এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • হাতিবাগান রহস্য - ৭

    Anjan Banerjee লেখকের গ্রাহক হোন
    ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | ১০২৭ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • রাত্রে কলতান একটা ফোন করল আশুতোষ মৈত্রকে । 
    — ‘ আজ্ঞে বলুন স্যার ’
    — ‘ হ্যাঁ .... আশুবাবু একটু ডিস্টার্ব করছি।  ওই যে দেবযানীদেবীর কথা বলছিলেন....
    — ‘ হ্যাঁ হ্যাঁ ... দেবযানী ঘোষ... কেন কি হয়েছে ?’
    — ‘ না .... কিছু হয়নি , ওনার অ্যাড্রেসটা দিতে পারবেন আপনি ? ওটা পেলে সুবিধে হয়।’
    — ‘ দেবযানীর অ্যাড্রেস .... হ্যাঁ ছিল তো ..... খুঁজে দেখতে হবে । আচ্ছা দেখব’খন । খুঁজে পেলে আপনাকে টেক্সট করব ... ঠি ক আছে ?’
    — হ্যাঁ.... ঠিক আছে । দেখবেন একটু । অনেক ধন্যবাদ ।’

    পরদিন সকাল এগারটা পর্যন্ত আশুতষবাবুর কাছ থেকে কোন খবর পাওয়া গেল না। আশুবাবু সম্ভবত কিছু খুঁজে পাননি।কলতান ভাবল, ওটা তাকে নিজেকেই সন্ধান চালাতে হবে। 
    সে তৈরি হতে লাগল নীলাম্বরবাবুর বাড়ি যাবার জন্য। ওখানে আজ ফরেনসিকের লোকেরা আসবে।

    সাড়ে বারোটা নাগাদ নীলাম্বরবাবুর বাড়ির উল্টোদিকে একটা মারুতি জেন দাঁড়িয়ে আছে। কলতান বুঝতে পারল ওরা এসে গেছে । সে ওপরে উঠল।

    গিয়ে দেখল গৌতম চৌধুরি  আছেন এবং তার সঙ্গে আরও দুজন সহকারি। ঋজু চ্যাটার্জিও রয়েছে স্থানীয় থানার তরফে। একজন পুরুষ কনস্টেবল এবং একজন মহিলা কনস্টেবল আছে।বাড়িতে মনীষা,ইরাবান শ্রুতি ছাড়া সত্রাজিৎও আছে। 
    গৌতম চৌধুরি কলতানের পূর্বপরিচিত। নারকেলডাঙায় একটা খুনের ঘটনার অনুসন্ধানের সময় দুজনের পরিচয় হয়েছিল বছর দুয়েক আগে।তিনি কলতানকে ঢুকতে দেখে একগাল হেসে করমর্দন করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলেন।
    কলতান বলল, ‘ কেমন আছেন মিস্টার চৌধুরি ? ’
    — ‘ ভাল । আপনি ভাল তো ? ’
    — ‘ হ্যাঁ ... চলছে ।’
    গৌতম চৌধুরি সবার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ আমরা তাহলে আমাদের কাজ শুরু করি । স্পট থেকে কালেক্টেড স্যাম্পল-এর ইমেজ ডিটেকশান এখন ডিসক্লোজ করা যাচ্ছে না । ওটা এই মুহুর্তে এক্সক্লুসিভলি কনফিডেনশিয়াল। ওক্কে.... আমরা এখন .... ’
    — ‘ মিস্টার চৌধুরি আমার একটা কথা ছিল ....’ কলতান বলে ওঠে। 
    গৌতম চৌধুরি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে কলতানের দিকে তাকালেন।
    — ‘ অনুমতি দিলে আপনারা কাজ শুরু করার আগে আমি এখানে উপস্থিত মেম্বারদের দু একটা কথা জিজ্ঞাসা করতে চাই।’
    গৌতম চৌধুরি বললেন , ‘ ও ইয়েস .... গো অ্যাহেড ।’

    মনীষা, ইরাবান এবং শ্রুতি বসে আছে এক একটা চেয়ারে। শুধু সত্রাজিৎ দাঁড়িয়ে আছে একপাশে। বোধহয় আর বসার জায়গা নেই বলে। শ্রুতির কাঁধে একটা চামড়ার ব্যাগ আছে। ওটা কোলের ওপর নিয়ে বসল।

