কে আবার! আমাদের পাড়ার পুরুতমশাই বাবু কাকার ছেলে সন্টা। আর ছুটবে নাই বা কেন? বড় কাকিমার ঘরে লুকোচুরি খেলতে গিয়ে জলের কুঁজো ভেঙেছে যে! সারা ঘর জলে জলাক্কার! খাটের তলায় টানা বিছানা আর গদি গুটোনো ছিল। সেগুলোর যে কি হাল সে বলাই বাহুল্য।
দেখতে দেখতে সে মেজকাকার ঘরের পেছনে ঘুড়ি ধরার নেড়া ছাদ থেকে ঠাকুমার ঘরের সামনের বড় দালান পেরিয়ে, পুবের বারান্দা দিয়ে দৌড়ে, দোতলা থেকে তিনতলায় ওঠার সিঁড়ি এক ধাপ, দু ধাপ বড় বড় পায়ে টপকে সোজা ছাদে। আর আমাকে পেছনে দেখেই এক লাফে পাঁচিল টপকে ঈসিতাদের ছাদে পগাড় পার!
আমাদের উত্তর কলকাতার শিমলে পাড়ার বাড়িগুলো ওই রকমই। ভাই বোনের মতো এ ওর গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে। দুটো ছাদের মাঝে পাতলা পাঁচিল, থেকেও না থাকার মতোই। এর ছাদ থেকে ওর উঠোন, এর রান্নাঘরের জানলা দিয়ে ওর বারান্দা – সব খুল্লামখুল্লা! কার রান্নাঘরে আজ কি রান্না হোল, কার ছেলে স্কুলে বদমাইশি করার জন্যে বেধড়ক মার খেলো আর কার মেয়ে ও পাড়ার ছেলের সঙ্গে লুকিয়ে দেখা করার জন্যে ঘরবন্দি - সব্বাই সব্বার পেটের কথা জানে।
যাকগে, যে কথা বলছিলাম। সন্টা হোল আমাদের ছাদপার্টির এক খুদে সদস্য। সে ছাড়া আর আছে আমার বোন রুমি। বাবুন, ওর বোন রিনি আর আরও এক খুদে বোন পিঙ্কু। আমাদের এই বাচ্চাপার্টির আমিই অঘোষিত দলনেতা! পাশের বাড়ির বাবুন আমার চেয়ে মাত্র তিন মাসের ছোট। কিন্তু আমার দাপট দেখে মনে হয় যেন আমি তিন বছরের বড়। মোটা মোটা দুবিনুনি ঘেরা রোগাসোগা চেহারায় বড় বড় দুটো চোখের দৌলতেই রাজত্ব। রাজত্ব না ডাকাতি! তবু সবাই ভালবেসে বলে ডাকাবুকো!
আমি তখন বিডন স্ট্রীটের হোলি চাইল্ড! আর এদিকে গান শিখতে দরজিপাড়ার জগন্নাথ ধরের স্কুল নির্ঝরিণী সঙ্গীত শিক্ষালয়! এছাড়া মিনারভা থিয়েটারের কাছে আমার মামার বাড়ির পাশে চৈতন্য লাইব্রেরী। কলকাতা বলতে এই চৌহিদ্দিটুকুই তখন চেনা জগত। তাই উন্মুখ হয়ে থাকতাম স্কুল থেকে ফিরে ওই হুড়োহুড়ি করে খেলার খোলা ছাদটার জন্যে। কখনো কুমির ডাঙ্গা, কখনো ঠাকুমা, কাকিমার ঘর জুড়ে লুকোচুরি। তিনতলা – একতলা, একতলা – তিনতলা। এবাড়ি থেকে ওবাড়ি। বেশ কিছু অনিত্য করেছি।