এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • হেডস্যার কামড়ে দিলেন (২য় ও শেষ পর্ব )

    Angsuman Ghosh লেখকের গ্রাহক হোন
    ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | ১১৬৫ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • হেডস্যার কামড়ে দিলেন (২য় ও শেষ পর্ব )

    প্রথম পর্বের লিঙ্ক: 
     
    https://www.guruchandali.com/comment.php?topic=26605
     
    আগের কথাঃ টেলিভিশন চ্যানেলে খবর প্রচারিত হয় একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক সেই স্কুলেরই এক ছাত্রকে কামড়ে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। সাংবাদিকরা স্কুলে ও হাসপাতালে পৌঁছে সেখানকার খবর জানাতে থাকেন, পাশাপাশি চ্যানেলের স্টুডিওতে বিজ্ঞাপনের ফাঁকে ফাঁকে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কামড়ানোর ওপর আলোচনা চলতে থাকে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা এই ঘটনার প্রেক্ষিতে টেলিভিশন চ্যানেলে বক্তব্য রাখেন। তারপর-

    সোশ্যাল মিডিয়া: একটি ভাইরাল ভিডিও

    নমস্কার, আদাব, আমি নাগরিক কবিয়াল। এখন রাত দুটো বাজে, সম্প্রতি বহু আলোচিত সেই পাষণ্ড শিক্ষকের উদ্দেশ্যে আমি একটি গান রচনা করেছি। এই গানটি আপনারা নির্দ্বিধায় যে কোন জায়গায় গাইতে পারেন, ব্রডকাস্ট করতে বা শেয়ার করতে পারেন, আমার অনুমতি নেবার প্রয়োজন নেই।

    ঝ্যাং ঝ্যাঝাং ঝ্যাং  ঝ্যাঝাং ঝ্যাং ঝ্যাঝাং ঝ্যাং
    কামড় দিয়েছ বিকারে অথবা বিকৃত কামের সুখে
    কামড় দিয়েছ না ফোটা কুঁড়ি হাসনুহানার বুকে
    যতবার ভুলে আনত হয়েছি হেনেছো বেতের বাড়ি
    জল্লাদ তুমি শিক্ষক নয় 'শেখা'য় টেনেছো দাঁড়ি
    ঝ্যাং ঝ্যাঝাং ঝ্যাং  ঝ্যাঝাং ঝ্যাং ঝ্যাঝাং ঝ্যাং

    আমার গান পশ্চিম বাংলার মানুষ বোধ হয় পছন্দ করেন না, শোনেন কিনা জানিনা, কেননা আমাকে কেউ গান গাইতে ডাকেন না। বাংলাদেশ এখনো আমাকে ভালোবাসে, তাঁদের ভালোবাসার টানে বারবার ছুটে যেতে ইচ্ছে করে, কিন্তু বয়স হয়েছে, পারিনা। যে কোন দিন মৃত্যু উপস্থিত হতে পারে তাই আমার একান্ত ইচ্ছা মৃত্যুর পর যেন আমার এই গানের পাণ্ডুলিপি পুড়িয়ে ফেলা হয়। আমি ধুতি পরে এই গান রেকর্ড করেছি। ধুতিতে আমি সাচ্ছন্দ বোধ করি, ধুতি আমার প্রিয় পোষাক। জয় বাংলা গজল, জয় বাংলা।

    একটি ফেসবুক লাইভ 

    নমস্কার। আমি বাংলা দক্ষর পক্ষ থেকে স্বর্গ চ্যাটার্জি বলছি, একটা নামকরা স্কুলের হেডমাস্টার এক ছাত্রীকে কামড়ে দিয়েছেন। হেডমাস্টারের নাম দংশন কুমার। তাঁর বিশদ পরিচয় আমরা জানতে পারিনি, তিনি গুটখাখেকো বহিরাগত না বাঙালি জানা নেই। যদি বাঙালি হন প্রশাসন ব্যবস্থা নেবে আর যদি তিনি গুটখাখোর হন তাহলে আমরাই তাঁকে বাংলা ছাড়া করে দেব। কোন গুটখাখোরকে বাঙালির ঘাড়ে দাঁত বসাতে দেব না। আমরা বাঙালির পক্ষে, জয় বাংলা দক্ষ।