    কলতান বসেনি এখনও, দাঁড়িয়ে আছে। সে শ্রুতির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ কেমন আছ ? ’
    শ্রুতি সপ্রতিভ উত্তর দিল, ‘ এই অবস্থায় যেমন থাকা যায় ।’
    — ‘ হ্যাঁ তাই তো .... কলেজে রেগুলার ক্লাস করছ ?’
    —- ‘ হ্যাঁ করছি মোটামুটি । বাড়িতে বসে থেকে কি করব ? যা হওয়ার তো হয়েই গেছে। বাবা তো আর ফিরবে না। ’
    — রাইট রাইট .... একদম ঠিক কথা। আচ্ছা সেদিন অনার্সের ক্লাসগুলো সব হয়েছিল ?’
    — ‘ কবে ? ’
    — ‘ গত সোমবার। যেদিন ফোনে আমাকে বললে পরপর তিনটে অনার্সের ক্লাস আছে ? ’
    — ‘ ও আচ্ছা ..... হ্যাঁ তিনটেই হয়েছিল’, শ্রুতি অম্লানবদনে বলল।
    — ‘ তুমি কোন কলেজে পড় যেন, বঙ্গবাসী কলেজে....না ?’
    — ‘ হ্যাঁ ’
    — ‘ তোমাদের কলেজটা কি টালীগঞ্জে ?’
    — ‘না না .... টালীগঞ্জে কেন হবে ? বঙ্গবাসী কলেজ শিয়ালদায় স্কট লেনে।’
    — ‘ ও হ্যাঁ হ্যাঁ .... আজকাল কিছু মনে থাকে না আমার .... কি মুশ্কিল .... ’ , কলতান মাথায় হাত দিয়ে হতাশ হবার ভঙ্গী করে।
    তারপর বলতে থাকে, ‘ তাই তো আমার আশ্চর্য লাগছে .... টালীগঞ্জে থেকে শিয়ালদার কলেজে অনার্সের ক্লাস করলে কি করে ! ’
    — ‘ তার মানে ? ’
    শ্রুতির মুখ চোখ হঠাৎ বদলে যায়। উত্তেজিত হয়ে দাঁড়িয়ে ওঠে।
    — ‘ কে .... কে বলল আমি তখন টালীগঞ্জে ছিলাম ?’
    — ‘ আহা .... খামোখা উত্তেজিত হচ্ছ কেন ? বসো বসো। এই  বয়েসে ওরকম হয়। আমাদেরও হত। বিশেষ করে যদি বয়ফ্রেন্ড বা গার্লফ্রেন্ড সঙ্গে থাকে। কিন্তু তুমি একেবারে সত্রাজিৎ এর অফিসে চলে গেলে ক্লাস বাঙ্ক করে। এটা ভাল কথা না .... ’, কলতান নির্বিকার ভঙ্গীতে বলে যেতে থাকে। 
    শ্রুতির চোখমুখ লাল হয়ে ওঠে । সে ঝটকা মেরে আবার দাঁড়িয়ে ওঠে । 
    — ‘ কি সব আবোলতাবোল কথা বলছেন আপনি ?  কে আপনাকে বলল এসব ?’ 
    — ‘ কেউ বলে নি, টেকনোলজি বলছে। মোবাইল কল ট্র্যাকিং আর মোবাইল ভিডিও রেকর্ডিং বলছে। ওরা মিথ্যে কথা বলতে পারে না।’
    — ‘ সব বাজে কথা । আমি সত্রাজিৎ-এর অফিসে কেন যাব ? আমার কি মাথা খারাপ নাকি ? ’
    — ‘ না না মাথা খারাপ হওয়ার কি আছে ! এই বয়সে ওরকম হয়। আর বাজে কথা যে নয় তার প্রমাণ আমি দিচ্ছি। সেদিন  ডেক্সটার অ্যান্ড স্মিথের গেটের সামনে তোমাদের বাইকের কাছে গিয়ে একটা বুড়ো আর একটা বুড়ি পাঞ্জাবী ধর্মতলার বাসের কথা জিজ্ঞেস করেছিল মনে আছে ?’
    প্রচন্ড উত্তেজনায় শ্রুতির কথা আটকে গেল। একটু সামলে নিয়ে সে বলল, ‘ কি .... কি প্রমাণ আছে আপনার কাছে ?’
    কলতান হাতের মোবাইলে রেকর্ড করা বাইক আরোহী যুগলের ভিডিও খুলে দিল। 
    — ‘ এই যে দেখ .... ’
    কলতান মোবাইলের পর্দা উল্টোদিকে ঘুরিয়ে ধরল, যেদিকে শ্রুতি, মনীষা, সত্রাজিৎ আর ইরাবান দাঁড়িয়ে আছে।
    ভিডিও চলতে লাগল। কলতান বলল, ‘ ওই পাঞ্জাবী বুড়ো বুড়ি ছিলাম আমি এবং আমার সহকারিনী।’
    বলতে বলতে কলতান ওদিকের চারজনের মুখের দিকে নজর বোলাতে লাগল সার্চ লাইটের মতো। দেখল, মনীষা মৈত্র থরথর করে কাঁপছেন। রাগে, ক্ষোভে না ভয়ে বলা কঠিন। সত্রাজিৎ পাথরের মূর্তির মতো এক জায়গায় দাঁড়িয়ে শিকারি দৃষ্টিতে কলতানের দিকে তাকিয়ে আছে। শ্রুতিকে প্রবল স্নায়ুপীড়নে ভীষণ অস্থির দেখাচ্ছে। আর, ইরাবান দাঁত দিয়ে নীচের ঠোঁট কামড়ে মোবাইল স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে আছে। 
    মনীষাদেবী হঠাৎ ছিটকে চলে এলেন সত্রাজিৎ এর সামনে এবং সবাইকে চমকে দিয়ে সত্রাজিৎ এর গালে সপাটে একটা চড় মারলেন। কলতান পরিষ্কার বুঝতে পারল এ চড়ের রহস্য। তা হল তীব্র যৌন ঈর্ষা। মা মেয়েতে দড়ি টানাটানির ফলশ্রুতি। এটা মেয়েকে মায়ের শাসনের চড় নয়।  

