আরেকটু অরিজিৎ মুখার্জির থেকে নেওয়া ---
"১২ই অক্টোবর ২০১৫ - রাতভর বৃষ্টির পর সেদিন সকালে পুণের বৈকুণ্ঠ শ্মশানঘাটের ইলেকট্রিক চুল্লিতে হিমানী সাভারকরের দেহ যখন তোলা হয়, হিমানীর ছেলে সাত্যকি সাভারকরের সঙ্গে শ্মশানে দাঁড়িয়েছিলো অভিনব ভারতের সমস্ত সদস্য। হিমানীর দেহ ছাই হয়ে যাওয়ার পর সকলে যখন সাত্যকির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যাচ্ছে, তখন একটাই কথা তারা প্রত্যেকে জানিয়েছিলো - হিমানীর মৃত্যুর সাথেই ছিঁড়ে গেছে তাদের সকলের "আদর্শ" দুই ঐতিহাসিক চরিত্রের সঙ্গে একমাত্র জীবন্ত যোগসূত্রটা।
কে এই হিমানী সাভারকর?
একদিকে গোপাল গডসে, অর্থাৎ নাথুরাম গডসের ভাইয়ের মেয়ে, অন্যদিকে বিনায়ক দামোদর সাভারকরের ভাই নারায়ণ সাভারকরের ছেলের বউ - হিমানী সাভারকর - একই সাথে সংঘ পরিবারের দুই সুপ্রীম নেতার লেগ্যাসি বহন করতেন। পেশায় ছিলেন আর্কিটেক্ট - ১৯৭৪ সালে থেকে ২০০০ সাল অবধি নিজের পেশাতেই নিযুক্ত ছিলেন মুম্বইয়ে। ২০০০ সালে আর্কিটেক্টের কাজ ছেড়ে পুণে চলে আসেন সাভারকরের সমস্ত লেখাপত্রের একমাত্র উত্তরাধিকারী হিসেবে সেইসব দেখাশোনার দায়িত্ব নিয়ে। গডসে এবং সাভারকর পরিবারের যৌথ লেগ্যাসিই তাঁকে নিয়ে আসে অভিনব ভারতের ছাতার তলায়। ২০০৮ সালের মালেগাঁও বিস্ফোরণে যখন অভিনব ভারতের সদস্যদের জড়িয়ে থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়, হিমানী তখন প্রকাশ্যে অভিনব ভারতকে ডিফেন্ড করতে গিয়ে বলেছিলেন - "বুলেটের বদলা বুলেট যদি হয়, তাহলে বিস্ফোরণের বদলা বিস্ফোরণ কেন হবে না?" [‘If we can have bullet for bullet, why not blast for blast?’, Outlook , 17 November 2008.]
অভিনব ভারতের প্রতিষ্ঠার ব্যাপারটা একটু ধোঁয়াশায় ঢাকা। সংগঠনের নামটা অবশ্যই ১৯০৫ সালে ফার্গুসন কলেজে পড়ার সময় সাভারকরের তৈরী গুপ্ত সংগঠনের নামে - সেই সময়ে সাভারকর এই সংগঠনের নাম রেখেছিলেন গাইসেপ্পে মাজিনির "ইয়াং ইটালি" অনুপ্রেরণায়। প্রথমবার গ্রেপ্তার হওয়ার আগে অবধি সাভারকর বাস্তবিকই সশস্ত্র বিপ্লবে আস্থা রেখেছিলেন - সেই আদর্শের ওপর ভিত্তি করেই অভিনব ভারতের সদস্যদের হাতে একাধিক ব্রিটিশ অফিসার খুনও হয়েছিলেন - ইতিহাস সাক্ষী রয়েছে। ব্রিটিশ শাসন এবং ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে সাভারকরের মনোভাব সম্পূর্ণ বদলে যায় গ্রেপ্তারির পর, এবং আবারও ইতিহাস সাক্ষী - যে আরএসএস বা হিন্দু মহাসভা পরবর্তীকালে ব্রিটিশের সাথে সহযোগিতার রাস্তাতেই হেঁটেছে। সাভারকরের তৈরী সেই অভিনব ভারত বন্ধ হয়ে যায় ১৯৫২ সালে।