    একটি রাজনৈতিক জনসভা: ধাঙড়পুর

    হ্যালো হ্যালো টেস্টিং.... এবার আপনাদের সামনে বক্তব্য রাখতে আসছেন ধাঙড়পুর এলাকার প্রাক্তন বিধায়ক, আপনার আমার সকলের প্রিয় ঘরের ছেলে কাজের ছেলে দুষ্টু ছেলে করিমুল আসলাম- 
    হাততালি

    - নমস্কার। আজকের এই জনসভায় আমার পূর্ববর্তী বক্তাদের কাছে আপনারা  অনেক কিছুই শুনেছেন। আমাদের পা-পার্টি-পাপোশের সরকার শীর্ষনেতৃত্বের অনুপ্রেরণায় বাংলার প্রতিটি দুয়ারে পৌঁছে ছেলে ভোলানো থেকে বৌ পালানো সমস্যার দ্রুত সমাধান করেন। দুস্থ সাথী, নারায়ণ ভাণ্ডার, বৃদ্ধশ্রী, বৌদিশ্রী প্রভৃতি প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলার মানুষ আজ উপকৃত হয়েছেন সেকথা বলার অপেক্ষা রাখে না। শিক্ষা ক্ষেত্রে যে অভূতপূর্ব সাফল্য এই পা-পার্টি-পাপোশের সরকারের আমলে হয়েছে সেই সাফল্যে কালীমা লিপ্ত করতে, নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করতে কিছু স্বার্থান্বেষী শক্তি উঠে পড়ে লেগেছে। আপনারা জানেন একটি নামকরা স্কুলের প্রধান শিক্ষক এক ছাত্রীকে কামড়ে দিয়েছেন। এটি একটি রাজনৈতিক চক্রান্ত এই নোংরা ঘটনার পিছনে কে বা কারা আছে খুব শীঘ্রই তা প্রকাশ পাবে। এইসব অত্যাচার আমরা সহ্য করব না, পশ্চিম বাংলার শান্ত পরিবেশ আমরা নষ্ট হতে দেব না, ঐ অমানুষ প্রধান শিক্ষককে সামনে পেলে তাঁর দাড়ি গোঁফ উপড়ে তাকে জলের জগ ছুঁড়ে মারা হবে।
    হাততালি

