নিল যে। মিলি, "নিষিদ্ধ"র মিষ্টি বউ গো, সে নাকি আমার সঙ্গে গল্প করতে চেয়েছে। কোনও মানে হয়?
৫
আজকাল ফোনে কথা বলা কত সহজ হয়ে গেছে। দূর-দূরান্তের সব কিছু হাতের মুঠোয় — তোমার নাম করে খুঁজেও দেখতে বলেছি কতবার বন্ধুদের সামাজিক মাধ্যমগুলোয় — কেউ খোঁজ দিতে পারে না। আমাদের সঙ্গে যারা পড়ত তারাও কিছু জানে না বলে। কথা এড়িয়ে যায়। আমি তাই এখানে এসে সাদা কাগজে একতরফা বকে মরি। কতবার যে তোমার মতো করে হাঁটা কাউকে দেখে বাস থেকে নেমে পড়েছি মাঝরাস্তায়। অনুসরণ করে দেখেছি সে অন্য কেউ। বাকি রাস্তা হাঁটতে গিয়ে হোঁচট খেয়েছি কত।
ও, বলা হয় নি, চাকরিটা শেষ অবধি গেল। যেতই। আমার তো শহর ছেড়ে নড়ার উপায় নেই। মা যদ্দিন আছেন। তারপরও। যদি তোমার চিঠি আসে, যদি তুমি.. কখনও.. ছ্যাঁৎ করে ওঠে বুক — ওই এলোমেলো চুল দাড়ির জঙ্গলে পৃথিবীর সবচেয়ে ঝকঝকে চোখ জোড়া.. ভাবছ কাব্য করছি?
ঠিক ধরেছ। স্বাগতার সঙ্গে চুটিয়ে আড্ডা হ'ল আজ সারাদিন। একসঙ্গে রান্না করলাম, খেলাম। বাড়িতেই। দু'জন বেকার মানুষ আর মা।
ও ফেরার বেশ কিছুক্ষণ পর পাঠাল…
অথচ বলার ছিল যেভাবে পুকুরের ধারে সন্ধ্যা নামে —
সে বিষয়ে কিছুটা বিশদে, স্বপ্নের সরু সরু আঙুলেরা
যেভাবে ছুয়ে দেখে দেখে ঘাস চেনে, আলো চেনে
পৃথিবীর কাছাকাছি এসে চেনা গল্পের অন্দরমহলে
নিজস্ব শিকড় বাড়িয়ে দেয়। ফলত রাতের ট্রেন ছাড়ে
পরাবাস্তবতায় ঘুমের ভিতরে। বলার ছিল তুমি, আমি
সুস্বপ্নের ইস্কুল, বাসস্টপ, রাস্তার ধারে ক্যাসেট দোকান
থেকে সুর টেনে বুঁদ হয়ে পড়ে থাকতাম স্বীয় অন্তঃপুরে।
মনে হয়, শরীরে এখনও বিষাদ কিছুটা অবশিষ্ট রয়েছে
চিনির কৌটোয় কয়েকটি দানা সর্বস্ব পণ ভাড়াটে যেমন
ঘাটি আগলে যতক্ষণ না দমকল পৌঁছয় ছাই সামলাতে
ভিড়ের মধ্যে আমি কত করে খুঁজলাম চেনা মুখ, চিঠি
অসম্ভব অভিজ্ঞানগুলি - যা দিয়ে দিন-মাস-বছর কেটেছে
তোমাকে বলার ছিল অনেকটা সময় নিয়ে অবান্তরের
মতো বারংবার — এবার যেভাবে হিম-সন্ধ্যাটি নেমেছে।
আসি? যতক্ষণ না দেখা হয় ফের অক্ষরে অক্ষরে।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।