২০০৮ সালে, মালেগাঁও বিস্ফোরণের পর আউটলুকের ওই সাক্ষাৎকারে হিমানী জানান যে ১৯৫২ সালের আরো পঞ্চাশ বছরেরও কিছু পরে নতুনভাবে অভিনব ভারত শুরু করেছিলেন সমীর কুলকার্নি, আর তিনিই হিমানীকে অনুরোধ করেছিলেন সংগঠনের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নিতে - হিমানী সেই সময়ে ছিলেন হিন্দু মহাসভার সভাপতি। ২০০৮ সালে পুলিশের কাছে হিমানী জানান যে ওই বছরেরই এপ্রিল মাসে ভোপালে একটা মিটিঙে তাঁকে সংগঠনের সভাপতি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। হিমানীর জবানবন্দী অনুযায়ী সমীর কুলকার্নি মূলতঃ মধ্যপ্রদেশেই ভিতরেই চেষ্টা করছিলেন অভিনব ভারতকে তৈরী করার। যে মিটিঙে তাঁকে সভাপতি স্থির করা হয়, সেই মিটিঙে উপস্থিত ছিলেন আরও কয়েকজন - স্বামী অমৃতানন্দ দেবতীর্থ (যাঁকে আরও অন্য কিছু নামে জানা যায় - সুধাকর দ্বিবেদী, সুধাকর ধর, আর দয়ানন্দ পাণ্ডে যার মধ্যে অন্যতম, এবং হিমানী যাঁকে জম্মু কাশ্মীর শঙ্করাচার্য্য বলে ডাকতেন), সাধ্বী প্রজ্ঞা সিং ঠাকুর, মেজর রমেশ উপাধ্যায়, সুধাকর চতুর্বেদী, এবং কর্ণেল শ্রীকান্ত প্রসাদ পুরোহিত - এই শেষের জনকে হিমানী অন্ততঃ দু বছর আগে থেকেই চিনতেন, পারিবারিক সম্পর্কের কারণে।
“I know colonel Purohit personally, for over two years but our families have ties that go back a long time. But, he has never ever spoken to me about the Abhinav Bharat Trust – either that he founded it or about its work. Similarly, I do not know if he as involved with the Abhinav Bharat Sangathan in Madhya Pradesh.” [Interrogatories: 8, Malegaon Blast Documents]
তবে, মালেগাঁও বিস্ফোরণের অন্যান্য টেস্টিমোনিয়াল থেকে মনে হয়ে অভিনব ভারতের আসল সংগঠক ছিলেন শ্রীকান্ত পুরোহিত নিজেই। তিনিই ২০০৬ সালের জুন মাসে ষোলোজন লোককে নিয়ে রায়গড়ে ছত্রপতি শিবাজীর দূর্গে অভিনব ভারত ট্রাস্টের সূচনা করেছিলেন। পুলিশের জেরায় সেই ষোলোজনের একজন জানান - “We took the blessings of Shivaji Maharaj’s throne and decided to name the trust Abhinav Bharat and prayed for its success” [Interrogatories: 1, Malegaon Blast Documents]। এর পরের বৈঠক হয় ২০০৬ সালের ১৬ই ডিসেম্বর - যেদিন উপস্থিত সদস্যরা একসাথে বিজয়দিবস (বাংলাদেশ যুদ্ধে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের জয়) সেলিব্রেট করেন। যদিও, ট্রাস্টের প্রথম অফিশিয়াল মিটিং হয় ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে, পুণের কারভে রোডের সন্ত কৃপা অ্যাপার্টমেন্টের এক ঠিকানায় - ট্রাস্টের অফিশিয়াল ঠিকানাও ছিলো এখানেই, ট্রাস্টের সদস্য এবং ট্রেজারার অজয় রাহিরকরের বাড়িতে।