যেমন ওই জলের কুঁজো ভাঙা আর কি। একবার তো খিল খুলতে গিয়ে মাথায় পড়ে বাবুনের মাথা ফেটে গেল। আর একবার আলমারীর পেছনে লুকোতে গিয়ে পুরনো খিলেন ভেঙে পড়লো। তখন কি বকুনি আর কি বকুনি। এই বকুনি আর শাস্তির ব্যাপারে কোন gender bias ছিল না, নিজের ছেলে কি পাশের বাড়ির সে বিষয়েও কোন বাছবিচার ছিল না। তবু মা, কাকিমা, বাবা, কাকারা আবাধ প্রশয় দিতেন আমাদের এই দাপিয়ে খেলার বিকেলগুলোকে। যেদিন বৃষ্টি হোতো সেদিন লুডো আর ক্যারাম। বিশ্বকর্মা পুজোর সময় বোতলের তলার কাঁচ ভেঙে মাঞ্জা দেওয়া আর ঘুড়ি ওড়ানো। আর ভোকাট্টা হলেই আবার দুড়দাড়িয়ে ছুট এবাড়ি ওবাড়ি পেরিয়ে কাটা ঘুড়ি তুলে আনার জন্যে।
তারপর সন্ধে হত। হাত মুখ ধুয়ে যে যার বই খাতার সামনে। আবার চেয়ে থাকা পরের দিনের সোনালি বিকেলটার, দল বেঁধে দৌড়াত্ব করার, প্রতিক্ষা আদরের প্রশয়ের আর খোলা ছাদের স্বাধীনতার। বিকেল গড়িয়ে যেমন সন্ধের সায়রে বিলীন, জীবনও যেন তেমনি বিশবাঁও জল! আমাদের বাচ্চাপার্টির সবাই প্রায় জীবনের মধ্যাহ্নে! তবু চোখ বুজলেই ছেলেবেলা কথাটার ম্যাজিক দমকা হাওয়ার মতো এক ঝটকায় উড়িয়ে নিয়ে ফেলে বাবুনদের সেই তিনতলার ছাদে। যেখান থেকে সোজা তাকালেই ডিমের কুসুমের মতো লালচে কমলাটে সূর্যটা অস্ত যায় ধোঁয়াশা ঢাকা হাওড়া ব্রীজের পেছনে। সেখানে বন্ধ বাক্সোর ভেতরে গুছিয়ে রাখা সাদা কালো ছবির এ্যালবামের মতো হাতড়িয়ে খুঁজি ছেলেবেলাটাকে। আর হাজার মাইল দূরে নিঃশব্দ বিদেশে নিশ্চুপ হয়ে ভাবি কোথায় গেল আজ সেই ছাদ জুড়ে দস্যিপনার বাচ্চাপার্টিরা?
ওরা সব টিউশনে। ওরা সব ইন্টারনেটে।
ছাদ তো আজ তেমনই খোলা। খালি পাল্টে গেছে সময় আর ছেলেবেলার সংজ্ঞা। আর তার সঙ্গে গল্প হয়ে গেছে পুরনো কলকাতার সেই সব মা, বাবা, কাকা, কাকিমারা যারা এনে দিত সেই খোলা ছাদের স্বাধীনতা।
তাই মাঝে মাঝেই কাজ পালিয়ে যাই আমার সেই এক ছাদ ছেলেবেলা খুঁজতে।
ছেলেবেলা গড়িয়ে পড়ে ছাদ থেকে। তাকে মুঠোয় করে ধরি।
ছেলেবেলা উপছে পড়ে মুঠো করা হাত থেকে, গড়িয়ে পড়ে আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে পাতলা নলেন গুড়ের মতো। তাকে চেটেপুটে খাই। ভাবি শেষ হয়ে গেল বুঝি!
তবু আশ্বাস! সব জলই বরফ হতে পারে।
আমার এক ছাদ ছেলেবেলা তাই বেঁচে থাকে নতুন গুড়ের পাটালির মতো জমাট মিষ্টি আর সুবাস নিয়ে, উত্তর কলকাতার অন্দরমহলে!
/ সুপর্ণা সান্যাল, উপসালা, সুইডেন।