এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • হৈমন্তী

    Supriya Debroy লেখকের গ্রাহক হোন
    ০৭ ডিসেম্বর ২০২১ | ৮৭৯ বার পঠিত
  • হিমের রাতে ওই গগনের
    দীপগুলিরে
    হেমন্তিকা করলো গোপন
    আঁচল ঘিরে।

    ঘরে ঘরে ডাক পাঠালো -

    'দীপালিকায় জ্বালাও আলো,
    জ্বালাও আলো, আপন আলো,
    সাজাও আলো ধরিত্রীরে।'

    রবিঠাকুর যেন শরৎ পরবর্তী সময়ের হৈমন্তীর হালকা কুয়াশা ভরা আকাশে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন দীপাবলি উৎসবের এই গানের মাধ্যমে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শরৎ নিয়ে ৩৩ টি গান লিখলেও, লিখেছেন মাত্র পাঁচটি গান হেমন্ত ঋতুকে নিয়ে। যদিও ওনার শরতের অনেক গানে পাওয়া যায় হেমন্তর ছোঁয়া, 'শিশিরে অরুণমালিকা উঠেতেছে ছলোছলি'।

    জানাচ্ছেন উনি আমন্ত্রণ হেমন্তলক্ষ্মীকে হিমের কুয়াশার মাঝে সাথে যেন একটা হালকা শীতের আমেজ, ওনার আর-একটি গানের মাধ্যমে।

    'হায় হেমন্তলক্ষ্মী, তোমার নয়ন কেন ঢাকা - / হিমের ঘন ঘোমটাখানি ধুমল রঙে আঁকা। / সন্ধ্যাপ্রদীপ তোমার হাতে মলিন হেরি কুয়াশাতে, / কণ্ঠে তোমার বাণী যেন করুণ বাষ্পে মাখা।'

    শরতের দুর্গা উৎসব শেষে রোদ্দুরের রঙ পাল্টিয়ে হালকা এক দখিনা বাতাস আর শীতের আমেজের সাথে চলে আসে হেমন্ত, একটু একটু শিশির ভেজা ঘাসের সাথে। কার্তিক মাসে হেমন্ত শুরু হলেও শীতের আগমনী বার্তা যেন শোনা যায় অগ্রহায়ণ থেকে। শীতের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে সবাই ধীরে ধীরে। কার্তিক মাসের কালীপুজো, দীপাবলি, কার্তিক পুজোর পরই চলে আসে অগ্রহায়ণ মাস। হেমন্তের অগ্রহায়ণ মাস মানেই নতুন ধানে নবান্ন উৎসব পশ্চিমবাংলা, অসম, ত্রিপুরা, বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে। এই উৎসবের আনন্দ বঙ্গদেশে না এলে কল্পনা অথবা উপলব্ধি করা যায় না। জন্ম এবং বাস যাদের গ্রামের পরিবেশে, পায় তারা ভোরের হালকা কুয়াশায় জমে ওঠা শিশির কণা মেঠোপথের জংলী ঘাসে। হেমন্ত যে আসে শিশির ভেজা সোনা রোদে, শরৎ ঋতুর পায়ে পায়ে। হৈমন্তীর বিকেল মানেই একটু আলাদা দৃশ্য দর্শন। মাঠে মাঠে সোনাঝরা সোনালী ধানের হাতছানি। পাকা ধানের ক্ষেত যেন উত্তরীয় হালকা হিমেল বাতাসে বলতে থাকে মাথা নেড়ে কৃষক-কৃষাণীকে, 'গোলায় তোলো আমাদের কেটে নিয়ে। ঢেঁকিতে ছেঁটে গুঁড়ো করে তৈরি করো হরেক রকমের পিঠে-পুলি। উড়ে যেতে চাই সুগন্ধি নলেন গুড়ের সাথে, হেমন্তের মাঠে মাঠে।'

    হেমন্ত ঋতুতে প্রকৃতি ও মানুষের রূপবদল খুবই অপূর্ব। দিগন্তবৃস্তিত মাঠজুড়ে কেবল সোনালি ধান আর ধান। গ্রামের সবাই ব্যাস্ত মাঠে মাঠে, খামারে খামারে। হেমন্তের নরম রোদে মাঠভর্তি নুয়ে পড়া পাকা ধান এখানে সেখানে। রয়ে গেছে খড়ের গোড়াগুলো ধান কাটা মাঠে। সোনালী ধানের স্তূপ গোবর-মাটি দিয়ে নিকানো ঘরের আঙিনার খামারে। ঢেঁকিশালের আনাচকানাচ ধোয়া মোছা। গেরস্থ বাড়ির বধূ প্রস্তুত ধান ভানতে, অঘ্রাণ মাসের শিরশিরে ভোরে স্নান সেরে। মাড়াই চলছে, পাশে ধানের গোলা। সাথে শোনা যায় গ্রাম্যবধূর লোকগীতি। বিরাজ করছে সুখ নতুন ধানে ঘরে ঘরে। রাতে যখন চাঁদের জ্যোৎস্নার আলো পরে ঐ ক্ষেতে, ঐ স্তূপীকৃত রাখা খড়ের উপর - ভাসিয়ে নিয়ে যায় আলোয় ভরিয়ে,দেখা যায় আর এক অপরূপ দৃশ্য, এক অবর্ণনীয় রূপ, করে তোলে স্মৃতিমেদুর। পড়ছে হিম একটু একটু, জ্বলে ওঠে মিটমিটে আলো রূপসী বাংলার ঘরে ঘরে। বলে যায় না বোঝানো এটা, উপলব্ধি করতে হয় দু'চোখ ভরে। তাই বোধহয় বৈষ্ণব কবি লোচনদাস গেয়েছিলেন, 'অগ্রাণে নতুন ধান্য বিলাসে / সর্বসুখ ঘরে কি কাজ ভাই সন্ন্যাসে।'