    ভিডিওটা শেষ হবার পর কলতান ওটা বন্ধ করে পকেটে রাখল। গৌতম চৌধুরিরা এইসব উদ্ভট নাটক দেখে বেশ বিব্রত বোধ করতে লাগলেন। 
    কলতান হঠাৎ সত্রাজিতের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ লিথাল কেমিক্যালটা তুমি সাপ্লাই দিতে গেলে কেন ? বাইকের ধাক্কা মারাটা বারবার ফস্কে যাচ্ছিল বলে ? ’
    আগুনে যেন ঘি পড়ল। সত্রাজিৎ সেন যেন দাউদাউ করে জ্বলে উঠল। চিৎকার করে উঠল,
    — ‘ কি আরম্ভ করেছেন আপনি ? যা খুশি বলে তাই বলে যাচ্ছেন এখানে দাঁড়িয়ে। কি মনে করেন নিজেকে ? ’
    — ‘ না:  কিছুই মনে করিনা । আমি শুধু সত্যটা খুঁজে বার করার চেষ্টা করি। ’
    — ‘ ওসব ফালতু কথা আপনার কাছেই রেখে দিন। কোন প্রমাণ আছে আপনার কাছে ? ’
    — ‘ অবশ্যই। প্রমাণ ছাড়া দুনিয়ায় কিছু হয় ? ঠিক এই ভিডিওটার মতোই স্পষ্ট প্রমাণ আছে। দেখাচ্ছি একটু পরে। আর একটা মামলায় আপনি ফাঁসবেন। অ্যাডালটারি। মানে, ব্যাভিচার’, বলে মনীষা মৈত্রের দিকে তাকায় কলতান। তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন। ঘনঘন শ্বাস ফেলতে ফেলতে চোখ বুজে ধপ করে বসে পড়লেন তিনি।
    সত্রাজিৎ কিন্তু উঁচু গলায় তর্ক চালিয়ে যেতে লাগল। 
    — ‘ এসব অসভ্যতার জবাব আপনি অক্ষরে অক্ষরে পাবেন।’
    — ‘ আমারও তাই মনে হয়। কিন্তু জবাব তো আমি পেয়েই গেছি। তোমার চাকরিটা থাকবে তো?’, কলতান ধীর স্থির কন্ঠে বলল।
    — ‘ কি জবাব শুনি ..... চাকরি .... কেন চাকরি থাকবে না কেন ?’, সত্রাজিৎ বলে ধড়ফড় করতে করতে।
    — ‘ তোমাদের কলকাতা অফিসের সিইও দেবপ্রসাদ রায়ের সঙ্গে আমার দীর্ঘক্ষণ কথা হয়েছে ...... ’
    — ‘ কি ! মিস্টার ডি পি রায় ..... কেন, আমি একাই সব করেছি নাকি? আর সবাই ধোয়া  তুলসীপাতা। একে গুমোট আবহাওয়া, তার ওপর কলতানের বজ্রগর্ভ মেঘস্তম্ভের নিম্নচাপ। 
    সত্রাজিৎ কুলকুল করে ঘামতে থাকল।
    কলতান দাঁড়িয়ে রইল প্যান্টের পকেটে দুহাত ঢুকিয়ে। 
    সত্রাজিৎকে বলল, ‘ তুমি বস সত্রাজিৎ .... তুমি অপরাধী কিনা তা আমি এখনও বলতে পারছি না। তবে এটা বলতে পারি,  বোকার মতো অন্যের কথায়  নাচলে বলে তোমার এই অবস্থা। তুমি আমাদের সব খুলে বল । তাতে তোমার ভালই হবে। আমাকে বিশ্বাস করতে পার।’
    কলতান এবার ইরাবানের দিকে ফিরল । সে জড়সড় হয়ে সোফার হাতলটা ধরে বসে ছিল।
    — ‘ ইরাবান ...... প্রতিটি মানুষই ষড়রিপুর অধীন। কিন্তু ছটা দুর্দম ঘোড়াকে মনের লাগাম পরিয়ে নিজের বশে রাখাই মানুষের কাজ। তুমি সেটা পারলে না। ভাই বোনের সম্পর্ককেও কলুষিত করলে। শুধু প্রথম রিপু নয়, তৃতীয় রিপু অর্থাৎ লোভের অশ্বকেও  নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে না। তোমার বাবা তো তোমাকে কম স্নেহ করতেন না। তোমার জন্মদাত্রী মায়ের জন্যও কম কিছু  করেননি। তাহলে নীলাম্বরবাবুর প্রতি এত ক্ষোভ ,এত বিদ্বেষ কিসের বলতে পার .....  ?’
    ‘ ...... যাই হোক ..... মিস্টার চৌধুরি ...... ডোন্ট মাইন্ড .... অামি অনেকটা সময় নিয়ে নিলাম। এগুলো আমার আগেই করা উচিৎ ছিল, কিন্তু কোঅর্ডিনেট করতে একটু টাইম লেগে গেল। সরি ....’
    — ‘ প্লিজ ..... প্লিজ ... একথা বলবেন না। আপনি আমাদের যেভাবে হেল্প করছেন উই শুড বি গ্রেটফুল টু ইউ .....’, গৌতম চৌধুরি উঠে দাঁড়ালেন।
    কলতান বলল, ‘ এনিওয়ে .... আপনারা আপনাদের অ্যাসাইনমেন্টটা এবার কমপ্লিট করে নিন । স্যাম্পল ডিটেকশান হতেও তো কদিন সময় লাগবে। তার মধ্যে এরা যেন কেউ এ পাড়ার বাইরে না যেতে পারে......এটা একটু দেখলে ভাল হয়.... ’
    কলতান শেষ কথাগুলো বলল ঋজুর দিকে তাকিয়ে ।
    কলতানের কথা শেষ হল না। হঠাৎ একটা সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত এবং নাটকীয় একটা ঘটনা ঘটল।
