এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • বটগাছের ছায়ায় 

    রজত দাস লেখকের গ্রাহক হোন
    ২১ জুন ২০২২ | ৫৯৪ বার পঠিত | রেটিং ৪ (১ জন)
  • সময়টা তখন খুব খুব কঠিন চলছিল। সদ্য চাকরিটা খুইয়েছি। পাঁচমাস হল জয়েন করেছিলাম। ছয়মাসে কনফার্মেশন। তাই আমার মত অনেকেরই ঘাড়ের ওপর খাঁড়া নেমে এসেছিল। আমাদের কোম্পানি প্রায় রাতারাতি অন্য একটি বড় কোম্পানির সঙ্গে মার্জ হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বড় কোম্পানিটি কনফার্ম না হওয়া কর্মীদের অধিগ্রহণ করবে না। এটা তাদের একটি সিদ্ধান্ত। যেটি আমাদের কোম্পানি মেনে নিয়েই অধিগ্রহণ করায় সায় দিয়েছিল। তাই আমাদের কিচ্ছু করার ছিল না। নির্বাক দর্শকের মত বলি হওয়ার দিন গুনছিলাম। বড় কোম্পানিটি আমাদের বেরিয়ে যাওয়ার জন্যে পঁয়তাল্লিশ দিন সময় নির্ধারণ করে দিয়েছিল। উক্ত দিনের মধ্যে রিজাইন করে দূর হয়ে যাও। 

    রোজ সেজেগুজে অফিস যেতাম। মুখ চুন করে টুকটাক কিছু কাজকর্ম করে দিনটা কাটিয়ে ফিরে আসতাম। পাশাপাশি চলত নতুন একটা চাকরি খোঁজার চেষ্টা... চাকরি হারানো ততটাই সহজ। যতটা কঠিন একটি চাকরি জোগাড় করা। এক একটি দিন পার হচ্ছিল। আর আমার মাথায় দুশ্চিন্তা পাহাড়ের মত আঁকড়ে বসছিল। কি করব, যদি না কোনো চাকরি জোগাড় হয় ? এই ভাবনা কুরে কুরে খাচ্ছিল। সেদিন দুপুরে অফিস থেকে বেরিয়ে একটা ইন্টারভিউ দিয়ে সন্ধ্যের আগেই বাড়ি ফিরে এসেছিলাম। ওরকম ইন্টারভিউ ওই সময়টায় অনেকগুলোই দিয়েছিলাম। কোনোটারই কোনো খবর নেই। অভাগা যেদিকে চায়, সাগর শুকায় যায়। বাড়িতে তখনও কেউ কিছুই জানে না। কাউকে কিছু বলিনি আর কি ! বলে হবেটাই বা কি ! আমার টেনশনের সাথে সারা পরিবারের টেনশন বাড়ানোর কোনো মানে হয়না, ভেবেছিলাম। 

    অফিস থেকে ফিরে নিজের ঘরে ঢুকে অফিসের পোশাকেই বিছানায় বসে থাকতে থাকতে কখন উপুড় হয়ে শুয়ে পড়েছিলাম, বুঝতে পারিনি। সন্ধ্যে নেমে গেছে। ঘরে অন্ধকার এসে জাঁকিয়ে বসেছে, খেয়ালই করিনি। সকালে অফিস বেরোনোর সময়ই আমার সাত বছরের ছেলেকে নিয়ে তার মা বাপের বাড়ি গেছে। দুদিন সেখানেই থাকবে। ঘরে তাই আমি একা। একরাশ চিন্তা এসে মনটাকে আচ্ছন্ন করে ফেলছিল। আর একটাই বেতন হাতে আসবে। তারপরের মাসে ছেলের স্কুলের ফি, প্রাইভেট টিউশনের ফি, লোনের ইএমআই, সংসারে আমার কন্ট্রিবিউশন... সব মিলিয়ে মোটা টাকার বোঝা। পরের মাস থেকে কি করব ? ভাবনার চোটে স্নায়ুর স্তর যেন ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। এমন সময় সেই অন্ধকারে একটা দৃঢ় হাত নিজের মাথার ওপর টের পেলাম। কানে এলো একটি কণ্ঠস্বর।

    কিরে, এই অন্ধকারে শুয়ে আছিস কেন ?