    টিভি চ্যানেল ভকত মিডিয়া 

    বঙ্গাল কা কিসি স্কুল কা প্রাধান শিকশক নে আপনা স্কুল কা কিসি গার্ল স্টুডেন্ট কো খা লিয়া... হামারে সাথ বঙ্গাল কা ভিরোধি দল নেতা শ্রী গদ্-ধর সরওয়াধিকারি হ্যায়, হাম উসে পুছনা চাতে হ্যায় - গদ্-ধর জী ইস ঘটনা কে বারে মে আপকা কেয়া রায় হ্যায়? আপ ভকত মিডিয়া কা দর্শকো সে বতাইয়ে
    - প্যাহেলে ম্যায় বোলনা চাতা হুঁ কি ম্যায় গদ্দার নেহি হুঁ, কিসিকা সাথ গদ্দারি নেহি কিয়া, শুধু আপনা ড্যাং ড্যাং বজায় রাখনে কে লিয়ে এপাং ওপাং কিয়া... মেরা নাম হ্যায় গদাধর সর্বাধিকারী
    - ষমা চাতা হুঁ গদা-ধর জী... আপ হমে ইয়ে বতাইয়ে বঙ্গাল কা লোগ সাবসিডি দিয়া হুয়া এল পি জি জ্বলাকে সর্ষো কা তেল মে মছলী তলকে খাতে থে... লেকিন কবসে মনুষ্য কা মাংস খানা শুরু কিয়া? পহেলে এয়সা কভি হুয়া থা?
    - খেয়ে ফেলেছে? তাই নাকি! ইয়ে, বর্তমান কা সরকার আর শাসক দলের চোর ছ্যাঁচোড় মিলকে সব পুকুর বোজাকে ফ্ল্যাট বানাতা হ্যায়, যত গরু বাংলাদেশ মে পাচার কর দেতা হায়, সাধারণ মানুষ কো খানে কা মছলী নেহি মিলতা, গরুর দুধ নেহি মিলতা, ফলস্বরূপ পুষ্টি নেহি মিলতা। গরু আমাদের মাতা হ্যায়, ষাঁড় আমাদের পিতা হ্যায়, বলদ গরুমা কা বয় ফ্রেন্ড হ্যায় কিন্তু এই সরকার এর সম্মান নেহি দেতা হায় শুধু গরুর বদলে বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গা আনকে ইলেকশন মে জিততা হ্যায়... পরিস্থিতি এমন হ্যায় কি আর কিছু দিন মে এই পশ্চিম বঙ্গ আরব দেশ বন জায়গা... ইয়ে রোকনে কে লিয়ে হামলোগ রাজ্যপাল কে পাস স্মারক লিপি দিতে যায়েঙ্গে কি নশো নিরানব্বই ধারা জারি করকে ইস সরকার কো বরখাস্ত করনে কে লিয়ে... জয় জাম্বুবান।
    - আপনে সুনা গদাধরজী কা রায় অব হম আপকো লে চলেঙ্গে শেয়ার বাজার মে... নাউ ওভার টু বোম্বে স্টক এক্সচেঞ্জ... কুবের ধনরাজ জী আপ হমকো আজ কা শেয়ার বজার কা হল চল বতাইয়ে
    - পহেলে কুছ দিনো মে বাজার সাইড ওয়াইজ চল রহা থা, লেকিন বঙ্গাল মে কিসি স্কুল কা হেড টিচার নে কিসি স্টুডেন্ট কা মাংস খানে কা খবর মিলতে হি ফাইনান্সিয়াল ইন্সটিটুশনস, ফরেন ইন্সটিটুশনাল ইনভেস্টরস অর এইচ এন আই ফ্রন্ট লাইন শেয়ার খরিদনা শুরু কিয়া অর সেন্সেক্স অর নিফটি তেজি হোনে লগা... অব তক সেনসেক্স হাজার পয়েন্ট অর নিফটি পানসো পয়েন্ট বাড় চুকা হ্যায়... মিড ক্যাপ মে ভী ভলিউম বড় রহা হ‍্যায়... মার্কেট কা এ্যায়সা তেজী জারি রহেগা তো কুছ হি দিনো মে মার্কেট বুম হো সকতা হ্যায়... বম্বে স্টক এক্সচেঞ্জ সে ক্যামেরা মে ডি ভালুকে সাথ ম্যায় কুবের ধনরাজ.. হর ওয়ক্ত ভকত মিডিয়া।

    একটি লিটল বিজ্ঞাপন

    'আঘাত' লিটল ম্যাগাজিনের পক্ষ থেকে আগামী 'কামড়' সংখ্যার জন্য লেখা আহ্বান করা হচ্ছে। বিষয় অবশ্যই কামড়া কামড়ি সংক্রান্ত হবে।  অনধিক সাড়ে সাত লাইনের কবিতা, দুশো তেইশ শব্দের গল্প ও চারশো কুড়ি শব্দের প্রবন্ধ পাঠান। লটারির মাধ্যমে শ্রেষ্ঠ লেখক নির্বাচন করা হবে। প্রথম পুরস্কার পত্রিকার এক ডজন সংখ্যা সম্পূর্ণ বিনামুল্যে, দ্বিতীয় পুরস্কার পত্রিকার ছয়টি সংখ্যা ও তৃতীয় পুরস্কার তিনটি সংখ্যা একদম বিনামুল্যে। এছাড়াও প্রচুর শান্তনা পুরস্কার- অবিক্রীত হলুদ হয়ে যাওয়া পুরানো সংখ্যা জেতার সুযোগ আছে। তাড়াতাড়ি করুন।