    ঘরের মধ্যে ঝড়ের বেগে সালোয়ার কামিজ পরা বাহান্ন তিপ্পান্ন বছরের এক ভদ্রমহিলা এসে ঢুকলেন। কেউ বাধা দেবার আগেই ঘরের আর কারো দিকে না তাকিয়ে তিনি উদভ্রান্তের মতো ছুটে গিয়ে ইরাবানকে জড়িয়ে ধরলেন। তার মাথায় মুখে পরম স্নেহে হাত বোলাতে লাগলেন। বলতে লাগলেন, ‘তুই ঠিক আছিস তো বাবা? শয়তানগুলো তোর কোন ক্ষতি করতে পারে নি তো? তোর মা বেঁচে থাকতে তোকে কেউ কিছু করতে পারবে না। তোর গায়ে একটা আঁচড়ও কাটতে পারবে না ....’
    ইরাবানের দু কাঁধ খামচে ধরে ভদ্রমহিলা সজল চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন। কলতান অনুমান করতে পারল ইনিই হচ্ছেন কাঁকুড়গাছির দেবযানীদেবী। সকলে প্রথমে হতচকিত হয়ে গেলেও খুব তাড়াতাড়ি সামলে নিল। ঋজু এগিয়ে গিয়ে বলল, ‘ ম্যাডাম.... আপনি প্লিজ একটু সরে দাঁড়ান। এখানে একটা লিগ্যাল প্রসেস চলছে। প্লিজ ডিসটার্ব করবেন না। কিছু বলার থাকলে ওদিকে আসুন। আপনার বয়ান রেকর্ড করান। আসুন .... থানায় যেতে হবে না, এখানেই বয়ান দিন .... তাতে আমাদের সুবিধেই হবে। ’
    দেবযানীর কিন্তু সরবার কোন লক্ষ্মণ দেখে গেল না। তিনি ইরাবানকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে রইলেন।
    মনীষা মৈত্রকে এতক্ষণ অবসন্ন এবং ম্রিয়মান দেখাচ্ছিল। তিনি হঠাৎ ফুঁসে উঠলেন।
    — ‘ তুমি আবার এ বাড়িতে ঢুকেছ ! একটা বাজারের মেয়েছেলে। সারা জীবন ধরে আমার সংসারটাকে ছারখার করেছে .... এখন আবার পুত্রস্নেহ উথলে উঠছে। নীলাম্বর মৈত্রকে শেষ করে শান্তি হল না, এখন আবার এসেছে নতুন করে আগুন লাগাতে ......’
    এর প্রতিক্রিয়ায় দেবযানীকে কিন্তু উত্তেজিত হতে দেখা গেল না। সে স্বাভাবিক গলায় বলল, ‘ তোদের  সবকটার দিন ঘনিয়ে এসেছে এটা ভালই বুঝতে পারছি ....’
    কেন কে জানে, মনীষাদেবীর মুখ থেকে এর কোন পাল্টা জবাব পাওয়া গেল না। দুর্বার ক্রোধে তার হয়ত বাক রুদ্ধ হয়ে গেল। তিনি আগুনে চোখে দেবযানীর দিকে তাকিয়ে বড় বড় শ্বাস ছাড়তে লাগলেন। 
    গৌতমবাবু বললেন, ‘অনেকটা সময় চলে গেল। এবার কাজ শুরু করা যাক। তিনি তার এক সঙ্গীকে বললেন,  ‘কুন্তল ... অ্যাকসেসরিজ বার কর। হ্যাঁ .... ঠিক  আছে, এখানে এই টেবলটার ওপর রাখ।’
    তারপর শ্রুতির দিকে তাকিয়ে গৌতমবাবু বললেন, ‘আসুন .... প্রথমে আপনি আসুন .... ’।
    শ্রুতি অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে থেকে জড়ানো গলায় বলল, ‘ আমি .... একটু টয়লেটে যাব ’
    — ‘ হ্যাঁ,  নিশ্চয়ই ....’
    শ্রুতির কাঁধে চামড়ার সাইড ব্যাগটা একইভাবে ঝুলছে। কলতানের মনে মাঝেই মাঝেই সন্দেহ ঝিলিক দিচ্ছে। কিন্তু আপাতত কিছু করার নেই। 
    শ্রুতি ওয়াশ রুমের দিকে চলে গেল। 
    ঋজু চ্যাটার্জি দেবযানী এবং ইরাবানের দিকে দু পা এগিয়ে গিয়ে দেবযানীকে জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনাকে তো ঠিক  চিনলাম না ম্যাডাম ......’
    দেবযানীদেবী কোন উত্তর না দিয়ে ইরাবানকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে রইলেন।
    ঋজু আবার বলল, ‘ ম্যাডাম ... আপনি ইরাবানের কে হন জানতে পারি কি ? আইনত অবশ্য আপনি এ কথার জবাব দিতে বাধ্য নন। তবু আপনাকে জিজ্ঞাসা করছি এ পরিবারের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কি ? ’।
    দেবযানীদেবী এবার উঁচু গলায় বলে উঠলেন— ‘ আমি এর কে হই এখনও বুঝতে পারছেন না? নাকি বুঝেও বুঝতে চাইছেন না? ভান করছেন ! ...... মা হই ..... মা ... বুঝলেন ? ‘
    ঋজু চমকে উঠে কলতানের দিকে তাকাল। কলতান চোখের ইশারায় ঋজুকে ওখান থেকে সরে আসতে বলল।
    এত গুমোট আবহাওয়া যে ঘরের সিলিং-এ দু দুটো ফ্যানের হাওয়া গায়েই লাগছে না। সকলেই রুমাল বার করে মুখের ঘাড়ের ঘাম মুছছে ঘনঘন। বাইরে টিপ টিপ করে বৃষ্টি শুরু হল। আকাশ কালো হয়ে আসছে।
     