    বাবা অফিস থেকে ফিরেই আমার ঘরে চলে এসেছিলেন। ঐভাবে অন্ধকারে বিছানার ওপর পড়ে থাকতে দেখে পিতৃসুলভ স্নেহ নিয়ে এগিয়ে এসেছেন। বিছানায় উঠে বসলাম। বাবা ঘরের আলোটা জ্বেলে দিলেন। আমি মাথা নিচু করে বললাম,

    এমনিই। তুমি কখন এলে ?

    এইমাত্র। এসে দেখলাম তোর ঘরের দরজা খোলা। ভিতরে অন্ধকার দেখে ভাবলাম, দরজাটা বন্ধ করে দিই। তোর মা বলল তুই নাকি ঘরেই আছিস। তাই ঢুকে পড়লাম। কি হয়েছে বাবু ? এত চিন্তার কি হল ?

    বাবাকে কি বলি ? কিসের চিন্তা কি করে বোঝাই ? মুখে বললাম,

    যাও। জামা প্যান্ট ছেড়ে ফ্রেস হও।

    তুইও তো অফিসের জামা প্যান্ট পরেই পড়ে রয়েছিস। ফ্রেস হয়ে আয়। একসাথে চা খাব। অত চিন্তা করিস না। আমি তো আছি নাকি ! সব ঠিক হয়ে যাবে, দেখবি...

    বাবা কি তবে জেনে গেছেন ? কই আমি তো কাউকে কিছুই বলিনি। এমনকি ছেলের মাকেও নয়। তাহলে ? বাবা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন। আমি ওঁর ডান হাতটা খামচে ধরে ফেললাম। বাবা দাঁড়িয়ে গেলেন।

    কি হল রে ?

    আমি বিছানা ছেড়ে উঠে গিয়ে ওঁকে জড়িয়ে ধরলাম। ওঁর চওড়া কাঁধে চিবুকটা রেখে নিঃশব্দে কখন কেঁদে ফেলেছি, বুঝতে পারিনি। আমার পিঠে দুটো হালকা চাপড় মেরে বলে উঠলেন,

    তুই না বললেও আমি অনেকদিন আগেই জেনে গিয়েছিলাম। খবরটা, কাগজে দেখেছিলাম। চেষ্টা তো করছিস। একটা কিছু ঠিক পেয়ে যাবি। যতদিন না পাচ্ছিস, এই সংসারের যাবতীয় ভার আমার। তোকে কিচ্ছু ভাবতে হবে না। দূর ব্যাটা... বোকার মত কাঁদছিস কেন ?

    আমার মুখ লুকিয়ে কান্নাও উনি বুঝতে পেরে গিয়েছিলেন। কোনো কথা না বলে, ঝুপ করে নিচু হয়ে দুহাত দিয়ে ওঁকে প্রণাম করেছিলাম। আর ভেবেছিলাম, এরকম বাবা আমি কি কখনো হতে পারব ? 
    প্রণাম করার পর আবার আমায় উনি নিজের বুকে টেনে নিয়ে ছিলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলেন,

    চিন্তা করিস না। আমি জীবনে কোনো অন্যায় করিনি। তাই আমার সন্তানের সাথেও কোনো অন্যায় ঈশ্বর হতে দেবেন না। সব ঠিক হয়ে যাবে। চল আয়। চা খাব। 

    বলতে বলতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। আর তিনমাস বাদে মানুষটার কর্মজীবনের ইতি ঘটবে। তবুও কতটা মনের জোর থাকলে এইভাবে অন্যকে সাহস জোগানো যায়। নিস্তব্ধ হৃদয়ে তাঁর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমার চোখের জল হুড়হুড় করে দুই গাল বেয়ে নামছে, টের পেলাম।

    আজ পিতৃ দিবসে জীবন সায়াহ্নে দেওয়ালে টাঙানো বাবার ছবিটার দিকে তাকিয়ে কথাগুলো হঠাৎ মনে পড়ে গেল। চোখের কোল আজও কখন ভিজে উঠেছে বুঝতেই পারিনি।
    _______________________
    ©রজত দাস / ১৯.০৬.২২
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Parikshit Manna | ২১ জুন ২০২২ ১৯:৩৪509238
  • গভীর স্মৃতিচারণ। বাবা বিষয়টা সত্যিই ভাবায়।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। বুদ্ধি করে প্রতিক্রিয়া দিন