এতে শাহরুকের কোনো দোষ নেই। কিন্তু এ একদম নির্জলা সত্য কথা, যে, 'বাবা কেন চাকর' দেখে কেউ উলুতপুলুত হলে তাকে নিয়ে আপনি যেমন হাসেন, শাহরুক খানকে নিয়ে উলুতপুলুত হলে, আপনাকে নিয়ে আমি ততটাই। হ্যাঁ, হতেই পারে, শাহরুক বিরাট শিল্পী, বড় পর্দাতে তাঁর অভিনয় দক্ষতা ঠিক আঁটেনি, হিন্দি সিনেমার খাতিতে নানা অখাদ্য ছবিতে তিনি নাগাড়ে চড়া দাগের মোটা অভিনয় করে গেছেন। তা, সে তো এও হতে পারে, আদতে স্বপন সাহা বিরাট পরিচালক, কষ্ট করে সিনেমার ছোটো ফ্রেমে আঁটেননি, কষ্ট করে 'বাবা কেন চাকর' বানিয়েছেন, স্রেফ বাংলা সিনেমাকে বাঁচাতে। সবই সম্ভব, কিন্তু যা দেখেছি তার ভিত্তিতে ৮০-৯০ এর শাহরুক এবং সমকালীন বলি-সমাজকে নিম্নমানের ভাঁড়ামো ছাড়া আর কখনও কিছু মনে হয়নি।
আমি একা না, এ ব্যাপারে সত্যজিৎ রায়ও মোটামুটিভাবে একমত। না, উনি শাহরুক বা স্বপন সাহা কাউকে নিয়েই কিছু লেখেননি, তবে ৮০-৯০ এর কোনো সময়ই বলেছিলেন, আমাদের দর্শকরা নেহাৎই পিছিয়ে পড়া। অপরিশীলিত। বেচারিদের হিন্দি বাণিজ্যিক সিনেমার সামনে খোলা ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, এক কথায়, ব্যাটাদের রুচির সব্বোনাশ হয়েছে। অর্থাৎ, 'বাবা কেন চাকর' দেখে কেউ উলুতপুলুত হলে রায়বাবু তাকে যতটা অপরশীলিত বেচারি ভাবতেন, শাহরুক খানকে নিয়ে উলুতপুলুত হলে, সম্ভবত তার চেয়ে বেশিই।
এতে হাঁহাঁ করে ওঠার কিছু হয়নি। আপনার শাহরুক কি অমিতাভকে গুরু মনে হত, এতে দোষের কিছু নেই। আপনারও নেই, শাহরুকেরও নেই। আমারও কম বয়সে ডিস্কো ড্যান্সার দেখে গা দোলাতে ইচ্ছে হত। তাতে কি আর 'আই অ্যাম আ ডিস্কো ড্যান্সার' উচ্চমার্গের গান হয়ে গেল? আমার যতই ভালো লাগ, ও যেমন ওঁচা তেমনই ওঁচা। ছোটোবেলায় ওরকম মধুর স্মৃতি থাকে। হয়তো কোনো গোত্রের নরখাদকদের মধুর বাল্যস্মৃতি হল কারো চোখ খুবলে খাওয়ার দৃশ্য। কিন্তু তাতে কি আর চোখ খুবলে খাওয়া মহৎ শিল্প হয়ে যায়?