    সকলকে চমকে দিয়ে হঠাৎ বিকট শব্দে টায়ার ফাটল ঘরের মধ্যে। কলতান মাথায় হাত দিয়ে বলে উঠল , ‘ ও মাই গড.... এ তো পিস্তল ফায়ারিং-এর শব্দ !’ বলে বাথরুমের দিকে ছুটে গেল। ছুটে গেল ঋজুও। শ্রুতির কাঁধের ব্যাগটার ওপর তার সন্দেহ তাহলে ঠিকই ছিল ।
    বাথরুমের দরজা বন্ধ। দরজার তলার সামান্য ফাঁক দিয়ে গড়িয়ে আসছে গাঢ় লাল রক্তের ধারা।  
    মনীষা দেবী ছুটে এসে বাথরুমের বন্ধ দরজায় পাগলের মতো ধাক্কা মারতে লাগলেন। দরজায় মাথা ঠুকতে লাগলেন বিপজ্জনকভাবে। বলতে লাগলেন, ‘এ তুই কি করলি .... কি করলি তুই ? তুই আমাকে কার কাছে রেখে গেলি .....’, ইত্যাদি ইত্যাদি। 
    ঋজুর ইঙ্গিতে মহিলা কনস্টেবল মনীষাকে কোনরকমে ওখান থেকে সরিয়ে এনে বাইরের ঘরে বসাল।
    গৌতম চৌধুরি এবং তার সঙ্গের দুজন এই অপ্রত্যাশিত ঘটনার আকস্মিকতায় স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।