পরের মিটিং সম্ভবত হয় ২০০৭-এর জুন মাসে, নাসিকে, যেখানে পরশুরাম সাইখেদকর থিয়েটারে ট্রাস্টের উদ্বোধন হয়। কর্ণেল পুরোহিত মুম্বই থেকে বেশ কয়েকজন লোককে নিয়ে সেখানে গেছিলেন...গেছিলেন দেওলালি ক্যাম্পেও - যেখানে অমৃতানন্দ দেবতীর্থ তাঁর শিষ্যদের "দর্শন" দিচ্ছিলেন সেই সময়েই। পুরোহিতের সঙ্গে যাঁরা গিয়েছিলেন দেওলালিতে, তাঁদের একজন ১৪ই ডিসেম্বর ২০০৮ তারিখে পুলিশের কাছে জানান যে এই মিটিঙেই কর্ণেল পুরোহিত দেশের অবস্থা সম্পর্কে অনেক কথা বলেন - বলেন দেশে যা হচ্ছে তার অনেক কিছুই ভুল, এবং সেই ভুলগুলো শুধরোতে হবে - তার জন্যে একতা জরুরী। শঙ্করাচার্য্য, মানে অমৃতানন্দ বলেন - হিন্দু ধর্মকে রক্ষা করতে হবে, হিন্দু ধর্ম বিপদে (সেই বিখ্যাত "হিন্দু খতরে মে হ্যাঁয়") - আমাদের দায়িত্ব হিন্দুধর্মকে রক্ষা করা। সেই জন্যে দেশের সব হিন্দুকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে…শঙ্করাচার্য্যের বক্তৃতার সময়েই পুরোহিত টেবিলে নিজের ল্যাপটপ রেখে চালু করেন মিটিং রেকর্ড করার উদ্দেশ্যে। পুরোহিত নিজে জোরগলায় দাবী করেন যে মুসলমানদের সঙ্গে লড়াই করতে গেলে দরকারে বোমা বিস্ফোরণ অবধি যেতে হবে - যদিও কয়েকজন এই বক্তব্যের বিরোধিতা করেন। একজন সদস্য পুরোহিতকে বলেন এই ধরণের মিটিঙে যেখানে বিভিন্ন বিষয়ে বিতর্ক হতে পারে, সেখানে বোমা ইত্যাদিতে উৎসাহী কাউকে না ডাকতে, এবং তিনি নিজে বোমা বিস্ফোরণ, দাঙ্গা বা অন্যান্য হিংসাত্মক পন্থার বিপক্ষে - অভিনব ভারত ট্রাস্ট সন্ত্রাসবাদকে সমর্থন করার জন্যে তৈরী হয়নি, ইত্যাদি... [Interrogatories: 2, Malegaon Blast Documents]।
সেই বছরেরই সেপ্টেম্বর মাসে দেওলালিতে আরও একটা বৈঠক বসে - আবারও মুম্বই থেকে আসা বেশ কিছু লোক, এবং কর্ণেল পুরোহিত ছিলেন সেখানে। এইবারে আরেকজন নতুন লোক ছিলেন - পূর্ব দিল্লীর সাংসদ, ভারতীয় জনতা পার্টির বিএল শর্মা। শর্মার সঙ্গে অমৃতানন্দর পরিচয় আগেই ছিলো - ২০০৪ সালে, নিজের লোকসভা কেন্দ্র ঘোরার সময়ে - সেই কেন্দ্রের কাশ্মীরি পণ্ডিত উদ্বাস্তুদের মধ্যে অমৃতানন্দ বেশ জনপ্রিয় ছিলেন। ২৬শে ডিসেম্বর ২০০৮ তারিখে পুলিশের প্রশ্নের উত্তরে শর্মা জানান যে সেই মিটিঙে অমৃতানন্দ নিজের ল্যাপটপে ইসলামিক উগ্রপন্থীদের নানান ভয়ানক কাজের ভিডিও দেখিয়েছিলেন। ২০০৭ সালের নাসিকের বৈঠকে অমৃতানন্দই শর্মাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। সেদিন তিনি অখণ্ড ভারতের আইডিয়ার কথা বলেন - কীভাবে অভিনব ভারতের হাত ধরে ভারতবর্ষ হিন্দুরাষ্ট্র হয়ে উঠবে...
"There he spoke about his idea of Akhand Bharat and of making India a Hindu Rashtra and he also talked about the Abhinav Bharat organisation. He told us that Prasad Purohit was trying to achieve Akhand Bharat through his Abhinav Bharat organisation. We were told that Sudhakar Chaturvedi was working full-time for the organisation. Our meeting lasted one hour during which we discussed the rape of Hindu women in J and K, their murder, etc…. I returned to Delhi after the meeting [Interrogatories: 6, Malegaon Blast Documents].