হ্যাঁ, প্রচুর লোকের (পুং এবং মহিলা) হার্টথ্রব শাহরুক। বা অমিতাভ। ছোটোবেলার অভ্যাস। সে আর কী করা যাবে। কিন্তু তা দিয়ে কিছু প্রমাণ হয়না। প্রসেনজিৎ কিংবা ধরুন তাপস পালও নির্ঘাত অনেকের হার্টথ্রব। নেটে সার্চ মেরে দেখুন, আমি এই মাত্র দেখলাম, বাবা কেন চাকর, আইএমডিবিতে সাত। সে কি এমনি এমনি? তারপরেও যখন ও নিয়ে খিল্লি করতে পারেন, তখন আপনার পছন্দ নিয়ে অন্যরাও পারে। আসলে আমাদের সমস্যাটা হল, যাকে আমরা নিচু মানের ওঁচা লোক মনে করি, তাদের দূর থেকে তেড়ে খিল্লি করতেই পারি। কিন্তু নিজের দিকে আঙুল উঠলেই, না-না এ আবার কী হচ্ছে, ছিছি। ওসব ছাড়ুন। মেনে নিন, ওঁচা জিনিস দেখে বাল্যকালে আনন্দ পেয়েছেন, কেউ আপনাকে মারতে যাবেনা।
এইখানে বিদ্বজ্জনরা অবশ্য অন্য একটা কোণ থেকে বাওয়াল দিতে পারেন। যে, বাপু হে, খুব তো সত্যজিৎ রায় দেখাচ্ছ, কিন্তু শিক্ষা, পরিশীলন সবই কি পাশ্চাত্য মাপকাঠিতে হবে? রায়দের বাবু কালচার অনুযায়ী? বোম্বের সিনেমা তো আমজনতার সিনেমা, পাবলিকের ভাসান নৃত্যের চলচ্ছবি, শাহরুক হল বাদশা, ইংরিজি কিং নয়, তার মাপ ওই একরৈখিক পরিশীলন কীকরে মাপবে? খুবই প্রণিধানযোগ্য ব্যাপার। কিন্তু কথা হল, প্রথমত সিনেমা, তার ছবি, শব্দ কম্পোজিশন সবই পাশ্চাত্য। ফলে সিনেমায় পশ্চিমকে একেবারে বাদ দেবার উপায় নেই। যেটা করা যায়, সেটা হল, পশ্চিমী টেকনোলজিকে নিয়ে দেশীয় ফর্মের বাড়বৃদ্ধিতে মনোযোগ দেওয়া যায়। যেমন ধরুন কীর্তনে একটু রিভার্ব লাগালেন, সঙ্গের বাদ্যযণ্ত্রে দিলেন বেস। বা যাত্রার ফর্মকে কেটেছেঁটে ব্যবহার করলেন সিনেমায়। ইত্যাদি প্রভৃতি। এর কোনটা বোম্বের সিনেমায় হয়েছে? কোনোটাই না। বরং যেটা হয়েছে, সেটা হল, দেশীয় ফর্মগুলোর বৈচিত্র্য , বিভিন্নতাকে গুঁড়িয়ে বস্তুত পাশ্চাত্যের অক্ষম অনুকরণে একটা সমতল এবং শিল্পগুণে ওঁচা হাইপার রিয়েলিটি তৈরি করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার দিয়েছে মনোপলি, আর হাতের কাছে অন্য কিছু না থাকায় আমরা হাড়হাভাতেরা তাই গোগ্রাসে গিলেছি। এটা মাপকাঠির ব্যাপারই না, হাভাতেদের পায়েস বলে ধুতরো ফুল খাওয়ানোর গপ্পো।
তা, এতে শাহরুকের কোনো দোষ নেই। আপনার-আমারও না। পুরোটাই রাজনৈতিক প্রজেক্ট। আমরা সবাই বোড়ে। কিন্তু দোষ যেখানে, সেটা হল, আমাদের বাল্যের নির্দোষ হাভাতেপনাকে অস্বীকার করা। ছোটোবেলায় আমাদের প্যান্টুল ছিলনা, উলঙ্গ হয়ে নেচেছি, বেশ করেছি। এতে দারিদ্র্যের করুণ রস একটু থাকতে পারে, কিন্তু দোষের কিছু নেই। দোষ হল প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থাতেও উলঙ্গ হয়ে নাচাটাকেই শিল্পের পরাকাষ্ঠা বলে চালানোতে। বা চালানোর চেষ্টা করাতে। বোম্বের হিন্দি সিনেমা, গত সত্তর বছর ধরে যেমন আমাদের কিশোর-কিশোরীদের নাচিয়েছে, একই সঙ্গে বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য ব্যপারটাকেই নষ্ট করেছে, আঞ্চলিকতাকে ভোগে দিয়েছে। এই দুটো একসঙ্গে মেনে না নেবার কিছু নেই। না নিলে সেটাই দোষের। শাহরুকের বা আমাদের।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।