    কবিগুরু রবিঠাকুরের 'নিঃশেষ' কবিতায় পাওয়া যায়, 'ঐ দেখো ভরা ক্ষেতে / পাকা ফসলের দোদুল্য অঞ্চলে / নিঃশেষে তার সোনার অর্ঘ্য রেখে গেছে ধরাতলে।'

    আবার ওনার গানে পাওয়া যায়, 'ধরার আঁচল ভরে দিলে প্রচুর সোনার ধানে / দিগঙ্গনার অঙ্গন আজ পূর্ণ তোমার দানে।'

    কবি নজরুলের ‘অঘ্রাণের সওগাত’ লেখাতে পাই, 'ঋতুর খাঞ্চা ভরিয়ে এলো কি ধরণীর সওগাত / নবীন ধানের আঘ্রাণে আজি অঘ্রাণ হলো মাৎ।' নতুন ধানের আঘ্রাণের মাঝেই পাই আমরা নবান্নের আবাহন। ‘মাঠের সাগরে জোয়ারের পরে লেগেছে ভাটির টান। / রাখাল ছেলের বিদায়-বাঁশিতে ঝুরিছে আমন ধান।‘ আমন ধান ফসল কাটার সমাপ্তি। বিদায়ের সুর কৃষক ছেলের বাঁশিতে। ‘হেমন্ত-গায় হেলান দিয়ে গো রৌদ্র পোহায় শীত। / কিরণ-ধারায় ঝরিয়া পড়িছে সূর্য-আলো-সরিৎ।‘ নবান্ন উৎসব হয় ১লা অগ্রহায়ণে। হেমন্তকাল। তেমন শীত তখনও নয়। তবু কবি নজরুল অদ্ভুত বাণী চয়নে কাব্যিক এক রূপ ফুটিয়ে তুলছেন প্রকৃতির।

    রূপসী বাঙলার কবি জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন ওনার 'আবার আসিব ফিরে' কবিতায়, 'আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে এই বাংলায়, হয়তো মানুষ নয়, হয়তো শঙ্খচিল শালিকের বেশে। হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে।'

    শিশিরস্নাত সকাল, কাঁচাসোনা রোদমাখা দুপুর, পাখির কলকাকলি ভরা সন্ধ্যা, মেঘমুক্ত জ্যোৎস্না আলোকিত রাত হেমন্তকে আরও রহস্যময় করে তোলে সবার চোখে। প্রকৃতিকে এনে দেয় ভিন্ন মাত্রা। আশেপাশে আনাগোনা ঘটায় অতিথি পাখিরা। হেমন্তের শেষের দিকটায় যেন এ দেশের প্রকৃতিকে ভালোবেসে তারাও আসে চলে। প্রকৃতিও তখন মুখর হয়ে পড়ে অতিথি পাখিদের কলকাকলিতে।

    হেমন্তকে বলা হয় 'ঋতুকন্যা'। প্রকৃতিতে হৈমন্তীর প্রখরতা বিরাজ করে না। তাই হেমন্তকে উপলব্ধি, অনুভব করতে হয়। কিছুটা অস্পষ্ট ঋতু এই হৈমন্তী। নেই গ্রীষ্মের মতো খরতাপ, বর্ষার বৃষ্টির মতো মুখরতা, শরতের ঘর্মাক্ত আবহাওয়া, অথবা শীতের তীব্রতা। হেমন্তকে তাই নিতে হয় খুঁজে, নিতে হয় বুঝে।

    ‘নবান্ন’ শব্দটি উচ্চারিত হলে এখনও সারা বছরের নিস্তরঙ্গ গ্রামে যেন একটা প্রাণকোলাহল ওঠে জেগে। গ্রামবাসী তো বটেই, বাইরে কাজের জন্য যাওয়া মানুষেরাও আসে ছুটে নবান্নের টানে।

    প্রায় বিলুপ্ত হলেও আছে হয়তো শান্ত-স্নিগ্ধ-হৈমন্তিক নবান্নের পরম্পরা আজও গ্রামে-গঞ্জে। নতুন প্রজন্ম আজও হয়তো আসে গাছ-গাছালি ঘেরা তাদের পূর্ব-পুরুষদের ছায়া নিবিড় গ্রামে, নবান্নের টানে।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • অন্ধকারে কিছুদিন | 42.***.*** | ০৭ ডিসেম্বর ২০২১ ২০:৩১501823
  • সুন্দর লেখা । হেমন্ত আমারো ভাল লাগে খুব ৷
  • বুড়ো হাবড়া | 42.***.*** | ০৭ ডিসেম্বর ২০২১ ২০:৪২501824
  • চমৎকার
  • Supriya debroy | 219.9.***.*** | ০৭ ডিসেম্বর ২০২১ ২১:০৬501825
  • ধন্যবাদ। খুশি হলাম , আপনাদের ভালো লেগেছে জেনে। 
  • bhanga gala | ০৮ ডিসেম্বর ২০২১ ০০:৩১501837
  • বড় ভাল লিখেছেন ৷ নবান্ন হেমন্তে ৷ ঐ সময়টা পিঠে টিঠে হয় ৷ আমার হেমন্ত বললে এইসব মনে পড়ে ৷ গ্রাম বাংলার হেমন্ত খুব সুন্দর ঋতু ৷ আমার শীতও ভাল্লাগে ... শীতের আগে আগে হেমন্তও ৷ 
  • Supriya Debroy | ০৮ ডিসেম্বর ২০২১ ০৯:৪৮501843
  • ধন্যবাদ অনেক। 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। পড়তে পড়তে মতামত দিন