পুলিশের বক্তব্য অনুযায়ী, মালেগাঁও বিস্ফোরণের গোটা ছক এবং তার খুঁটিনাটি তৈরী হয়েছিলো ২০০৮ সালে হওয়া চারটে মিটিঙে [Chargesheets and Miscellaneous Documents – Malegaon Case: 61]।
২০০৮ সালের ২৫-২৭শে জানুয়ারি প্রথম মিটিঙে কর্ণেল পুরোহিত, মেজর উপাধ্যায়, সমীর কুলকার্নি, সুধাকর চতুর্বেদী এবং অমৃতানন্দ দেবতীর্থ দেখা করেন ফরিদাবাদে "সেভ আওয়ার সোল" সংস্থার এক বাড়িতে যেখানে অমৃতানন্দ সেই সময়ে থাকতেন। এই মিটিঙের একটা বড় অংশ ইকোনমিক অ্যান্ড পলিটিকাল উইকলির ওয়েবসাইটে পাওয়া যায় - ক্রিস্টফ জাফ্রেলোর আর্টিকলের সাথে। পুলিশ তদন্তের সময়ে অমৃতানন্দের রেকর্ড করা এই মিটিঙের পুরো ভিডিও খুঁজে পেয়েছিলো - সেই ভিডিও থেকে জানা যায় যে আরও তিনজন ব্যক্তি এই মিটিঙে উপস্থিত ছিলেন - সাংসদ বিএল শর্মা, অ্যাপোলো হাসপাতালের ডঃ আরপি সিং, আর কর্ণেল আদিত্য ধর। ফরিদাবাদের এই মিটিঙে আরপি সিং গল্পচ্ছলে বলেছিলেন যে তিনি কীভাবে মকবুল ফিদা হুসেনের নামে মামলা করেছিলেন, এমনকি জামিয়া মিলিয়ায় এক অনুষ্ঠানে যেখানে হুসেনের বক্তৃতা দেওয়ার কথা ছিলো, সেখানেও উনি পৌঁছে গেছিলেন ১৫ লিটার পেট্রল নিয়ে - হুসেনকে আক্রমণ করার উদ্দেশ্যে - যদিও সুযোগ পাননি, কারণ অসুস্থতার কারণে হুসেন সেই অনুষ্ঠানে যাননি...
এপ্রিলের ১১-১২ তারিখে এঁরাই (মানে, মূল পাঁচজন - পুরোহিত, উপাধ্যায়, কুলকার্নি, চতুর্বেদী আর অমৃতানন্দ) ভোপালে দেখা করেন প্রজ্ঞা সিং ঠাকুরের সঙ্গে, এবং মালেগাঁওয়ের কোনও একটা জনবহুল এলাকায় বিস্ফোরণ ঘটিয়ে মুসলমানদের ওপর বদলা নেওয়ার কথা স্থির করেন। পুরোহিত দায়িত্ব নেন বিস্ফোরক যোগাড়ের, প্রজ্ঞা সিং ঠাকুর দায়িত্ব নেন বিস্ফোরণ ঘটানোর লোক যোগান দেওয়ার...এবং এই মিটিঙে উপস্থিত প্রত্যেকে একযোগে এই সিদ্ধান্ত সমর্থন করেন। পুলিশ এও প্রমাণ করেছিলো যে বিস্ফোরণে মূল অভিযুক্তরা ছাড়া অন্য কয়েকজনও এই মিটিঙে ছিলেন - এমনকি হিমানী সাভারকরও - তাঁর নিজের জবানবন্দী অনুযায়ীই।
এরপর, ১১ই জুনের পরবর্তী মিটিঙে সাধ্বী প্রজ্ঞা তাঁর সঙ্গে আনেন আরও দুজন লোককে - রামচন্দ্র কালসাংরা, আর সন্দীপ ডাঙ্গে - বিশ্বস্ত সহযোদ্ধা যারা মালেগাঁওয়ে বোমা রাখার আসল কাজটা করবে - এইভাবেই এদের পরিচয় করিয়ে দেন অমৃতানন্দের সঙ্গে [Chargesheets and Miscellaneous Documents – Malegaon Case: 65]।
৩রা আগস্ট উজ্জয়িনীর মহাকালেশ্বর মন্দিরের ধর্মশালায় হওয়া এক মিটিঙে কর্ণেল পুরোহিতকে দায়িত্ব দেওয়া হয় কালসাংরা আর ডাঙ্গের জন্যে আরডিএক্স যোগাড় করার। পুরোহিতের নির্দেশে তাঁর সহযোগী রাকেশ ধাওরে (পুরোহিতের ভাষায় “a trained expert in committing explosions and assembling improvised explosive devices”), আগস্টের ৯/১০ তারিখে পুণেতে কালসাংরা আর ডাঙ্গের সঙ্গে দেখা করে তাদের হাতে বিস্ফোরক তুলে দেন [Chargesheets and Miscellaneous Documents – Malegaon Case: 66]।
শুরু হয় চূড়ান্ত প্রস্তুতি - যার ফল মালেগাঁও বিস্ফোরণ, এবং সেই বিস্ফোরণের তদন্তের সময়েই প্রথম সামনে আসে স্যাফ্রন টেরর বা হিন্দু উগ্রপন্থার কথা।"
সূত্র
(১) Shadow Armies - Fringe Organisations and Foot Soldiers of Hindutva, Dhirendra Kr. Jha
(২) Abhinav Bharat, the Malegao Blast and Hindu Nationalism: Resisting and Emulating Islamist Terrorism, Christophe Jaffrelot, Economic & Political Weekly, Vol. 45, Issue No. 36, 04 Sep, 2010
(৩) Chargesheets and Miscellaneous Documents regarding the Malegaon কেসে