    একটি ঘরোয়া ফোনালাপ

    - হ্যালো
    - বল
    - শুনেছ?
    - শুনব না আবার! সব জায়গায় তো একটাই আলোচনা। বুড়ো বয়সে আরও কত কী দেখতে হবে কে জানে? ভাইপোটাকে কোলে পিঠে মানুষ করলাম, সে কিনা মাঝ বয়সে এসে তারই এক ছাত্রীকে কামড়ে দিল! ছিঃ 
    - কত বড় মুখ করে বলতাম আমার আত্মীয় অমুক স্কুলের হেডমাস্টার!!! আর এখন মুখ লুকিয়ে থাকতে হচ্ছে 
    - লোকে ভাইপো নিয়ে গর্ব করে! আর আমি! তবে আমার কি মনে হয় জানিস, কামড়ানো রোগটা ওর জন্মের সময়ই হয়েছে
    - কেন কেন? উনি আগেও এরকম কামড়াতেন নাকি?
    - সে তো ছোটবেলায় দাঁত ওঠার সময় প্রায় সব বাচ্ছাই একটু আধটু কামড়ে দেয়, ও ও দিত। একটা ঘটনার কথা মনে পড়ল
    - কি কথা গো?
    - আমি তখন কলেজে পড়ি। দাদার কিছুদিন আগে বিয়ে হয়েছে। আমাদের যে বাড়িউলি বুড়ি ছিল, এমনিতে খুবই সাদা মাটা জীবন যাপন করত, বিয়ে থা করেনি, সংসার টংসার সেভাবে ছিলনা। তবে এক গাদা হুমদো হুমদো অপগণ্ড গুন্ডা মস্তান ভাই ছিল। একটা চিটিংবাজ, একটা তোলা বাজ, কোনটা জেল খাটছে, কোনটা বালি চোর, কোনটা গরু চোর। তার মধ্যে একটা আবার অন্যের সুন্দরী বৌকে ফুসলে নিয়ে থাকত, দুজনে তাতা থৈ থৈ নেচে গেয়ে ভিডিও করত।  বাড়ীউলি গরীব দুঃখীদের দান ধ্যান করত, স্কুলের ছেলেমেয়েদের সাইকেল কিনে দিত, মোবাইল কিনে দিত, কাউকে মেয়ের বিয়ের টাকা দিত, তাছাড়া হরি সভায়, মাজারে টাকা পয়সা দিত বলে অনেক লোক বেশ পছন্দও করত, শ্রদ্ধা ভক্তিও করত। কিন্তু বুড়ি খুব ঝগড়ুটে ছিল। একদিন বৌদি মানে দংশনের মায়ের কোন একটা জিনিস বুড়ির এক ভাই আর তার সাগরেদরা মিলে চুরি করে নিয়েছিল। সেই ব্যাপারে বাড়িউলির সঙ্গে খুব ঝগড়া লাগল। দংশন তখনও জন্মায়নি, বৌদির নয় মাস চলছে। হঠাৎ করে বাড়িউলির পোষা একটা সাদা পাহাড়ি বিছে এসে বৌদির হাতে কামড়ে দিল। সেই ঘটনা নিয়ে  খুব হৈচৈ হল, ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে যেতেই লেবার পেইন উঠল, দংশন জন্মাল। বিছের কামড়ের পরই ওর জন্ম বলে নাম রাখা হল দংশন। ধীরে ধীরে সে সব কথা চাপা পড়ে গেল, সবাই ব্যাপারটা ভুলেও গেল- যেরকম ভুলে যায়। মনে হয় সেই বিছের কামড়ের বিষই এতদিন পরে ওর শরীরে জেগে উঠেছে। 