    কলতান মনে মনে বিড়বিড় করতে লাগল, ‘অ্যাকিউট কেস অফ সাইকোলজিক্যাল ডিসঅর্ডার.... ইনটেন্স প্যারানয়া .... পুয়োর ফেলো .... এই গ্রুপটার সকলেই অল্পবিস্তর তাই .... সকলেরই রেগুলার কাউন্সেলিং-এর দরকার ছিল। কোনদিন হয়নি খুব সম্ভবত: । হা ঈশ্বর ....’

    বিড়বিড় করে কথা বলা কলতানকে এক মনোরুগীর মতোই দেখাচ্ছিল। পরিবেশের তাৎক্ষণিক প্রভাব । কেউ শুনতে পেল না ওর অস্ফূট বাক্যগুচ্ছ।

    কলতান এও ভাবল এটা একটা ভিশিয়াস সার্কেল। আমরা এই সার্কেলে ঢুকে পড়ায় বাকি কটা প্রাণ আপাতত বেঁচে গেল। ভবিষ্যতের কথা ভবিষ্যৎই জানে। আমার আরও সাবধান হওয়া উচিৎ ছিল। 

    ঋজু চ্যাটার্জিকে দেখা গেল চিন্তিত মুখে কাকে ফোন করছে। বোধহয় ওদের হেডকোয়ার্টারে সাম্প্রতিকতম তথ্য সরবরাহ করছে। গৌতমবাবুকেও দেখা গেল  ব্যস্তভাবে কাকে যেন ফোন করছেন। নিশ্চয়ই অফিসে অতি দ্রুত সংশ্লিষ্ট ঘটনার আপডেট দিচ্ছেন। 

    কলতান ঋজুর কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল, ‘ তোদের আরও কাজ বেড়ে  গেল’।

    মনীষা মৈত্র পিছনে মাথা হেলিয়ে চোখ বুজে বসে আছেন পাথরের মূর্তির মতো। সত্রাজিতের বাবা ওপরে উঠে এসে দরজা ঠেলে ভিতরে উঁকি দিলেন প্রবল উৎকন্ঠায়। কিন্তু একজন কনস্টেবল সঙ্গে সঙ্গে বলল, ‘ এখন ভিতরে যাবেন না স্যার .... অসুবিধে আছে .... ’।

    (পরের পর্বে সমাপ্য )
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা খুশি প্রতিক্রিয়া দিন