    টিভি চ্যানেল একটি লাইভ অনুষ্ঠান

    নমস্কার। আমি সুমন্ত দেব, শুরু করছি আজকের বিশেষ অনুষ্ঠান।
    কয়েক দিন ধরেই আমাদের চর্চায় উঠে এসেছে একটি ঘটনার কথা - শহরের একটি নামকরা স্কুলের প্রধান শিক্ষক একজন ছাত্রীকে কামড়ে দিয়েছেন। অনাবিল নিরানন্দের চ্যানেলেই প্রথম এই খবরটি আমরা দর্শকদের কাছে নিয়ে আসি, তারপর অন্যান্য টিভি চ্যানেল, প্রিন্ট মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়া, ইন্টারনেট চ্যানেল ও লোকমুখে চর্চার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়ায় এই ঘটনাটি। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি ভিকটিম অর্থাৎ যে ছাত্রীকে প্রধান শিক্ষক দংশন কুমার কামড়ে দিয়েছেন বলে আমরা জেনে এসেছি সে একজন শিশু, ক্লাস ফাইভের ছাত্রী। অনাবিল নিরানন্দের পর্দায় আপনারা দেখতে পাবেন সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ও বহুল চর্চিত ঘটনার ভিকটিমের অর্থাৎ ঐ ছাত্রীর একটি সাক্ষাৎকার। এই অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রচার করা হচ্ছে এবং সঙ্গত কারণেই কোন বিজ্ঞাপন বিরতি রাখা হচ্ছে না।  শিশুটি মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত, তার মা সঙ্গে আছেন, অনাবিল নিরানন্দ চ্যানেলে তাঁরা সাক্ষাৎকার দিতে রাজি হয়েছেন তার জন্য অশেষ ধন্যবাদ জানাই। সামাজিক সম্মান রক্ষায় ও তাঁদের ইচ্ছে অনুযায়ী আমরা  তাঁদের নাম প্রকাশ করব না ও সরাসরি মুখ দেখাব না, আপনারা সিলয়টে তাঁদের দেখতে পাবেন। শুরু করছি আজকের অনুষ্ঠান। প্রথমেই আপনাদের স্বাগত জানাই। আপনাদের নাম উল্লেখ করা হবে না আগেই বলেছি, তাই ছাত্রীকে জিজ্ঞেস করছি তুমি কোন ক্লাসে পড়?
    - আমি ক্লাস ফাইভে পড়ি
    - তোমার স্কুলে যেতে ভালো লাগে?
    - হ্যাঁ
    - তুমি পড়াশোনা ছাড়া আর কী কর? মানে অবসর সময়ে কী কর? খেলাধুলা, নাচ গান...
    - আমি ছবি আঁকতে ভালোবাসি। ড্রইং ক্লাসে যাই আঁকা শিখতে।
    - বাহ্। তুমি কোন রঙ দিয়ে ছবি আঁক? ওয়াটার কালার না প্যাস্টেল?
    - আমি এখন কালার পেন্সিল আর প্যাস্টেলে আঁকছি। ওয়াটার কালার এখনো শেখায়নি।
    - বেশ। আচ্ছা ছাত্রীর মাকে বলছি, সন্তানের কাছে প্রধান আশ্রয় তার মা, তাই সেই দিনের ঘটনা প্রকাশ্যে আসার আগে থেকে এখন পর্যন্ত সবকিছুই আপনার জানা। আমরা ওকে কোন অস্বস্তিকর প্রশ্ন করতে চাই না, যা কিছু জানার আপনার কাছেই জানব।
    - হ্যাঁ বলুন, আমিই সব বলছি। এমনিতেই নানা জনের প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে ও ক্লান্ত 
    - আচ্ছা ওর হাতে দেখছিলাম একটা ছোট ব্যান্ডেজ বাঁধা রয়েছে, ওখানেই কি হেডমাস্টার মশাই কামড়ে দিয়েছেন?
    - প্রথমেই বলি হেডমাস্টার দংশন স্যার ওকে কামড়াননি। 
    - মানে? হেডমাস্টার ওকে কামড়ে দেননি? আমরা যা শুনছি তা ঠিক নয়?
    - একেবারেই। একটা সাধারণ ছোট দুর্ঘটনাকে অন্য দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া হচ্ছে আর বলির পাঁঠা করা হয়েছে আমার ছোট্ট মেয়েটাকে
    - কিছুই বুঝতে পারছি না, আচ্ছা আপনি নিজেই বলুন সেই দিনের ঘটনা 
    - হ্যাঁ, বলছি। সেদিন ছুটি হবার বেশ কিছুক্ষণ আগে স্কুল থেকে আমাকে ফোন করা হয়, বলা হয় আমার মেয়ের একটু হাত কেটে গেছে আমি যেন এক্ষুনি স্কুলে চলে যাই। আমি তাড়াহুড়ো করে স্কুলে পৌঁছে যাই, আমার আশঙ্কা হচ্ছিল নিশ্চয়ই ওর কোন বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে, আমাকে বলা হচ্ছে একটুখানি হাত কেটেছে। স্কুলে যেতেই কয়েকজন স্টাফ ভিতরে নিয়ে যায়, দেখি আমার মেয়ে বসে আছে, মুখচোখ ভয়ে কালো, হাতে একটা ছোট ব্যান্ডেজ বাঁধা। একজন স্টাফ আমাকে বলেন ওর হাতে কেটে গেছে, ফার্স্ট এইড দেওয়া হয়েছে, ওকে নিয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে যেতে। বাড়ি আসার পথে আমি মেয়েকে জিজ্ঞেস করি কি করে হাত কেটে গেল? ও বলে - "কিছুদিন আগে যে ড্রইং কম্পিটিশনে আমি ফার্স্ট প্রাইজ পেয়েছিলাম, হেডস্যার সেই খবর শুনে বলেছিলেন যে ছুটির আগে আমার ড্রইং খাতা নিয়ে দেখা করতে, উনি আমার আঁকা ছবিগুলো দেখবেন। লাস্ট পিরিয়ডে আমি তাড়াতাড়ি ক্লাস ওয়ার্ক জমা করে মিসকে বলে হেডস্যারের ঘরে ড্রইং খাতা নিয়ে গিয়েছিলাম। ঘরে তখন কেউ ছিল না, দেখি স‍্যার চেয়ার ছেড়ে উঠে জানলার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি আসবো কিনা জিজ্ঞেস করলে স‍্যার মুখ ফিরিয়ে ইশারায় আসতে বললেন। ঘরে তখন ফ‍্যান চলছিল তবুও স‍্যার খুব ঘামছিলেন, জামা ভিজে গিয়েছিল। স‍্যারের বোধহয় খুব কষ্ট হচ্ছিল, স‍্যার হাঁ করে নিঃশ্বাস নিচ্ছিলেন, বুকটা খুব ওঠানামা করছিল। আমি স‍্যারকে জিজ্ঞেস করলাম যে স‍্যার আপনার কি শরীর খারাপ লাগছে? স‍্যার ঘাড় নেড়ে হ‍্যাঁ বললেন। তখন আমি স‍্যারকে ধরে চেয়ারে বসিয়ে দেব বলে কাছে যেতেই উনি চোখ বন্ধ করে পড়ে যাচ্ছিলেন আমি হাত দিয়ে আটকানোর সময় স‍্যারের মুখ আমার হাতের ওপর পড়ে আর দাঁতের চাপে হাত কেটে যায়। আমি ভয়ে, ব‍্যাথায় চিৎকার করে উঠি, তখন স্কুলের অন্য স‍্যাররা, মিসরা, সিকিউরিটি কাকুরা ছুটে আসে। স‍্যার তখন মেঝেতে পড়ে রয়েছেন, সবাই আমাকে সরিয়ে নিয়ে যায়"

    মেয়ের মুখে সব শুনে আমি আমার হাজব্যান্ডকে ফোন করে জানাই, ও বলে মেয়েকে কাছাকাছি কোন ডাক্তারের চেম্বারে নিয়ে যেতে, কিন্তু তখন আমাদের পাড়ায় কোন ডাক্তার চেম্বারে ছিলেন না, ওষুধের দোকানে গিয়ে একটা টেটভ্যাক দেওয়াই, ঠিক করি সন্ধ্যায় ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব। এর পরই আমার মোবাইলে একের পর এক ফোন আসতে থাকে, আমার মেয়ের ক্লাসের অন্য গার্জেনরা জিজ্ঞেস করে হেডস্যার কী করেছেন আমার মেয়ের সঙ্গে? কোথায় কোথায় কামড়ে দিয়েছেন? আরও অস্বস্তিকর সব প্রশ্ন। আমি মেয়েকে বারবার জিজ্ঞেস করি যে হেডস্যারের ঘরে ঠিক কী হয়েছে নির্ভয়ে আমাকে বলার জন্য কিন্তু ও একই কথা বলে। তার পর অজানা নম্বর থেকে ফোন আসতে শুরু করে, বিভিন্ন টিভি চ্যানেল, খবরের কাগজের সাংবাদিক, ইউটিউবাররা ফোন করে জানতে চায় ঘটনা সম্পর্কে। কিছুক্ষণ পরে দেখি আমাদের বাড়ির সামনে ভীড় জমছে, ডিস এ্যান্টেনা লাগানো নিউজ চ্যানেলের গাড়ি এসে দাঁড়াচ্ছে।  আসেপাশের বাড়ি থেকেও আমাকে ঐ ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়। আমি খুব ভয় পেয়ে যাই, হাজব্যান্ডের সঙ্গে কথা বলে সামান্য কিছু জিনিসপত্র আর জামাকাপড় সঙ্গে করে মেয়েকে নিয়ে বাড়ির পিছনের দরজা দিয়ে প্রায় পালিয়ে এক আত্মীয়ের বাড়িতে চলে যাই, সেখানেই এখন লুকিয়ে থাকছি।
    - বেশ। বুঝতে পারা যাচ্ছে যে হেডমাস্টার মশাই অসুস্থ হয়ে পড়ে যাবার সময় আপনার মেয়ের হাতে আঘাত লেগে কেটে গেছে কিন্তু এই ঘটনাকে তো বিকৃত রূপ দেবার চেষ্টা হচ্ছে!
    - ঠিক তাই
    - কিন্তু কেন? এর পিছনে কী কারণ থাকতে পারে? আপনার কী মনে হয়?
    - কারণটা অনেক টাকার। স্কুলের বিশাল খেলার মাঠটা এক ক্ষমতাবান প্রোমোটার গোষ্ঠীর নজরে পড়েছে। হেডস্যার ঐ জমি হস্তান্তরে বাধা দিয়েছেন, গার্জেনদের নিয়ে একটি প্রতিরোধ কমিটি গঠন করেছেন।  আমরা শুনেছি হেডস্যারকে বিভিন্ন মহল থেকে চাপ দেওয়া হচ্ছে, ভয় দেখানো হচ্ছে। স্কুলের মধ্যেও কিছু প্রোমোটারের সহযোগী আছে, যারা হেডস্যারকে চুপ করিয়ে রাখতে বিভিন্ন ফন্দি আঁটছে। এই ঘটনার সুযোগ তারাই নিয়েছে। এর পর থেকে আমার ছোট্ট মেয়েটার ওপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেছে, জানিনা ওকে কবে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে পারা যাবে।
    - আমরা আশা করব শীঘ্রই যেন আপনার কন্যা সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারে, আপনার বক্তব্য আমাদের চ্যানেলের মাধ্যমে লক্ষ্য লক্ষ্য দর্শকের কাছে পৌঁছে গেছে, প্রশাসনের কাছেও বার্তা নিশ্চয়ই পৌঁছে যাবে।অশেষ ধন্যবাদ আপনাদের। আজকের মত বিশেষ অনুষ্ঠানের এখানেই সমাপ্তি। 

    ব্রেকিং নিউজ - এইমাত্র খবর পাওয়া গেল অসুস্থ হেডমাস্টার শ্রী দংশন কুমারকে আই সি ইউ থেকে সাধারণ ওয়ার্ডে দেওয়া হয়েছে, তিনি অনেকটাই সুস্থ হয়েছেন বলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন। শিক্ষা মন্ত্রী আজ দুপুরে এস এস জি এম হাসপাতালে এসে দংশন কুমারের সঙ্গে দেখা করেন ও প্রায় পনেরো মিনিট তাঁদের আলোচনা হয়। যদিও শিক্ষা মন্ত্রী এই আলোচনা সম্পর্কে কিছু জানাতে চাননি। দেখতে থাকুন অনাবিল নিরানন্দ, শুধু আতঙ্কে নয় আশায়ও রাখে।

     গল্প ফুরিয়ে যায়, আতঙ্কের অবসান হয়, আশা থাকে।
     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Amiya Kumar Panda | ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ২১:৩১516190
  • আমরাও আশায় রইলাম
    প্রণাম
  • Ranjan Roy | ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ২৩:০৮516192
  • গ্রেট!
  • Sobuj Chatterjee | ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১০:১৪516193
  • সাধু সাধু। 
  • Nirmalya Nag | ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৩:৫৭516467
  • ফাটাফাটি 
  • যোষিতা | ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০০:৫১516490
  • দারুন
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঠিক অথবা ভুল প্রতিক্রিয়া দিন